জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

হে শালবন, আপনাকে নমস্কার

সৌমিত্র সেন

এই প্রথম! হ্যাঁ, জীবনে এই প্রথম ডিসেম্বরের নিঝুম ঠান্ডায় এবং ততোধিক নির্জন অন্ধকারে পাহাড়তলির এক গাঁয়ের উঠোনে গাছের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, মুরগি-প্রত্যাশী! মুরগি নাকি গাছে বসে আছে! আঁধার আরও গাঢ় হবে, তাকে নামানো হবে, দামাদামি হবে, কেনা হবে এবং শেষমেশ বাংলোযাত্রা। হ্যাঁ, এমনটা এই প্রথমই। কোনও ভুল নেই এতে।

এতদিন ধরে মুরগি কিনতে গিয়ে মাটিতে নজর রেখেছি, কিংবা আর একটু উঁচুতে, চৌকি বা ধাপিতে! মুরগির জন্য শেষবার কোনও বাড়ির চালে নজর রেখেছিলাম, এবং সেটাই প্রথম, কাঁকড়াঝোরে। গোপী মাহাতোর লজের খানিক দূরের এক বাড়িতে।

কিন্তু শরীরে সারাদিনের জার্নির অসম্ভব ক্লান্তি এবং পেটে সারাদিনের অনশনের (কোনও সত্যাগ্রহ-ট্রহ নয়, খাওয়া হয়ে ওঠেনি, খাবার পাইনি) অসহ্য ক্ষুধা নিয়ে, বাংলোয় ঢুকে তারপর সঙ্গে গাইড-কাম-রাঁধুনি টাইপের একটি ছেলেকে পাকড়ে প্রায় তক্ষুনি বাংলো থেকে বেরিয়ে এসে, বিনষ্ট অন্ধকারে এভাবে মাংসের সাধনায় কখনও নামতে হয়নি, এর আগে।

বুনো গাঁয়ের যে বাড়িটিতে এসে থামলাম, সেখানে খানিক নজর চালানোর পর বোঝা গেল, গাছে মুরগি রয়েছে। মালিক তাকে নামাবে। এই মুহূর্তে মালিক বাড়ি নেই। এক ছেলে-কাঁখে এক রমণী বেরিয়ে এসে সেই গা-কা-রাঁ ছেলেটিকে নিজস্ব ভাষায় কিছু বললেন। ছেলেটি আমাদের সংকটটা তাঁকে হিন্দিতে বোঝাল। অবস্থা দেখেশুনে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বাংলোয় ফিরে যাই। সঙ্গে চাল-ডাল-নুন-তেল-মশলা-সবজি তো রয়েছেই। কিছু একটা রেঁধে খাওয়া যাবে’খন। কিন্তু, তবু বিষয়টার শেষ দেখতে ইচ্ছা হল।

বাংলোয় (এতক্ষণ তো বলাই হয়নি কোথাকার কোন বাংলো; এ হল সারান্ডার থলকোবাদ; অরণ্য এখানে আদিম, নিশ্বাসের শব্দ পাওয়ার মতো চিরনির্জন, সেদিন পূর্ণিমা ছিল না বলে, অন্ধকার, সোলার আলো-ক্লিষ্ট। তখনও পর্যন্ত অবশ্য সৌর-সংবাদ না জানা থাকায়, আমরা মোম-সংবলিত) আছেন মঙ্গল সিং। অমল ধবল এক মানুষ (তখনও পর্যন্ত জানি না, পরে জানব; যিনি, আমাদের দলের মেয়েরা ‘মঙ্গলজি, আজ আপনার হাতের রান্না খাব’ বললে, আপ্লুত আনন্দিত হয়ে বাংলোর ডান হাতায় উঠোনে আগুন করে মৌজ করে মুরগি রাঁধেন এবং নিজেদের জন্য একটুও না রেখে আগে আমাদের সার্ভ করেন)। তাঁকে দেখেই ভাল লেগেছে। যিনি বাংলোর বাঁকে তাঁর সাইকেলটিকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে দেন— মঙ্গল যে রয়েছেন আশপাশেই কোথাও, সেটা বোঝা যায় এই স্থির সাইকেল দেখেই। যিনি নীচে যান জল আনতে। ঝোরা থেকে। প্রচুর গাছগাছালির মধ্যে পথ করে নীচে যেতে হয়, বনজ গন্ধের মাতোয়ারা শুঁড়ি ধরে, সে এক অপূর্ব কনচের্তো। রোজ রোজ। হয়তো ওঁর নয়। আমাদেরই। যেহেতু, একদিন। কিংবা, হয়তো ওঁরও। হলেই-বা রোজ। কেননা, মঙ্গল সিংহের মুখে ও শরীরে, ভাষায় ও চোখে সেই আশ্চর্য অরণ্যের মায়ামদির ছায়া কি দেখিনি?

