রেশমি প্রামাণিক
কেজো জীবন থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই মনটা ছুটি চাইছিল। অফিস যাওয়ার পথে ভরদুপুরে ভিড়ে ঠাসা ননএসি মেট্রোতেও পাহাড়-মেঘ-বর্ষার স্বপ্ন দেখতাম।
এমনই একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে আড্ডা চলছিল। কলকাতা তখন গরমে ক্লান্ত। আর বৃষ্টি রানি তো মজা পেয়ে সবাইকে লেজে খেলাচ্ছেন। তাঁর আগমন বার্তা সঠিক ভাবে কেউই দিতে পারছেন না। কোন মেঘে বৃষ্টি হতে পারে তা জানাতে স্বয়ং গুগল দাদুও ফেল। সবে সন্ধ্যে নেমেছে গঙ্গার বুকে। জোয়ারের জল বেশ পায়ের পাতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিন জোড়া চোখ এক দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ কেউ যেন বলে উঠল — ‘এই বর্ষায় পাহাড়ে যাবি?’ শুনে বাকি দু’জন জাস্ট লাফিয়ে উঠল। ভরা বর্ষায় পাহাড় দেখার লোভটা তিনজনেরই যে বহুদিন ধরে লালিত তা আর বুঝতে বেশি সময় লাগল না।
কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে তা আর ঠিক হয় না। শুধু মালবাজার পর্যন্ত যাওয়া আসার টিকিট কাটা রইল। তবে ঠিক হল, যেখানেই যাই না কেন পাহাড়, জঙ্গল, ঝরনা, নদী— একসঙ্গে সব থাকতে হবে। ডুয়ার্স, মূর্তি থেকে নাগরাকাটা সাজেশনে আসছিল বহু কিছুই। কিন্তু ঠিক যেন মনে ধরছিল না। এদিকে যাওয়ার দিন প্রায় চলে এল। ঠিক সাতদিন আগে প্রস্তাব এল, ঝান্ডি। নামটা শুনে আমরাও প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু গুগলে সার্চ করতেই মন আনন্দে সাতপাক নেচে নিল।
নির্ধারিত দিনে সময়ের চেয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা দেরিতে মালবাজার নামলাম। আগে থেকেই গাড়ি বলা ছিল। মেঘ-চা বাগান আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটল গরুবাথানের দিকে। গরুবাথানে পৌঁছতেই শুরু হল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। পাশে বয়ে চলা তিস্তার শাখানদী চেল যেন তখন ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর। চেলের গর্জন, পাহাড়, ঝর্না প্রকৃতির সব রূপ একসঙ্গে মিশে সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। শুধু দু’চোখ ভরে উপলব্ধি করা যায় মাত্র। ক্যামেরার লেন্স তাকে ছুঁতে পারে না।
কিছুক্ষণ পরে স্থানীয় একটা ঝুপড়িতে চিকেন মোমো সহযোগে দুপুরের লাঞ্চও সারা। বৃষ্টি একটু কমতেই আমরা রওনা দিলাম ঝান্ডির দিকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেঘ স্বাগত জানাল ঝান্ডি ইকো হাটে। আসার পথেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, পায়ে হেঁটে ঘুরব। সেই মতো রাস্তাঘাট জেনে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু বাধ সাধল জোঁকাতঙ্ক। কামড় খেয়ে তো বোঝার উপায় নেই। রক্ত দেখে মালুম হল। এবং তাই দেখে অযথা আতঙ্কিত হয়ে বেশ খানিকক্ষণ সময় নষ্ট হল। সন্ধ্যেবেলা কফির কাপ হাতে ভিউ পয়েন্ট থেকে তাকাতেই চোখে পড়ল পাহাড়চূড়ায় অকাল দীপাবলী।
