রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
আচ্ছা ধরুন, আপনার হাতে দু’তিন দিন ছুটি। অনেকদিন একটানা অফিস, বাড়ি করে ক্লান্ত। ভাবছেন, কটা দিন ঘুরে আসা যাক। কোথায় যাবেন? দীঘা? সে তো আপনি অনেকবার গেছেন। এবার একটু অন্য কিছু ভাবুন না। চলুন পুরুলিয়া ঘুরে আসি। লাল মাটির পুরুলিয়া। পলাশ, শিমূলের পুরুলিয়া।
এবার যখন বাড়ি থেকে পুরুলিয়া যেতে বলল একটু সংশয় ছিল। পুরুলিয়ার জন্য ছুটি নেব? তারপর এখন প্রায় শেষ বসন্ত। পলাশ, শিমুলের যে ছবি গুগুল দেখাচ্ছে আদৌ দেখতে পাবো? নাকি গরমে পচবো?
শেষপর্যন্ত বেরিয়ে পড়লাম। ১৭ই মার্চ। আমাদের গাড়িচালক দাদাকে নিয়ে আলাদা করে লিখব। লোকটা আপনার আইডলও হতে পারে। কোনা এক্সপ্রেসওয়ের জ্যাম কাটিয়ে গাড়ি ছুটল ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে। মাঝখানে একবার চা বিরতি। যে বাঙালি বর্ধমান হয়ে যায় আর শক্তিগড়ে থামে না সে বাঙালিই নয়। শক্তিগড়ে ল্যাংচা ঘর, ল্যাংচা হাউস, ল্যাংচা পার্ক। আদি অন্ত, নিউ নামের বাহার। সেখানে চারেক লুচি, দুটো রসগোল্লা, একটা ল্যাংচা।
বর্ধমান পেরোতেই পরিবেশ বদলাল। ইতিউতি পলাশ গাছের উঁকিঝুকি। পুরুলিয়া দুটো রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায়। একটা আসানসোল হয়ে। আর একটা দুর্গাপুরের বাঁকুড়া মোড় থেকে বাঁদিকে ঢুকে। আমরা দ্বিতীয়টা নিলাম। কারণ দুটো। এক, রাস্তাটা ভাল। দুই, মুকুটমণিপুর এই রাস্তাতেই গিয়েছিলাম। বাঁকুড়ার আগে বেশ ঘন জঙ্গল আছে। সম্ভবত জয়পুরের জঙ্গল। একটু ফটোশ্যুট হবে আর কী। রাস্তাতেই দেখতে পাবেন দুর্গাপুর ব্যারেজ। ব্যারেজ অবধি রাস্তায় একটু জ্যাম। রাস্তাও তেমন ভাল নয়। কিন্তু ব্যারেজ চলে গেলেই সব ছবির মতো। গাড়ির গতি বাড়বে।
জঙ্গলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফটোটটো তুলতে মিনিট কুড়ি গেল। পুরুলিয়ায় ঢুকে যাওয়ার পর বুঝলাম, না এলে ভুল করতাম। রুক্ষতা আর সৌন্দর্যের অপরুপ মিশ্রণ। রাস্তার দু’ধারে চাষ আবাদের তেমন কোনও চিহ্ন নেই। দূরে কিছু আদিবাসী গ্রাম। আর যে দিকেই আপনার চোখ যাবে শুধুই লাল। লাল মাটি। লাল পলাশ।
পুরুলিয়া শহরে যখন ঢুকলাম ঘড়িতে দুপুর ১.৩৫। ইয়ুথ হস্টেলে বুকিং ছিল। হস্টেলটা পুরুলিয়া-রাঁচি রোডের উপর। সার্কিট হাউসের কাছে। শহরের ভিড় থেকে একটু দূরে। ভাল ব্যবস্থা। পেটে তখন ছুঁচো ডন মারছে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা হোটেলে ঢোকা হল। মাছ, ভাত। অসাধারণ! একটাই অনুরোধ, না খেয়ে থাকবেন। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের হোটেলগুলোয় খাবেন না। ভাত খাওয়া ভুলে যেতে পারেন। মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে হোটেলে ফিরলাম যখন প্রায় ৩টে বাজে। সবার ভাবগতিক দেখে মনে হল, আজ আর কেউ ঘর থেকে নড়ছে না। অগত্যা ঘরেই বডি ফেললাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁকডাক। ঘুরতে যাওয়া হবে। কাছাকাছি দুটো ঘোরার জায়গা আছে। ডিয়ার পার্ক আর পুটিয়ারি ড্যাম। ডিয়ার পার্ক তো মোটামুটি সব জায়গাতেই থাকে। শুনলাম, হরিণের সঙ্গে নাকি খান দুয়েক ভালুকও আছে। ড্যাম থেকে ফেরার পথে ভালুকবাবুর সঙ্গে মোলাকাত হবেখন। একজন পুটিয়ারি ড্যাম যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিলেন। তাঁর হিসাবে, মেরেকেটে ১০ কিমি।
গ্রামের মানুষ খুব ভাল হয়। মানলাম। আপনার বিপদে সাহায্য করবে তা-ও মানলাম। কিন্তু ভুলেও তাঁদের দেওয়া কিলোমিটারের হিসাবে একদম বিশ্বাস করবেন না। ১০ কিলোমিটার তখন অতীত। যাঁকেই জিজ্ঞাস করছি বলছেন, ‘এগিয়ে যান।’ শেষে কলকাতায় না পৌঁছে যাই! ১৬ কিমি যাওয়ার পর একজন বললেন, ড্যামটার আসল নাম ফুটিয়ারি। বড় রাস্তা থেকেও প্রায় আড়াই কিমি। সত্যি বলতে এক নিমেষে বিরক্তিটা চলে গেল। বিশাল বড় ড্যাম। টলটলে জল। তিন দিকে ঘন পলাশের জঙ্গল। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সূর্যের শেষ সোনালি আভা আর লাল পলাশ। অসাধারণ। মায়াবী। একদমই ট্যুরিস্ট আসেন না এখানে। তবে হলফ করে বলছি, এলে পস্তাবেন না। ফেরার পথে আলো কমে আসায় আর ডিয়ার পার্কটা ঘুরে আসা হলো না।
পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় গাড়ি ছাড়ল। লক্ষ্য অযোধ্যা পাহাড়। শহর থেকে দূরত্বটা মোটামুটি ৪৫ কিমি মতো। তবে শহর থেকে কিছু খেয়ে রওনা দেবেন। রাস্তায় খাওয়ার পরিকল্পনায় থাকলে পস্তাতে হবে। অযোধ্যা পাহাড়ের যত কাছে যাচ্ছিলাম ততই বিস্ময় বাড়ছিল। এত বড়! সত্যি? সত্যি বিশাল বড়। একে বেঁকে পাহাড়ি রাস্তা। দু’দিকে ঘন জঙ্গল। হাতি বিষয়টা ওখানে জলভাতের মতো।
ভেবেছিলাম, এতদিন যে সব পাহাড়ি জায়গায় গেছি মোটামুটি প্রচুর দোকান, খাবার জায়গা, ভিড়। এখানেও তাই হবে হয়তো। বাকি জায়গাগুলোর থেকে আকাশপাতাল তফাৎ অযোধ্যা পাহাড়ের। সব থেকে বড় সমস্যা হলো কোথায় যেতে হবে তাই বুঝবেন না আপনি। কটা স্পট, কোনদিকে কোনটা, কতটা দূর? বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করেও খুব একটা সুরাহা হবে না। প্রথম কারণ ওখানে ট্যুরিজমটা ব্যবসা নয়। তাই তাঁরা দিন চালাতে এতটাই ব্যস্ত যে আপনাকে সাহায্য করার সময় তাঁদের নেই। দ্বিতীয় কারণ শালপাতা বা কাঠ নিয়ে তাঁদের দরকার। ঝর্ণা দিয়ে তো পেট ভরবে না। তৃতীয় কারণ ভাষা সমস্যা। যাই জিজ্ঞাসা করা হয়, যে কোনও একদিকে হাত দেখিয়ে দেয়। যদি জিজ্ঞেস করতাম, তাজমহলটা কোনদিকে? হাত তুলে দেখিয়ে দিত। আর যে বোর্ডগুলো লাগানো আছে তা থেকে স্থানীয়েরাও কিছু বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। গাইড কী জিনিস তাই জানে না অযোধ্যা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত সৌন্দর্য কিন্তু কোনও প্রচার নেই? পর্যটকদের জন্য সামান্যতম সাহায্যও নেই? কে খারাপ ছিল বা কে ভাল সেই তর্কে যেতে চাই না। শুধু এটুকু বলব, অযোধ্যটার কথা সবাই একটু ভাবুক। ওখানকার মানুষগুলো একটু খেয়েপড়ে থাকবে। একটা ছোট্ট পাহাড়ের সামনে দেখলাম, এক আদিবাসী ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। সেদিন দুপুর অবধি বিক্রি হয়েছে ১০ টাকার। তার আগের দিন ৪০ টাকার। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে? জঙ্গলের কাঠ, শালপাতা, কেন্দুপাতা বিক্রি করে আর কতদিন?
মনখারাপ নিয়েই গাড়ি চলল। উদ্দ্যেশ্য বাগমি ফলস। কেমন জানি না। তবে নামটা শুনে বেশ ভাল লেগেছে। কিছুক্ষণ পর পিচ রাস্তা উধাও। মোরাম ঢালা পাহাড়ি রাস্তা। দুটো গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারবে না। একসময় পৌঁছলাম বাগমি ফলস। জলের উৎস জানা নেই। ফলসটা দেখতে গেলে পাহাড়ি সিঁড়ি ধরে নামতে হবে। ফলসটার দু’টো ভাগ। মোটামুটি শ’তিনেক সিঁড়ি নামলে প্রথম অংশে পৌঁছনো যায়। সেখানে ফলসটা বিশেষ চওড়া না। আসল ফলসে যেতে গেলে নামতে হবে আরও শ’চারেক সিড়ি। মনে তখন জোশ। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে নামতে থাকলাম। নীচে গিয়ে মুখ দিয়ে একটাই শব্দ বেরোলো। আহা! শেষ বসন্তেই জলের ধারার আওয়াজ বেশ। বর্ষায় যে বাগমি ফলস যে আরও ভয়ঙ্কর হয়, তা বলাই যায়। বাগমি ফলসের জল নেমে যাচ্ছে আরও নীচে। কিন্তু সেখানে ট্রেক না করে পৌঁছান সম্ভব নয়। রাস্তা বলে কিছু নেই।
এবার ওঠার পালা। যে সিঁড়ি সংখ্যা এতক্ষণ ছিল সাতশো সেটা এখন সা আ আ আ আ ত শওওও! শদুয়েক সিঁড়ি ভেঙে মনে হল, এখানেই আমি শেষ। ভালো থেকো কলকাতা। কাছে জল নেই। কোনওমতে আরও শতিনেক সিঁড়ি ভেঙে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার কিছুটা উঠে একটা ছোট্ট দোকান। জল কিনলাম। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, জলের আরেক নাম কেন জীবন। তখনই দেখলাম, একঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে নামছে নীচে। স্কুলের এক্সকারশন। মনটা কিছুটা ভাল হল। বাকি রাস্তাটা কোনওমতে উঠে ধপ করে বসে পড়লাম। নিজের শারিরীক ক্ষমতার উপর ১০০% ভরসা থাকলে তবেই নীচে নামবেন। কারণ নীচে কেউ নেই। অসুস্থ হয়ে পড়লে হয়েছে আরকী!
এবার কোথায় যাওয়া যায়? আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, খয়রাবেড়া ড্যাম, যোগিনী কেভ। একটা ম্যাপে দেখলাম যাওয়ার জায়গা অনেক আছে। কিন্তু বিকেলের মধ্যে পুরুলিয়া পৌঁছতে হবে। আর একটা জায়গায় যেতেই হবে। সেটা হচ্ছে মুরগুমা। অযোধ্যা পাহাড় থেকে দুরত্ব ১৬ কিমি। কিন্তু হঠাৎ সব ছেড়ে মুরগুমা কেন? মুরগুমার কথা প্রথম শুনেছিলাম প্রশান্তদার মুখে। নেটে ছবি দেখে বেশ ভাল লেগেছিলো। ইচ্ছা ছিলো ওঁর সঙ্গেই একবার মুরগুমা আসব। হয়ে ওঠেনি। তাই চল মুরগুমা।
পাহাড় থেকে যখন মুরগুমা প্রথম দেখলাম, মনে হল, এটা সত্যিই পশ্চিমবঙ্গই তো? পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা বিশাল ড্যাম মুরগুমা। নীলচে জল। একদিকে পলাশের জঙ্গল। তার মাঝখান থেকে গ্রামের মেঠো পথ। সবমিলিয়ে যেন ক্যালেন্ডারের ছবি। শুনেছি, মুরগুমাতে তাঁবুতে থাকারও ব্যবস্থা আছে। মুরগুমা হয়েই ফিরলাম পুরুলিয়া। তবে আমি বলব, আপনি অযোধ্যাতেই থাকবেন। পুরুলিয়ায় নয়। তাহলে আরও ভাল করে ঘুরতে পারবেন। অযোধ্যা থেকে ফিরেই ঠিক করলাম শনিবার কলকাতা ফেরার সময় গড়পঞ্চকোট আর পাঞ্চেত ড্যাম যাব।
গড়পঞ্চকোট পুরুলিয়া শহর থেকে ৬০ কিমি। রঘুনাথপুর টপকালেই আপনি হঠাৎ চমকে উঠবেন। একটা বিশালাকার পাহাড় আপনার চোখের সামনে। ওটাই পঞ্চকোট পাহাড়। আর সেখানে বেশ কিছু পুরনো মন্দির। ছবির মতো দৃশ্য। সবুজ পাহাড়। তার কোলে গ্রাম। যে পর্যন্ত গাড়ি যায়, সেখানে গেলে দেখবেন একটা নতুন মডেলে তৈরি মন্দির। যেটা একদমই খাপ খায়না জায়গাটার সঙ্গে। আর একটা মন্দিরের ভগ্নাংশ। আর কিছু দোকান। গড়পঞ্চকোটে একটা রিসর্টও আছে। এসি ডাবল বেডরুম ২৭৫০ টাকা।
মন্দির নিয়ে আমার বরাবরই উৎসাহ কম। তার চেয়ে পাহাড়ের উপরে কী আছে জানায় আগ্রহ বেশি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বা কতটা যাওয়া যায়? উত্তর মিলল। পাহাড়ের উপরে একটা ৭৫০ বছরের মন্দির আছে। উঠতে মিনিট চল্লিশেক লাগে। স্থানীয় এক বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে আমরা উঠতে লাগলাম। ছেলেটার নাম অশোক কৈবর্ত। একটা গল্প আছে ওর। সেটা আর একদিন হবে। বামনি ফলসে তবু সিঁড়ি ছিল। এখানে তা-ও নেই। রীতিমতো পাথুরে রাস্তা। খাড়াই। প্রচণ্ড কষ্ট করে মন্দির অবধি এলাম। জঙ্গলে ঘেরা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। উপর থেকে আমাদের গাড়িটা আর তলার মন্দিরগুলো ক্যামেরার লেন্সের ফুল জুম করেও বিন্দু লাগছে।
ফেরার সময় পাঞ্চেত। গড়পঞ্চকোট থেকে পাঞ্চেত সময় লাগে মেরেকেটে আধঘণ্টা। পাঞ্চেত হয়ে কলকাতা ২৫০ কিমি। বিকালের মধ্যে ঢুকে যেতে পারতাম। যদি না আসানসোলের আগে গাড়ির ব্রেক খারাপ হতো। ওখানে গেল ঘণ্টাদুয়েক।
ঘুরে আসুন পুরুলিয়া। গরমটা বাদ দিয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, আপনার ব্যবহার করা কিছু পুরনো জামাকাপড় পারলে নিয়ে যাবেন। ওখানকার মানুষগুলোর খুব দরকার। ওখানে প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। আমরা গেলেই মানুষগুলো নতুন করে স্বপ্ন দেখবে। দু’মুঠো ভাতের স্বপ্ন।