না, অবসন্ন সন্ধ্যার কুয়াশা ভেঙে ব্যর্থ ফিরে আসতে আমাদের হয়নি। আমরা মুরগি নিয়েই ফিরেছিলাম, ‘তার সঙ্গে খারাপ-কিছু-একটা ঘটতে চলেছে’ বুঝতে পারা প্রাণীটির আতুর আর্তনাদ-সমেত। নিষ্ঠুরের মতোই। অসহায়! যুগপৎ প্রাণীটি ও আমরা।

চাঁদহীন আকাশের মেঝেয় যেন ছোট্ট মেয়ের হাত ফসকে পড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে অযুত মোতির দানা। বন্য বাতাসের বিলোল লীলায় কেঁপে-ওঠা বাংলো-চত্বরের মহাবৃক্ষগুলির অন্ধকার প্রশ্রয়ের শামিয়ানায় অনেক আগুন তৈরি করা হয়েছিল সেদিন। সাইকেলের চেনরিং থেকে অপার সৃষ্টিশীলতায় বানিয়ে-নেওয়া বঁটিতে কাটা হয়েছিল সেই লাল মুরগি। এবং মঙ্গল সিংয়ের বাংলো-রেসিপিতে বানানো সেই মুরগিকারি-সহ সাদা ভাতের শীতরাত্রি আমাদের সারান্ডাভ্রমণের মৌতাতকে যেন ‘লিটারেলি’ নক্ষত্রখচিত করে তুলেছিল।

কিন্তু এই মুরগি-পর্বের আগেই আমরা চলে গিয়েছিলাম জঙ্গলের অনতিদূরের ভিউ পয়েন্টে। পথ-হীন পথ। পাহাড়ি, পাথুরে। প্রথমে কিছুটা ঝুঁকে নেমে গিয়ে সেই পথ পরে উটের মতো গলা তুলেছে। সেই গলার ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেই চকিতে সামনে খাদের মরু! ঠিকই। কিন্তু তার অপার বিস্তৃতির মধ্যে গভীর সবুজের অন্ধকার আর পাহাড়ের অজস্র ঢেউয়ের কঠিন নীলিমা! পাখি নেই। থাকেও না সম্ভবত ওইসব জায়গায়। পায়ের নিচে বিরল কোয়ার্টজ। ছোট-বড়। গোল-চ্যাটালো। সরে যায়। গতি থমকায়। চলে আসতে হয় সেখান থেকে। অপ্রয়োজনীয় হাওয়ার সঙ্গ ছেড়ে গহন বনের সমীপে চলে যাই। সেখানে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের ওয়াচ টাওয়ার। নীচের ঘুলঘুলিওয়ালা ঘরে বন্যজন্তু, বিশেষত হাতি দেখার ব্যবস্থা। লোহার সিঁড়ি, যদিও ভয়ংকর নড়বড়ে, রয়েছে একটি, যা ওপরের তলায় পৌঁছে দেয়। তবে সেই ভয়-জাগানো সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্ককে একপাশে ঠেলে সরিয়ে আমি গেলাম একটি জলধারার কাছে। পাহাড়ের নীচ থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমশ স্রোত হয়ে যা বেরিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের মজলিশ ছেড়ে, দূরে। শুকনো পাতা এবং আরও কিছু কুটো-টুটো সরিয়ে সেই জল দু’হাতে আঁজলা ভরে না খেয়ে পারা গেল না। অসম্ভব ত্রস্ত সেই জল।

পরে কয়েক গজ হেঁটে পৌঁছে গেলাম পরবর্তী গন্তব্য, গুহার কাছে। তখন বিকেল পেকে গিয়েছে। কালচে লাল সেই অপরাহ্ন টুপ করে জঙ্গলের মধ্যে খসে পড়ার আগেই আমাদের বাংলোয় ফিরতে হবে, এই মর্মে আমাদের রাজি করিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে যে ছেলেটি, স্বাভাবিকভাবেই সে বেশি সময় দিতে চায় না। তবু তাকে বিরক্ত করেই, ক্রমশ-সন্ধ্যার আবছা-আঁধার-রণিত সেই বুনো আবহাওয়ায় আমরা গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তীব্র গন্ধ নাকে এল। আসতেই থাকল। জঙ্গল-অশিক্ষিত আমাদের মনে ভয়ই বেশি। তবু ভয়কে পরাজিত করেই আমরা এলাকাটা ঘুরে বেড়ালাম। গুহাটার অবস্থান, তার আলো-ছায়া, শৈত্য, শ্যাওলা, কার্ভেচার, টেক্সচার, এবং যেটা আগেই বলা উচিত ছিল, তার বটানিও— ‘বটানি’ মানে, তার আশপাশের দুরন্ত অটল সব গাছ— আমাদের ঘাড় ধরে ঘোরাল ওখানে, কিছুক্ষণ কাটিয়ে যেতে আদেশ করল। ওই আদিম আদেশ না মেনে উপায়ও ছিল না। নমস্কার আপনাকে, হে অরণ্য!

