স্যমন্তক ঘোষ
আবার একটা সীমান্তের গপ্পো। একটা নয়, অনেকগুলো। পর্বে পর্বে পাড়া হবে, পড়া হবে।
আকাশের কি সীমান্ত হয়? কবি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন। কিন্তু এক পাইলটদাদার কাছে শুনেছিলাম, আকাশের সীমান্তের গল্প। বিমান-বাস নিয়ে বাংলাদেশের আকাশ সীমান্তে ঢুকলেই নাকি মন ভাল হয়ে যেত তাঁর। এটিসি থেকে ভেসে আসত—‘‘আসসালামু আলেকুম। ঢাকা এটিসি আপনারে স্বাগত জানায়।’’ যাকে বলে শুদ্ধ বাংলা। ভাবা যায়?
পাইলটদাদা কিন্তু ভাবতেন। আমার কাছে অবশ্য আকাশের কোনও সীমান্ত নেই। ছোটবেলায় দূরদর্শনের মহালয়ায় স্বর্গের দৃশ্যে প্রচুর তুলো তুলো মেঘ ছাওয়া থাকত। বড় হয়ে বুঝেছি, ওরা স্বর্গকে পৃথিবী থেকে ৩৫ হাজার ফুটের বেশি ভাবতে পারেনি। এরোপ্লেনও তার উপর দিয়ে ওড়ে। আবহাওয়ার স্তর পার করলেই পায়ের তলায় স্বর্গের মেঘ। বাকিটা নীল আকাশ। স্বর্গেরও কি সীমান্ত আছে নাকি?
এ সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই জলের সীমান্ত চোখ ধাঁধিয়ে দিল। অ্যান্টিকুইটি ব্লু’র বোতলের মতো জল আন্দামান সাগরের। ওদিকে গাল্ফ অফ তাই, যাকে বলে সত্যিকারের বটল গ্রিন। অত ওপর থেকে সমুদ্রের ঢেউ বিশেষ বোঝা যায় না (পরে অবিশ্যি বুঝতে পারব, শীতের মরশুমে সামনে থেকেও এই দুই সমুদ্রের ঢেউ গোনা যায় না। বড়ই শান্ত) কিন্তু রং চমকে দেয়। আর মাঝের ওই স্বাভাবিক সীমান্ত রেখা।
স্বর্গ থেকে পাতালের দিকে চোখ সবে সরেছে। হুটোপুটি শুরু হল তখনই। অনেকটা মেট্রোর মতো। স্টেশন আসার নাম নেই, দরজার কাছে ঠেলাঠেলি। যেন কয়েক সেকেন্ড লেট হলেই সীমান্তের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে! এখানে অবশ্য মানুষের ঠেলাঠেলি নয়। জিনিসের। সাদা সাদা বস্তাগুলো এতক্ষণ মাথার উপরের চেম্বারে রাখা ছিল, বিশ্বাসই হয় না। এতো পেল্লায় ব্যাপার! এত ওজন নিয়ে উঠতে দিল? আমার সবে ধন নীলমণি স্যাকের ওজন ২০ কেজির থেকে পৌনে দু’কিলো বেশি বলে সাড়ে সাতবার কথা শুনতে হয়েছে। আর এ সব বস্তা, কেবিন লাগেজ? এ তো দিনেদুপুরে জোচ্চুরি!
পাইলট সাহেব সিটবেল্ট লাগানোর হুকুম জারি করেছেন। বস্তাদের লাইনের বেগও বেড়েছে দ্বিগুণ উৎসাহে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বস্তা। আইলের সিটে বসা লোকগুলো পায়ে পায়ে ঠেলে দিচ্ছে। সেবিকারাও কিছু বলছেন না। কটকটে ইংরিজিতে আনাড়ি কয়েকজনকে সিট বেল্ট দ্রুত বাঁধার হুকুম দিচ্ছেন। আর ওই লোকগুলোর যে বস্তা ঠেলা ছাড়া আর কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, সেসব নিয়ে সেবিকাদের কোনও ট্যাঁ-ফুঁ নেই!
পাশে বসা তেমনই এক বস্তাবাজ তৃতীয় বিয়ারটি চেয়ে বসল। আশ্চর্য! চলেও এল মুহূর্তে! অ্যান্টিকুইটি ব্লু’র মতো দেখতে আন্দামান সাগর দেখে আমারও তৃতীয় হুইস্কির পেগ চাইতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু সেবিকা মহোদয়া কঠিন গলায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, আর দেওয়া সম্ভব নয়। ল্যান্ডিংয়ের সময় হয়ে গিয়েছে।
এই বস্তাবাজগুলো কারা?
দেবের, চলতি মহানায়ক যিনি, প্রতি বরাবরই একটা দুর্বলতা আছে আমার। যতবার দেখেছি, ততবারই মনে হয়েছে ছেলেটা পারবে। যদি মুখটা বন্ধ রাখে। অনেক আশা নিয়ে ‘বুনোহাঁস’ দেখতে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, উপন্যাসটা পড়া ছিল না। অনেকটা দেখার পর এবং দেবকে সহ্য করার পর বুঝেছিলাম, ওই প্রফেশনটার নাম ‘ক্যারিয়ার’। হাবাগোবা লোক খুঁজে তাদের স্মাগলিংয়ের কাজে লাগানো হয়। বস্তাবাজগুলো ‘ক্যারিয়ার’ নাকি?
তৃতীয় বিয়ার পেটে পড়ায় আমার সহযাত্রী খুবই সুপ্রসন্ন হয়েছেন। কানের সামনে মুখ এনে গুণগুণ করে বললেন, ‘‘ব্যাঙ্কক?’’
বলাই যেত, গন্তব্য কাম্পুচিয়া। উদ্দেশ্য প্রাচীন আঙ্কোরভাট দেখা। মাঝে ব্যাঙ্কক বিমানপোতে ঘণ্টাতিনেকের বিরতি। কিন্তু অত কথা বলব কেন ওকে? ও তো হ্যাভসের দলে, আমি হ্যাভ নট! বিমান কোম্পানি ওকে এক পেগ ভালুক মারতে দিয়েছে। আমাকে তো দেয়নি। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে দিলাম, ‘‘হুম’’।
ততোধিক রসিয়ে জিজ্ঞাসা, ‘‘একা?’’
‘‘হুম।’’
‘‘মাল কিনতে নাকি?’’
কী মাল, কেন মাল, কিছুই বোঝা গেল না। তবে যথেষ্ট বিরক্তির উদ্রেক হল। ফলে উত্তর স্কিপ করে দূরে মেকং নদীর যে সুতোটা দেখা যাচ্ছে সেদিকে চোখ ফেরানো গেল।
সঙ্গীটি ছাড়ার পাত্র নয়। হিসেব কষতে শুরু করেছে। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্ককের রিটার্ন ফেয়ার কত। তার ওপর ভিসা। ব্যাঙ্ককে ফেক ইলেকট্রনিক্সের কত দোকান। ঠকে যাওয়ার কী ভয়ংকর সম্ভাবনা। শেষপর্যন্ত বক্তব্য, ইলেকট্রনিক্স বা কসমেটিক্স কেনার থাকলে ওকে বলে দিলেই হবে, সময়মতো আমার দোকানে পৌঁছে যাবে।
দু’চার অক্ষর চলে এসেছিল ওষ্ঠপ্রান্তে। আমাকে দোকানদার বলে মনে হচ্ছে? অফিস যেতে যদিও চাঁদনি মেট্রো স্টেশনে নামতে হয়। তা বলে চাঁদনি মার্কেটে আমার বেওসা আছে, এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। যত্তসব!
বহুক্ষণ অসৎসঙ্গে একটা দোষ হয়। হয়তো সে কারণেই, হয়তো ওর প্রশ্নবাণ কমানোর জন্যই জিগ্যেস করলাম—‘‘আপনি কি ক্যারিয়ার’’?
বিয়ার ক্যান ঝাঁকিয়ে সম্মতি এল।
কোনও দরকার ছিল না। তবু দেবের কথা বলে ফেললাম। চলে এল দুষ্টুলোকদের কথা। আর গোলাগুলি। বেশ জমিয়ে গপ্পোটা শুনল লোকটা। মজাই পাচ্ছে মনে করে আমিও খানিক রসালাম। কষালাম। আচমকাই থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘যত্তসব! বোগাস!’’
এতটা চাপ কল্পনা করিনি। এবার গপ্পো আসছে উল্টো পিঠ থেকে। ক্যারিয়া-কীর্তন। ‘ক্যারিয়ার’ এক মহান জীবিকা। বহু পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায়ে এই পেশায় আসতে হয়। এর সঙ্গে স্মাগলিংয়ের কোনওই সম্পর্ক নেই। শুধু কাস্টমস অফিসারদের সঙ্গে একটু সম্পর্ক ভাল রাখলেই হয়। প্রতিদিনের যাতায়াত। কেষ্টনগর-শিয়ালদার মতোই। কাজ হল, ইধারকা মাল উধার আর উধারকা মাল ইধার। ভাল বাংলায় বললে, ‘এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট’। গত চার বছর ধরে লোকটা এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং আর ক্যাটল ক্লাস, মানে ইকনমিতে ট্র্যাভেল করে না। প্রিমিয়ার কার্ড পেয়ে গিয়েছে। তাই এয়ারলাইন্সে যাকে বলে রয়্যাল অর্কিড ক্লাস। কিন্তু মাঝে মধ্যে ইকনমিতে যাতায়াতের অভ্যাস রাখার জন্য উঠে পড়ে আরকী!
প্লেন ঢুকে পড়েছে তাইল্যান্ডের সীমান্তে। ব্যাঙ্কক বিমানবন্দর ঝকঝক করছে নীচে। প্লেন চক্কর কাটছে। সম্ভবত রানওয়ের ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যাচ্ছে না।
চক্কর দিয়ে দিয়ে জীবনের গপ্পো বলছে সহযাত্রী। একটা মুদির দোকানে ‘সেলসে’র চাকরি করতো নাকি! অ্যাড দেখে ইন্টারভিউ দিয়ে কেরিয়ার গুছিয়ে নেওয়া ক্যারিয়ারের চাকরি পেয়েছে। উৎসাহভাতা পর্যন্ত আছে। ব্যাঙ্ককে থাকা-খাওয়া ফ্রি ছিলই। এখন তো একেবারেই ফ্রি।
প্রথম ফ্রি পর্যন্ত বোঝা গিয়েছিল। চাকরিজীবী মানুষ। কোম্পানি নিশ্চয়ই থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু পরের ফ্রি-টা?
গল্পের গরু গাছে উঠলে কী হতে পারে, সে তো এই লেখা পড়েই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আকাশে উঠলে কী হয়, শোনাচ্ছে সহযাত্রী। বছরতিনেক আগে ইলেকট্রনিক্সের ডিল দিয়ে লোকটাকে নাকি ব্যাঙ্কক পাঠিয়েছিল এক নতুন ট্রেডার। সঙ্গে একটা খাম। দেবের মতোই। এয়ারপোর্টে নামার পর সেই খামকে কেন্দ্র করেই প্রচুর ঢিসুম ঢিসুম হয়েছিল দেবের জীবনে। এর জীবনের গপ্পোটা মিলনাত্মক। ওই খামে ছিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। কলকাতার এক স্পা’য়ে কাজ করার জন্য চিঠি পৌঁছেছিল এক তাই রমণীর কাছে। ক্যারিয়ার পৌঁছেছিল তাঁর বাড়িতে। জলপানি দিয়ে শুরু হয়েছিল পরিচয়। শেষপর্যন্ত সব জল ঝরে নির্জলা হয়েছে ব্যাপারটা। মানে জলপানির জল গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে পানি। বানানটাই যা একটু আলাদা। সেই চিঠি প্রাপক তাই রমণীর পাণিগ্রহণ করেছে সে।
আপাতত তার জীবনে দুই নারী। একজন কলকাতায়। তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে দেশের সংসার। আর তাই রাজার দেশের সংসারের কর্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। প্লেন চাকা রেখেছে সীমান্তপারের মাটিতে। বস্তার লাইন সীমান্ত তৈরি করেছে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে ক্যারিয়ারদের মধ্যে। ততক্ষণে নিমন্ত্রণ মিলেছে আমার। ফিরতি পথে একবার যেন কলকেতার বর আর তাই বউয়ের সংসারটা দেখে যাই। ব্যাঙ্কক থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। আমার অপেক্ষায় সহযাত্রী তিন সপ্তাহ পরের উইকএন্ডটা কাটিয়ে যাবে সমুদ্রপারের সংসারে।