রাত থেকে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। হু হু করে তাপমাত্রা নেমে গিয়ে প্রায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবে আমদের জন্যে তৈরি নিখাদ আড্ডার পরিবেশ। এটার প্রতীক্ষাতেই তো ছিলাম। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর শুরু হল হাঁটা। প্রায় চার কিলোমিটার হাঁটা। পথের মাঝে পেরোলাম বেশ কয়েকটা পাহাড়ি গ্রাম। ঝর্না আর একাটা চা বাগান। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরিতে মাঝেমধ্যেই হার মানছিল পাহাড়। বিস্তর ঘোরাঘুরি শেষে ফিরে এলাম লাঞ্চের জন্য। তারপর আবার পথ চলার আনন্দ। এবার গন্তব্য আরও একটি পাহাড়ি গ্রাম। মেঘের চাদর রাস্তাকে এমন ভাবে মুড়ে রেখেছে, যে দেখে বোঝা মুশকিল ভোর চারটে নাকি সকাল। স্থানীয়রা এভাবে তিনটে মেয়েকে হাঁটতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলেন। ওঁদের ভাষায় উৎসাহ দেবার সঙ্গে জোঁকের ভয়ও দেখালেন। এক ভদ্রমহিলা তো তাঁর বাড়িতে ডেকে জলও খাওয়ালেন। একগোছা পাহাড়ি ফুল হাতে নিয়ে ফিরে এলাম ইকোহাটে।
চায়ের কাপ হাতে ভিউ পয়েন্টে বসতেই আবার শুরু বৃষ্টি। বৃষ্টি কি পিছু ছাড়বে না? হঠাৎ করে আলোগুলো বন্ধ হয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর বৃষ্টির শব্দে পাহাড় যেন কোথায় একটা হারিয়ে যাচ্ছিল। ওই কয়েক মুহূর্তে অন্ধকার যেন আরও ভালো ভাবে জানান দিয়ে গেল তার অসীম রূপের। রাতে টর্চ হাতে পাহাড় বেয়ে ডিনার সারতে যেতে হতো ডাইনিং হলে। স্থানীয় খাবার থুকপা আর মোমতেই মোটামুটি আমাদের লাঞ্চ ডিনার সারা হত। মজা পেতাম অন্য বাঙালি পর্যটকদের দেখে। ওই ঠাণ্ডাতেও মাছ ভাত তো চাইই। আর তার সঙ্গে প্রাইম টাইমের বাংলার টেলি সিরিয়ালও দেখা চাই।
পরদিন সকালে লম্বা যাত্রা। লাভা-লোলেগাও–চালসা–সামসিং হয়ে একেবারে মালবাজার। সন্ধ্যেয় সেখান থেকেই ছিল ফেরার ট্রেন। লাভা থেকে ঝান্ডির দূরত্ব মোটে ৬ কিলোমিটার। কিন্তু তার মধ্যেই অদ্ভুত ভাবে বদলে গেল প্রকৃতি। আসলে ঝান্ডির সৌন্দর্যের কাছে হার মানতে সবাই বাধ্য।
এই সফরে ভাল চা পাতা কেনারও লক্ষ্য ছিল আমাদের। ড্রাইভার দাদাকে সে কথা বলতেই নিয়ে গেল ‘মিশন হিল’ টি এস্টেটে। বাগানে ফ্রেশ চা পাতা কেনার সঙ্গে রয়েছে চেখে দেখার সুযোগও। চা খেয়ে ফুরফুরে মনে এবার বাড়ির পথ ধরার পালা। স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে আলাপচারিতায় খোঁজ পাওয়া গেল অন্যরকম ঘোরার জায়গার। যা নাকি খোদ গুগলদাদুও খুঁজে পাবেন না। কাজেই ট্রেনে বসে হয়ে গেল পরবর্তী মিশনের পরিকল্পনা।
এবার শুধু ব্যাগটা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ার পালা।
যে পথে ঝান্ডি যাবেন—
শিয়ালদহ থেকে একমাত্র কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস মালবাজারে দাঁড়ায়। মালবাজার থেকে গাড়িতে ঝান্ডির দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। গরুবাথান হয়ে বা লাভা হয়েও ঝান্ডি ঢুকতে পারেন। থাকার জন্যে রয়েছে ঝান্ডি ইকো হাট ও দ্য রিট্রিট।তবে যাওয়ার আগে বুক করে যাওয়াটাই ভাল।