অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
বসন্তের শেষে বীরভূমের প্রাকৄতিক দৃশ্য বিশেষ লোভনীয়। লাল মাটি আর পলাশের মেলবন্ধন। সাঁইথিয়ার নন্দকেশ্বরী মায়ের মন্দির সতীর একান্ন পীঠের উনপঞ্চাশতম পীঠ। এখানে সতীর কণ্ঠহার পড়েছিল। সকালেই এখানে পুজো দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বীরচন্দ্রপুরের উদ্দেশ্যে। পথে কোটাসুরে খেলাম ডালপুরি আর ছোলার ডাল। ময়ূরাক্ষীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখলাম নদী শুকিয়ে মাঠ হয়েগেছে।পলি পরে নদীর বুক চিরে রাস্তা হয়েগেছে। মায়ূরাক্ষীর এমন অবস্থা দেখে খারাপই লাগছিল। আগের চিত্রপটের সাথে এ ছবি ভিন্ন।
বীরচন্দ্রপুরের পথে দু ধারে সবুজ ক্ষেত , লাল পলাশ দেখে মন ভাল হয়ে যাচ্ছিল । কোথাও আবার দুপাশের গাছগুল রাস্তার উপর এসে পড়েছে।আমরা সবাই চলন্ত গাড়ি থেকেই টপাটপ ক্যামেরা বন্দী করলাম ছুটে যাওয়া দৃশ্য। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে পারদর্শী আমার বোনপো। বীরচন্দ্রপুরের জগন্নাথ মন্দিরে পৌছতে সাড়েএগারোটা বাজল । ততক্ষনে সূর্যদেব মাথার ওপরে ওঠার তোরজোড়ে ব্যস্ত। কিন্তু ঘুরতে এসে ক্লান্ত হলে চলবে না। ‘চোখ দিয়ে সব বন্দী করো আর মনের খাতায় সব লিখতে থাকো’ – এটি আমার দিদির উক্তি।
মন্দিরে ঢুকতেই পুরির মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ন্যয় সিংহ দুয়ার।মন্দিরটিও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরী। মন্দিরের গায়ে স্বয়ং জগন্নাথদেবের আবির্ভাবের কথা বলা আছে। ছবি তোলা মানা। তাই মন্দিরের ভেতরের একটি ছবিও তোলা গেল না। মন্দিরের ভিতরে বই ও ছবি বিক্রি করছেন এক ভদ্রলোক, জানালেন এখানে পাশেই থাকার এবং ভক্তদের জন্য ভোগপ্রসাদের ব্যবস্থা আছে। ভোগপ্রসাদের কথা শুনলেই একটু খিদে বেড়ে যায় কিন্তু আমরা ভোগের প্রসাদ পেলুম না। সকালে কুপন নিতে হয় নয়তো ফোন করে জানাতে হয়। ভদ্রলোক একগাল হেসে দু’কুচি শসা ধরালেন সবার হাতে।
সামনের রাস্তায় বাঁক নিতেই সুরু হল একেক করে মন্দির- ইস্কন মন্দির ,নিত্যানন্দ মন্দির, চৈতন্য মন্দির। চৈতন্য মন্দিরের পাশের জমিতে বসন্তের শেষবেলার গমে সোনালি রঙ ধরেছে। এই প্রথম এমন সোনালি গম ক্ষেতের ভিতর দিয়ে হাঁটা তাই সবাই একটু বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। আমার সাত বছরের ছেলের মাথায় বিস্তর প্রশ্ন উদয় হয়েছে ইতিমধ্যেই। এবার সে বুদ্ধি দান করছে আমাদের – গমগুল নিয়ে চল, রুটি বানিয়ে খাব।
গম ক্ষেতের শেষে একটি ছোট মন্দির, মাটির দাওয়া-পঞ্চপাণ্ডব তলা। এখানে নাকি পাণ্ডবদের জতুগৃহ পুরে যাওয়ার পর তারা আশ্রয় নিয়েছিল – ঠাকুর মশাই জানালেন। এখানেই বক রাক্ষশ বধ হয়। এখান থেকে পায়ে হেঁটেই এগোলাম সামনের একটি পুকুরে। পুকুরের মধ্যে মন্দিরের চুড়াটি শুধু দেখা যাচ্ছে। সেখানে একজন পুরহিত কপালে টিপ পড়িয়ে কাহিনী বিবৃতি করছেন।
কৃষ্ণকে এখানে বাঁকা রায় হিসাবে কল্পনা করে পূজ করা হয়। তিনি এই জমিতেই অন্তর্ধান হয়ে ছিলেন। জানালেন, কয়েকবছর আগে জমি খনন করে বেশ গভীরতায় পৌঁছলেও মন্দিরের তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছন যায়নি। নীচ থেকে জল উঠে এসে একটি পুকুর হয়েগেছে। পুরহিত মশাই ঐশ্বরিক মাহাত্ম্য প্রচারে ব্যস্ত । অনেকেই প্রনাম করে ওনাকে দক্ষিনা স্বরুপ কিছু দিয়ে যাচ্ছেন।
এই পুকুরে স্নান করলে নাকি সব রোগ সেরে যায়।পুকুরের জল গ্রীষ্মে শুকিয়ে যায়না ,বর্ষায় জল উপচে পড়ে না। অনেকে স্নানও করছিল সামনের ঘাটে। আমার স্বামী পুকুর থেকে একটু জল এনে সবার মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।বাংলার পথে পথে কত যে লৌকিক আলৌকিক ঘটনা ছড়িয়ে আছে, তা অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জীবিকা নির্বাহক হয়ে ওঠে।
আমাদের সবার পেটে ততক্ষনে ছুঁচোয় ডন মারছে। তাই ইস্কন মন্দিরে ফিরে এসে ভোগ খাওয়ার জন্য কুপন কাটতে গেলাম। অফিসে একজন গম্ভীর মুখে জানালেন বারোটা বেজে গেছে এখন কুপন দেওয়া যাবে না। একটু অনুনয় বিনয় এবং আসানসোল থেকে এসেছি শুনতেই কুপন জুটল। ভাত, ভাজা, দুটো তরকারি, চাটনি, পায়েস। পেট পূজো তো হল।
এবার ছুটব একদম উল্টোদিকে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির হাটে। মনটা কেমন ছটফট করছিল সোনাঝুরির হাটে বাউল গান শোনার জন্য।
সমাপ্ত