আমার ক্যারিয়ার বদলাল। তাই এয়ারওয়েজের টিজি ৩৫৬ থেকে চড়ে বসলাম টিজি ৭৬৭ ক্যারিয়ারে। কাম্পুচিয়ার রাজধানী নমপেনে প্লেন নামার পর আরও অনেক কিছু ঘটবে জীবনে। নেহাত গরুর রচনা বলে তাকে চালিয়ে দেওয়া যায় না।
ক্যারিয়ারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল হঠাৎ করেই। কোথা থেকে কী হইয়া গেল, ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরেও চেকিংয়ের চক্কর কড়া হল হঠাৎ করে। নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙিয়ে দিব্যি লাউঞ্জে ঢুকে পড়লাম আমি। কিন্তু বন্ধুবরকে আটকে দেওয়া হল।
অক্টোপাসের গন্ধ নাকে নিয়ে এরপর বিমান নামবে নমপেনে। কামপুচিয়ার রাজধানী। সেখানে বলার মতো অনেক কিছুই ঘটবে। কিন্তু সীমান্তের গল্পে সেসব গুঁজে দেওয়া ঠিক হবে না। বরং সপ্তাহখানেক টপকে চলে যাওয়া যাক কাম্পুচিয়ার উত্তর-পশ্চিম কোণে। জায়গাটার নাম সিয়েমরিপ।
গল্পে ঢোকার আগে কিছু কথা বলে নেওয়া ভাল। ইংরেজি মানচিত্রে কাম্পুচিয়ার নাম কম্বোডিয়া। কিন্তু স্থানীয় ভাষায় জায়গাটা কাম্পুচিয়া। অনেকটা ভারত-ইন্ডিয়ার মতো। লোকের মুখের ভাষাপ্রয়োগ করতে বরাবরই ভাল লাগে, তাই শুরু থেকে ওই নামটাই ব্যবহার হচ্ছে এই লেখায়। দ্বিতীয় জরুরি কথাটাও এইসূত্রে বলে নেওয়া যাক। গল্পের প্রয়োজনে কখনও কখনও ‘খামের’ কথাটাও চলে আসতে পারে। কাম্পুচিয়ার মানুষ ও সংস্কৃতিকে খামের বলা হয়।
দেশটা বহুকাল আগে ট্রেন দেখে ছিল। তখন সেখানে ফরাসিদের আধিপত্য। কিন্তু দিনে দিনে লাইন থাকলেও ট্রেন বাতিল হয়েছে। স্লিপারে চড়ে বেড়াতে যাওয়ার মজা থেকে বঞ্চিত আস্ত একটা দেশের মানুষ। বিকল্প বাস। দেশের প্রধান এবং একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। একমাত্র? না না, বোট-নির্ভরতাও যথেষ্ট। তবে বাসই প্রধান। ভ্রমণার্থীদের জন্য আরামদায়ক বাসেরও ব্যবস্থা আছে। রীতিমতো এসি বাস উইথ টয়লেট। গাল্ফ অফ তাইয়ের কিনারা থেকে সিয়েমরিপ পৌঁছতে গেলে ঘণ্টাবারো জার্নি করতে হয়। মাঝে নমপেনে বাস বদল। ভোর ভোর রওনা হওয়া গিয়েছিল সিহানুকভিলা থেকে। কাম্পুচিয়ার সর্বদক্ষিণ এলাকা। কাম্পুচিয়ার সমাদৃত রাজা সিহানুকের নামে তৈরি হয়েছে এই সমুদ্র বন্দর। সিহানুক থেকে নমপেনের রাস্তা প্রশস্ত না হলেও মসৃণ। জায়গায় জায়গায় মোটেল তৈরি হয়েছে সত্তর দশকের ফরাসি আদবে।
নমপেন বাসস্ট্যান্ড শহর থেকে অনেকটাই বাইরে। এতক্ষণ সঙ্গী ছিল ১৮ সিটের ভিআইপি ভ্যান। এবার পাওয়া গেল বড়সড় বাস। রাস্তার বর্ণনা এক কথায় শেষ করে দেওয়া যায়। কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গুসকরা বাইপাস ধরলে যে ছবি, এই রাস্তাটাও একেবারে তেমনই। ছবির মতো ধানক্ষেত দু’ধারে। গ্রামবাংলার সবুজ গ্রাম যেন উঠে এসে জুড়ে বসেছে। তফাত কেবল একটাই। মাঝে মাঝে চোখে পড়েছে গ্রামীণ বিয়ে। প্যান্ডেল অনেকটা আমাদের মতোই। তবে তফাৎ কেবল ছবি আর বর-বউয়ের পোশাকে। প্রতিটি প্যান্ডেলের বাইরেই ঝুলছে রাজা-রানির ছবি। আর বর-বউয়ের পোশাকের ধরন অনেকটা পুরনো ফরাসি ধাঁচের। সস্তার সাদা গাউন আর ফিট না-হওয়া কোট।