ফিরে, মুখ-হাত ধুয়ে, পোশাক না-বদলে, থলকোবাদের এই নবনির্মিত বাংলোর কান-এঁটো-করে-হাসা বিস্তৃত বারান্দায় চেয়ার টেনে কিছুক্ষণ বসে থেকে, জংলি আবেশটাকে শরীরে ও মনে নিতে-নিতে এবং কখনও-সখনও পরাভূত হয়ে যখন আমরা অব্যবহিত পরবর্তী নৈশ সিরিজের রহস্য-রোমাঞ্চ নিয়ে ভাবছি, ঠিক তখনই চা এল। প্রথম চুমুকেই স্নায়ুতন্ত্রে যেন জাকিরের আঙুল বেজে উঠল তবলার ওপর! আঃ! কী আস্বাদ, কী আস্বাদ!

রাত যত জটিলতার দিকে হামাগুড়ি দিতে থাকল, ততই আরণ্যক শীত ও বাতাস এই বনবাংলোর চতুর্দিকে অম্লান ঔদাসীন্যে টহল দিতে থাকল। ঘুম আসে না এসব জলসায়। তবু এল।

এবং ভোরও। মিঠে, নরম, ভেজা-ভেজা, শান্ত কিন্তু ব্যক্তিত্বের ঠাটে আগাগোড়া চপল মেজাজি। সেই সুকোমল সকালের ভিতরেই আমরা পাড়ি দিলাম টোয়েবু ফলস্। পথ ভয়াবহ নয়। কিন্তু সহজ-সরলও নয়। ওঠা-নামার ছন্দে ও পতনে কল্লোলমুখর। এ যাত্রার একেবারে শেষপ্রান্তে, মানে টোয়েবুর কাছাকাছি পথ বেশ সংকীর্ণ, চিরনিরুৎসুক অরণ্য-উদ্ভিদের অপরূপ প্রাচুর্যে আত্মখণ্ডিত; যে দ্বিধা-খণ্ডে জলপতনের শব্দ আসছে, ঠান্ডা হাওয়ার ওড়না উড়ছে, গাছেদের বাসি গায়ের গন্ধ মদির করে তুলেছে মহাল, একটি ‘নেই’-সমেতই! হ্যাঁ, অনেক পাওয়ার মাঝে একটুখানি ‘নেই’! কোনও পাখির গান নেই সেখানেও! জলকল্লোলের প্রণয়প্রলম্বিত সুষমার আসরে পাখিরা বোধ হয় হাসে না, গায় না, কাঁদেও না! অথবা, বিশ্বাস করুন, আমি জানি না। ওই মাথা-ঘুরিয়ে-দেওয়া সুন্দর আমাকে বধিরও করে তুলেছিল হয়তো। বন্য, বন্য হে অরণ্য, আপনাকে নমস্কার! ফলে পাখির গানের কথা আর বেশি চিন্তা না করে এগিয়ে গিয়েছিলাম। যেতে হয়েছিল। কাটা মুন্ডু ঝরনার রক্ত-কথার মিথ-মেদুরতায়।

কাটা মুন্ডু? (আহা! বিভূতিভূষণে পড়েননি? এ লেখারও শিরোনাম যেটি হতে পারত, সেই ‘থলকোবাদে একরাত্রি’তে? তবে, আমার ভার্সন বিভূতিভূষণের থেকে সামান্য আলাদা) ওই অঞ্চলের প্রাচীন প্রবাদ— এই টোয়েবুর জলে একদিন এক দম্পতি মাছ ধরছিলেন। স্বামীটি মাছ ধরে স্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন এবং স্ত্রীটি সেসব ঝটিতি গুছিয়ে রাখছিলেন। মাছ এত দ্রুত আসছিল যে, শ্বাস নেওয়ার ক্ষণিক অবসরেও তাঁর মুখ তুলে স্বামীর দিকে তাকানোর ফুরসত মেলেনি। তাতে ক্ষতি ছিল না, মাছ তো মিলছিল! কিন্তু সহসাই, সেই আদিবাসী রমণীটির হাতে যা এসে পৌঁছল, তা মাছ নয়। উফ্, সেটা ছিল তার স্বামীরই কাটা মুন্ডু! এবং এই প্রথম, অনেকক্ষণ পর, অবাক বিস্ময়ে ভয়কাতর দৃষ্টি মেলে তার সামনের দিকে অতর্কিতে তাকানোর ফুরসত মিলল, অজান্তেই! কী দেখলেন তিনি? কেউ জানে না। গল্প ওখানেই শেষ। সমস্ত আতঙ্ক, ভয়াবহতা, মৃত্যু, রক্ত-সমেত লোককথাটি ওখানেই চিরস্থবির। মিথ-পরদার ওপারে, জলের ঝাপসা অন্তরালে, অন্ধকারে কী ছিল, কী আছে— এসব কেউ জানতে যায়নি আর। জানতে পারেওনি! এরপর টোয়েবু দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। মিথও আপাদমাথা মথিত হতে-হতে শিকড়হীন রোমাঞ্চে কণ্টকিত হয়ে জলের মতোই অনেক দূর গড়িয়ে এসেছে, কোথাও কোনও দাগ না রেখে।

মিথ হোক বা মিথ্যা, কিচ্ছু যায় আসে না! আমরা নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ দিয়ে বুঝতে পারছিলাম জায়গাটার আনক্যানি নৈরাজ্যের শিরদাঁড়া শীতল করা নৈঃশব্দ্য! জল পড়ছে, তারই শব্দ শুধু, আতপ্ত আশ্লেষের আদর-কাড়া শাসানির মতো চুপ করিয়ে দেওয়া নিষ্ঠুরতায় মাখা, অতলস্পর্শী, দুর্মর। তা এসে পড়ছে যেখানে, সেখানে আগাগোড়া সমস্ত তরঙ্গ সমাহিত হওয়ার স্পেস-সমেত একটা ধারক-বাহক জল-এলাকা, ভয়ার্ত, গভীর এবং নিষ্পাপ পৌনঃপুনিকতায় কুটিল কিন্তু উজ্জ্বল! কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। যাওয়া নেই। আসা নেই। সময়ও নেই। ‘নেই’ মানে, সময় সেখানে মহাস্থবির জাতক। অ-জন্ম এক বিচ্যুতির কলরোলে সমীচীন মরণের প্রশান্তিতে আলোড়িত। শীত-শীত করে। ভরা গ্রীষ্মেও নিশ্চয়ই করে। করবেই। এখানে এসে যত দ্রুত এখান থেকে ফিরে যাওয়া যায়, ততই প্রাণের আরাম। কিন্তু মর্ষকামী মন নিজস্ব লিবিডোর অসহায় এন্ট্রান্স নিতে-নিতে ওখানে, ওই ভিজে মসৃণ বুনো পাতার নির্ভীক রাজ্যে, বিজনে, জীবন বরাবর যা করে— নিজেকে নিয়ে বিমল গ্যাম্বলিং— তাই করতে-করতে অনর্থক দেরি করে ফেলে। দেরি করতে দেয়ও মন। নিরুপায় লাবণ্যের অগোচরে।

টোয়েবু থেকে বাংলোয় ফেরার পথে (গাড়িতে, আর যদি হেঁটে ফেরা যায়, তখনও) একেবারে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। কিন্তু এই জায়মান শ্রেয়বোধকে বিস্মৃত হয়ে যেন নিজেদের রক্তকে ঠান্ডা করতে চেয়েই আমরা অনর্গল নিজেদের মধ্যে অকিঞ্চিৎকর সব বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছিলাম। নিরুপায় লাবণ্যের গোচরেই!

কলকাতা ফিরে যেতে হবে আজ। কিন্তু ফেরার গল্পে যাওয়ার আগে আসার গল্পে আসি। আমি যেখান থেকে এ-লেখা শুরু করেছি, বলাই বাহুল্য, আমাদের ভ্রমণ আমরা মোটেই সেখান থেকে শুরু করিনি!

করিনি, কেননা, সেখান থেকে শুরু করা যায় না।

শীতসকালের হাওড়ার নতুন কমপ্লেক্স থেকে রীতিমতো বরবিল জনশতাব্দী দিয়ে আমাদের শীতরোদ্দুরের ছুটির শুরু। নামা বড়াজামদায়। বেলা একটা নাগাদ। সেখান থেকেই আমরা চালান হয়ে যাই জনৈক গাড়িচালকের কাস্টডিতে। তিনি আমাদের নিয়ে যান প্রথমে কিরিবুরু। ঝাড়খণ্ডের বনবিভাগের বাংলো। স্প্রলিং, সব অর্থেই। খাবার পেতে একটু সমস্যা হল। স্রেফ কমিউনিকেশন গ্যাপ। সেই ‘গ্যাপ’কে ‘ব্রিজ’ করে যা হোক খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হল। ‘সেল’এর গেস্ট হাউসে। লাঞ্চ এমন জায়গায় শেষ হল যেখান থেকে সূর্যাস্ত শুরু হয়। ফলত, আমরা শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি সত্ত্বেও তড়িঘড়ি বাংলো ফিরে গেলাম না।

সেল গেস্ট হাউসেরই পিছনে ‘সান সেট পয়েন্ট’। ডাইনিং রুমের ঠিক সোজাসুজি লাল উঠোন পেরিয়ে, তারপর সরু বাঁধানো পথ, যা বড় বড় গাছেদের মধ্যে দিয়ে সোজা চলে গিয়ে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়েছে। পথটা যেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সেখানটা তন্বী রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিংয়ের কয়েক হাত পরেই খাদ। সেই খাদের ভিতর থেকে তখন আসন্ন গোধূলির কুয়াশা-ভরা আহ্বান জেগে উঠছে। অসম্ভব সিনিক জায়গাটা। থমথমেও। এক আদিবাসী মহিলা আর একটি কিশোর গোটা-চল্লিশেক ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে নীচের অতলছোঁয়া সন্ধের দিকে চলে যাচ্ছিল তখন। ওদের পিছনে লাল সূর্য। প্রগাঢ় নিশীথের বার্তা নিয়ে সে হা হা শূন্যতার বুকের মধ্যে, আজানুলম্বিত অরণ্যকে কোমরের নীচে রেখে, শীতের ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিতে-দিতে ক্রমশ সরে-সরে যাচ্ছে। মেঘের অপরিসীম প্রাণবন্ত ছিনালপনার চিলেকোঠায় তার নাকটা তখন সবে ঢুকিয়েছে সে। শীতের দাঁতের ধার অনুভব করতে পারছিলাম আমরা। কুট কুট করে সহাস্য নির্মমতায় সে কেটে দিচ্ছিল আমাদের ঢাল-তরোয়ালহীন যুদ্ধাপরাধ। অন্ধকারটাও গুঁড়ি মেরে আসছিল। মাটিতে গেঁথে থাকা পাথরের মাথাগুলো কুকুরের নাকের মতো ঠান্ডা। গাছের ছায়া-শামিয়ানায় শীত যেন চক্রবৃদ্ধিহারে বর্ধিত সুদ। পেরে ওঠা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমরা লড়ে যাচ্ছিলাম। শেষমেশ সমস্ত অন্ধকার নামিয়ে এনেই আমরা ফিরেছিলাম।

পরদিন সকালেই আমাদের বেরনো। ঠিক সকাল নয়। অনেকটা ধূপ-জ্বালা অন্ধকার ঘরের ছায়াছন্নতায়— পাহাড়ি শীতের ভোর যেমন হয় আর কী! সূর্য খুব কাছেই, তবু, মাঝখানের অনেকগুলো কুয়াশাপরত এমন অটল দূরত্ব রচনা করে যে, সূর্যসকালের নিখিলবিশ্বকে যেন অখিল ভবিষ্যতের বস্তু বলে মনে হয়। তো, ক্রিসমাসের সেই কুয়াশাসনেটগুচ্ছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমাদের গন্তব্য ‘সানরাইজ পয়েন্ট’। বনবাংলো থেকে ছ’কিলোমিটারের মতো। উঁচুনিচু পথ আর গাছগাছালির অভিবাদনের মধ্যে দিয়ে কয়েককিলোমিটার গিয়ে গাড়ি একটা টি-ব্রেক কষল। পথের ধারের নগ্ন নির্জন চা-দোকান। নাক-কান-গলা (‘ই-এন-টি’ নয়) মাফলারে সুকঠিন সাবলীলতায় মোড়া কয়েকটি শীতজবুথবু শরীর স্টোভের চারিদিকে স্বল্পবাস নারীদর্শনের লোলুপতায় আগুনের দিকে চেয়ে স্থির। দুধ-চিনি সহযোগে চা-পাতা ফোটানোর তাজা গন্ধের সুচে সেলাই করা সেখানকার বাতাসকন্থা। সেই আমেজের কুয়োয় নেমে দাঁড়িয়ে এক গ্লাসের জায়গায়, স্বাদে-আপ্লুত আমরা চালাতেই থাকলাম আবিল চুমুক। তবে, একসময় থামতে হলই। আবার গাড়ি। আরও কয়েক চাকা। একটু চড়াই। তারপর বাঁক ঘুরেই ‘পয়েন্ট’।

কুয়াশাচ্ছন্নতা দেখে প্রাথমিকভাবে আমরা কিঞ্চিৎ হতাশই। তারপর গাড়ি থেকে অবতরণ। এবং নামা মাত্রেই আত্মঘোষিত ফোটোগ্রাফার সব আমরা, দুঃসহ তৎপরতায় পটাপট ‘স্ন্যাপ’ নিতে থাকলাম। আকাশের। রঙের। তখনও-ভাল-করে-না-ফোটা সূর্যের ঠোঁটের ওপরের লাস্যময়ী মেঘের। গাছের। শুধু বাতাসেরই নয়। এইসব ক্রিয়াকর্মের মধ্যেই কখন যেন আকাশ একটু ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম হয়েছে, স্বচ্ছ হয়েছে মেঘের মুলুক। আর সেই স্বচ্ছতার রাজপথেই ভোর তার সমস্ত রূপ ও রূপক নিয়ে কিরিবুরুর পাহাড়শীর্ষে আকাশনিম্নে বিকচকুসুম, আমাদের সামনে!

দেখা সেরে দ্রুত ফিরলাম। ফিরেই আবার বেরনো। এবার সারাদিনের জন্য। দ্রষ্টব্য পুন্ডুল ফলস্, স্বপ্নেশ্বর শিবের মন্দির। তার আগে গরম-গরম আটার রুটি আলুভাজা, ডিমসেদ্ধ আর চা। এবং ঠিক এইখানে পৌঁছে, এই গরম চায়ের পেয়ালার কিনারায় এসে, কিরিবুরুর বনাবাসের রান্নাঘরের চায়ের প্রসঙ্গে বেঁটেখাটো, সদাত্বরিত, বাংলা-একদম-বুঝতে-না-পারা-এবং-হিন্দিও-স্পষ্ট-বুঝতে-না-পারা অসম্ভব মিষ্টি ছেলেটির উল্লেখ না-করলে কিরিবুরু নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হবে না!

সিকন্দর তার নাম। ছোট্ট মেয়ে রয়েছে তার। যদিও প্রথম দর্শনে তাকে ‘বাবা’ বলে মেনে নেওয়া কঠিন। কী দারুণ চা-ই না সে তৈরি করে (বলতে গেলে, তার রান্নার হাতও মন্দ নয়; তখনও জেনে ওঠা যায়নি, পরে জানব, সেদিন ফিরে এলে, ডিনারে সে আশ্চর্য সুন্দর বেগুনপোড়া বানাবে)!

সেই আস্বাদ নিয়েই আমাদের বেরিয়ে পড়া। পুন্ডুল যাওয়ার পথ দারুণ! ডানদিকে পাহাড়-জঙ্গল, বাঁ দিকে খাদ। চরাচর জুড়ে মহাবৃক্ষের প্রদর্শনী। উজ্জ্বল রৌদ্রময় শীত। হাওয়ায় হাড়ের কণিকায় হিম পৌঁছে দেওয়ার অকুণ্ঠ প্রতিজ্ঞা। অবিনাশী আনন্দের সৌকর্যে জীবনের ছন্দস্পন্দময় ভ্রমণরতি। তারই টানে মানুষের পথ চলা। পথ ভাঙা। পথ চেনা। পথ হারানো। পথপ্রাপ্তিও!

সেই পথ পেতে-পেতেই আমাদের ক্রমশ জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে চলা। যাওয়ার পথে অজস্রবার থামা। না থেমে উপায় নেই বলে। দাঁড়িয়ে না দেখে চলে যাওয়া অসম্ভব বলে। ‘দেখা’ বলতে ওই একই জিনিস। পাহাড় আর আকাশ আর গাছ আর এসবের নির্ভুল মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা টানটান বনসড়ক। এই দেখাই ফুরোচ্ছে না আমাদের। একই পথে ছত্রিশবার হেঁটে গিয়ে কখনও দেশলাই, কখনও সেফটিপিন, কখনও হলুদ কিনে আনলে সেই পথ নিয়ে মনে যে অজানিত উদাসীনতা জমে ওঠে, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি নির্লিপ্ততার সঙ্গে আমাদের গাড়িচালকদাদা আমাদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেখে চলেছেন একটানা, নিঃশব্দে, সকৌতুকে, সকৌতূহলেও। তবু আমরা নিজেদের শুধরে নিচ্ছি না। নানা প্রশ্ন নিয়ে তাঁকে নিয়ত জাগাচ্ছি। তিনি হেসে উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। এই করতে-করতে আমরা একসময় পুন্ডুল। গাড়ি ছেড়ে কিঞ্চিৎ হাঁটা। একটু উঠে তারপর বেশ টানা ঢাল-ওয়ালা সংকীর্ণ পথে অমিত্রাক্ষর হোঁচট-সমেত হনহন হেঁটে আমরা পুন্ডুলের মুন্ডুর ওপর পৌঁছলাম।

ভয়ানক। অসম্ভব দ্রুত জলপতন। ক্ষুরধার। ক্ষমাহীন। হাতির পিঠের মতো পাথরের ওপর দাঁড়ালে একদিকে নদী, যে নদী এই প্রপাতকে সৃষ্টি করেছে, আর অন্যদিকে রাশিরাশি জলপতন-জনিত জলপ্রপাত, যা এই নদীকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামিয়ে পুন্ডুল নির্মাণ করেছে। অনেকদিন ধরে জীবিত-থাকা শ্যাওলায় জাজিম বিছানো চারদিকে। শুকনো শ্যাওলাও রয়েছে বইকী! হলুদ, রাগী, তিতিবিরক্ত। অনেকক্ষণই কাটালাম সেখানে। আবার হতে হল ফোটোগ্রাফার, স্বঘোষিতই। এবং, এখানেও, কী আশ্চর্য, আমার শোনা হল না, পাখির ডাক। পুন্ডুল দেখে এবং শুনে আমরা বিশ্রাম করতে বসলাম যে দাওয়ায়, সেটিই স্বপ্নেশ্বর শিবের মন্দির। কেউ নেই। নিজেরাই টিন-সাঁটা জং-ধরা গ্রিল-দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে লিঙ্গদর্শন করে বেরিয়ে আসি। মন্দিরঘরটি ঠান্ডা, ভিজে-ভিজে, যেন ওই পুন্ডুলের জলধারা তার শৈত্য এবং স্যাঁতসেঁতে ভাবটি অগোচরে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে।

বলা হয়নি, পন্ডুলে আসার আগেই আমরা, ‘বেসক্যাম্প’ বলে খ্যাত একটি জায়গা (যেটি বাই ডিফল্ট একটাই খাওয়ার দোকান), সেখানে যাওয়ার পথে ‘অর্ডার’ না-দিলে দুপুরের খাবার মিলবে না, সেখানে বলে যেতে হয়েছিল আমাদের। প্রপাত এবং মন্দির দেখে ফিরে সেখানেই খেয়ে নিয়েছিলাম। সাধারণ ডাল-ভাত-সবজি-চাটনি সেদ্ধ ডিম-সহযোগে। এবং সেখানেই প্রথম একটি পাখি পেলাম আমরা। মুক্ত বিহঙ্গ নয়। খাঁচা-বন্দি পায়ে-শিকল এক টিয়া। যে অনবরত কথা বলে যায়। যা শোনে তাই বলে। আমার কন্যার নাম সে যখন অম্লানবদনে ঢেকে উঠল, সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আমার বাক্‌রহিত! ফেরার গোটা পথটা সে ওই পাখির কথাই বলেছে, তার জন্য মন খারাপ করেছে।

মন আমাদেরও খারাপ। কেননা, ছুটি ফুরোচ্ছে। এই তো দেখতে-দেখতে কিরিবুরু দু’দিন হয়ে গেল। কাল সকালেই বেরনো থলকোবাদের জন্য।

যথারীতি পরদিন বেরনো হল। মিনিট-পনেরোর মধ্যেই কিরিবুরুর হাটে পৌঁছে গেলাম। আহা! কী হাট! স্বপ্নের, আদিবাসীর, মুরগির, পিঁপড়ের, নানারঙের সিমের, কাঁচালংকার! কত কিছু যে বিকোচ্ছে হাটে। শুকনো মিষ্টি গজা খাওয়া হল। কাঁচা শালপাতায় মুড়ে দিলেন আমাদের, যিনি বেচছেন। তাতেই যেন স্বাদ আরও বেড়ে গেল। হাটটা ঘুরে-ঘুরে দেখলাম।

হাট ছেড়ে যেতে যেন ইচ্ছেই করছে না। সকলের সামনে উবু হয়ে বসে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কত রকম শব্দ। দরাদরির, আদরের, পারস্পরিক চেনা-শোনা-জাত বাঁকোচোরা কথাবার্তার। মুরগির পায়ে দড়ি বেঁধে হাসি মুখে দীর্ঘ শালের নীচে বসে আছেন এক প্রৌঢ়া। ওদিকে তিনটি প্রশস্ত শালপাতায় ডিম-সমেত জ্যান্ত পিঁপড়ে ডাঁই করে রাখা। একজন কিনলে, সাদা প্লাস্টিকের প্যাকেটে সেসব যখন ভরা হচ্ছে, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের গায়েই সতত সুখের স্মৃতির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল তারা! ভ্রুক্ষেপহীন ক্রেতা পয়সা মিটিয়ে সেসব বেঁধে তুলে নিচ্ছেন। এবং হাঁড়িয়া। আছেই। গোল গোল তেলেভাজা, সেদ্ধ কড়াই, কাঁচালংকা-সমেত। একপাশে মাছও নানারকম। লালমাটির উপর নানা রঙের বর্ণিল হাট। মাথার ওপর গাছের চাঁদোয়া। গাছের ওপর আকাশের তেরপল। হাওয়ায়-হাওয়ায় উজ্জ্বল সেই হাট-ক্ষেত্রে নানারঙের মানুষের কল্লোলে কী মজলিশি জীবন যে উপচে পড়ছে, উথলে উঠছে, ফেনা-সমেত, ফেনার কবোষ্ণ সুগন্ধ-সমেত, জীবনকে তেল-লংকা-সহযোগে শিলে বাটা ওই পিঁপড়ের ডিমের চাটনির মতো টাকনা মেরে খেতে-খেতে কত দূর চড়াই-উতরাই বেবাক ভোঁ ভোঁ তারা জন্মের শালবনে, মৃত্যুর উপত্যকায়! ধ্বংস-উত্তীর্ণ আদি মানবের ধারণক্ষেত্র হে শালবন, আপনাকে নমস্কার!

হাট দেখে, মনে খারাপ নিয়ে আমরা দ্রুত থলকোবাদের দিকে। একটু থমকাতে হল। কেননা, ‘সেল’এর লৌহ-খনি অঞ্চল দিয়ে পথ। বিশেষ অনুমতি লাগে। সেসব পর্ব সমাধা হলে আমরা পথ পেলাম। সাধারণ লালমাটির পথের চেয়েও আরও প্রগাঢ় লাল এই পথ। আশপাশের গাছ এবং পাথরও লাল মূর্তি ধারণ করেছে। বাঁকে বাঁকে রঙের খোয়াবনামা। এক সময় হা হা করছে লোহা-গর্তের মুখ, অসহ্য ব্যাদান-সহ। নামার নিয়ম নেই বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হল (যদিও ফেরার সময়, এই পথেই একটু ঝুঁকি নিয়ে নেমে পড়েছিলাম, এবং ছবি!)। আয়রন-ওর অঞ্চলে একটু ঢুকেই তারপর জঙ্গল যেখানে আবার ঘন, সেখানে বাঁদিক ঘুরে একটা ফল্‌স।

ঘাঘারতি। এর সঙ্গে একটি পাম্প হাউসও। শোধন করে জল পাঠাচ্ছে কিরিবুরু শহরে। অসম্ভব ঘন গম্ভীর শব্দ। অথচ, পাম্প হাউসকে পিছনে ফেলে জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে গেলে পিছনের ঘন শব্দ ক্রমশ হারিয়ে গিয়ে সামনের জলপ্রপাত-এলাকাটির ভারী পরিবেশই মনে দাগ কাটে বেশি। ভয়জাগানো, ছমছমে, কালোছায়ামাখা, রোমাঞ্চকুটিল, শিহরনজটিল— কিন্তু এখানকার জলধারাটির গতি তেমন ভীম নয়। জল এসে যেখানে জমছে, সেখানে বরফের মতো স্থিরতা ও কাঠিন্য। আশপাশের পাহাড় যেন কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ছে। গাছপালার হাত যেন গলা টিপতে আসছে। বেশিক্ষণ থাকা যায় না, থাকার দরকারও নেই।

কিন্তু ঘাঘারতির ক্ষীণ জলধারা, চাপা হুমকির শব্দহীন জলুম, ঠান্ডা চাহনির রক্ত শীতল-করা হাসি এবং অনেক অনেক নিবিড় মদির নিঠুর অরণ্যসৌধ, সেই বাকি পথটায়— যেখানে পথের গলাটাকে দু’পাশ থেকে এসে জঙ্গল ক্রমশ জড়িয়ে ধরছে, সেই গোলকধাঁধার সান্ধ্য বুনোপথে, গাছের গন্ধের সঙ্গে আকাশের শেষ আলোর কড়া মিশেল— সেখানে যে ত্বরিত মন্ত্রের চকিত শৈলীতে মুরগি-লাফে গলার কাছটায় রোমাঞ্চ উঠে আসে বারম্বার, সেখানে আমাদের অরণ্যভ্রমণের শেষ স্টেশন, থলকোবাদ, ক্রমশ এগিয়ে আসছে! আবছা অন্ধকার আর গাঢ় ঠান্ডার মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি তার ঝুঁটির দিকে, সেই অজানায়, যেখানে মঙ্গল সিং নামের এক অমল ধবল মানুষের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে! হে অকরুণ, অরণ্য, আপনাকে এক-শালবন নমস্কার। আপনাকে সূর্যের আলো এবং পাখির গান উপহার দেন যিনি, তাঁকেও! এবং অনেক!

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *