ভিনদেশি ভ্রমণ

মাতাল জ্যাক থেকে হিলারিকে বাঁধল হ্যালুইন

প্রসেনজিৎ সিংহ

বেশ কিছু দিন আগে থেকেই দেখছিলাম বিভিন্ন মলে বড় বড় কমলারঙের কুমড়ো বিক্রি হচ্ছে। আমার প্রতিবেশী এলিক উফম্যানকে সেদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘ও তো হ্যালুইনের জন্য। ওই দিয়েই তো তৈরি হবে ‘জ্যাক-ও –ল্যানটার্ন’। তখন আর বুঝতে অসুবিধা হল না ব্যাপারটা কী। হ্যালুইন নাকি এই ল্যানটার্ন ছাড়া ভাবা যায় না। এলির মুখেই শুনলাম, এ নিয়ে মজার গল্পও আছে।

আয়ারল্যান্ডে এক মাতাল চাষি ছিল। নাম জ্যাক। একদিন রাতে প্রচুর মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে সে পড়ল ‘শয়তানে’র পাল্লায়। শয়তান বলল, ‘চল তো বাপু হেল-এ।’ জ্যাক জাতে মাতাল। তালে ঠিক। বলল, ‘ঠিক ঠিক। যাব তো বটেই। তবে, তার আগে দুপাত্তর চড়িয়ে না নিলে….। তুমি বাপু আর না কোরো না। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।’ অগত্যা একটা পাবে গিয়ে গলা অবধি চড়িয়ে জ্যাক বলল, ‘আমার কাছে বাপু কিছুই নেই। তুমি দাম মেটাও।’ শুনে শয়তান রেগে আগুন। জ্যাক বলল, ‘আহা রাগছ কেন? তুমি রুপোর কয়েন হয়ে যাও।’ সেই মতো রুপোর কয়েন হতেই জ্যাক তাকে পকেটে বন্দি করল। পকেটে ছিল ক্রশ। কাজেই বেরনোর পথ বন্ধ। নাস্তানাবুদ শয়তানকে এবার জ্যাকের সঙ্গে শর্ত করতে হল। শর্ত, ১০ বছরের জন্য জ্যাককে মুক্তি দিতে হবে। তাই হল।

হ্যালুইনের কুমড়ো হাতে।

দশ বছর পরে শয়তান আবার ধরল জ্যাককে। এবার জ্যাক বলে, ‘আমি ভাল হয়ে গিয়েছি। তুমি বরং আমার শেষ ইচ্ছানুসারে আমাকে একটা আপেল পেড়ে দাও। আমি ওটা খেয়ে শান্তিতে মরে যাই।’ যেই আপেল পাড়তে শয়তান গাছে উঠল, অমনি গাছের কাণ্ডে জ্যাক একটা ক্রশ গেঁথে দিল। ব্যাস। শয়তান আর নামতে পারে না। এবারেও শর্ত। মোক্ষম। ‘হেল’-এ নেওয়া যাবে না তাকে। সেই শর্তে রাজি হয়ে শেষে শয়তান মুক্তি পেল জ্যাকের কাছ থেকে।

লেকিন পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।

এর কিছু দিন পরে জ্যাক সত্যি সত্যিই মারা গেল। সোজা হাজির হল হেভেনে। সেখানে দ্বাররক্ষী তাকে আটকাল। এখানে তো তোমার মতো মাতাল ধড়িবাজ আর অলস লোকের জায়গা হবে না। অগত্যা হেল-এ গেল জ্যাক। কিন্তু সেই পুরনো শর্ত। অতএব সেখানেও জায়গা মিলল না। হেল অ্যান্ড হেভেনের ফারাকটুকুর মধ্যে রইল জ্যাক। তার চলার ফেরার জন্য বিছিয়ে দেওয়া হল কয়লার আগুন। সেই থেকেই তাকে কমলা আগুনের মধ্য দেখা যায়। সেই থেকেই জ্যাক-ও–ল্যানটার্নের উৎপত্তি। তবে এ নেহাতই লোককথা। কান পাতলে এমন অনেক গল্পই হয়তো শোনা যাবে। তবে এই লণ্ঠন ছাড়া হ্যালুইন উদযাপনের কথা ভাবা যায় না।

ইতিহাস বলে হ্যালুইন আসলে কেলটিক (আইরিশ উচ্চারণে সেলটিক) উৎসব। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, কর্নওয়াল, ওয়েলস, ব্রিটানি এবং আইল অফ ম্যান— ব্রিটিশ আইলসের এই ছ’টি জাতিকে বলে কেলটিকনেশন। এদের নানারকমের আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। সেরকমই একটা উৎসবের নাম samhain (প্রাচীন আইরিশ শব্দ। উচ্চারণ সা-উইন। যার অর্থ, গ্রীষ্মশেষ)। কেলটিকরা মনে করত, ৩১ অক্টোবর আর পয়লা নভেম্বরের মধ্যে যে রাত, সেটা আসলে আলো আর অন্ধকারের মধ্যবর্তী সীমানা। এই গোলমেলে সন্ধিক্ষণেই তেনারা ঢুকে পড়েন। সেই অশরীরীদের তাড়াতেই কেলটিকরা ভূত-প্রেত সেজে তাদের ভয় দেখানোর উৎসবে মেতে উঠত।

হ্যালু-সাজধারীর সঙ্গে পুত্র।

এই সময়েই মানে, পয়লা নভেম্বর আবার খ্রিস্টানরা ‘অল সেইন্টস ডে’ পালন করে। ওই উৎসবের নাম ‘অল হ্যালোস’। মনে করা হয়, ওই ‘অল হ্যালোস’ এবং ‘সা-উইন’ মিলেমিশেই তৈরি হয়েছে হ্যালুইন।

শুধু তাই নয়, কেলটিকদের নতুন বছরও শুরু হতো নভেম্বরের গোড়া থেকে। সেইসময় ফসলও উঠতো। তাই কেউ কেউ মনে করেন, এটা হার্ভেস্ট ফেস্টিভ্যাল (অমন গোদা গোদা কুমড়ো দেখে আমিও আন্দাজ করেছিলুম)।

তা এ হেন উৎসব আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকায় ঢুকতেই তা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এখন গোটা পৃথিবীতেই হ্যালুইন নিয়ে এই যে বিস্তর মাতামাতি তা মূলত আমেরিকায় জনপ্রিয় হওয়ার পরেই। তা অত বড় সাগর আটলান্টিকের এপারে কে তাকে নিয়ে এল? হনুমান? এমন কোনও কথা তো রামায়ণে ছিল না। হনুমান ওই ইন্ডিয়া-শ্রীলঙ্কা টু অ্যান্ড ফ্রো করেছে কয়েকবার, এটুকুই জানি! তাহলে?

হ্যালুইনকে আটলান্টিক পার করেছিল দুর্ভিক্ষ। ১৮৪৫-’৪৯ সালে আয়্যারল্যন্ডে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যার নাম ‘আইরিশ পট্যাটো ফেমিন’ বা ‘গ্রেট ফেমিন’। এতে প্রচুর মানুষ যেমন মারা গিয়েছিলেন, তেমনই অনেকে দেশ ছাড়া হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় থেকে দু’দশকে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আমেরিকায় আসেন। এদের হাত ধরেই হ্যালুইন আসে আমেরিকায়। আমেরিকার পূর্ব উপকূলেই বিভিন্ন জায়গায় প্রথমদিকে হ্যালুইন জনপ্রিয় হয়।

পূর্ব উপকূলেরই একটি প্রদেশ পেনসিলভ্যানিয়ার ফিলাডেলফিয়া আমি থাকি। বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাল্টিমোর অ্যভিনিউ। সেখানেই উদ্‌যাপন। শহরের অনেক বাড়িতেই বারান্দায় রাখা হয়েছে, জ্যাক-ও –ল্যানটার্ন। সংলগ্ন এক চিলতে বাগানে এখন ভূতেদের দাপাদাপি। সাদা কালো কাপড় দিয়ে বানানো ভূত, কঙ্কালেরা সব বারান্দার রেলিংয়ে বসে রয়েছে। কৃত্রিম মাকড়সার জাল তৈরি করে গাছপালায় ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। একটা বাড়ির বাগানে দেখলাম, কবরস্থানের মতো ছোট ছোট ফলক। এপিটাফ। কালো হাঁড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মানে, ধরে নিতে হতে ওই হাঁড়িতে ফেলে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে পাপীদের। এই আর কী!

ছোট বড় সকলেই বিচিত্র পোশাকে খুশিয়াল। ভূতেরা ব্যান্ড বাজিয়ে চলল বাল্টিমোর অ্যাভিনিউ থেকে ওসেজ স্ট্রিটের দিকে। বেশ বড়সড় শোভাযাত্রা। এতরকমের ভূতের সমাগম যে দেখলেই মজা লাগবে। তবে এটা এখন আর শুধু ভূতের সমাগম বলা যাবে না। কারণ এই মিছিলে দেখলাম রয়েছে হ্যারি পটারও। রয়েছে সিন্ড্রেলা, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, রয়েছে টিরানোসরাস রেক্সও। ও বাবা একজনের হাতে আবার প্লাস্টিকের ত্রিশূল। বেশিরভাগই কচিকাঁচা। বুড়োখোকারাও রয়েছেন। তাঁরা মনের বয়স বাড়তে দেননি। এক চশমাপরা জেঠু তো গোলাপি স্বল্পবসনা সুন্দরী সেজেছেন। এইসব সাজপোশাক হ্যালুইনের আগে থেকেই দোকানে দোকানে বিক্রি হয়। খোঁজ করে জানা গেল আমেরিকায় হ্যালুইন-ব্যবসা কয়েক বিলিয়ানের।

ছোটছোট ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়ির দরজায় দরজায় বসে রয়েছেন বড়রা। হাতে ক্যান্ডির পাত্র। ছোট ছোট ভূতের ছানারা এসে ক্যান্ডি নিয়ে যাচ্ছে। ও-এ এক খেলা। এই খেলার নাম ‘ট্রিক অর ট্রিট’। একবার তো দেখলাম, একটি বাড়ির দরজায় হিলারি ক্লিন্টনকে। মুখোশ পরে বসে আছেন গৃহকর্ত্রী। দেদার বিলোচ্ছেন ক্যান্ডি।

আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের ভিড়। সেই মানবসাগরের তীরে হ্যালুইনকে কেন্দ্র করে এ যেন ছোট্ট পৃথিবী।

 

সমাপ্ত

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *