জঙ্গল যাপন

ভালকির জঙ্গলে পাঁচমুড়ো

দীপক দাস

সমস্যাটা শুরু হয় শুরুতেই। টিকিট কাটা থেকে। আর সেই সমস্যার মূলে আমাদের ইন্দ্রকুমার।

ইন্দ্র একাই ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের প্রথম ভ্রমণের সদস্য সংখ্যা অর্ধেক করে দিয়েছিল। সেবার বাঁকুড়া যাওয়া হবে। দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী পর্যন্ত। পুজোর সময় তো। অনেকেরই পিছুটান থাকে। দীপু, শুভ সেসব কাটিয়েই সম্মতি দিয়েছিল। ইন্দ্র খুশি মনে টিকিট কাটল। অনলাইন। তারপর সেই টিকিটের টেক্সট সকলের মোবাইলে ফরোয়ার্ড করল। তার ঠিক দিন দুই পরে খবর আসতে শুরু করল, ‘দাদা আমি যেতে পারছি না। কাজ আছে।’ কেউ বলল, ‘বোনকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। যেতে পারছি না।’ রাজি হওয়ার পরেও এমন গ্রেট রিট্রিট’ কেন? টিকিট কনর্ফামেশনের টেক্সটটা ভাল করে দেখার পরে বিষয়টি বোঝা গেল। ইন্দ্রবাবু টিকিট কাটার সময়ে সময়-তারিখ গুলিয়ে একদিন পরের টিকিট কেটেছে। ফলে বাড়ি ফেরাও একদিন পিছিয়ে গিয়েছে। যারা নিজের লোকজনকে বাঁকুড়া থেকে ফিরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারাই পিছিয়ে গিয়েছিল।

টিকিট কাটা নিয়ে কেলেঙ্কারি হল ভালকি মাচান যাওয়ার সময়েও। টিকিট রিজার্ভেশন করে, আগে থেকে ঘর বুক করে ঘোরার পক্ষপাতী নই আমি। তাতে অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা থাকে না। এই নেশার খোয়ারিতেই একটি দলের সঙ্গে আমার আড়ি হয়ে গিয়েছিল। সেবার শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা। গাইড আমি। ভোরের গণদেবতা। যথারীতি রিজার্ভেশন করিনি। এইটুকু যাব, তার জন্য রিজার্ভেশন! তাছাড়া যতবার গিয়েছি গণদেবতা ফাঁকাই পেয়েছি। কিন্তু আমাদের যাত্রার দিনেই সকলে শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে বসবেন কী করে জানব? ট্রেন তখনও স্টেশনে ঢোকেনি। তার আগেই মেলার ভিড়। দেখেই আমার প্রাণ ধুকপুক। সঙ্গে আমার প্রিয়জনেরাই ছিলেন। বন্ধু-বন্ধুনী। ওরা দম্পতি। তাদের পুচকে। দুই দিদি আর তাঁদের দুই অর্ধাঙ্গ। আর তাঁদের বড় বড় চার পুচকে। এক অর্ধাঙ্গকে আমার বেশ ভয় লাগত। এখনও লাগে। সেদিন প্রবল ভিড়ে ট্রেনে উঠতেই পারলাম না। সেই অর্ধাঙ্গের মুখটা তখন ক্রমশ ভারী হচ্ছিল। তারপর থেকে আমার গাইডের চাকরিটা গেল!

ভালকি যাওয়ার পথে। সড়ক ছাড়ার পরে।

এবারেও গণদেবতা। এবারেও রিজার্ভেশন নেই। এবারেও হাওড়া স্টেশনে লোক থইথই। কাউন্টারে কাউন্টারে এঁকেবেঁকে চলেছে অজগর সাপ। স্টেশনে আসতে একটু দেরিই হয়েছে। ইন্দ্রবাবু যথারীতি দেরি করেছেন। ফলে একটা বাস ছাড়তে হয়েছে। বাবলা আর শুভ দু’টো কাউন্টারে লাইন দিল। কে যেন বলল, গঙ্গার পাড়ে একটা কাউন্টার আছে। সেটা ফাঁকা থাকতে পারে। যাওয়া হল। কিন্তু সেটি বন্ধ। আমাদের মুখ ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছে। এমন সময়ে ইন্দ্র একটা টিকিট ভেন্ডিং মেশিন দেখতে পেল। যন্ত্রপাতি দেখলে ও উৎসাহিত হয়। কিন্তু যন্ত্রেরা হয় ওর বিপরীত। ভারী দমে যায় তারা। যন্ত্রদের চমকে দেওয়ার জন্যই বাবলা ওকে ‘ভাইরাসম্যান’ নাম দিয়েছে।

ভালকির জঙ্গল।

ইন্দ্র নামটা সার্থক করে ছাড়ল। কয়েকজনের পরে এল ওর পালা। আর মেশিনও গেল বিগড়ে। গুসকরা চিনতে পারছে না মেশিন। কী কাণ্ড! ভালকি যেতে গুসকরায় নামতে হয়। বললুম, ‘বোলপুর দে। বনবাদাড় চিনতে না পারে। কবিগুরুর কর্মক্ষেত্র চিনবেই।’ এবং মেশিন চিনল। কিন্তু অর্থ নিতে অস্বীকার করল। ইন্দ্র যতবার ১০০ টাকার নোট দেয় সবই উগরে দেয় মেশিন। ইন্দ্র চেঁচাল, ‘কার কার কাছে নতুন নোট আছে বের কর।’ সকলেই পকেটে হাত দিল। একটা দু’টো নতুন নোট বেরোল। আবার সেগুলো মেশিনের পেটে গেল। দু’টো গ্রহণ করে বাকিদের প্রত্যাখ্যান করল সে। ইন্দ্র আবার দিল। পিছনের লোকেরা তখন চিৎকার করছে, ‘একজনকে নিয়েই কি ব্যস্ত থাকবেন নাকি?’ আমরাও পাল্টা দিলাম, ‘আমরা যাব না নাকি?’ এই ‘দিবে না নিবে’ খেলার মধ্যেই টিকিট মিলল। তা-ও চারটে। আমরা যাচ্ছি পাঁচজন। আবার মেশিনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি। তারপর সাফল্য এল।

পরে আবিষ্কার করেছি, মেশিনের সঙ্গে ইন্দ্রও ঘাবড়ে গিয়েছিল। এত প্রত্যাখ্যান কার সহ্য হয়! ও ঘাবড়ে গিয়ে নিতে না যাওয়া নোটগুলোই আরেকবার করে মেশিনে ঢোকাচ্ছিল।টিকিট পর্ব শেষে ট্রেনের দিকে এগোতে এগোতে আমার দাবিটা আরেকবার মনে করিয়ে দিলুম। বাসে ওঠার আগেও দিয়েছিলুম।

মৎস্য দফতরের ভেড়ি।

যদি একটা বসার জায়গা পাওয়া যায় তাহলে সেটা আমাকেই দিতে হবে। তার সঙ্গত কারণও ছিল। দলের মধ্যে আমিই একমাত্র সিনিয়র সিটিজেন। মানে বয়সে বড়। ফলে আমার একটা দাবি থাকেই। দ্বিতীয় কারণ, আমি অফিসে নাইট করে ঘুরতে বেরিয়েছি। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে জামাকাপড় বদলেই লাগেজটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলুম। চোখ ভরা ঘুম। তৃতীয় কারণ, খুব ঠান্ডা লেগেছিল। কাঁচা জল বৃষ্টি থামার পর গাছের পাতা থেকে টুপটুপাচ্ছিল। পকেটে দু’টো রুমাল। তাতেও সেই জল আটকানো যাচ্ছে না।

তবে জায়গা মিলেছিল। নীচে ‘সুযোগসন্ধানী’ ইন্দ্র। ওটা বাবলা আর শুভ বললেও আমার আর দীপুর মনে হয়েছিল, ওকে এখন রবি ঠাকুরের গান গেয়ে বলতে হবে,‘আমার এই দেহখানি তুলে ধরো’। না হলে ওই দেহ নিয়ে ওর পক্ষে বাঙ্কে ওঠা অসম্ভব। মুখোমুখি দুই বাঙ্কের একটায় আমি, শুভ, আর বাবলা। অন্যটায় দীপু। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজতেই শুভর অধপতন ঘটল। বাঙালির স্বভাব। আগে এসে ভাই বেরাদরদের জন্য সিট রেখেছিলেন। কিন্তু সেই বেরাদরটি সময়মতো পৌঁছতে পারলেন না বলে সিট ছাড়তে বাধ্য হলেন সহযাত্রী। আরেকজনেরও একই কীর্তি। সেই কীর্তিতে আমিও বাঙ্ক থেকে ভূমিষ্ঠ হলুম। তারপর একটু চোখ বুজে বকেয়া ঘুমের ঋণশোধের চেষ্টা।