সিয়েমরিপ পৌঁছনো গেল প্রায় মাঝরাত্তিরে। ধর্মীয় সীমান্তের এক আশ্চর্য ছবি ধরা পড়বে এখানেই। ভারতের বর্তমান সংস্কৃতি যখন ঐতিহ্যের নামে ক্রমশ সংকীর্ণতার পথ বেছে নিচ্ছে, তখন কাম্পুচিয়ার ওই মিশ্র সংস্কৃতি কেবল গল্প করার মতো নয়, শেখার মতোও।
আমরা পৌঁছে যাব পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য আঙ্করভাট মন্দিরে। বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের ছবি ধরা পড়বে যেখানে। ধরা পড়বে সেই সব গল্প, কিছুদিনের স্বেচ্ছাচারী কমিউনিস্ট শাসন কীভাবে ভেঙে দিয়েছিল সেখাকার স্বাভাবিক জীবনযাপন। কীভাবে লড়াইয়ের প্রান্তর থেকে নিজেদের পরবর্তী জীবনের রসদ সংগ্রহ করেছিলেন কাম্পুচিয়ার প্রোলেতারিয়েত মানুষ।
মাঝরাত্তিরে সিয়েম রিপ বাসস্ট্যান্ডে আলাপ হয়েছিল গাট্টাগোট্টা, ছোট্টখাট্টো সানির সঙ্গে।
সানির একটা বড়সড় নাম ছিল। লিখেও দিয়েছিল টুকরো কাগজে। কিন্তু যথারীতি, এতদিন পর সে কাগজের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। তবে খুজে পেলেও যে খুব লাভ হতত, বলা যায় না। প্রথম দিনেই বোঝা গিয়েছিল ওই খটোমটো নাম বাংলা জিভ উচ্চারণে অক্ষম। ব্যাপারটা বুঝে নিজের ডাকনামটা জানিয়েছিল, সানি।
আগামী কিছুদিন সানি হবে আমার সঙ্গী। আঙ্করের পথে পথে তার টুকটুকই হবে আমার স্বর্ণরথ। টুকটুকের পরিচয়টা একটু দিয়ে রাখা ভাল। যানটির ব্যবহার অনেকটা আমাদের অটোর মতো। কিন্তু দেখতে ঠিক অটো নয়। সামনে একটা বাইকের অর্ধেক লাগানো। যার পিছনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটা ছোট গাড়ি। চাপাচাপি করলে মুখোমুখি তিন-তিন ছ’জন বসতে পারেন। আরাম চাইলে চারজন।
সানির সিটের তলায় রাখা থাকত সিল্ড জলের বোতল এবং আঙ্কর বিয়ার। বস্তুত গোটা কাম্বোডিয়ায় যে কোনও জিনিসের সঙ্গেই আঙ্কর নামটা জড়িয়ে দেওয়া অভ্যাস। দেশের জাতীয় পতাকা থেকে বিয়ার পর্যন্ত সমস্ত জিনিসেই আঙ্কর। মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ঘর্মাক্ত ভ্রমণার্থীকে জল এবং বিয়ার দিয়ে পরিষেবা দিত সানি। কিন্তু পয়সা নিত না। ‘‘ফ্রি-ফ্রি।’’ ভাঙা ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠত সানি।
টুকটুকে চড়ে সিয়েম রিপ চষে বেড়ানোর সময় কত গল্পই না করেছে সানি। সত্তরের সিভিল ওয়ার যখন শুরু হল, সানির বয়স তখন একদিন। কাম্পুচিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি খামের রুজের ভয়ে তখন গ্রাম ছাড়া হচ্ছে তাঁর পরিবার। একদিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ভিতর দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন সানির বাবা। কিন্তু শেষপর্যন্ত খামের রুজের হাত থেকে নিস্তার পাননি। পরিবারকে সুরক্ষিত করতে পারলেও ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে তাঁর আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। যুদ্ধের পরেও না। চোখ ছলছল করে উঠল সানির। মস্ত আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই তখন বিয়ার ঠান্ডা হচ্ছি। পাশের হাইওয়ে দিয়ে হুশহুশ করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। খানিক দূরে নিজের ক্ষেতের তরিতরকারি নিয়ে হাইওয়ের ধারে দোকান খুলেছেন এক বৃদ্ধা। এক মনে উল বুনে যাচ্ছেন।
পরতে পরতে উলের বল খুলছে সানি। ওর বাবা ছিলেন ইস্কুলমাস্টার। মায়ের কাছে সানি শুনেছে, এক সময় নাকি গ্রামের বাড়িতে সারাদিন ছাত্র ভরে থাকত। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেও পড়াশোনা করে মস্ত বড় হবে। কলেজের অধ্যাপক হবে।
পড়াশোনার সুযোগই পায়নি সানি। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে এসে খামের রুজের ক্যাডাররা পরীক্ষা করে যেত কেউ কোথাও পড়াশোনা করছে কি না! অ্যাগ্রেরিয়ান বিপ্লবে পড়াশোনায় মানা ছিল। পড়াশোনা করলে মানুষ নাকি অলস হয়ে যান, শ্রমদান কমিয়ে দেন!
১৫ বছর বয়সে পৌঁছে পড়াশোনার সুযোগ পায় সানি। তার আগে মায়ের কাছে গোপনে বর্ণমালা আর নাম সই করতে শিখে নিয়েছিল সে। কিন্তু পড়াশোনা খুব বেশিদিন চালানো যায়নি। রোজগার করতে হবে তো! বিপ্লব পরবর্তী কাম্পুচিয়ার অবস্থা হয়েছিল মস্ত একটা শ্মশানের মতো। রক্ত আর বারুদের ছোপ চতুর্দিকে। নমপেনের যে কলেজে ছেলেকে পাঠাতে চেয়েছিলেন সানির বাবা, খামের রুজ সেই কলেজ বন্ধ করে জেলখানা তৈরি করেছিল। এখনও যা প্রিজন মিউজয়াম নামেই পরিচিত।অত্যাচারের জীবন্ত ইতিহাস দেখে গা গুলিয়ে ওঠে।
কথায় কথায় টুকটুক পৌঁছে গিয়েছে আঙ্কর মন্দিরের সামনে। গেটের বাইরের চাতালে বিবিধ মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে বসে পড়েছেন একদল মানুষ। রাজস্থানে কোনও কোনও ফোর্টের বাইরে এমন দল দেখতে পাওয়া যায়। নিজেদের মধ্যে আনন্দ করতে করতে গান গাইতে থাকেন যাঁরা। তা শুনে কেউ দাঁড়ালে সম্ভাষণ করেন তাঁরা, না দাঁড়ালেও কোনও সমস্যা নেই। তফাত কেবল দু’টো। সুর এবং তাঁদের সামনে দাঁড় করানো ছোট্ট প্ল্যাকার্ডে। লোকসংগীতের সুরে অনেকটা দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচ। স্নিগ্ধ। মন কেমন করা। প্ল্যাকার্ডে চোখ গেলে মন আরও ভেঙে যায়। এঁরা সকলেই ‘ওয়ার ভিক্টিম’। যুদ্ধের সময় খামের রুজের হাতে কেউ হারিয়েছেন চোখ, কেউ হারিয়েছেন পা, আয়রন ক্যাম্প থেকে পালাতে গিয়ে কারও গুলি লেগেছে পিঠে। বহু চেষ্টার পরেও যে বুলেট বের করা যায়নি শরীর থেকে।
ততটা না-হলেও ‘ওয়ার ভিক্টিম’ হয়েছিল আঙ্করভাটও।খামের রুজ ক্যাম্প বসিয়েছিল মন্দির প্রাঙ্গণে। জ্বালানির প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো খুলে নেওয়া হয়েছিল কড়িবরগা। এখন অবশ্য তা আর বিশেষ বোঝা যায় না। রেস্টোরেশনে সে সব কিছুই ঢাকা পড়ে গিয়েছে। তবে ঢাকা যায়নি ভিয়েতনামের ছোড়া শেলের দাগটি। মন্দিরগাত্রে যুদ্ধের দাগ বলতে কেবল সেটুকুই।
দ্বাদশ শতাব্দীতে কম্বোজের রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মন তৈরি করেছিলেন বিপুল বিশাল এই মন্দির। কুলদেবতা শিব হলেও সূর্যবর্মন তৈরি করেছিলেন বিষ্ণুমন্দির। যে মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের আয়তনই হল ৩.৬ কিলোমিটার। ভিতরে ধাপে ধাপে উঠেছে দক্ষিণমুখী মন্দিরশৈলী। গর্ভগৃহের উপরের চূড়া সবচেয়ে উঁচুতে। যেখানে দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায়, শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। দীর্ঘদিন জঙ্গলের ভিতর হারিয়ে ছিল এই অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য। উনিশ-বিশের শতকে রেনোভেশনের কাজ শুরু হলেও ধ্বংস করা হয়নি জঙ্গল। গাছগাছালির মাঝখান থেকে চমৎকারভাবে বার করে আনা হয়েছে ইউনেস্কো’র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজটিকে।
আঙ্করভাটের স্থাপত্য এবং ইতিহাস নিয়ে লিখতে গেলে আস্ত একটা বই তৈরি করে ফেলা যায়। বই হয়েছে প্রচুর। ফলে নতুন করে সে সব কথা বলার অর্থ হয় না। সেই পরিসরও নেই। তবে একটা কথা বলতেই হয়। তথাকথিত উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি যখন প্রবলভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দিকে দিকে ঝুঁকছে, প্রাচ্যের কম্বোজ তখন অন্য এক উদাহরণ তৈরি করছে।
দ্বাদশ শতাব্দীতে মূলস্রোতের হিন্দু সংস্কৃতি গ্রাস করার চেষ্টা করছে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সত্ত্বাগুলোকে। আর ঠিক সেইসময়েই কম্বোজ বা কাম্পুচিয়ায় রাজার পরিবর্তন হচ্ছে। সূর্যবর্মার হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হচ্ছে সপ্তম জয় বর্মনের হাতে। মাঝের সামান্য একটা সময় রাজত্ব দখল করেছিল ভিনদেশী শক্তি। জয় বর্মন সেখান থেকে আবার পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনেন। সবটাই কি ফেরাতে পারেন?
শিব থেকে বিষ্ণুর প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর বর্মন রাজারা। শতাব্দীর শেষ পর্বে জয় অনুরক্ত হলেন বৌদ্ধ ধর্মে। মনে রাখা ভাল, ঠিক সেই সময়েই উপমহাদেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটা বড় দল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। জয় প্রভাবিত হলেন তাঁদের কথায়। কিন্তু ভাঙলেন না কিছু। গড়লেন। রাজমন্দির বদলাল। নতুন বাইয়ন বৌদ্ধ মন্দির স্থাপিত হল আঙ্করের অদূরে। আঙ্করেও স্থাপিত হল বুদ্ধের বিগ্রহ। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি মন্দিরে বুদ্ধ এবং বিষ্ণু একই সঙ্গে পূজিত হন। কারও সঙ্গে কারও কোনও বৈরিতা নেই।
পৃথিবী জুড়ে ধর্ম নিয়ে যখন তীব্র সংঘাত চলছে, আঙ্করভাট এবং সংলগ্ন মন্দিরগুলি তখন এক আশ্চর্য মৈত্রীর বাতাবড়ন ছড়িয়ে দিচ্ছে। ধর্মীয় সীমান্ত ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আঙ্করের দেওয়ালে একই সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে বৌদ্ধ স্থাপত্য আর রামায়ণের দৃশ্য।
মন্দির থেকে আবার ফেরা যাবে কাম্পুচিয়ার জনজীবনে। ক্রমে ক্রমে এই গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠবে সানি। বলা যাবে ভয়ঙ্কর পয় পে সীমান্তের গল্প। কিন্তু আরও কিছুদিন পর। মাঝে অন্য অন্য গল্প শুনে কিছুদিন স্বাদ বদল হোক।
সমাপ্ত