খাদ্য সফর

মুখরোচক পর্ব

সৌগত পাল

 

পায়ের তলার সরষেগুলো সরে গিয়েছিল। এর কাজ ওর অসুবিধে। ফলে বেরনোই হয়নি বেশ কয়েকটা মঙ্গলবার। সরষেগুলো আবার পায়ের নীচে জড়ো করে দিল দীপকদা। গত মঙ্গলবার।

গরমকালটা এখন ইলাস্টিকের মতো হয়ে গিয়েছে। নিজেকে টানতে টানতে বাড়িয়ে নিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত পৌঁছেছে। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। দীপকদা প্রস্তাব দিল, ‘চল, তাহলে বেরনো যাক আজ।’ যাবে তো! কিন্তু কোথায়? দীপকদাই বলল, ‘মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে ঘুরে তো জিভ হেজে গিয়েছে। একটু নোনতা হোক এবার!’

বোঝা গেল ব্যাপারটা। দীপকদা কাছাকাছি এলাকার ভাজাভুজি-ম্যাপ তৈরি করতে চাইছে। শীতের আমেজে নানা তেলেভাজা জমবে ভাল।

দীপুর কাজ ছিল। ও যাবে না বলল। দুপুরবেলা দুটো বাইকে রওনা দিলাম ইন্দ্রদা, দীপকদা, বাবলা আর আমি। হাওড়া-আমতা রোড। মুন্সিরহাট থেকে রাস্তা ভাগ হয়ে পেঁড়ো গেছে। আমরা সেই রাস্তা ধরেই চলতে লাগলাম। লক্ষ্য, টুটুলের পকোড়া। এই এলাকাটা এখনও নষ্ট হয়নি। মানে উন্নয়নের নামে প্রকৃতির উপরে যথেচ্ছাচার করা হয়নি। রাস্তার দু’ধারে প্রচুর গাছপালা। বেশ বুলেভার্ডের মতো লাগে এখানে এলে। যেদিকেই তাকাও আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত। মাঝে মাঝে গাছে ঘেরা দু’একটা পাড়া। রাস্তার পাশেও গ্রাম গড়ে উঠেছে। পোষ্য গরু-ছাগল রাস্তায় হেলতে দুলতে চলেছে। মুশকিল হচ্ছিল মুরগিগুলোকে নিয়ে। তারা যে মুরগি তার প্রমাণ দিতে ব্যস্ত। খালি বাবলার বাইকের সামনে এসে পড়ে। বাবলা বলছিল, মুরগিগুলো প্রাণ দিয়ে মালিকের উপকার করার চেষ্টা করছে। আমি ওর বাইকেই ছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী বলছিস?’ বাবলার ব্যাখ্যা, ‘এই মুরগিগুলো মাংস হিসাবে বিক্রি হলে মালিক কত টাকা পাবে? বড় জোর ২৫০ টাকা। কিন্তু আমার গাড়ির নীচে যদি চাপা পড়ে তাহলে এই মুরগির দামই ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু মাংস নয়, মুরগিটা কতগুলো ডিম পাড়ত, তার দাম কত হতো, সেই ডিম থেকে বাচ্চা হলে তারা যে ডিম পাড়ত তার দাম সমেত হিসাব করা হতো। আর মুরগি মালিক দলবল জুটিয়ে ঠেঙিয়ে যদি কেড়েকুড়ে নেয় তাহলে দাম হাজার ছাড়িয়ে যাবে।’

ভাল খবর হল, বাবলার দক্ষতায় কোনও মুরগি আত্মহত্যা করতে পারেনি। একটা উড়ে এসে চাকার সামনে পড়ে কোঁক করে আওয়াজও করে উঠেছিল। সর্বনাশ হল নাকি! না তা হয়নি। বাবলা ঠিক সময়ে ব্রেক কষেছে। মুরগিটা বোধহয় রসিকতার সেই লোকটা। যে গলায় দড়ি দিতে যাওয়ার সময়ে হ্যারিকেন নিয়ে যাচ্ছিল, রাস্তায় যদি সাপে কামড়ায়! মুরগিটাও সমাগত মৃত্যুভয়ে কোঁক করে উঠেছিল।