ঘুরতে যাওয়ার পথে। গড়ের রাস্তায়।

ঘুম অতি সাধনার বিষয়। ট্রেনে ঘুমনো আরও বেশি সাধনার। বিশেষ করে যে ট্রেনে পুজোর আনন্দে যোগ দেওয়ার জন্য মানবকুল বাড়ি ফিরছেন। আমার তো মনে হয়, পুরাকালে ট্রেন আবিষ্কার হলে মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভাঙাতে অপ্সরাদের আর মর্ত্যে এসে নাচাগানার কষ্ট করতে হতো না। পালোয়ান কোনও দেবতাকে দিয়ে ধ্যানরত মুনিকে ট্রেনে চাপিয়ে দিলেই হতো। একদিকে বাঙ্ক থেকে ইন্দ্রর দিকে ছুড়ে দেওয়া গায়ে জ্বালা ধরানো বাবলার টিপ্পনি। আরেক দিকে দীপু-শুভ আর সহযাত্রীর সমবেত ‘হোক কলরব’। তার সঙ্গে ফেরিওয়ালা। খাবার নিয়ে কোনও ফেরিওয়ালা উঠলেই ইন্দ্র চমকে উঠছে। শেষে থাকতে না পেরে চার ঠোঙা ঝালমুড়ি কিনেই ফেলল।

ইন্দ্রর একটা মস্ত সুবিধে হল, ও ওর সব কাজ মাত্র দু’টো বাক্যেই সারতে পারে। একটি বাক্য অতি সংক্ষিপ্ত। মাত্র একটা শব্দের। ও প্রচণ্ড গেঁতো। তাই কোনও কাজ করতে বললেই দেবদেবীদের বরাভয় দেখানোর মতো করে হাত তুলে বলে, ‘পরে’। আর খেতে প্রচণ্ড ভালবাসে। ফলে যে কোনও খাবার বহুভোগ্য পরিমাণেই কেনে। তারপর সেই খাবার খাওয়ার জন্য সঙ্গীদের পীড়াপীড়ি করে, ‘খা কিছু হবে না’। কারণ নিজেও সেই খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আগেও একবার ভালকি মাচান গিয়েছিলুম। সেবার ও ট্রেনে ৫০০ গ্রাম তিলেখাজা কিনেছিল। অত তিলেখাজা আমরা চারজন মিলেও শেষ করতে পারিনি। ইন্দ্রও নয়। শেষে ভালকির গেস্টহাউসে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের দিয়ে এসেছিল।

গড়ের পথের পাশে দেখেছিলাম। সুয়াতা গ্রামে সৈয়দ মহম্মদ বাহমনি পিরের মাজার।

এবারেও খাবারদাবার নিয়ে কাণ্ড একটা ঘটবেই। ঝালমুড়ি দিয়ে তার সূচনা ট্রেনেই হল। তারপর আবার। ট্রেন তখন একটা স্টেশনে থেমেছে। এখন আর তার মনে করতে পারা যাচ্ছে না। তবে এটা বলতে পারি, অতিরিক্ত ঝালের ঝালমুড়ি তখনও পাকস্থলীতে পৌঁছয়নি। উঠলেন চা-কফি। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এক হকার চিৎকার করলেন, ‘বাদামচা.আ.আ.আ ক।’ ইন্দ্রও লাফিয়ে উঠল, ‘উরিশ্লালা, বাদামচাক!’ ওর লাফানিতে আমার অনীকের কথা মনে পড়ে গেল। ইন্দ্রর ভাইপো অনীক। একদম ছোট্টটি। ওর তখন বছরতিনেক বয়স। আমরা ফিস্টে গিয়েছিলাম সত্যনারায়ণ খাঁয়ের বাড়ি। সত্যনারায়ণবাবু মানে টলিউডের একসময়ের নামী প্রযোজক। তাঁর বাড়িতেই শ্যুটিং হয়েছিল ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ‘প্রতিদান’, ‘প্রতিকার’-এর মতো সিনেমার। ওই বাড়ির পাশেই কানানদী। ভাল নাম কৌশিকী। আমরা দলবেঁধে নদীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলুম। অনীকও। ব্যাটা দেখে সবই নেবে বলে বায়না করে। নদীর জলে প্রচুর গেঁড়ি-গুগলি। দেখে ওর আদুরে গলায় বিস্ময়, ‘উইবাবা, কত গেয়ি। আমাকে গেয়ি ধয়ে দাও না।’ ভাইপোর মতো কাকাও ট্রেনে যা দেখছে তাতেই লাফাচ্ছে।

সাধারণত খাবার দোকানিরা ইন্দ্রকে দেখলেই কোনও অজানা কারণে খুশি হন। কিন্তু ইন্দ্র ‘উরিশ্লালা’ বলে লাফিয়ে উঠতেই বাদামচাকওলা তড়বড় করে ছুটে পালালেন। ট্রেন কাঁপিয়ে হেসে উঠল শুভ। বলল, ‘বাদামচাকওলা তোমার চিৎকার শুনে ভেবেছে, তুমি ওর সব মাল কেড়ে নেবে।’ আবার সবাই মিলে হইহই। ট্রেনের সহযাত্রীরাও আমাদের কথায় মজা পেয়ে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ টিপ্পনিও কাটছিলেন। ট্রেনে আরও নানা ফচকেমি ছিল। কিন্তু সেসব কহতব্য। লিখিতব্য নয়। সকলে মিলে মজা করতে করতে আর আমি নাক মুছতে মুছতে গুসকরা পৌঁছলুম। ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে ছবিটবি তুলে স্টেশনের বাইরে। এবার ভালকি যাওয়ার পালা।

মাচানে দু’ভাবে যাওয়া যায়। বাসে করে। নয়তো গাড়ি ভাড়া নিয়ে। স্টেশনের বাইরে সার সার ভাড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন লোক দেখলেই তাঁরা সব কাঞ্চনমূল্যে দর হাঁকেন। কিন্তু বাসের খরচ তার তিন ভাগের এক ভাগ। অবশ্য বাসে মাচান পর্যন্ত যেতে হলে অভিরামপুরে নেমে ইঞ্জিন ভ্যান বা কিছু ভাড়া করতে হবে।

লোকে বলল, চাষের জন্য জলের ব্যবস্থা।

এবারেও বাসেই যাওয়া হবে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে আমাদের ইন্দ্রবাবু রয়েছেন। তিনি বাবুয়ানি ছাড়া তো থাকতে পারেন না। দাম বেশি হলেই জিনিস ভাল বলে মনে করেন। এক ফিস্টের ঘটনা। আমরা বাজার করতে গিয়েছি। সারা বাজারে ৩০ টাকা কেজি পেঁয়াজ। উনি বাবু কোথা থেকে ৫০ টাকা কেজির পেঁয়াজ কিনে এনে হাজির। তারপর সেই হাড়ে আগুন জ্বালানো উক্তি, ‘দেখো, খুব ভাল গো।’ শুনলেই হাত নিশপিশ করে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের মতো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব (এ ক্ষেত্রে গ্রুপবাজি) চাই না বলে হাত দু’টো পকেটে ঢুকিয়ে দিই। ইন্দ্র বলল, ‘চল না, দাম করে দেখাই যাক।’ দাম করলুম। সেই বাড়াবাড়ি। আমরা একটা দাম দিলুম। তাতে রাজি নন। ‘বাসে যাব’ বলে গুমর দেখিয়ে চলে এলুম।

আমরা লোটাকম্বল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাসের অপেক্ষায়। গাড়িচালক এলেন। বললেন, ‘মাত্র ৫০ টাকার জন্য এমন করছেন কেন? চলুন।’ লোকটার মুখে আর কথায় কী একটা মায়াবি ভাব ছড়ানো। স্থানীয় বাসিন্দা। চাকরিবাকরি নেই। পরের গাড়ি চালান। গাড়িচালান মানে খদ্দের ধরার জন্য গুঁতোগুঁতি করেন। যা প্রতিযোগিতা দেখছি এখানে! আর উনি সত্যি কথাই বলেছেন। ঘুরতে এসেছি। কত ৫০ টাকা খরচ হবে কত দিক দিয়ে।

লোটাকম্বল নিয়ে গাড়িতে ওঠা গেল। গাড়ির মডেল বলতে পারব না। শুভ বলছে, মডেলটা পুরনো অল্টো ৮০০। বেশ ছোট। পাঁচজনেই ঠাসাঠাসি। আমি তো একদিকে হিপো আরেকদিকে রাইনোর মাঝে পড়ে কার্টুনের বিড়াল টমের মতো চ্যাপ্টা হয়ে রইলুম। ইন্দ্রকে এমনিতেই আমরা মোটা বলে ডাকি। এখন তার দোসর হয়েছে শুভ। খাওয়াদাওয়া এবং শরীর বাগানোয় দু’জনে পরস্পরকে জোর লড়াই দিচ্ছে। তবে কে হিপো আর কে রাইনো, সেটা বললুমনি। ওরাই ঠিক করে নিক। গাড়িচালকের পাশের সিটে দীপু আর বাবলা। দীপুর ভারী শরীর হলেও বাবলা ছোটখাট চেহারার। ফলে ওদের ততটা সমস্যা নেই।

ঠাসাঠাসি।

গাড়ি এগিয়ে চলল ভালকির দিকে। আগের বারে যেদিক দিয়ে গিয়েছিলুম গাড়ি সেই পথ ধরল না। চালক বললেন, ‘ওদিক দিয়ে গেলে রেলগেট পার হতে হবে। গেট পড়ে গেলে সময় নষ্ট।’ সেই সময়েই বেজে উঠল ফোনটা। কিছুতেই বার করতে পারি না। কনুই দিয়ে ঠেলে হিপো-রাইনো সরাতে গামা পালোয়ান বা আমাদের গ্রামের ভীম ভবানীরাই বোধহয় পারতেন। অনেক কষ্টে এগিয়ে-কাত হয়ে ফোনটা বার করলুম। আমার অফিসের এক ছানা। পুজোর ছুটিতে বাড়ি চলেছেন। অফিসে আমার বেশ কয়েকটা ছানাপোনা আছে। জুনিয়র সব। কিন্তু ওদের সঙ্গই আমার ভাল লাগে। কত ভাবনা। কত ইচ্ছের সঙ্গে রোজ চেনাজানা হয়। ‘অচলায়তন’-এর পঞ্চকের মতো আমিও বলি, বিদ্যেবুদ্ধিতে ওদের সঙ্গেই আমার একটু যা মেলে। ফোনের ছানা মিষ্টি গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায়?’ বললুম। শুনে রেগে গেলেন তিনি, ‘নাইট করে না ঘুমিয়ে এই সকালে (তখন বড়জোর দশটা হবে) অতদূর পৌঁছে গ্যাছ!’ ছানাপোনার আমাকে শাসন করে, চোটপাট করে, একেকজন কটাক্ষের হূল বেঁধায়। আমি উপভোগ করি সেসব।

অভিরামপুরে গাড়ি একটু দাঁড় করালুম। নাকের জলকে বশ মানানো দরকার। কিন্তু আমি গাড়ি থেকে নামতে পারছি না। অসুস্থ শরীরে দু’টো পাহাড় সরিয়ে নামা সম্ভব নয়। দীপুকে একসময় পড়িয়েছিলুম। ওর সেন্টুতে ঘা দিয়ে বললুম, ‘গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সময় এসেছে। অসুস্থ গুরুর জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে আয়।’ কলিকালে গুরুকুল শুধু ‘মোহব্বতে’ সিনেমায় দেখা যায়। তাতেও তো বিদ্রোহের সুর। দীপু নিজেকে যুগল হংসরাজ, জিমি শেরগিল না উদয় চোপড়া ভাবতে ভাবতে নেমেছিল, সেটা জানতে পারিনি। তবে দীপুর নামার পরেই শুভ আমাকে ফিসফিস করে পরামর্শ দিচ্ছিল, ‘ওকে পাশের দোকানটায় যেতে বলো। তাড়াতাড়ি সর্দি সারবে।’ পাশের দোকানটার মতো দোকানগুলো রাজ্য সরকারকে ভাল মতো কর জোগান দেয়। মানে মদের দোকান। শুভ ঠান্ডা ছেলে। ও এত কিছু জানল কী করে কে জানে!…

অরণ্যসুন্দরীর পথে।

অভিরামপুর থেকেই ভালকির দিকে এগোতে হয়। গাড়ি এগোল। চলল অরণ্যসুন্দরীর দিকে। ভালকির জঙ্গলের মধ্যে একমাত্র গেস্টহাউস। দু’দিকে মাঠ, জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝে মাঝে পোলট্রি ফার্ম। এত মুরগি খান কারা? লোক কোথায়? রাস্তায় দু’টো আদিবাসী পাড়া পড়ল। সুন্দর একতলা, দোতলা বাড়ি। সেসব ছাড়িয়ে গাড়ি এসে থামল অরণ্যসুন্দরীর সামনে। মালপত্র নামিয়ে, টাকা মিটিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হল। আমরা গেলুম কেয়ারটেকারের কাছে। তাঁর কাছে পৌঁছইনি কানে এল, ‘ঘর খালি নেই।’ ঘর খালি নেই! আগেরবার এরকমই পুজোর সময়ে এসেছিলুম এখানে। প্রায় জনমানবহীন ছিল অরণ্যসুন্দরী। আমাদের নিয়ে তিনটি দল। প্রায় সব ঘরই ফাঁকা। রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে ডর্মিটরিতে বসে পাচকঠাকুরের সঙ্গে বসে বসে আড্ডা মেরেছিলুম। দু’বছরের মধ্যে এত রমরমা! কোনও সেলিব্রিটির পদধূলি পড়েছিল নাকি!

কেয়ারটেকারও হাঁকিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘর পেতে মরিয়া ছিল ইন্দ্র। ও কেয়ারটেকারকে বলল, ‘অফিসরুমটা ছেড়ে দিলেও হবে।’ জঙ্গলের মধ্যে রাত্রিবাস করানো হবে বলে কথা দিয়েছি দীপুকে। অরণ্যসুন্দরী খালি হাতে ফেরাচ্ছে দেখে ওর মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দিদির অর্ধাঙ্গের মুখটা। এই জন্যই বোধহয়, বড়দের কথা শোনা উচিত। কিন্তু এখন থাকা হবে কোথায়? এখানে রুম স্টে’র ব্যবস্থা এখনও চালু হয়নি। আর কোথাও ঘর পাওয়া হবে কিনা সেটাও জানি না। তাছাড়া সেখানে যাবই বা কী করে! গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। কেয়ারটেকারই উপায় বাতলালেন। অভিরামপুরের কাছে এড়াল নামে গ্রামে মৎস্য দফতরের একটা গেস্টহাউস আছে। তড়িঘড়ি করে গাড়িচালককে ফোন করা হল। টেনশনের চোটে রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে গেল, ‘গাড়ি ঘুমাকে লে আইয়ে।’

গড় এলাকায় পুরনো মন্দির।

গাড়িতে উঠতেই ইন্দ্র আর শুভর চোটপাট শুরু হল— ‘বলেছিলুম, আমরা যেখানে যাই সেখানটাই বিখ্যাত হয়ে যায়।’ ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যেখানে ঘুরতে চাই সেই জায়গাই খবরের কাগজে খবর হয়। জনাইয়ের মনোহরা, খানাকুলে রামমোহনের বাড়ি বা বেলিয়াতোড়ে যামিনী রায়ের বাড়ি— সব ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটেছে। মনোহরার ক্ষেত্রে তো পত্রপত্রিকায় ধূম লেগেছিল। আমাদের ভ্রমণ এবং লেখালেখির পরে একাধিক কাগজে এবং পত্রিকায় মনোহরা নিয়ে লেখা হয়েছিল। কাকতালীয় হবে বোধহয়।

গাড়িতে বসে বসেই আর কোথায় কোথায় থাকার ব্যবস্থা আছে জানার চেষ্টা করছিলুম। গাড়িচালক বললেন, ‘অভিরামপুরে একটা থাকার জায়গা আছে। কিন্তু রাতে সেখানে দরজায় ধাক্কা পড়ে।’ ডাকাতির ভয় নাকি। চালক আশ্বস্ত করে, ‘না, না। কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করে।’ ব্যাপারটা বুঝলুম। কিন্তু আমাদের মধ্যেই কোন অর্বাচীন প্রশ্ন করে বসেছিল, ‘দরজা ধাক্কা দিয়ে কী লাগার কথা জানতে চায়?’ গাড়িচালক লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘বোঝেনই তো সব।’

মৎস্য দফতরের গেস্ট হাউস।

মৎস্য দফতরের গেস্টহাউসটা বেশ ভাল লেগে গেল। বিশেষ করে পরিবেশ। প্রচুর গাছগাছালি। অনেক ভেড়ি। অনেকটা ফাঁকা জায়গা। গেস্টহাউসের সামনের ফাঁকা জায়গাগুলোতে ফুল, সবজির ক্ষেত। এখন শুধু ঘর পাওয়ার অপেক্ষা। কলকাতা থেকে বুকিং করতে হয়। সরকারি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললে তো চিত্তির। এক কর্মীকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘ঘর পাওয়া যাবে?’ উনি বললেন, ‘একটু বসুন লোক আসছে।’ আমরা একটা আমগাছতলায় সিমেন্টের বেঞ্চে গা এলিয়ে দিলুম। ইন্দ্র ব্যাগ হাতড়ে খাবারের প্যাকেট খুলেছে। এক ব্যাগ মজা আর চিঁড়েভাজা। আমাদের বেড়াতে যাওয়ার অনিবার্য টিফিন। এক ব্যাগ মজা মানে প্যাকেটের টোস্ট। বাবলা খালি বলছিল, ‘তাহলে ফলার হয়ে যাক? চিঁড়ে তো আছেই।’ আমরা ফল আনিনি তাহলে ফলার হবে কী করে? ও দফতরের বাগানের বিশাল একটা কলার কাঁদি দেখিয়ে বলল, ‘চিঁড়ে দিয়ে মাখা হোক।’ খিদে পেয়েছিল। সেইসঙ্গে ঘুমও। ওরা টোস্ট হাতে করে ভেড়ির পাড়ে ঘুরতে গেল। যাওয়ার আগে বাবলা বলে গেল, ‘ঘর পাই আর না পাই, দু’টো ছিপ জোগাড় করে দিতে বলব। তারপর পুকুর পাড়ে বসেই মৎস্যশিকারে দিনকাবার করে দেবো।’

আর আমি ঢুলতে ঢুলতে লোকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলুম। ততক্ষণে আবার গাড়িচালককে বিদায় জানানো হয়ে গিয়েছে।…

ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। টোস্ট হাতে করে ঢুলছিলুম। তখনই একটা গাড়ি ঢুকল। বাচ্চা হাতি মডেল। তবে ঘেরাটোপ লাগানো। ‘লোক’ এলেন। তিনি অফিসে ঢুকলেন। ঘর পাওয়া যাবে তো? আমি ওদের ডেকে নিলুম। তারপর গুটি গুটি অফিসে গিয়ে ঢুকলুম। ঘর পাওয়া যাবে? লোকটি মানে এখানকার বড়কর্তা, জানতে চাইলেন, ‘কীরকম ঘর? এসি না নন এসি?’ এসি শুনেই ইন্দ্র আমার দিকে তাকাল। বুঝলুম, ওর সেই দামি সত্তাটা জেগে উঠেছে। পাত্তা না দিয়ে বললুম, ‘নন এসি। একটা বড়সড় ঘর দিলেই চলবে।’ কিন্তু সেটা মিলবে না। উনি জানালেন, আমাদের ডাবল বেডের দু’টো ঘর নিতে হবে। যেহেতু একজন বেশি হচ্ছে তাই তার জন্য অতিরিক্ত মাসুল লাগবে। অতিরিক্ত মাসুল লাগবে? অতিরিক্ত ঘর নিতে বাধ্য তো করা হচ্ছে না। দেওয়া যাবে।

ঘরের চাবি হাতে পেতেই প্রায় দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকলুম। তারপর বিছানায় শরীরটা ছুড়ে দিয়ে কঁকিয়ে উঠে বললুম, ‘ভাই, আমি ঘুমোতে চাই।’ হে ঋত্বিক ঘটক, হে শক্তিপদ রাজগুরু, হে বেণুদিদা এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’র অন্য কুশীলব ও ভক্তেরা— এই অর্বাচীনকে ক্ষমা করুন।

লোকটা ভারী অসভ্য তো! আমাকে ধাক্কা দিয়েই চলেছে। সিট থেকে ফেলে দেবে নাকি? আরেকটা ধাক্কা দিতেই আমি ট্রেনের সিট থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলুম। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি, শুভ ওর থামের মতো হাত দিয়ে ঠেলছে। আর বলছে, ‘ও বড়দা, ওঠো না গো। আমাদের সবাইয়ের চান হয়ে গ্যাছে।’

বালিশ থেকে মাথা তুলতে পারছিলুমনি। সর্দির ওষুধে অসুখ ভাল করার থেকে শরীর কাহিল করে দেয় বেশি। কোনওমতে চোখটা খুলে দেখি, সবাই চানটান করে ফিটফাট। ঘড়িতে তখন আড়াইটে বাজে। মানে খিদেও জোর পেয়েছে। বার্ড ফ্লু হওয়া মুরগির মতো ঝিমুতে ঝিমুতে ডাইনিং হলে গেলুম। বেশ বড় হল। অনেকগুলো অতিথিকে একসঙ্গে আপ্যায়ন করা যাবে। টিভির ব্যবস্থাও আছে। কী একটা হিন্দি সিনেমা চলছিল। আমাদের সবারই দেখা। সিনেমায় মন না দিয়ে গল্পগুজব করছিলুম। আমি নই। আমার মাথাটা তখনও ওষুধের প্রভাবে বুকের কাছে ঝুঁকে আছে। সেই সময়েই কী খাব জানতে এলেন। ইন্দ্রর মতলব ছিল মাংস। ও ব্যাটা বড়ই মাংসাশী। কিন্তু কে যেন বলেছিল, ‘রাত জাগা হয়েছে। এখন মাছ খাই। রাতে মাংস খাব।’

ভাগ্যিস বলছিল! কাকতালীয়ভাবে সেটা দারুণ সিদ্ধান্ত ছিল। টেবিলে খাবার পরিবেশন করতেই আমার ঘুমটা একদম উবে গেল। ইয়াব্বড় আকারের মাছের টুকরো বাটিতে। সকলেরই। মাছের তেল বা ছাল যাই বলুন না কেন, শতরঞ্জির মতো মোটা। আর কী স্বাদ! আহা। অন্য রান্নাগুলোও ভাল। সরু চালের ভাত। তৎসহ আলু-করলা ভাজা, ডাল, বাঁধাকপির তরকারি। শেষ পাতে চাটনি-পাঁপড়। আমরা অবশ্য ভেবেছিলুম, নিশ্চিত মোটা চালের ভাত আর আলুপোস্ত পাচ্ছি। এর আগে ভালকিতে এসে সেসবই খেয়েছি। বাঁকুড়া ভ্রমণের সময়ে যেখানে যেখানে খেয়েছি সব জায়গায় মোটা চালের ভাত আর পোস্ত অনিবার্য ছিল। তবে সেই চালের ভাত সুমিষ্ট। যদিও হজম হতে একটু সময় লাগে।

খেয়ে উঠে পিঠটা আবার পাতার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওরা সকলে মিলে টেনে নিয়ে গেল গাছতলায়। আমাদের ঘরের কাছেই বাঁধানো পুকুরঘাটের মতো করে মুখোমুখি সিমেন্টের দু’টো বসার জায়গা। এখানে শুধু পুকুরের বদলে ভেড়ি। কাত হয়ে, চিৎ হয়ে, গা এলিয়ে আড্ডা শুরু হল। যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু সবুজ। কতরকম পাখি ডাকছে। মাঝে মাঝে হুশ করে একটা একটা গাড়ি যাচ্ছে। দূরে কোথায় দুর্গাপুজো হচ্ছে। জনপ্রিয় হিন্দিগানগুলো পরপর বাজছে সেখানে।

আমাদের আড্ডা মানে এর-ওর পিছনে লাগা। নয়তো কেউ কিছু বললে তার মন্তব্যকে সমূলে উৎপাটন করার জোর চেষ্টা। সেদিন যেমন চলছিল ভেড়ির পাড়ে মাছের জন্য ওত পেতে থাকা পাখিগুলোর পরিচয় নিয়ে তর্কাতর্কি। বকের মতো পাখিগুলো বিশাল। কিছু না বুঝেই আমি বললুম, সারস। ইন্দ্র বলল, শামুকখোল। সঙ্গে সঙ্গে বাবলা খিঁচিয়ে উঠল, ‘শামুখখোল চেনো? দক্ষিণবাড়ি, সন্তোষপুরে (আমাদের এলাকার কাছাকাছি জায়গা) যাবে। দেখে আসবে, শামুকখোল কাকে বলে।’ শুভ চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘ছবি তোল, ছবি তোল। ঝগড়া করতে হবে না।’ ক্যামেরা তো ঘরে। গেঁতো ইন্দ্র উঠবে না। শেষে সবাই মিলে ঠেলেঠুলে ওকে ক্যামেরা আনতে পাঠানো হল। আমাদের চিৎকারে ভড়কে গিয়ে মাথার উপরে আমগাছটা থেকে লেজ কাঁপিয়ে কিচকিচ করে ডেকেই চলেছে কাঠবেড়ালি। এত হট্টগোলের মধ্যে দীপু কিন্তু চুপ। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কী রে তুই কিছু বলছিস না?’ ওর সটান জবাব, ‘আমি বটানির ছাত্র। জুওলজির এলাকায় ঢুকবোই না। শেষে ‘চুপকে চুপকে’র অমিতাভের মতো গাঁদাফুল ফুল নয় কেস হোক আরকী!’ কী চালাক ছেলে রে!

মৎস্য দফতরের ভেড়ি।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরনোর জন্য তৈরি হলুম। কাছেই গড় নামে একটা জায়গা আছে। সেখান ঘুরেটুরে দীপুকে রাতের জঙ্গল দেখিয়ে এনে ঘরে ফিরব। পরের দিন সকালে আরেকটু জঙ্গল ঘুরে ফেরার ট্রেন। একদিনই তো ছুটি। অফিসে বলা আছে, একটু দেরি করে ঢুকব। তৈরি হচ্ছি, হঠাৎ টিভির খবরে চোখ পড়ল। সাঁতরাগাছি ব্রিজে অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হয়েছে। তখন তো জানতাম না এই দুর্ঘটনাই কতটা মর্মান্তিক হতে চলেছে।

সবাই সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়ালুম। বাস ধরতে। রাস্তায় মানে গেস্টহাউসের গেটের সামনেই। বাসস্টপ কাছেই। গেস্টহাউসের অন্য গেট দিয়ে বেরোলে একেবারে স্টপেজেই ওঠা যাবে। এখান থেকে তিন মিনিটের হাঁটা পথ। বাবলা বলল, আড়াই মিনিট। কিন্তু ওইটুকু হাঁটতেও নারাজ আমরা। হাত দেখাব, বাস থামবে। দুর্ভাগ্য, বাস থামল না। সভ্যভদ্র পোশাক, কেতা দেখিয়ে চোখে সানগ্লাস, গলায় ক্যামেরা, হাতে ক্যামেরার স্ট্যান্ড। বলিউড-হলিউডের সিনেমা দেখে শেখা বাঁ হাতের চারটি আঙুল মুড়ে বুড়ো আঙুলটা উঁচিয়ে বাম দিকে সঞ্চালন করে গাড়ি থামানোর কেতা এবং পাঁচ পাঁচজন যাত্রী— কোনও কিছুই বাসচালককে প্রভাবিত করতে পারল না। আমাদের বুরবক করে নাকের ডগা দিয়ে ভ্যাঁপো ভ্যাঁপো করতে করতে বাস হাঁকিয়ে চলে গেলেন।

অথচ আমাদের হাওড়ার বাস? কী ভাল! হাটে-মাঠে-ঘাটে যেখানে হাত দেখাবেন দাঁড়িয়ে যাবে। আর যেখানে দাঁড়াবে সেখানে কন্ডাক্টর চেঁচিয়েই যাবেন, ‘ডোমজুড়,শলপ, বাঁকড়া, শানপুর, হাওড়া হাওড়া হাওড়া…।’ লোকে বলে আমাদের ওখানে বাস চলে না। গড়ায়। চালু রসিকতা, রাস্তার পাশে বাড়ি এরকম কোনও যাত্রী জানলা দিয়ে যদি বলেন, ‘একটু দাঁড়াও গো, জামাটা গলিয়ে নিই’ তাহলেও বাস তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। এরকমও হয়, একটি পরিবার বাস ধরতে আসছে। কিন্তু বাস ছেড়ে দিয়েছে। তখন পরিবারের যুবাটি ছুটে এসে বাসে উঠে পড়ে। আর কন্ডাক্টরকে বলে, ‘একটু দাঁড়াও লোকজন আসছে।’ বাস দাঁড়িয়ে থাকে। ওই পরিবারটির বাকি সদস্য একটু তাড়াতাড়ি এসে বাসে ওঠেন। কিন্তু নব্যকিশোরী তখনও হেলতে দুলতে রাস্তায়। কারণ তিনি বাইরে বেরিয়েছেন বলে শ্যাম্পু করেছেন। পায়ে হিল। নতুন পোশাক। এই অবস্থায় ছোটা কি শোভা পায়! তাই তিনি ফ্যাশন প্যারেডের মতো করে ধীর পায়ে বাসের দিকে হেঁটে আসেন। জানলা দিয়ে অধীরভাবে তাকিয়ে থাকেন বাকি যাত্রীরা। তিনি বাসের পাদানিতে পা দিলেন। ওমনি বাসের যাত্রীদের তালিয়া তালিয়া। আসেল তালিয়া নয়, গালিয়া দেওয়ার ইচ্ছে থাকে যাত্রীদের। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেন না। দিনকাল ভাল নয়। তাই অনুচ্চ স্বরে গজগজ চলে।

কিন্তু এখন আমাদের কী হবে? আধঘণ্টা ছাড়া বাস এখানে। দু’টো ফসকেছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঘুরব কখন? এক সাইকেলওয়ালাকে থামিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করা হল। তাঁর কথা মতো থামানো হল একটা ভুটভুটি ভ্যান। সে ভ্যান গড় যাবে না। পরে আবার একটি ভুটভুটি এল। সেটাকে থামানো হল। এবং ভ্যানচালক গড়ে যেতে রাজি হলেন।

কী খারাপ রাস্তা! হাড় মাস এক করে ধকাং ধকাং করতে করতে চলল ভুটভুটি। কিছু দূর গিয়ে ডানদিকে গড়ের রাস্তা। অনেক বড় বড় বাড়ি পেরিয়ে অবশেষে গড়ে পৌঁছনো গেল। গড়ে একচালা একটা দুর্গামন্দির। আর সেই মন্দিরের চারপাশে টেরাকোটার কাজ করা আরও কয়েকটি মন্দির। ইতিহাস শোনালেন মন্দিরের চাতালে বসে থাকা মধুসূদন রায়। এই এলাকাটির নাম আসলে অমরাগড়। রানি অমরাবতীর নামে। এককালে রায় বংশ রাজত্ব করত এই এলাকায়। সেই বংশের রাজা মহেন্দ্র রায়ের রানি অমরাবতী। মধুসূদনবাবুর কথা শুনে বোঝা গেল, রায়েদের রাজধানী পানাগড়ের কাছে।

গড়ের দুর্গামন্দির।

গড় ঘুরে আবার ভালকির দিকে যাচ্ছি, পথে পড়ল এক অপূর্ব দৃশ্য। একটা খাল আর খালের পাশে ক্ষয়ে যাওয়া ভূপ্রকৃতি। মাধ্যমিকের ভূগোল পড়ার জ্ঞানে মনে হল, আবহবিকারের দারুণ নমুনা। সেই দৃশ্য ধরে রাখতে শুরু হল ফটোসেশন। তখন বিকেলের রোদ মরে এসেছে। তাড়াতাড়ি ছবি তুলতে হবে। কিন্তু ইন্দ্র কিছুতেই ক্যামেরা আর তাক করে না। ব্যাগ-পকেট হাতড়ে কী যেন খুঁজছিল। পরে একটা চিরুনি বার করে চুল আঁচড়াতে শুরু করেছিল। ওদিকে ভুটভুটি থেকে নেমেই দেখি, শুভ ল্যাংচাচ্ছে। কী হল রে? ওর উত্তর, ‘একটা পা ছোট হয়ে গ্যাছে।’ পা ছোট হয় কী করে! ঝিনঝিনে ধরেছে? শুভ বলল, ‘না, জুতোর সোল খুলে গ্যাছে।’

এরপরের কাহিনি শুধু জঙ্গল। দু’পাশে জঙ্গল। মাঝে পাকা রাস্তা। সন্ধ্যেবেলাতেই নিস্তব্দ চারিদিক। শুধু ভুটভুটির ইঞ্জিনের শব্দ। আর আমাদের পরস্পরকে কথার চিমটি কাটার আওয়াজ। ভুটভুটিচালক বলছিলেন, এই জঙ্গলে নেকড়ের মতো একটা জন্তু আছে। শীতকালে নাকি দু’কিলো সাইজের খরখোশ পাওয়া যায়। শিকার করে আদিবাসীরা সেসব বিক্রি করে। শুনেই উৎসাহিত ইন্দ্র আর বাবলা। ওরা ঠিক করল, শীতকালে তাহলে একবার আসতে হবে। অনেকক্ষণ বেরিয়েছি। এবার ফিরে বিশ্রাম নিতে হবে। কাল ভোরে উঠে ঘুরতে বেরোব। ঠিক সেই সময়েই আবার ফোন বাজল। ধরতে পারলাম না। তার পরেই ঢুকল এসএমএস। অফিসের বস। আগামিকালও আমার ছুটি। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠে বললুম, ‘গাড়ি ঘোরাও। গাড়ি ঘোরাও। আরও ঘুরব।’

সেই অদ্ভুত ভূমিরূপ।

ঘুরব মানে জঙ্গল এলাকার পুজো দেখব। এখানকার পুজো কেমন হয়। গানের আওয়াজ ধাওয়া করে এক মণ্ডপে যাওয়া হল। টিউবলাইট জ্বলছে বটে। কিন্তু আলো খুব কম। দু’চারটে বাচ্চা ঘুরছে।

এবার ফেরার পালা। কিছুটা আসার পরে সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাপ সাপ সাপ।’ ভ্যান থামল। সবাই লাফিয়ে সাপ দেখতে ছুটল। আমরা সকলেই গ্রামবাসী। কিন্তু দূরে কোথাও গেলে শহুরেদের মতো আচরণ করি। যেন সাপ আমরা কোনও দিন দেখিনি। আমাদের সঙ্গে ভ্যানচালকও সাপ দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখি, ভ্যান নেই। ভ্যানচালক আঁতকে উঠে চিৎকার করলেন, ‘এই রে ** ভ্যান কোথায় গেল!’ খুঁজে পেতে দেখা গেল, ভ্যান নিজেই কিছুদূর গিয়ে একটা ঝোপে আটকে গোঁ গোঁ করছে। ভাগ্যিস ঝোপ ছিল। না হলে ভ্যান সোজা খালে।

সন্ধ্যের খাবার জোগাড় করতে হবে। চপ মুড়ি পেঁয়াজ লঙ্কা। একটা আনাজপাতির দোকান। সবজি আছে। কিন্তু পেঁয়াজ-লঙ্কা নেই। এলাকায় দোকানপাট খুব কম। অনেকটা যাওয়ার পরে আবার আনাজপাতির দোকান। সেখানেও নেই। পরে একটা মুদিখানার দোকানে মিলল। শুভদের আবার তাস খেলার নেশা জেগেছিল। পেঁয়াজ কিনছি, শুভ ভ্যান থেকে চেঁচিয়ে দীপুকে বলল, ‘ওইটা আছে কী জিজ্ঞাসা কর।’ দোকানে বসে থাকা দু’জন তীব্র প্রতিবাদ বলতে শুরু করেছিল, ‘না, না, এখানে ওসব পাওয়া যায় না।’ ওইটা মানে দোকানদার বোতল ভেবেছেন। আবার কিছুটা গিয়ে চপ কেনা হল। ভ্যানচালকের জন্য আলাদা করে কিনে দেওয়া হল।…

গেস্টহাউসে রাতের মেনু রুটি-মাংস। আমাদের মাছ খাওয়ারই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইন্দ্রর প্রবল আপত্তি। মাছ দিয়ে কি রুটি খাওয়া যায়। খাওয়ার পরে ভেড়ির পাড়ে ঘুরতে গেলুম। একটু এগোয় আর শুনি, ‘ওই ওই…’। শুনেই দাঁড়িয়ে পড়লুম। আবার এগোতে যাব, আবার ওই। সেই সঙ্গে টর্চের তীব্র আলো ঘুরে গেল জলাশয়ের উপর দিয়ে। আমাদের যেতে বারণ করছে? ফিরেই আসছিলুম। তখনই এক সিকিওরিটি গার্ডকে দেখতে পেলুম। ভেড়ি পাহারা দিচ্ছেন। যাব না? উনি বললেন, যান। তবে আলো জ্বেলে যাবেন। ওদিকে গানম্যান আছে।’ গ্যানম্যান! শুনেই পিছিয়ে আসছিলুম। বাবলা বলল, ‘আরে চল চল।’ ও তো বলবেই। ব্যাটা হেবি বেঁটে। গ্যানম্যান গুলি চালালে সব ওর মাথার উপর দিয়ে যাবে। গুলি খাব আমরা। শুভ আর দীপু তো নড়তেই চাইছিল না। ওরাই দলে সব থেকে বেশি লম্বা কিনা!

গড় ছাড়িয়ে দেখতে পেয়েছিলাম এমন ভূমিরূপ।

তারপর দেখা হল গানম্যানের সঙ্গে। আরও কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গেও। জীবন, চাকরির কষ্ট, অর্থাভাব, চোর ধরা— কত গল্প।

ফিরে ভেড়ির পাশের বাঁধানো চাতালে এসে বসলুম। শরীর আর চলছে না। বাবলা আর দীপু তো চাতালে শুয়েই পড়ল। আমি টর্চ জ্বেলে ঘাটের কাছটা দেখছিলুম। আলোয় দেখতে পেলুম, একটা মাছ এসেছে। কী মাছ? বাবলাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘বাবলা একটা মাছ এসেছে রে!’

ঘুম জড়ানো গলায় বাবলা বলল, ‘আসতে দাও। কাল দেখা যাবে।’

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাউকে দেখতে পাইনি। আমার জুতো জোড়াটিকেও নয়। রাতে আরেক দফা ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলুম। ফলে সকালে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আর ওরা আমাকে ফেলেই ঘুরতে পালিয়েছে। কোনও একজন আমার জুতো জোড়াও গলিয়েছে। আবার কিটো স্টাইল জুতো। সহজে খোলা-পরা যায়। বাবুদের সবার পায়ে বুট। খালি পায়েই বেরিয়ে পড়েছিলুম সাতসকাল নয়, আট সকালে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারা গেল না। রাস্তায় ইটের টুকরো, খোয়া, নুড়ি ছড়ানো। নিয়মিত শহরে এসে বাবুয়ানি বেড়েছে ফলে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল।

ঘরে ফিরে এসে ইন্দ্রর বুট জোড়া গলিয়ে লগবগ করতে করতে হাঁটা শুরু করেছিলুম। ওর পা রাবণের সাইজের। জুতো পায়ে থাকতেই চায় না। কিন্তু বেশি দূর যাওয়া হল না। প্রকৃতি জোর ডাকাডাকি করছে। ফিরে আসতে বাধ্য হলুম। সব কাজ মিটিয়ে আবার যখন যাত্রা শুরু করলুম তখন দেখি ওরা ফিরে আসছে। কাছাকাছি আসতেই শুভ বলল, ‘মিস করে গেলে তো?’ কী মিস? ওদের মুখে শুনলুম, ভেড়িতে ভেড়িতে মাছেদের খাবার দেওয়া হচ্ছিল। প্রতিদিনই দেওয়া হয়। একটা ভেড়িতে শুধু পাঙস মাছ ছিল। মাছেদের খাবার নিয়ে হুড়োহুড়ি নাকি দেখার মতো দৃশ্য। আরেকটি দৃশ্যও দেখার মতো ছিল। বাবলার অবস্থা। ও দারুণ মৎস্যশিকারি। ছুটির দিনে পুকুরে পুকুরে ছিপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে একসঙ্গে এত মাছ দেখে ভেবলে গিয়েছিল। ভেড়ির পাড়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিল চুপটি করে।

খাবার দেওয়ায় ভেড়ির মাছেদের আনন্দ।

আজ ভালকি মাচানে অরণ্যসুন্দরীর পাশের জঙ্গলে অভিযান চলবে। ব্যাপারটা অনেকটা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাখ্যাত প্রাণ যেমন করে বিষণ্ণ হয়ে কাব্যি করে, করুণ নয়নে তাকায়, প্রেমাস্পদের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে আমাদের দশাও তেমনি। অরণ্যসুন্দরী ফিরিয়েছে? ঠিক আছে, আমরা যে কতটা ভালবাসি ওকে বুঝিয়েই ছাড়ব। ঢোকা হল জঙ্গলে। প্রচুর উইঢিবি। কত অচেনা গাছ। ও হ্যাঁ বলা হয়নি, কালকের ভ্যানচালকই আমাদের নিয়ে এসেছেন আজও। তিনি একটি ছোটখাট গাছ দেখিয়ে বললেন, ‘এই গাছটা সাংঘাতিক। এর রস গায়ে লাগলে প্রচুর চুলকোয়। চুলকোতে চুলকোতে মানুষ নাকি দ্বিগুণ ফুলে যায়।’ ভেলা ফলের না কীসের যেন গাছ বলেছিলেন। প্রচুর গাছ থেকে দীপুর খুব উৎসাহ। কিন্তু আমাদের বদমায়েশিতে ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেল। যা নতুন গাছ দেখি, ওকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এটা কী গাছ রে?’ দু’একটার নাম-গোত্র বলেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে খেই হারিয়ে ফেলল। যাই জিজ্ঞাসা করি বলে, ‘ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।’ ম্যাডাম মানে ওর ইউনিভার্সিটির ম্যাডাম। গেস্টহাউসে পাখি চেনার সময়ে ছোড়া বটানির ছাত্র বলে নিজেকে পাশ কাটিয়েছিল। এখন আর ওকে ছাড়া যায়! বদমায়েশির ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছিল বাবলা। চলতে চলতে একবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল বাবলা। তারপর ঘুরে নির্দেশ দেওয়ার সুরে দীপুকে বলল, ‘ফোনটা বার কর।’ দীপু বলল, ‘কেন?’ ও বলে, ‘ম্যাডামের কাছ থেকে জান, এটা কী গাছ।’ এরকম চলতেই থাকল।

জঙ্গলের যত গভীরে ঢুকছি ততই সঙ্গীসাথীরা যে যার জ্ঞানের ডালি উপুড় করে দিচ্ছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, সেসবই ডিসকভারি চ্যানেল লব্ধ জ্ঞান। এইরকম আদিম পরিবেশে মনটা বেশ খোলামেলা হয়ে যায়। কিন্তু আমার মন এতটাই খুলল যে সেটা একেবারে আদিম জীবনে পৌঁছল। সেই যখন মানুষ দল বেঁধে শিকারে বেরোত। আমারও জাগল শিকারের সাধ। ক্যামেরার স্ট্যান্ডটা তুলে টেলিস্কোপিক রাইফেলের মতো বাগিয়ে ধরলুম। সঙ্গীরা এত শয়তান যে সেই বাগিয়ে ধরা দেখে হুড়োহুড়ি করে এ ওর পিছনে লুকিয়ে পড়ল। যেন সত্যি সত্যিই আমি বন্দুক তাক করেছি! আমাদের ভ্যানচালক কাল থেকেই নেকড়ের মতো একটা জন্তুর কথা বলছিলেন। আজ সেটার নাম মনে পড়েছে। হুড়াল। ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ ক্ষেপে গেলে কেন? কাকে গুলি করবে?’ কাকে গুলি করব? কাকে গুলি করি! মনে মনে বাড়ি, পাড়াপ্রতিবেশী, অফিস, আমার সঙ্গী এই শয়তানগুলোর মুখ ভেবে নিলুম। তারপর বললুম, ‘থাক। নিজেকেও বেঁচেবর্তে থাকতে তো হবে। পরে ভেবে দেখব।’

সেই আশ্চর্য ভেলা ফল আর তার গাছ।

জঙ্গল থেকে বেরনোর অন্য রাস্তা ছিল। কিন্তু আমরা বেরোলুম অরণ্যসুন্দরীর পিছন দিয়ে। আমাদের থাকতে দেওয়া হয়নি। তা বলে কী রাস্তায় রাত কাটিয়েছি নাকি আমরা! তুমি ছাড়লেই কি আমি শেষ? অন্য কেউ ধরার নেই বুঝি? অরণ্যসুন্দরীতে ঢোকার আগে সিমেন্টের একটা ভালুক আছে। সেটা দেখলেই ইন্দ্র উৎসাহিত হয়ে পড়ে। ছুটে গিয়ে তার কোলে বসে পড়ে আমাদের বলে, ‘ছবি তোল ছবি তোল।’ আগের বারেও তাই করেছিল। শুভ বলে, ‘উৎসাহিত হবে না! সাজাত্যবোধ তো একেই বলে।’

ভালকির প্রতীক একটা মিনার। তিনমাথার একটা চুড়ো।তার পাদদেশে বিশাল একটা গর্ত। আগের বারে আমার মেজভাই ব্যাখ্যা দিয়েছিল, ‘এটাই ভালকি মাচান। রাজা-মহাকাজার এর ওপরে মাচান বেঁধে ভালুক শিকার করত। ওই গর্তের ওপরে টোপ দিত। ভালুক এলেই গর্তে পড়ে যেত।’ সহোদরের কল্পনাশক্তির তারিফ না করে পারা যায় না। কিন্তু ঘটনা হল, গর্তটা যে খুবই রোগাটে। অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিকের মতো চেহারার ভালুক হলে ঠিক আছে গর্তে পড়বে। কিন্তু ভালুকের আকার তো ইন্দ্রর সাইজের কমে হয় না। তাহলে পা দু’টো ঢুকে কোমরের কাছে আটকে যাবে না! লোকে অবশ্য বলে, এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা গোপন সুড়ঙ্গ ছিল। সেই সুড়ঙ্গটা নাকি পানাগড় পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এই গর্তটা তার মুখ। শত্রুর আক্রমণের সময়ে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে রাজারা পালাতেন। মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকা সুড়ঙ্গ কী করে গোপন হয়! রাজারা নিশ্চয় কাটেননি। তাঁরা কায়িক শ্রম করতে পারেন বলে মনেও হয় না। তাহলে কেটেছেন অনেক শ্রমিক। রাজাদের স্বভাব অনুযায়ী, সব শ্রমিকদের কি মেরে ফেলা হয়েছিল? তারপরে সুড়ঙ্গ কাটার অত মাটি কোথায় ফেলা হয়েছিল? সেসব কি লোকের চোখে পড়েনি।

জঙ্গলে পাঁচমুড়ো।

খিদে পেলে ইন্দ্রর মেজাজ বিগড়ে যায়। আর শুভ ভুরুগুলো কুঁচকে ফেলে। দু’টো লক্ষণ দেখে মাচান ঘোরা বন্ধ করলুম। তাছাড়া রোদটাও বেশ চড়া উঠেছে। ঠিক হল, আউশগ্রাম যাওয়া হবে ভুটভুটিতেই। আর কাছাকাছি একটা দোকানে কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে। গাড়ি, ইয়ে মানে ভুটভুটিভ্যান, ঘুরল আউশগ্রামের পথে। অরণ্যসুন্দরীর আগে ডানহাতি একটা রাস্তা চলে গিয়েছে। ওই রাস্তা ধরলেন চালক। কিছুটা যাওয়ার পরেই একটা মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল। ভ্যান থামল। শুভ আর বাবলা ভ্যান থেকে লাফিয়ে নেমেই বলতে শুরু করল, ‘আরে দাদার দোকান! আর কোনও চিন্তা নেই।’ দাদার দোকান! এখানে ওদের দাদা এল কোথা থেকে? দু’জনে দোকানের নামের দিকে ইশারা করল। দোকানের নাম, ‘মদনদার মিষ্টির দোকান’। আমি টিপ্পনি কাটলুম, ‘দাদার কি মিষ্টির দোকান থাকা উচিত? আবগারি বিভাগ কাঁদবে না?’ দাদার দোকানেই জলযোগ হল। শিঙাড়া, মিষ্টি। আমরা খেলাম রসগোল্লা। ইন্দ্র নিল পান্তুয়া। সব কিছু নিয়েই ওর আলাদা চিন্তাভাবনা থাকে। তবে সেই চিন্তার দায় আমাদেরই মেটাতে হয়। এখানেও হল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, পান্তুয়াগুলো ভাল নয়। কেমন যেন থ্যাসথ্যাসে। রসগোল্লার জেল্লাই আলাদা। ওকে রসগোল্লা খেতে বারবার বলা হয়েছিল। কিন্তু বাবুর জেদ বেশি।

তবে পান্তুয়া খাওয়ার পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছিল ও। দেখি খাওয়া শেষ করে আবার প্লেট বাড়াচ্ছে। ‘কী রে আরও নিবি?’ জিজ্ঞাসার উত্তরে ও বলল, ‘না, রসগোল্লা খাব।’ শুনেই বাকিরা রে রে করে উঠল, তাহলে আমরাও আরও রসগোল্লা নেব। ও কেন শুধু আমাদের কাঁচিকলে ফেলবে? আমরাও ওকে ফেলব।’ কাঁচিকল শব্দটা আমাদের বাঁকুড়া সফরের সময়ে কৃষ্ণ আবিষ্কার করেছিল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। আমাদের ঘোরাঘুরির হিসেবনিকেশ। যা খরচ হয় সেটা শেষে হিসেব করে সমান ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়। এখানে সকলের জন্য রসগোল্লা বরাদ্দ। কিন্তু ইন্দ্র খেল পান্তুয়া। তাতে কোনও সমস্যা নেই। রসগোল্লার বদলে পান্তুয়া। একযাত্রায় পৃথক কিন্তু সমান ফল। ইন্দ্র দু’টোই খাওয়ায় বিপত্তি। হিসেব মতো, ওর রসগোল্লার দাম তো আমাদের মেটাতে হচ্ছে। আমরা ছাড়ব কেন? সকলে আবার রসগোল্লা খেয়ে সমানভাবে কাঁচি চালিয়ে নিলুম। ইন্দ্রর মুখটা হয়েছিল দেখার মতো।

আউশগ্রাম যাওয়ার পথে কী দেখলুম? একবাক্যে বললে, প্রকৃতি প্রকৃতি আর প্রকৃতি। কোথায় রাস্তার দু’পাশে আদিগন্ত চাষের জমি, কোথাও পোলট্রির পরিত্যক্ত এবং সতেজ ফার্ম। কোথাও দু’পাশের বাঁশবন ঝুঁকে পড়ে রাস্তাটাকে সজীব গুহার মতো করে তুলেছে। নিজেরা আলোচনা করছিলুম, এখানেই যদি থেকে যাওয়া যেত! বাবলা খালি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পুকুর আছে তো?’ মানে, ও কাজকর্ম সেরে ছিপ হাতে করে পুকুর পাড়ে বসবে। কিন্তু আমার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছিল। রাজধানীর পাশের জেলার বাসিন্দা আমরা। পণ্য নির্ভর জীবন। দু’দিন ভাল লাগবে। তিনদিনের দিন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র চরিত্রগুলোর মতো সকালে চায়ের সঙ্গে ডিম না হলে কষ্ট হবে। এখানে দোকানপাট কোথায়? বাজার কতদূরে। সকালে উঠে অতদূরে বাজার যেতে হবে! ভাবলেই তো ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।

আমাদের বাংলা।

আউশগ্রামে ঢোকার আগে সুন্দর একটা জায়গা পড়ল। একটা প্রান্তর। সেখানে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে অনেক গাছ। তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। এত ভাল লাগল। আউশগ্রামের জঙ্গলে আমরা ঢুকিনি। পাকা রাস্তা ধরে ভুটভুটি ছুটেছে। আর আমরা জঙ্গলের শোভা দেখেছি। শেষে ক্লান্ত হয়ে গেলুম। চড়া রোদ, একনাগাড়ে ভুটভুটির ভ্যাটভ্যাট শব্দ আর ঝাঁকুনি থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলুম আমরা। এক জায়গায় থামা হল। সেটা অবশ্য ইউক্যালিপ্টাসের তৈরি করা জঙ্গল। কিছুক্ষণ ধরে চলল প্রবল ফটোসেশন।

ফেরার সময়ে দারুণ একটা দৃশ্য দেখেছিলুম। বটগাছের একটা বিশাল ডাল। তাতে কোনও পাতা দেখিনি। ডালে এক মা তাঁর শিশুটিকে বসিয়ে দোল খাওয়াচ্ছেন। আরেকটি বছর পাঁচেকের মেয়েও ওই ডালে বসে আছে। মায়ের দুলুনিতে সে-ও উঠছে নামছে। মন ভরে গেল। মনে মনে বলে উঠলুম, এদের জীবন থেকে প্রকৃতি কেড়ে নিও না। লেখাপড়ার সুযোগ দাও, জীবনজীবিকার ব্যবস্থা কর। কিন্তু উন্নয়নের নামে পণ্যনির্ভর জীবনের শরিক করো না। কাদের উদ্দেশে বলেছিলুম কথাগুলো? ঈশ্বর, প্রকৃতি, ক্ষমতাবান? কে জানে!

আমাদের মধ্যে সিরিয়াসনেস নেই। সেটা ভাল করেই জানি। ওইরকম একটা দৃশ্য দেখার কিছুক্ষণ পরেই আমরা খিল্লি গিয়ারে চলে গিয়েছিলুম। গিয়ার টপে উঠেছিল গেস্টহাউসের গেটে নামার সময়ে। ভুটভুটি থেকে নামতেই শুভ বাঁ হাতের মুঠো খুলে দেখাল। দেখি, হাতে একটা স্ক্রু। কোথায় পেলি? ও ইন্দ্রর ক্যামেরার স্ট্যান্ডটার দিকে আঙুল দেখাল। চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘সর্বনাশ! ওই ইন্দ্র দ্যাখ, তোর স্ট্যান্ডের কী হাল?’ ইন্দ্র দেখল। তবে রাগল না। হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করে খুললি রে?’ কী করে খুলল সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। শুভর বাঁ হাতটা সবসময় চলে। আড্ডা দিতে দিতেও দেখেছি, ও মোবাইল ধরে, স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই টিকটাক টুপটাপ করে টাইপ করে চলেছে। এসএমএসের উত্তর দিচ্ছে। এত এসএমএস কাকে করে? দীপু বলে, আত্মীয়স্বজনদের। ভুটভুটিতে বসে এসএমএস করেনি বটে। কিন্তু স্ট্যান্ডের স্ক্রুয়ে পাক দিয়ে বাঁ হাত সচল রেখেছিল। স্ট্যান্ডটি গোটা সফরে আর খাড়া হতে পারেনি।

গেস্টহাউসে ফিরে দ্রুত চানটান করে ডাইনিং হলে। এবার আলুপোস্ত পড়ল পাতে। আর সেই বোম্বাই আমের মতো মাছ। এবং ইন্দ্রর হামলে পড়া স্বভাব। ও প্রথমেই জাঁদরেলের মধ্যে আরও জাঁদরেল সাইজের মাছ রাখা প্লেটটি নিজের দিকে টেনে নিল। এবং প্রতিবারের মতোই ভুল করল। বাবলা ঘোষণা করল, ও মাছ খাবে না। মাছ ধরতে ভালবাসে ও। কিন্তু খেতে নয়। ওর মাছটা আমরা ভাগ করে নিলুম। কিন্তু ইন্দ্রকে বাদ দিয়ে। শাস্তি…। খাওয়াদাওয়ার পরে বিল মেটাতে অফিস ঘরে। একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলুম, মাছের প্লেটের দাম এখানে মাংসের থেকে অনেকটাই বেশি। কুড়ি টাকার তফাৎ। তা হোক। খেয়ে যে সুখ পেয়েছি। অফিসের ভদ্রলোকের সঙ্গে নানা গল্প হচ্ছিল। উনি বললেন, ‘আপনারা কি মানকুর কলেজে কোনও কাজে এসেছেন?’ আমরা জানালুম, কাজ থেকে পালিয়ে শুধু ঘুরতে এসেছি। উনি বললেন, ‘কে যেন বলছিল, কী মাপজোকের কাজে এসেছেন।’ বুঝলুম, ইন্দ্রর ক্যামেরার স্ট্যান্ড থেকে এই ভ্রান্তি। কার্যসিদ্ধিতে কেন ভেক ধরতে হয়, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলুম। তবে যে স্ট্যান্ড আমাদের এমন সম্মানজনক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে সে যে এখন নিজেই দাঁড়াতে পারছে না সেই সত্য ফাঁস করিনি ওখানে।

আউশগ্রামে রাস্তার পাশে এক দঙ্গল ইউক্যালিপটাস।

ফেরার সময়ে আর ভুল করিনি। একদম বাসস্ট্যান্ডে গিয়েই দাঁড়িয়েছিলুম। কিন্তু বাস আসতে ভীষণ দেরি করেছিল। পুজোর মরসুম। দু’একটা বাস হয়তো রাস্তায় বেরোয়নি। গুসকরা স্টেশনে এসে আমি আর থাকতে পারছিলুমনি। প্রকৃতি প্রবলভাবে ডাকছে। প্ল্যাটফর্মে একটা সুলভ ছিল। ঢোকার আগে থমকে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রকে বললুম, ‘সবাইকে ডেকে নে।’ ও অবাক। আমি বললুম, ‘প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার খরচটা তো কাঁচিকলে পড়বে। মানে আমার প্রাকৃতিক কাজের দাম তোদের মেটাতে হবে। তার থেকে তোরাও সবাই মিলে…।’ শেষ করার আগেই চেঁচিয়ে উঠেছিল ইন্দ্র, ইয়ার্কি মেরো না। ট্রেন এসে যাবে।’

ট্রেনের বাঁশি সুলভে বসেই পেয়েছিলুম। মাতারা প্যাসেঞ্জার আসছে। সুলভের লোকটি বললেন, ‘এই ট্রেনে যাবেন না। পরেরটায় যান। এটা খুব লেট করে। পরেরটাই আগে বর্ধমান পৌঁছবে।’ বর্ধমানে সীতাভোগ, মিহিদানা কিনতে নামব। ভদ্রলোকের পরামর্শ মতো পরের ট্রেনেই বর্ধমান নেমেছিলুম। পুরসভার মোড়ের গণেশ সুইটস থেকে প্রচুর সীতাভোগ, মিহিদানা কিনে আবার স্টেশনে ঢুকতে দেখি একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল। প্ল্যাটফর্ম ছাড়াতে একজনকে ট্রেনের নাম জিজ্ঞাসা করলুম। সহযাত্রী বললেন, ‘মাতারা প্যাসেঞ্জার।’

তার মানে সেই লেট লতিফ ট্রেনটা। যেটাকে গুসকরায় পাত্তা দিইনি! প্রবাদে যাই থাকুক না কেন, আমি বঙ্গে গেলেই কি ভাগ্য সঙ্গে যায়!

আউশগ্রামের পথে।

সমাপ্ত

One thought on “ভালকির জঙ্গলে পাঁচমুড়ো

  1. লেখায় যে মাজারের ছবিটি দেওয়া আছে সেটি সৈয়দ মাহমুদ বাহমনি পিরের মাজার। আমরা গিয়েছিলাম ২০১৫ সালের পুজোর সময়। ছবিও তুলেছিলাম সুয়াতা গ্রামের মাজারের। তখন জানা ছিল না পির সম্পর্কে। ২০২০ সালে মেহবুব কাদের চৌধুরী আনন্দবাজারে একটি ভ্রমণ কাহিনি লেখেন। তাতে জানা যায়, এই পির সাহেবে ভালকির রাজাদের পুজোয় নরবলি প্রথা বন্ধ করেন। তাঁর সম্মানে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে মেলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *