দীপক দাস
আক্ষেপটা পুরোপুরি রাবীন্দ্রিক। ওই ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…’ মামলা।
আমাদের ক্ষেত্রে অবশ্য কবিতিকার কয়েকটি শব্দ বদলাতে হবে। লিখতে হবে এমনভাবে, ‘চাখা হয় নাই জিহ্বা মেলিয়া/ঘর হতে শুধু মাইল কয়েক উজিয়া…’ রাবড়ি। আমাদের ঘরের এত কাছে ঘর ঘর রাবড়ি তৈরি হয়, সেটাই জানা ছিল না। অথচ আমরা ওই এলাকা উজিয়েই জনাইয়ে গিয়েছি। মনোহরা খেতে। ভালকি মাচান থেকে ফেরার সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিয়ে বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানা কিনতে নেমেছি। অথচ আঁইয়ায় যাইনি। আঁইয়া আমাদের বাড়ি থেকে মেরেকেটে ১৫-১৬ কিলোমিটারের বেশি হবে না।
জানা যখন হয়েই গিয়েছে তখন কী কর্তব্য? মঙ্গলবার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। তারপর বাইক নিয়ে সাঁইসাঁই। আমি আর ইন্দ্র। এখন বেশিরভাই সময়ে আমি আর ইন্দ্রই গ্রুপের পাগলা জগাই। প্রতিবন্ধকতা নামের সাত জার্মানের সঙ্গে ফাইট দিচ্ছি। আমাদের অবস্থা এখন ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-এর সেই বুড়ির মতো। সেই বুড়িটা জিজ্ঞাসা করত না, ‘কে, নিরঞ্জন এলি?’ আমরা জিজ্ঞাসা করি, ‘কী রে শুভ আসছিস?’ (রেলের গার্ডবাবু মোগলসরাই থেকে ছুটি পেয়েছেন কিনা জানার চেষ্টা)। কিংবা ‘কোথায় চললেন দীপুভাই?’ (গবেষক ভাইয়ের এবারের সরেজমিন ক্ষেত্র কোথায়? জব্বলপুর না সিকিম না হিমাচল, তা জানা)। বা ‘বাবলা যাবি?’ (কাজ ফেলে যাওয়ার সময় হবে কি?)।…
আঁইয়া জায়গাটা আমাদের হাওড়া জেলার সংলগ্ন জেলা হুগলিতে। ফুরফুরা-আঁইয়া-গোপালপুর রোড ধরে ছুটল বাইক। কিছুটা খারাপ রাস্তা আর রাস্তার পাশে অনেকটা এলাকা জুড়ে বিদ্যুতের সাবস্টেশনের লোহার খাঁচা ছাড়া দু’পাশ বেশ মনোরম। আঁইয়া পাঁচমাথা মোড়ে এসে মনে হল, একবার স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞাসা করা উচিত। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, রাবড়িপাড়া আমরা ফেলে এসেছি। আবার পশ্চাৎ অপসারণ।
গ্রামটার নাম গাংপুর। এখানে ঘর ঘর বালতি। এই বালতিরা জলাধার নয়, রাবড়িকর। বালতিরাই রাবড়ি করেন। তারপর বালতি করে সেসব কলকাতার দোকানে দোকানে সরবরাহ। একটা ভাল বালতির খোঁজ সেই পাঁচমাথার মোড় থেকেই জেনে এসেছিলাম। তাঁর খোঁজ করা গেল। আসলে গাংপুরের এই জায়গাটি গোপপল্লি। এক গোপবধূই বালতি-কারখানা দেখিয়ে দিলেন।
কারখানায় তখন আরেক গোপবধূ কড়াইয়ে ফুটন্ত দুধে পাখার বাতাস করছেন। তিনি জানালেন, এটিই আমাদের খোঁজ করা কারখানা। তবে তাঁর জবাব ভীষণ কাঠ কাঠ। কেন? কী দরকারের মতো আরও নীরস এবং সন্দেহ প্রকাশক বাক্য বেরোল গোপবধূর স্বরযন্ত্র থেকে। ব্যাপারটা কী? আমাদের কোনও কারণে সন্দেহ করছেন নাকি? বললাম, ‘এই একটু খোঁজখবর নেব?’ জানা গেল, কলকাতা থেকে ফিরে বালতি এখন কাত হয়েছেন। ঘুমোচ্ছেন। আমাদের অনুরোধে গোপবধূ স্বামীকে ডেকে আনতে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে যাঁকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন তাঁকে দেখে আমরা নটনড়নচড়ন। এ যে আয়ানপতি! দুর্জন অতি কিনা জানি না। তবে নিশ্চিত, এঁর পদবি কখনও বালতি হতে পারে না। চৌবাচ্চাই ঠিকঠাক। কী চেহারা! আর মুখখানাও রাগী রাগী। কাঁচা ঘুম ভাঙানোর জন্য পেটাবেন নাকি? ইন্দ্র ক্যারাটেয় কী একটা যেন বেল্টধারী। কিন্তু শুভ-বাবলা তো সেসব মানতে চায় না। বেল্টের কথা উঠলেই ওকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কীসের বেল্ট? চামড়ার না রবারের?’ ইন্দ্র রেগে গিয়ে চুপ করে থাকে।
গোপমানবও রেগে ছিলেন। মুখ খুলতেই মালুম হল। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার?’ আমার এমনিতেই নরম গলা। লোকে বলে, ন্যাকা গলা। তার উপর চেহারা দেখে ভড়কে গিয়ে গলার স্বর প্রায় আকুতি-কাকুতির পর্যায়ে নেমে এসেছিল। কী আর বলব? স্বরযন্ত্রের বিশ্বাসঘাতকতায় আমার প্রবল ব্যক্তিত্ব পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, ‘এই ইতিহাসের খোঁজে এসেছি।’ ফুৎকারে আমাদের অনুসন্ধিৎসা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘ইতিহাস-ফিতিহাস আবার কী! বাপ-ঠাকুরদা করত, আমরাও করছি। এর মধ্যে ইতিহাস আবার কোতা?’ ছাত্রাবস্থায় অনুচ্ছেদের সারসংক্ষেপ করা নিয়ে হেব্বি ঝাড় খেতাম। নিয়ম ছিল, সারসংক্ষেপ যেন অনুচ্ছেদের এক তৃতীয়াংশ হয়। কিন্তু আমার কখনই আড়াই তৃতীয়াংশ ছাড়া আঁটত না। বেশি ভাবনা, বেশি কথার অভ্যাস সেই ছেলেবেলা থেকেই! ভদ্রলোক বোধহয় সারসংক্ষেপে অনেক নম্বর পেতেন। আরও একটা ভাবনা মাথায় এল, এই আয়ান ঘোষের রাধাদেবীকে, ইয়ে মানে রাবড়িদেবীকে, যদি কুলচ্যুত, কড়াইচ্যুত আর কী, করতে হয়, তাহলে ইতিহাস দিয়ে হবে না। অঙ্ক লাগবে।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা কারখানা থেকে রাবড়ি বিক্রি করেন?’ মুখের পেশি কিছুটা নরম হল। গলার স্বর নামল দু’পরত। জানতে চাইলেন, ‘কতটা নেবেন?’ হিসেবনিকেশ করে বললাম, ‘দু’কিলো।’ উনি কারখানায় ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ খুটখাট করে আবার বেরিয়ে এলেন। তারপর বললেন, ‘বুঝলেন দাদা, আমরা প্রচার চাই না। প্রচারে আমাদের প্রবলেম হয়।’ সোশ্যাল সাইটের বিস্ফোরণের যুগে এ কী কথা! তাহলে যে শুনি, অ্যাড এজেন্সিগুলো গুচ্ছের টাকা কামাচ্ছে শুধু লোকের হয়ে প্রচার করে! কিন্তু ইনি প্রাচীন পদ্ধতিতেই বিশ্বাসী। নিজেরে যে বড় বলে সে বড় নয় (মানে নিজের পয়সায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আমরাই সেরা, ভুয়ো দাবি)। লোকে যারে বড় বলে সেই বড় হয়। মানে লোকমুখে প্রচারই যথেষ্ট। একজন খেয়ে প্রশংসা করল। আরেকজনকে বলল। সে খুশি হল। এভাবে জ্যামিতিক এবং গাণিতিক হারে প্রচার বৃদ্ধি।
কিন্তু প্রচার চান না কেন? ভদ্রলোকের ভয়, তাঁদের খদ্দের তো সবই কলকাতার বড় বড় দোকান। বেশি প্রচার হলে খদ্দেরা জেনে যাবেন, ওই নামী দোকানগুলো নিজেরা রাবড়ি বানায় না। ফ্র্যাঞ্চাইজিতে চালায়। তাতে দোকানদাররা খেপে গিয়ে প্রচার উন্মুখ রাবড়িকরদের বালতি আর উপুড় করতে না-ও দিতে পারেন। তারপর বললেন, ‘খবরের কাগজে বেরনোর পরে আমাদের একটু প্রবলেম হয়েছে।’
আমরা অভয় দিলাম। উনি কারখানায় ঢুকে গেলেন। ততক্ষণে ইন্দ্র ছবি তোলার অনুমতি পেয়ে গিয়েছে। ও কারখানায় ঢুকে ছবি তুলতে শুরু করল। আর আমি রাবড়ির প্রস্তুতপ্রণালী দেখতে লাগলাম। উনুনে বিশাল দু’টো কড়াই। তাতে ঢিমে আঁচে দুধ ফুটছে। আর সেই গোপবধূ ফুটন্ত দুধে পাখার বাতাসের তোয়াজ করে চলেছেন। যে তোয়াজে প্রেমিকা তাঁর অধরপল্লব আলগা করে মধুক্ষরা স্বর ভাসিয়ে দেন। বধূর বাতাসের তোয়াজে ফুটন্ত দুধও শরীর আলগা করে সর ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেই সর কাঠি দিয়ে তুলে কড়াইয়ের গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছেন তিনি। দুধ কমবে আর কড়াইয়ের গায়ে সর বাড়বে। মেঝেয় আরও দু’টো কড়াই। তাদের গায়ে পুরু সরের চাদর জমাট হয়ে রয়েছে। কড়াইয়ের তলদেশে ফুটিয়ে ফুটিয়ে কমিয়ে আনা দুধসাগর। সুধাসাগরও বলা যায়।
ভদ্রলোক আবার বেরোলেন। পরীক্ষায় যতই কম নম্বর পাই না কেন, আমার তখনও ইতিহাসের মোহ যায়নি। বালতি পদবির উৎস জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘বলতে পারব না। শুনেছি, বর্ধমানেও গাংপুর বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে বালতিরা আছে।’ অনুমান করলাম, এই এলাকার জমিদার হয়তো নবশায়ক সম্প্রদায়কে গ্রামে জায়গা দেওয়ার সময়ে বর্ধমানের গাংপুর থেকে কোনও বালতিকে এনে বসিয়েছিলেন। কথার মাঝেই ছুরি নিয়ে বেরোলেন গোপবধূ। নিপুণ হাতে কড়াইয়ের গায়ে জমাট সরে ছুরি চালাতে লাগলেন। চালনার শেষে ছুরি দিয়ে উস্কে দিলেন বরফি বরফি কাটা সরের পাপড়িগুলো। সেগুলো ঝরে পড়তে শুরু করল সুধাসাগরে। পাপড়িগুলো সুধাসাগরে ভালমতো চান করার পরে হয়ে উঠবে রাবড়ি। গল্প করতে করতে জেনে গিয়েছি, ভদ্রমহিলা বিয়ের আগে পর্যন্ত রাবড়ি তৈরির কিছুই জানতেন না। এখানে এসেই শেখা। বাড়ির কাজ সামলে উনি রাবড়ি তৈরিতে স্বামীকে সাহায্য করেন।
ততক্ষণে আমাদের রাবড়ি প্যাকেট বন্দি হয়ে গিয়েছে। সেগুলো আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার আগে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘একটু জল খান।’ জল মানে তো সঙ্গে রাবড়িও। আমি আর ইন্দ্র পরস্পরের দিকে তাকালাম। থার্মোকলের প্লেটে এল গরমাগরম রাবড়ি। তারপর সেসব…। খেতে খেতে শিব্রাম চকরবরতীর কথা মনে পড়ছিল। ইস! লোকটা যদি বেঁচে থাকতেন। মালদার চাঁচলের রাজপুত্র থেকে কলকাতার চাতালের প্রিন্স হয়ে ওঠা লোকটা রাবড়ি ভালবাসতেন খুব। আমার জীবনের অন্যতম আইডল। বেঁচে থাকলে এক টিফিন রাবড়ি সুকরেষু করে আসতাম মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে গিয়ে।…খাওয়া শেষে ‘ভাল লাগল’, ‘দারুণ’, ‘আবার আসবেন’, ‘বিয়েবাড়িতে অর্ডার থাকলে বলবেন’ ইত্যাদি সৌজন্যমূলক, কেজো বাক্যালাপ এবং বিদায় সম্ভাষণ সেরে আমরা আবার বাইকে।
তখন সন্ধে নেমেছে। হাতে ক্ষীরসমুদ্রের থলি, মুখে পোকা (ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা তখন রাস্তায়। চোখে-মুখে ঢুকছে) আর কানে ইন্দ্রর গজগজানি। ওর দাবি এবং বিশ্বাস, আমাদের কোনও জায়গায় ঘোরা এবং তা নিয়ে লেখার পরে খবরের কাগজ, পত্রিকাগুলো খবর করে। কথাটা কাকতালীয় কি না জানি না। কিন্তু বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সত্যি। ইন্দ্রর রাগ, এই প্রথম আমরা খবরের কাগজ পড়ে কোনও কিছুর সন্ধানে বেরিয়েছি।
এই অমৃত কটাহের সন্ধানে।