খিলা মোড়ে পৌঁছতে দেখি, তখনও পকোড়া ভাজা শুরু হয়নি। তাই একটু দামোদরের চরে ঘুরে নিলাম। নদীচরে গিয়ে অবাক। আরে! এতো সেই রাধানগর এর মতো! মানে সেই বাঁশের সাঁকো। সেই সাঁকো পার হতে আবার বাবলার চোখ বড়ো বড়ো। তাই ওকে আর আতঙ্কে না রেখে আমরা পকোড়ার দোকানে যাওয়াই স্থির করলাম। হাজির হলাম পকোড়ার দোকানে, মানে ‘টুটুলের চপ’। দোকানে অবশ্য পকোড়া বানান লেখা ‘পোকোড়া’। লোকে বলে, চেহারা দেখলেই রসিক আর খেঁকুড়ে চেনা যায়। ইন্দ্রদার ক্ষেত্রে কথাটা বেশ খাটে। আমরা পরিমাণ জানানোর আগেই দোকানদার হাতে ধরিয়ে দিলেন গরম গরম চিকেন পকোড়ার ঠোঙা। দেরি করার চেষ্টা করল না কেউ। প্রায় হাফ কেজি পকোড়া সাঁটিয়ে দোকান ছাড়লাম।

আমরা বহু জায়গায় পকোড়া খেয়েছি। কিন্তু টুটুলের পকোড়া অন্যরকম। সাইজে বড় হয় না। মশলাও খুব বেশি থাকে না। ফলে বড় পকোড়াগুলোর মতো চিকেন খাচ্ছি না মশলা ভাজা খাচ্ছি বলে মনে হয় না। চিকেন আর মশলা দু’টোর স্বাদই মেলে। মশলার থেকে চিকেনের পরিমাণ বেশি। সে জন্যই বেশি স্বাদু।

পকোড়ার ঠোঙা শেষ হতেই ইন্দ্রদার প্রস্তাব, অ্যালোপ্যাথি তো হল এবার একটু কবিরাজি চিকিৎসা হয়ে যাক। মানে? ইন্দ্রদা বলল, ‘খাঁদারঘাটের ফিস কবিরাজি।’ দীপকদা বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘একদিনে দু’রকম চিকিৎসা করলে শরীর নেবে না।’ কিন্ত ও যাবেই। উল্টে হুমকি দিল, ‘আমি একাই চলে যাব। লাস্ট বাস চলে গেছে।’ ভয়ে ভয়েই সকলে রাজি হলাম।

খাঁদারঘাটের মোড়ের কবিরাজির দোকানটা সাধারণ তেলেভাজার দোকানের মতোই। ময়লা কাচের শোকেস। শোকেসে তেলকালির ঝুল। নোংরা মেঝে। কিন্তু এই দোকানটা আবার একটু আলাদাও। ভিতর দিকে বেশ খানিকটা জায়গা আছে। বসে খাওয়ার জন্য টেবিল-চেয়ার আছে। দোকানের নাম নেই। মালিক গৌরাঙ্গবাবু জানালেন, কবিরাজির দোকান বলেই লোক চেনে। বসে অর্ডার দিতেই কাগজের প্লেটে চলে এল ফিস কবিরাজি। সঙ্গে কাসুন্দি আর শসা কুঁচনো। গ্রামাঞ্চলে চপের দোকানে ফিস কবিরাজি তৈরি করে গৌরাঙ্গবাবু অসাধ্য সাধন করেছেন বলে মনে হয়। হাতেনাতে তার প্রমাণ পেলাম। আমরা খাচ্ছি। সেই সময়েই একজন কবিরাজি কিনতে এসেছিলেন। জিনিস হাতে পেয়েই তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘চপের ছাল ওঠা কেন গো?’ গৌরাঙ্গবাবু বোঝানোর চেষ্টা করেন, এগুলো এরকমই হয়। খদ্দের কী বুঝলেন কে জানে? কিন্তু গৌরাঙ্গবাবুর সহকারী ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে বসলেন, ‘গেঁড়ি-গুগলি খাওয়া জিবে এর স্বাদ কী বুঝবে?’

‘যথা ইচ্ছা’র লেখার জন্য নোনতা খুঁজতে বেরিয়েছি। পাতিহালের মোচার চপ বাদ যায় কী করে! দোকানের পোশাকি নাম ‘সুরুচি চপ সেন্টার’। কিন্তু লোকের মুখে মুখে ‘উড়ের চপ’ হিসাবেই বেশি পরিচিত। উৎকলবাসী এক ভদ্রলোক মোচার চপ খাইয়ে বহু লোককে মোহিত করে দিয়েছেন। ভদ্রলোক প্রকৃতপক্ষে একজন লড়াকু মানুষ। আগে বড়গাছিয়ায় এক ছোট কাচের শোকেস নিয়ে ফুটপাথে চপ ভাজতেন। সেখান থেকে তাঁর এই উত্থান। কেমন বিক্রিবাটা দোকানের? ‘সুরুচি চপ সেন্টারে’ সিসিটিভি লাগানো। লম্বা টেবিল পাতা। আড্ডা দিতে দিতে চপ-মুড়ি খাওয়া যায়। মোচা ছাড়াও ডালবড়া, টম্যাটো চপ, ডিমের চপ করে। সব আইটেমেরই দারুণ বিক্রি।

লেখার জন্য একটা ছবি দরকার। কিন্তু ইন্দ্রদা ক্যামেরা বের করতে ইতস্তত করছিল। টুটুলের দোকানের সামনে কিছুক্ষণ আগেই কটাক্ষ শুনে এসেছে ও। ক্যামেরা বাগিয়ে ছবি তুলছে…বাইকের পিছনে বসা এক ভদ্রমহিলা ‘চপের দোকানেরও কেউ ছবি তোলে!’ বলে চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়া ইন্দ্রদার ভয় ছিল, কিছু না কিনে ছবি তুললে দোকানদার মারধর করতে পারে। দীপকদা বলল, ‘চপ খাবি? তাই তো? পরিষ্কার করে বল না।’ ইন্দ্রদার জন্য চপ কেনা হতে আমারও মনটা কেমন করে উঠল। ওর থেকেই ভাগ বসালাম।

তেলেভাজার কথা যখন উঠল তখন বড়গাছিয়ার কালোর চপের দোকানের কথা বলতেই হয়। দারুণ বিক্রি। ওই তল্লাটে প্রচুর চপের দোকান। কিন্তু কালোর চপের তুলনা হয় না। উড়ের চপ শুধু বিকেলে পাওয়া যায়। কালোর চপ দু’বেলা। দোকানে মেলার ভিড় লাগে।

বড়গাছিয়ার আরেকটি দোকানের তেলেভাজা প্রসিদ্ধ। যশোদার শিঙাড়া। ইয়াব্বড় বড়। বোম্বাই আমের সাইজের। মোটা ছাল। মুচমুচে। নানারকম উপকরণের মিশেলে তৈরি সুস্বাদু পুর। দামটাও বেশ। সারা ভারতে যখন তিনটাকায় শিঙাড়া মিলত তখনই যশোদা পাঁচটাকায় বেচত। এখন সময় পাল্টানোর সঙ্গে দাম আরও বেড়েছে। এখন সাত টাকা।

সকাল বিকেল ঝুড়ি ঝুড়ি শিঙাড়া হরির লুটের বাতাসার মতো উড়ে যায়।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *