শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়
(২০১৩ সালের ১৭ই জুন সকালে এক প্রলয়ঙ্কর বন্যায় বিধ্বস্ত হয় কেদারনাথ উপত্যকা, শুধু মন্দির বাদে প্রায় সবকিছুই ভেসে যায় মন্দাকিনীর জলে। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় কেদারনাথ পৌঁছানোর প্রাচীন পায়ে চলা পথটাও। উত্তরাখণ্ড সরকার, ভারত সরকার, নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং এবং ইণ্ডিয়ান আর্মির অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৪ সালেই তৈরি করা শুরু হয় কেদারনাথের নতুনপথ। সেই নির্মীয়মান নতুনপথেই আমরা ঘুরে এলাম কেদারনাথ, ২০১৫র অক্টোবরে। কেমন সেই পথ, প্রলয়ের পর কেমনই বা আছে কেদারনাথ উপত্যকা ও তার অধিবাসীরা? সেইসব অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নেব ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র সদস্যদের সাথে বেশ কয়েকটি পর্বে। আজ রইল প্রথম পর্ব)
প্রথম পর্ব
১৯শে অক্টোবর ২০১৫, ভোর সাড়ে পাঁচটা। দুন এক্সপ্রেস এই কিছুক্ষণ হল আমাদের নামিয়েছে হরিদ্বার স্টেশনে। হরিদ্বার এই নিয়ে আমার তৃতীয় বার। প্রথম এসেছিলাম তখন ২০০৬ সাল, সদ্য মাধ্যমিক দিয়েছি; সঙ্গে জেঠু ছাড়াও বাবা, মা ও দিদি ছিল। সেবারও এসেছিলাম এই দুন এক্সপ্রেসেই। কাজেই এবছর জুলাই মাসে জেঠু যখন বলল যে উপাসনায় টিকিট পাওয়া যায়নি, দুনেই যেতে হবে, তখন মন্দ লাগেনি। ন’বছর আগের দুন এক্সপ্রেসে যাত্রার অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করছিল।
এবছর আমরা চারজন। জেঠু, আমি আর আমার দুই বন্ধু অতনু ও শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ মুর্শিদাবাদের ছেলে, আমার কলেজের বন্ধু। আমার ছিল কেমিস্ট্রি আর ওর সংস্কৃত। সাবজেক্ট আলাদা হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়, তাই যখন কৃষ্ণকে বললাম পুজোয় কেদারনাথ যাচ্ছি ও আসবার জন্যে এক পায়ে খাড়া। অতনু হাওড়ার বাসিন্দা। ওর সাথে আলাপ বেড়ানোর সুত্রে, দুবছর আগে এই হরিদ্বারেই। ও পলিটেকনিকের ছাত্র। আমার কলেজ বিদ্যামন্দির, আর অতনুর কলেজ শিল্পমন্দির। বেলুড়মঠের দোরগোড়ায় আমাদের দুজনের কলেজ ছিল একদম পাশাপাশি। যদিও কলেজে পড়ার সময় কেউ কাউকে চিনতাম না। আরেক বন্ধু, রামকৃষ্ণ, ওরও আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষমুহুর্তে বাড়ির কিছু সমস্যায় পড়ে গিয়ে তার আর আসা হয়নি। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই রামকৃষ্ণের ফোন আসছিল, সশরীরে না আসতে পারলেও ওর মন পড়ে ছিল আমাদের সাথেই।
দুন এক্সপ্রেসের যাত্রার শুরুর দিকটা মন্দ হয়নি। ভোর হতে না হতেই গয়া, সকাল দশটায় বারাণসী। গঙ্গার উপর রেলের ব্রীজ পার হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল নবছর আগে প্রথমবার বারাণসী দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা। একে একে পেরিয়ে গেল অযোধ্যা, ফৈজাবাদ। দুন বেশ ভালোই ছুটছে, প্রায় রাইট টাইম। সমস্যাটা প্রথম দেখা দিল লক্ষ্ণৌয়ে। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে না ঢুকতেই অন্তত জনা পঞ্চাশেক যুবক উঠে পড়ল আমাদের সংরক্ষিত কামরায়। তাদের সে কি দাপট। অতনুকে তো নিজের জায়গা থেকেই তুলে দিল। গোটা কামরায় চরম বিশৃঙ্খলা, চিৎকার চেঁচামেচি। আমি খানিকটা ধাক্কাধাক্কি করেই আমার আর জেঠুর জায়গাটা দখলমুক্ত রাখলাম। কোথায় টিটি আর কোথায়ই বা জি আর পি?
ঘণ্টা খানেক বাদে টিটি এলো, যার কাছ থেকে যেমন পারল টাকা নিল, তারপর চলে গেল। খুব ইচ্ছা করছিল টিটিকে ঘা কতক দিই, কিন্তু লক্ষ্ণৌয়ের যুবকদের সংখ্যা আর চেহারা দেখে মনের রাগ মনে মনেই হজম করে নিলাম। বাকি রাতটা আমার আপার বার্থে আমি আর অতনু বসে রইলাম। সারারাত ধরে ভেবেছি হরিদ্বারে নেমেই স্টেশন মাষ্টারের কাছে টিটির নামে অভিযোগ জানাবো। কিন্তু হরিদ্বারে নেমে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরের সাথে মনটাও যেন জুড়িয়ে গেল, অভিযোগ করতে আর ইচ্ছা হলনা। হয়ত দেবভূমির প্রভাব, অথবা আমার তামসিকতা।
সূর্য উঠতে এখনও দেরি আছে, চারিদিক বেশ অন্ধকার। দূরে পাহাড়ের মাথায়, বেশ খানিকটা উঁচুতে, দেখা যাচ্ছে মনসা দেবীর মন্দির। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত। এখন নবরাত্রি চলছে, আজ দুর্গাষষ্ঠী, তাই হয়ত এত আলোর সাজ। স্টেশনের বাইরে থেকে অটোয় চাপলাম, গন্তব্য বিষ্ণুঘাটের রাজস্থান গেস্ট হাউস। হরিদ্বার শহরকে জেঠুর সেকেন্ড হোম বলা চলে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে প্রতি বছর আসছে, কোনও কোনও বছর একাধিকবার। আগে উঠত ভোলাগিরির ধর্মশালায়, এখন ওঠে রাজস্থান গেস্ট হাউস অথবা কালীবাড়ি গেস্ট হাউসে। দুটো গেস্ট হাউসের নাম আলাদা হলেও আসলে একটিই বাড়ির দুটো ভাগ, রিসেপশানও একজায়গাতেই। চেনা পরিচিতি থাকায় আগে থেকে ফোন করে বুকিং করা হয়নি, একেবারে গিয়ে হাজির হওয়া যাবে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, হরিদ্বার শহর এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি; তাই দেখতে দেখতে চলে এলাম বিষ্ণুঘাট। রাজস্থান গেস্ট হাউস ভরতি, কাজেই ঠাই হল কালীবাড়িতে। হাতমুখ ধুয়ে, জামা কাপড় পালটে, চলে এলাম গঙ্গার ঘাটে। সেই অতি পরিচিত বিষ্ণুঘাট, প্রবল স্রোতে উচ্ছলা গঙ্গা, হিমশীতল জল আর কুল কুল শব্দ। তখন সদ্য সূর্যোদয় হচ্ছে, লাল আলোয় ঝলমল করছে গঙ্গা। ওপাড়ে মাইল দুয়েক দূরে দেখা যাচ্ছে নীলপর্বত, যার মাথায় দেবী চণ্ডীর মন্দির।
আগের দুবারই চণ্ডী মন্দির দর্শনে গিয়েছি, প্রথমবার উড়ন খাটোলা অর্থাৎ রোপ ওয়েতে, দ্বিতীয়বারে পায়ে হেঁটে। এবারে সময় কম, তাই আর যাওয়া হবে না চণ্ডীপাহাড়ে। সেজন্য দূর থেকেই প্রণাম জানালাম মা চণ্ডীকে। কাল সকালেই রওনা দেব কেদারনাথের উদ্দেশ্যে। পথে ষোল কিলোমিটার চড়াই ভাঙ্গতে হবে। বাড়িতে থাকতে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তেমন একটা করা হয় না, তাই ঠিক করা হল চা খেয়েই ঘুরে আসব শহরের পাশেই, মনসা পাহাড়ে। মনসা দেবীর দর্শনও হবে আবার একটু ওয়ার্ম আপও হবে। মাইল খানেক পথে ছশো ফুট চড়াই উঠতে হবে, কেদারনাথের চড়াইয়ের কাছে এ কিছুই নয়, তবুও পাহাড়ের পথে হাঁটলেই মনে সাহস আসে, উতসাহ বাড়ে।
বিষ্ণুঘাটের পাশেই সবজিমণ্ডী, অর্থাৎ বাজার। সবজিমণ্ডীর পশ্চিমপ্রান্ত থেকে মনসা পাহাড়ে ওঠার পায়ে চলা পথ। শুরুতে খানিকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে তারপর পিচঢালা সুন্দর রাস্তা, মাঝে মধ্যেই পাশ দিয়ে হুস করে বেড়িয়ে যাচ্ছে স্কুটি, বাইক। রাস্তার ধারে ধারে বসে আছে অজস্র বাঁদর। অত্যন্ত ভালোমানুষের মত চাহনি, কিন্তু সুযোগ পেলেই প্রসাদের প্যাকেট ছিনিয়ে নিতে এরা অত্যন্ত নিপুন। আধঘন্টা একটানা হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথায়, মনসা মন্দিরে। নীচে কুয়াশা ঘেরা হরিদ্বার শহর, অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ভক্তের মনস্কামনা পুর্ণ করেন দেবী, নাম তাই মনসা। পুজো দিয়ে আমরাও আমাদের মনস্কামনা জানালাম। নির্বিঘ্নে কেদারনাথ পৌঁছানই তখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রার্থনা। পরে বুঝেছিলাম তিনি আমাদের সে প্রার্থনা শুনেছেন।
এবার নামার পালা। ফিরতি পথে একটানা উতরাই। শ্রম নেই, কোনও তাড়াও নেই। ধীরে সুস্থে নামছি, আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছি সকালের নরম রোদে ভেজা শিবালিক পর্বতকে, ধাপে ধাপে উত্তরদিকে উঠে চলেছে একটানা। সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে অনেক দূরের চূড়া দেখা যায়, বেলা বাড়লে কুয়াশা আর ধুলোকণার জন্য আর দেখা যায় না। রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে জড়িবুটি, আদা, বিভিন্ন ধরণের রঙ্গিন পাথর, কন্দমূল। কন্দমূল পাওয়া যাচ্ছে দশ টাকায় চার ফালি। রামচন্দ্র বনবাসের সময় নাকি এই কন্দমূল খেয়েই জীবনধারণ করতেন।
কন্দমূল খেতে খুব সুস্বাদু নয়, তবে একফালি খেলেই বেশ খানিকক্ষণের জন্য জল পিপাসার হাত থেকে ছুটি।
দ্বিতীয় পর্ব
মনসা পাহাড় থেকে নীচে নেমে এলাম যখন, তখন সবে সাড়ে আটটা। এই বিষ্ণুঘাট এলাকাটা হরিদ্বারের মধ্যে বাঙালিদের প্রধান আখরা। এখানে এলে মনেই হয়না পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আছি। মানুষের মুখের কথা থেকে দোকানের সাইনবোর্ড সর্বত্রই বাংলার ছড়াছড়ি। আসলে এখানের এই বাঙালি কেন্দ্রিক ব্যবসা গড়ে উঠেছে মূলত দুটো সংস্থার হাত ধরে। ভোলাগিরির ধর্মশালা, আর বলাই মুখার্জী প্রতিষ্ঠিত ‘দাদা-বৌদির হোটেল’।
এখন হোটেল, লজের বাড়বাড়ন্ত হলেও ভোলাগিরির ধর্মশালার চাহিদাও কম নয়। ‘দাদা-বৌদির হোটেল’ তো রীতিমত ব্র্যাণ্ড-নেম হয়ে গেছে। বিষ্ণুঘাটের চত্বরে কত যে দাদা-বৌদির হোটেল আছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। ‘আসল দাদা-বৌদির হোটেল’, ‘আসুন দাদা-বৌদির হোটেল’, ‘ডিলাক্স দাদা-বৌদির হোটেল’ আরও কত নাম। প্রত্যেকেই দাবি করে তাঁদের প্রতিষ্ঠানটিই আসল।
যদিও এদের নাম একরকম হলেও খাবারের মানে তফাত আছে। কাজেই ঠিক দোকানটি না চিনলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়া আছে মাসির হোটেল, মৌসুমী চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত। মাসির হোটেলের খাবার বেশ ভাল, সত্যিকারের দাদা-বৌদির হোটেলের মতনই। মনসা পাহাড়ে ওঠানামা করে খিদে পেয়ে গিয়েছিল বেশ, তাই মাসির হোটেলে লুচি তরকারি খেয়ে ব্রেকফাস্ট হল। তারপর খোঁজ পড়ল কালকের যাত্রার জন্য বাহনের।
প্রথমে ঠিক ছিল কাল ভোরে সোনপ্রয়াগ যাওয়ার প্রথম বাসেই যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু কালীবড়ির ম্যানেজার বাসে যাওয়ার কথা শুনে বলল আমরা যেহেতু চারজন রয়েছি, তাই বাসে না গিয়ে ছোটগাড়িতে গেলে ব্যাপারটা জমবে ভালো। কমখরচে ইন্ডিকা গাড়ির ব্যবস্থা সে-ই করে দেবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল পরের দিন সকাল সাড়ে ছটায় গাড়ি আসবে কালীবাড়ির সামনেই, পাঁচদিনের চুক্তি নেবে দশ হাজার টাকা। এখন অক্টোবরের শেষদিক, চারধাম (কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী) যাত্রার সিজন শেষের মুখে, তাই ভাড়া বেশ কমই।
গাড়ির ব্যবস্থা পাকা করে এবার বাকি রইল গঙ্গাস্নান। কনকনে ঠান্ডা জল, তায় প্রবল স্রোত, চেন ধরে সাবধানে ডুব দিতে হবে, তবুও হরিদ্বারে গঙ্গাস্নানের মতন তৃপ্তি আর কিছুতেই নেই। স্নান সেরে সোজা দাদা বউদির হোটেলে (আমরা আসল দোকানটা চিনতাম)। বেলা তখন মাত্র এগারোটা, কাজেই হোটেলে সেবেলা আমরাই প্রথম খরিদ্দার। দেরাদুন রাইসের ভাত, গাওয়া ঘি, ডাল, মুচমুচে বেগুনি, দুরকমের সুস্বাদু নিরামিষ তরকারি, চাটনি, পাঁপড়; ভরপেট খেয়ে নিলাম। তারপর হোটেলে ফিরে সোজা বিছানায়। গতকাল ট্রেনে ঘুম হয়নি মোটে কাজেই একঘুমেই বিকেল চারটে।
বিকালে হোটেল থেকে বেড়িয়ে প্রথমেই গেলাম শর্মাজেঠুর দোকানে চা খেতে। দাদা বউদির হোটেলের দুটো দোকান পরে, ভোলাগিরির ধর্মশালার ঠিক উল্টোদিকে। জেঠুর পুরোনো আলাপী। প্রথম দেখেছিলাম ২০০৬-এ, খুব হাসিখুশি অমায়িক ধরনের মানুষ, যদিও কথা বলেন কম। নবছর বাদেও আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছেন, কেদারনাথ যাব শুনে খুব খুশি। এটা সেটা কথার পর চা খেয়ে পা বাড়ালাম হর কি পৌড়ির দিকে।
তেলেভাজা, গাওয়া ঘি, ধূপ, কর্পূর, ও আরও কত না জানা বস্তুর গন্ধ মিলে মিশে হরিদ্বারের নিজস্ব একটা গন্ধ তৈরী করে। এই পড়ন্ত বিকালে হর কি পউড়ি পৌঁছানোর গলিপথ সেই গন্ধে ভরপুর। হর কি পউড়ি এখান থেকে হেঁটে মিনিট দশেকের পথ। কিন্তু পথে জেঠুর পরিচিতের সংখ্যা কম নয় তাই সময় লাগল প্রায় আধ ঘণ্টা।
হর কি পৌড়ি হল হরিদ্বারের প্রাণকেন্দ্র। এর উত্তর দিকে খানিক দূরে লকগেটের সাহায্যে গঙ্গার মূলস্রোত নীলধারা থেকে জলরাশিকে অনেকগুলো ক্যানেলের মধ্যে দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এই ক্যানেলগুলোর সবকটিই গঙ্গা নামে পরিচিত, কয়েকটি ধারা হরিদ্বার শহরের দক্ষিনপ্রান্তে গিয়ে আবার নীলধারায় মিশে গিয়েছে। কতগুলো ক্যানেল আর কোথা দিয়ে তাদের গতি এ ঠাহর করা হরিদ্বারবাসীদের কাছেও বেশ দুস্কর ব্যাপার। ক্যানেলগুলোর মধ্যে প্রধান যেটি তার নাম গঙ্গানহর।
এই গঙ্গানহরের তীরেই রয়েছে হরিদ্বারের নামকরা সব ঘাটগুলো। দক্ষিনে কনখলে বিবেকানন্দ ঘাট থেকে শুরু করে উত্তরে পরপর বিড়লা ঘাট, বিষ্ণুঘাট, রামঘাট, গৌঘাট, কুশাবর্ত বা কুশোঘাট, নেতাজী ঘাট (মুলায়ম নয় আমাদের সুভাষ বোসের নামেই) আর একদম শেষে হর কি পউড়ি। গঙ্গানহরের পশ্চিম তীরে মূল গঙ্গামন্দির। তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, ভগীরথের মন্দির, শঙ্কর মঠের মন্দির ও আরও অনেক অনেক মন্দির। গঙ্গানহরের বুকে সরু একফালি আইল্যান্ড, পশ্চিম তীরের সঙ্গে তিন চারটে সেতু দিয়ে যুক্ত। আইল্যান্ডের মাঝে রয়েছে ঘড়ি লাগানো একটি টাওয়ার, নাম বিড়লা টাওয়ার। গঙ্গামন্দিরের ঠিক সামনে আইল্যান্ড আর পশ্চিম তীরের মধ্যের অংশটুকুর নাম ব্রহ্মকুণ্ড। ব্রহ্মকুণ্ডেই হরিদ্বারের বিখ্যাত ‘গঙ্গা আরতি’ হয়, প্রতিদিন সন্ধ্যায়।
এখন ঘড়িতে সওয়া পাঁচটা, আরতি শুরু হবে আরও আধঘণ্টা পরে। এই সময়টুকু চুপ করে বসে রইলাম গঙ্গার তীরে। স্রোতের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মৃদু হয়ে আসে পাশের কোলাহল, দৃষ্টিপথে শুধু গঙ্গার স্রোত, একটানা চেয়ে থেকে ঘোর লেগে যায়। একসময় মনে হয় স্রোতের সাথে সাথে আমিও ভেসে চলেছি কোথায়। মনে পড়ছে কত পুরোনো কথা, সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি হরিদ্বারের কথা, জেঠুর কাছে, ঠাকুমার কাছে। ছেলেবেলায় ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর কথা যত না শুনেছি তার চেয়ে ঢের বেশী শুনেছি ‘হর-কি-পারির ঘাটের’ কথা, কেদার বদরীর কথা, গোমুখের পথে লালবাবার আশ্রমের কথা, সুন্দরডুঙ্গা উপত্যকার অদ্ভুত পাথরের কথা।
হিমালয়ের নেশা আমাদের পরিবারে নতুন নয়। চরম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটিয়েও ঠাকুমা পায়ে হেঁটে ঘুরে গেছে কেদার-বদ্রী, দুই জেঠু সারা জীবন ঘুরেছে হিমালয়ের পথে পথে। দুজনেই অকৃতদার। কাশ্মীর, হিমাচল, গাড়োয়াল, কুমায়ুন, নেপাল, হিমালয়ের কোন অংশ বাদ নেই। তাদেরই একজন এবার আমাদের সঙ্গী ও গাইড।
জেঠুর হিমালয় দেখা শুরু অমরনাথ দিয়ে, আঠাশ বছর বয়সে, তারপর প্রতি বছর এক দুবার করে হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছে। রূপকুণ্ড, সুন্দরডুঙ্গা উপত্যকা, পিণ্ডারি গ্লেসিয়ার, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, পঞ্চকেদার, সপ্তবদ্রী, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, হিমালয়ের অপরূপ সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে জীবন কাটিয়ে এই সত্তর বছর বয়সেও হিমালয় না এসে পারে না। জেঠুর মতে হিমালয়ের শ্রেষ্ঠ রূপ দেখা যায় এই গাড়োয়াল হিমালয়েই, তাই গাড়োয়ালের এক একটা তীর্থস্থানে একাধিক বার আসতে হয়। জেঠু শুধু কেদারনাথেই গিয়েছে এগারো বার।
আমি হরিদ্বার আগে দুবার এসেছি, কিন্তু হিমালয় দেখেছি উপর উপর। ওই দেরাদুন, মুসৌরি আর ঋষিকেশ। দূর থেকে দেখে নেওয়া হিমালয়, যেন পার থেকে সমুদ্র দেখার মতন। জলে নেমে চান করা এখনো বাকি রয়ে গেছে। হিমালয়ে অবগাহনের স্বাদ পাওয়ানোর জন্য জেঠু নিয়ে যেতে চেয়েছে অন্তত দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত, কিন্তু প্রতিবারেই নানা কারনে প্ল্যান বাতিল হয়েছে। সেজন্য এবার আমার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করে চলেছে সেই টিকিট কাটার পর থেকেই। এবারে হবে তো, পারব তো যেতে কেদারনাথে? সময় যত এগিয়েছে উত্তেজনা তত বেড়েছে। মা গঙ্গা যদি ইচ্ছা করেন, তবে কাল থেকে শুর হবে আমার হিমালয় স্নান।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় বয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ, আরতি শুরু হল বলে। গঙ্গার স্রোতে ভেসে চলেছে অজস্র দিয়া, কত না আশা আকাঙ্খার শিখা বুকে নিয়ে। মাইকে ঘোষণা হয় আরতির মাহাত্ত্য, প্রনামী চাইতে এগিয়ে আসে স্বেচ্ছা সেবক। তারপর সব কোলাহল বন্ধ হয়, গঙ্গামন্দির থেকে ভেসে আসে কাঁসর ঘণ্টার ধ্বনি। মাইকে বাজতে থাকে অনুরাধা পাড়োয়ালের কণ্ঠে গঙ্গা আরতির গান, ‘জয় গঙ্গে মাতা…’ বিশাল বিশাল প্রদীপের লকলকে শিখায় ব্রহ্মকুণ্ডের জল অগ্নিবর্ণ হয়ে ওঠে। একই লয়ে ও ছন্দে ঘুরতে থাকে সবকটি প্রদীপ। দূরে চণ্ডী মন্দির ও মনসা মন্দিরের পাহাড় চূড়া থেকেও ঘোরানো হয় আলো। রাজকীয় আয়োজনের সাথে মেলবন্ধন ঘটে স্বর্গীয় সুষমার, হরিদ্বারের এই গঙ্গা আরতিতে।
আরতি শেষ হয়, যে যার আস্তানায় ফিরে যায় ধীরে ধীরে। হর কি পৌড়ি ডুব নির্জনতায়, সন্ধ্যা তখন সাড়ে সাতটা। সেই নির্জন গঙ্গাতীরে বসে থাকি খানিক। শুধু গঙ্গার স্রোত আর কুলুকুলু শব্দ। তবে নির্জনতার আস্বাদ বেশীক্ষণ নিলে চলবে না, কাল সকালে যাত্রা শুরু, আজ সকাল সকাল শুয়ে পড়াটা খুব জরুরি।
তৃতীয় পর্ব
ঘুম ভাঙল তখন ভোর পাঁচটা। বেশ ঠান্ডা। পরের কয়েকটা দিন যেখানে থাকব সেখানে ঠান্ডা থাকবে আরও অনেক বেশি, স্নান হবেনাই ধরে নিতে হবে। কাজেই জেঠুর আদেশ মেনে সবাই ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে স্নান সেরে নিলাম। সাড়ে ছটায় গাড়ি আসবে, আমরা ছটার মধ্যে রেডি। সবার কাছে একটি করে পিঠব্যাগ। ব্যাগে একসেট করে জামা কাপড়, সোয়েটার, জ্যাকেট, উলিকটের ইনার, মাঙ্কি ক্যাপ আর নিজের নিজের একটি করে জলের বোতল। বাকি দেহ ঢাকনা, ব্যাগপ্যাক সব কালীবাড়ি লজের ক্লোক রুমে গচ্ছিত দেওয়া হল।
বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে অনেক রসিকতা চালু আছে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হল উলটো। আমরা রেডি সময়ের অনেক আগেই, কিন্তু বাহন আর এসে পৌঁছায় না। ঠায় সওয়া এক ঘণ্টা বসে রইলাম।
ভোরের হরিদ্বার, সামনেই মাসির হোটেলের উনুনে সবে চা চড়েছে। এক বাঙালি দম্পতি বেঞ্চে বসে আছেন, চায়ের অপেক্ষায়। ভদ্রলোকের গায়ে ফুল আঁকা বিছানার চাদর জড়ানো। ভদ্রমহিলা মহিলা জমিয়ে গল্প জুড়েছেন হোটেলের ছেলেটির সাথে, কলকাতার কথা, তাঁর পরিবারের কথা। এইসব দেখেশুনে সময় কাটছিল।
সওয়া সাতটার সময় গাড়ি এলো, সাদা রঙের ইন্ডিকা, বেশ ঝকঝকে নতুন। ড্রাইভারের বয়স বড়জোর তিরিশ, নাম রাজু। কপালে ছোট্ট তিলক, স্টাইলিশ বাঁকানো গোঁফ (দেখলেই বোঝা যায় যত্ন করে বানানো)। প্রথম কয়েকঘণ্টা মনে হয়েছিল বুঝি খুব কম কথা বলে রাজুদা, পরে দেখলাম এত বকবকে ড্রাইভার সচরাচর মেলেনা। সাড়ে সাতটায় দুগগা দুগগা বলে আর কেদারনাথের নামে জয় দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল।
গঙ্গানহরের পূর্ব পাড় ধরে উত্তরে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। হর কি পউড়ির পাশেই বিশাল শিবমূর্তি, বরাভয় মুদ্রায়। আমরা চলতি গাড়ি থেকেই মনে মনে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চললাম। প্রথম গন্তব্য ঋষিকেশ, হরিদ্বার থেকে দূরত্ব কুড়ি কিলোমিটার। রাস্তার উপর সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে কেদারনাথ ২৫৩ কিলোমিটার। হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ পর্যন্ত রাস্তা সমতল দিয়েই চলেছে। ডানদিকে গঙ্গা কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে চলেছে, বামদিকে মনসা পাহাড়ের সঙ্গী সাথীরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, ওদের একটা পোশাকি নাম আছে, মতিচুর রেঞ্জ। মতিচুর রেঞ্জ আসলে শিবালিক রেঞ্জেরই দক্ষিণভাগের একটা অংশ। আর আছে পথের দুদিকে গভীর অরণ্য, রাজাজী ন্যাশানাল পার্ক। এই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পাশাপাশি ছুটে চলেছে আমাদের রাস্তা আর হরিদ্বার থেকে দেরাদুনের রেলপথ। পথের ধারে ধারে সাইনবোর্ড ঝোলানো, ‘বুনোহাতির থেকে সাবধান’। এই জঙ্গলে নাকি প্রচুর হাতি আছে। তাই গাড়ি আর ট্রেন দুটোই চলে সতর্ক হয়ে ধীরে ধীরে।
আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা ঋষিকেশ। চন্দ্রভাগা নদীর ব্রীজ, মুনি কি রেতি পার হয়ে লছমন ঝোলাকে ডানহাতে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম ব্যাসীর দিকে। লছমন ঝোলা ও ঋষিকেশ, কৃষ্ণ-বাদে আমাদের সবার দেখা আছে আগেই। কাজেই ঠিক হল ফিরতি পথে কৃষ্ণকে লছমন ঝোলাটা দেখিয়ে নেওয়া হবে।
একটা কথা এখানে বলে নিই, হরিদ্বারের সব্জিমণ্ডী পার হতেই রাজুদা গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে আমাদের একটার পর একটা পুরনো হিন্দি গান শোনাচ্ছে। অধিকাংশই মহম্মদ রফির। গানের তালে তালে টুকটুক করে দুলে চলেছে রাজুদার মাথা; সঙ্গে আছে মাঝে মাঝেই স্টিয়ারিং ছেড়ে দুহাত নেড়ে ‘আহা’, ‘কেয়াবাৎ’, এইসব বলে ওঠা। বুঝলাম রাজুদা বেশ রসিক মানুষ। মাঝে অতনু একবার বলল, গান একটু বন্ধ রাখতে, যাতে করে হিমালয়ের নৈঃশব্দ্য অনুভব করা যায়। রাজুদা বলল গাড়ির মধ্যে থেকে তা অনুভব করা যায় না।
ঋষিকেশ পেরিয়ে আমরা আস্তে আস্তে হিমালয়ের গভীরে ঢুকতে শুরু করলাম। ঋষিকেশ থেকে ব্যাসী ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা। এই ৩৫ কিলোমিটারের প্রায় পুরোটাই রাস্তার ধারে বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোডিং। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের বিজ্ঞাপন। পুরাকালে ঋশিকেশের খ্যাতি ছিল তপোভূমি হিসাবে, মুনি ঋষিদের আবাসস্থল ছিল এই ঋষিকেশ। এখন ঋষিকেশ বিখ্যাত বিদেশী ‘ইয়োগী’ আর অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য। বাঞ্জি জাম্পিং, ফ্লাইং ফক্স, রিভার র্যাফটিং, ফরেস্ট ক্যাম্পিং কী নেই সেই তালিকায়। আমাদের গাড়ির আগে পিছে চলেছে রিভার র্যা ফটিং টিমের ভ্যান, তার মাথায় বাঁধা স্পিডবোট। এরই মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি সাইড করল রাজুদা।
অতনু হিমালয়ের নৈঃশব্দ্য অনুভব করতে চেয়েছিল, রাজুদা মনে রেখেছে সে কথা। এখানে রাস্তা গঙ্গার কিনারা থেকে খুবই কাছে, অর্থাৎ রাস্তা পাহাড়ের খুব একটা উপরে নয়। বাঁদিকে হিমালয়ের প্রাচীর, ডানদিক দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার সনাতনী ধারা। সেধারার কুলুকুলু শব্দ ছাড়া একটাও শব্দ নেই কোনদিকে। সামনে কিছটা আগে একটা তারের ঝোলা সেতু বেয়ে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে গঙ্গার ওপারে কোন পাহাড়ি গ্রামে। আমরা পাঁচজনেই চুপ, চোখে-কানে-হাতে-মুখে মেখে নিচ্ছি সকালের এই হিমালয়কে। রাজুদাই আবার তাড়া দিয়ে আমাদের গাড়িতে তুলল।
সকাল সাড়ে নটায় পৌছালাম ব্যাসী। এখানে আধঘণ্টা বিরতি। রাস্তার ডানদিকে, খাদের কিনারা ঘেঁসে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। তারই একটায় আমরা বড় বড় আলুর পরোটা, চানা মশলা, আলুর সবজি, আচার, টকদই সহযোগে বেশ ভারী ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। দুপুরের খাওয়ার জন্য এখন আর না ভাবলেও চলবে। দ্বাপর যুগে ব্যাসী ছিল মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাসের তপোস্থলী। এই ঘোরকলিতেও ব্যাসীতে বেদব্যাস বর্তমান, একটি শ্বেতপাথরের ব্যাসমূর্তিরূপে। তার দুটি হাত জড়ো করা, সেখান থেকে নেমে আসছে শীতল জলধারা। বেদব্যাস বর্তমানে তীর্থযাত্রীদের হাতে জল দিয়ে থাকেন।
ব্যাসী ছাড়িয়ে আমরা চললাম দেবপ্রয়াগের পথে। আঁকাবাঁকা পথ, ধীরে ধীরে চড়াইয়ের পথে উঠে চলেছে। পাহাড়ি পথে উঠলে প্রথমটায় কানে তালা ধরে যায়, ব্যাসী ছাড়াতেই আমার কানে তালা লেগে গেল। একটু যেন বমি বমি পেতে লাগল। একে ভরা পেট, তার উপর মিনিটে মিনিটে পথের বাঁক। অতনুর কাছে প্রচুর কাঁচা আমলকি ছিল, একটুকরো আমলকি মুখে দিতেই সব উপসর্গ বিদায় নিল।
হিমালয়ে অবগাহন বলতে যা ভেবেছিলাম তার স্বাদ এবার পেতে শুরু করলাম। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে অপেক্ষা করে রয়েছে বিস্ময়। একদিকে মাথা উঁচু করে রয়েছে হিমালয়ের অভ্রভেদী চূড়া, ডানদিকে অতল খাদ, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখানে হিমালয় সবুজে সবুজ। পাহাড়ের গায়ে নিরাবরণ পাথরের স্তর নেই বললেই চলে। গাছপাতার ফাঁক দিয়ে রোদের রশ্মি এসে পড়েছে পিচঢালা মসৃণ পথের উপর। কখনও কখনও পাহাড়ের গায়ে দূর অবধি দেখা যাচ্ছে রাস্তা, মনে হয় বুঝি এইতো ওই পাহাড়টার গায়ে কত আর দূর ? কিন্তু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছাতে হয়ত লেগে গেল পনেরো মিনিট।
পথের পাশে, পাহাড়ের গায়ে দুয়েকটা গুহা চোখে পড়ছিল। রাজুদা বলল ওই গুহাগুলোয় আগে মহাত্মারা থাকতেন। এই একশো বছর আগেও চারধাম যাত্রা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর, বিপজ্জনক। সাধারণত সাধু সন্ন্যাসীরাই এই পথে আসতেন। সংসারী মানুষ যারা আসতেন তারাও ফেরার আশা রাখতেন না। এই পথ ছিল মহাপ্রস্থানের। সেযুগের এইসব যাত্রীদের গাড়োয়ালের মানুষ মহাত্মা বলে থাকেন। ব্যাসী থেকে দেবপ্রয়াগ ৩৯ কিলোমিটার। বেলা সাড়ে দশটায় রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে বলল, দেবপ্রয়াগ সঙ্গমের ছবি তোল।
রাজুদা আমাদের দেখে বুঝেছিল যে আমরা শুধুমাত্র তীর্থযাত্রী নই। কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শন নিশ্চয়ই করব, কিন্তু আমাদের চোখের পিপাসা শুধু তাতে মেটার নয়। দুচোখ ভরে দেখব হিমালয়কে, মহাদেবের জটাকে। তাই পথের কোন মন্দিরে বা তীর্থস্থানে রাজুদা আমাদের নামতে বলেনি, কিন্তু অনেকবার চলতি পথ থেকে দুই-এক কিলোমিটার দূরেও নিয়ে গিয়েছে অসাধারণ সব দৃশ্য দেখাতে। রাজুদা জানত সঙ্গমের ঘাটে নেমে স্নান করার ইচ্ছা আমাদের খুব একটা নেই, আমরা চাই সঙ্গমের মুগ্ধকরা দৃশ্যে দুচোখকে ধুয়ে নিতে।
গাড়ি থেকে নেমে ডানদিকে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম দেবপ্রয়াগের অপার সৌন্দর্যে। বাঁদিক থেকে ভাগীরথী, ডানদিক থেকে অলকানন্দা এসে মিলেছে দেবপ্রয়াগ সঙ্গমে। মাঝখানে ত্রিভুজাকার পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট শহর দেবপ্রয়াগ। ত্রিভুজাকার পাহাড়টা সবুজে সবুজ। তার পিছনে দেখা যাচ্ছে দূরের দূরের নীল রঙের সব পাহাড়চূড়া, একটার পর একটা। ভাগীরথীর জল খানিক ঘোলা, অলকানন্দার জল সবুজাভ।
সঙ্গমে দুই নদীর জলের বিভেদ স্পষ্ট। এই সঙ্গমেই উৎপত্তি পতিতপাবনী গঙ্গার। (গঙ্গোত্রী থেকে ভাগিরথীর উৎপত্তি, দেবপ্রয়াগে ভাগীরথীর সঙ্গে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলিত ধারা একত্রে অলকানন্দা নামে মিশে গঙ্গার সৃষ্টি করেছে)। চারজনে মুগ্ধ হয়ে দেখেই চলেছি দেবপ্রয়াগ, কানে আসছে দুই ধারার মিলনের গমগমে আওয়াজ। কেটে গেল কতক্ষণ… রাজুদার ডাকে চটক ভাঙল। এখনও প্রায় ১৩২ কিলোমিটার রাস্তা গেলে তবে পৌছাব আজ রাতের আশ্রয় রামপুরে। কাজেই চরৈবেতি।
চতুর্থ পর্ব
ঋষিকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত আমাদের রাস্তার বামপাশে ছিল হিমালয়ের প্রাচীর, ডানপাশে খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা। এখন আমরা চলব ডানদিকে অলকানন্দাকে রেখে। এইভাবে আরও ২৮ কিলোমিটার চলে কীর্তিনগর। কীর্তিনগরে এসে পুল পেরিয়ে অলকানন্দাকে বামহাতে রেখে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম শ্রীনগর। কাশ্মীরের নয়, এই শ্রীনগর গাড়োয়ালের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যনগরী। বিশাল মার্কেট, স্কুল, কলেজ ছাড়াও রয়েছে আর্মি ট্রেনিং অ্যাকাডেমি। আমরা চলতি গাড়ি থেকেই শ্রীনগর দেখে নিলাম, থামার কোন প্রশ্নই নেই।
শ্রীনগর ছাড়াতেই হিমালয়ের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেল। পাহাড়ের গা সবুজে সবুজ, বনে বনে নিবিড়। মাঝে মাঝে নেমে এসেছে দুএকটা ঝর্না। কোথাও কোথাও পাথুরে পথ চড়াই ভেঙে উঠে গেছে কোন পাহাড়ি গ্রামে। সেই পথ বেয়ে কাঠের বোঝা নিয়ে উঠে চলেছে পাহাড়ি মেয়েরা। বাঁদিকে অলকানন্দার সবুজ স্রোত। শ্রীনগর থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ৩৩ কিলোমিটার। মাঝে দুটি বড় জনপদ পড়ে, কালিয়াসৌর ও অগস্তমুনি। কালিয়াসৌরে এসে রাজুদা আমাদের শোনাল ধারিদেবীর কথা।
ধারিদেবীকে বলা হয় উত্তরাখণ্ডের চারধামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ধারণকারিণী অর্থে ধারি। দেবীকে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল অলকানন্দার গর্ভে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী প্রাপক ব্রাহ্মণ অলকানন্দার নদীগর্ভেই তাঁর আরাধনার প্রচলন করেন। কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নেয় নদীগর্ভ থেকে দেবীকে তুলে এনে শহরের মধ্যে ভব্য মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই তাঁর পূজা অর্চনার ব্যবস্থা করতে। স্থানীয় মানুষ প্রথমে বাধা দেয়, কারণ জনশ্রুতি বলে যে ধারিদেবীকে তাঁর নিজের জায়গা থেকে সরালেই বিপর্যয় নেমে আসে (১৮৮২ সালে এইরকম চেষ্টা করা হয়েছিল, সেসময় নাকি প্রবল ধসের শিকার হয় উত্তরাখণ্ড)। যাইহোক, বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে ২০১৩ সালের ১৬ই জুন সন্ধ্যার সময় দেবীকে তাঁর আদি মন্দির থেকে সরানো হয়। ১৭ই জুন প্রলয়ঙ্কর বন্যা ধ্বংস করে দেয় কেদারনাথ উপত্যকা। এরপর আবার দেবীকে ফিরিয়ে আনা হয় তাঁর আদি মন্দিরে। বাড়ি ফিরে নেট সার্চ করে দেখেছিলাম রাজুদার গল্প সত্যি।
অগস্ত্যমুনির কিছুটা আগে পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরেই আমার বুক শুকিয়ে গেল। সামনে প্রায় আধমাইল রাস্তা ভয়াবহ ধসের শিকার। মাথার উপরে মাটির পাহাড়, ধুলোয় ভর্তি, দেখলেই মনে হয় এই বুঝি ধসে পড়বে। এই জায়গাটার নাম সিরোবাগাড়। রফির গান বন্ধ হল এই প্রথম। রাজুদা বলল, ‘কেউ কথা বলবেন না, সাবধানে চলাতে হবে গাড়ি’।
সাধারনত দুধরণের পাহাড় থেকে ধস নামার সম্ভাবনা বেশি। একটা হল এইরকম মাটির পাহাড়, বা চুনাপাথরের পাহাড়, এর মাটির রঙ সাদা। দেখলেই বোঝা যায় অত্যন্ত নরম। সিরোবাগাড়ের পাহাড় এই ধরনের। আরেকধরনের ধস প্রবণ পাহাড়কে বলা যায় ‘খাজা-পাহাড়’। পাথুরে পাহাড়, কিন্তু দেওয়ালের গায়ে স্তরে স্তরে পাথর যেন ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেওয়া রয়েছে, খাজার মতন অনেকটা। এই পাহাড় দেখলেই মনে হয় এইবুঝি হুড়মুড় করে নেমে আসবে, যেমন অগোছালো বইয়ের তাক থেকে বই পড়ে যায় হুড়মুড় করে।
ন’বছর আগে যেবার প্রথম হরিদ্বার এসেছিলাম সেবার ঋষিকেশ থেকে একটু দূরে পাহাড়ের মাথায় নীলকণ্ঠ মহাদেবের দর্শন করতে গিয়েছিলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ, একটা বাঁক ঘুরেই গাড়ি দাড়িয়ে গেল। সামনেই ঝলমলে পেখম নিয়ে চড়ে বেড়াচ্ছে ময়ূর। আগে পড়ে অনেক ময়ূর দেখেছি, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দেখা সেই ময়ূরের তুলনা খুজে পাইনি। যাইহোক, এই নীলকণ্ঠ মহাদেবের মন্দিরে পৌঁছনোর রাস্তার অধিকাংশটাই এইধরনের খাজা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে। একদিকে খাদ, একদিকে মাথার উপর অবধি ঝুলে আছে খাজা পাহাড়ের পাথরের স্তর। রাস্তার অবস্থা তথৈবচ। প্রায় গোটা রাস্তা ত্রাহি মধুসূদন করতে করতে যেতে আসতে হয়েছিল। সিরোবাগাড়ের ধস দেখে সে স্মৃতি আরেকবার ঝলসে উঠল।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ধসের এলাকা ছাড়িয়ে গেছি অনেকক্ষণ, পার হয়ে গেছি অগস্ত্যমুনি নামের ছোট্ট পাহাড়ি শহর। রুদ্রপ্রয়াগ আর মাত্র মাইল সাতেক। রুদ্রপ্রয়াগের যত কাছে এগিয়ে চলেছি বাঁদিকের অলকানন্দার দিকে তাকালে ততই দু’বছর আগের সেই প্রলয়ের চিহ্ন খুজে পাচ্ছি বেশী করে। বিশাল বিশাল বোল্ডার, নদীর খাতে দুএকটা বাড়ির ভাঙ্গা অংশ। রুদ্রপ্রয়াগের ঠিক আগেই একজায়গায় দেখলাম রাস্তা নতুন করে তৈরি চলছে। বাঁদিকে খানিক নীচে পুরনো রাস্তার ধ্বংসাবশেষ।
রুদ্রপ্রয়াগ দুই যুগে দুই বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পৌরাণিক যুগে এই রুদ্রপ্রয়াগেই রুদ্রনাথ মহাদেব সৃষ্টি করেছিলেন রাগ রাগিণীর। পরবর্তীকালে দেবর্ষি নারদও এই রুদ্রপ্রয়াগেই তপস্যায় তুষ্ট করে আশুতোষ শিবের কাছে সঙ্গীতের জ্ঞান লাভ করেছিলেন বলে কথিত আছে। এযুগে রুদ্রপ্রয়াগ বিখ্যাত জিম করবেটের জন্য।
ভারতপ্রেমী সাহেব জিম করবেট এই রুদ্রপ্রয়াগেই মানুষখেকো লেপার্ড মেরেছিলেন ১৯২৬ সালে। লেপার্ডটি মরার আগে অন্তত ১২৫ জন মানুষ মেরেছিল বলে শোনা যায়। জিম করবেটের লেখা ‘দি ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ অথবা মহাশ্বেতা দেবীর অনুবাদ করা ‘রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতা’ পড়েনি এমন লোক বিরল। এককালে করবেটকে গাড়োয়ালের মানুষ দেবতার মতন ভক্তি করত। সঙ্গমের থেকে মাইল খানেক আগেই যে জায়গাটায় লেপার্ডটাকে মেরেছিলেন করবেট, সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করে দিয়েছিল সরকার। সেটা দেখার ইচ্ছা ছিল খুব, রাজুদাকে জানালাম সেকথা। আমাদের অবাক করে দিয়ে রাজুদা বলল স্মৃতিস্তম্ভের কথা তো দূরের কথা, ও নাকি জিম করবেটের নাম শুনল এই প্রথম। একটু খারাপ লাগল, গাড়োয়ালের লোকের জিম করবেটকে ভুলে যাওয়া দেখে।
রুদ্রপ্রয়াগ পৌছালাম তখন বেলা একটা বাজতে চলেছে। রুদ্রপ্রয়াগে অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদীর সঙ্গম। রাস্তাও এখানে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মন্দাকিনীর তীরে তীরে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে কেদারনাথের পথে। অলকানন্দার ধার বরাবর আরেকটা রাস্তা চলে গিয়েছে বদ্রীনাথ।
আমরা অলকানন্দা নদী পেরিয়ে ঢুকে গেলাম একটা পাহাড়ি সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতেই আমাদের সামনে প্রথমবারের জন্য এলো মন্দাকিনী। ঠিক যেন উচ্ছলা, খামখেয়ালি এক কিশোরী। ভাগীরথীর স্নেহ সুশীতল ছায়া নেই তার বুকে, নেই পুর্ণযৌবন অলকানন্দার স্থৈর্য। মন্দাকিনীর পরিচয় তার দ্রুত লয়ের নৃত্যে, দুধ-সাদা অমৃতধারার চোখ-ঝলসানো রূপে, তার নবযৌবনের অহঙ্কারে, তার হঠাৎ রেগে ওঠায়, আবার হঠাৎ গলে জল হয়ে যাওয়ায়। তার প্রচণ্ড রাগে অথবা অভিমানে দুবছর আগেই কেঁপে গিয়েছিল কেদারনাথ উপত্যকা সহ গোটা উত্তরাখণ্ড রাজ্যটা, তার স্মৃতি দুদিকে চোখে পড়ছে হরবকত। তবুও আমি বলতে বাধ্য, প্রথম দর্শনেই মন্দাকিনীকে ভালবেসেছি। পরের দুটো দিনে এই ভালোবাসা বেড়েছে আরও।
রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গম এই সময় আমাদের দেখা হলনা। রাজুদা কথা দিল ফেরার পথে সঙ্গম দেখার ব্যবস্থা করবে। কথা রেখেছিল রাজুদা। ফিরতি পথে মূলরাস্তা থেকে প্রায় দুমাইল উজিয়ে পাহাড়ের অনেকটা উপর থেকে আমাদের দেখিয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগের সঙ্গম। গোধূলির পড়ন্ত আলোয় দেখেছিলাম অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলন, সারাজীবন মনে রাখার মতন সে দৃশ্য।
যাইহোক, এখন আমাদের গাড়ি চলেছে মন্দাকিনীকে বাঁহাতে রেখে। এভাবে যাবে আরও ৩৫ কিলোমিটার, কুণ্ড চটি পর্যন্ত। সেখান থেকে মন্দাকিনী চলে যাবে আমাদের ডানদিকে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পথের দৃশ্য বেশ খানিকটা বদলে গেছে। গাছপালার সংখ্যা অনেক বেশী। বেশিরভাগ জায়গায়ই মনে হচ্ছে সুপরিকল্পিত কোনও বনপথ দিয়ে আমরা চলেছি। একটা বিষয়ে উত্তরাখণ্ড সরকারের প্রশংসা না করলেই নয় (পরে দেখেছি হিমাচল প্রদেশের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি) সেটা হল রাস্তা ঠিক রাখার ব্যাপারে এদের আন্তরিকতা। এসব জায়গায় প্রায় রোজ কোথাও না কোথাও ধস নামেই, কিন্তু গোটা যাত্রাপথে দেখেছি অগুনতি ক্রেন, বুলডোজার, আর ঝাড়ু ও গাইতি হাতে অসংখ্য কর্মী। এদের মিলিত চেষ্টায় এই দীর্ঘপথের প্রায় পুরোটাই যাকে বলে ঝাঁ চকচকে, তাই। দ্বিতীয়ত আমাদের রাজ্যে যেখানে একটা জলের কল স্থাপন হলেও পাড়ার পার্টি সদস্য থেকে মুখ্যমন্ত্রী সবার করুণার কথা বড় বড় হোডিং করে লেখা থাকে এখানে সেরকম দৃশ্য তো নেই, উপরন্তু রাস্তার ধারে প্রায়শই লেখা রয়েছে, ‘ধন্যবাদ দেবেন না’ (অর্থাৎ ভাবখানা এই যে, পরিষেবা দেওয়া আমাদের কর্তব্য)।
ইতিমধ্যে, অতনু আর কৃষ্ণ জেঠুকে ধরল কেদারনাথের গল্প বলতে। আমি এই গল্প শুনেছি অনেকবার, সেই ছোট্টবেলা থেকে, তবুও জেঠুর মুখে গল্প শোনার আনন্দই আলাদা। সামনের সিটে বসে আমিও শুনতে লাগলাম সেই গল্প।
পঞ্চম পর্ব
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর জ্ঞাতিহত্যার পাপ স্খালন করতে পাণ্ডবেরা তীর্থদর্শনে বেরলেন। বিভিন্ন তীর্থ দর্শনের পর তারা এসে পৌঁছালেন কাশীতে। সত্যদ্রষ্টা যুধিষ্ঠির কিন্তু জানতে পারলেন বিশ্বনাথ শিব তাঁদের দেখা দেবেন না বলে হিমালয়ে আত্মগোপন করেছেন। অগত্যা পাণ্ডবেরা হরিদ্বারের পথে এসে হিমালয়ে খুজে বেড়াতে লাগলেন কাশীশ্বর বিশ্বনাথকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যুধিষ্ঠির জানতে পারলেন গুপ্তকাশিতে বিশ্বনাথ এক বৃষের ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছেন। পঞ্চপাণ্ডব সেই বৃষের পিছনে ধাওয়া করল।
গৌরীকুণ্ডের কাছে এসে মধ্যম পাণ্ডব ভীম দেখলেন তাঁদের এড়ানোর জন্য সেই বৃষ মাটিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ভীম ছাড়বার পাত্র নন। জাপটে ধরলেন সেই বৃষকে। তারপর তার লেজ ধরে চলতে লাগল টানাটানি। এই টানাটানির ফলে মাটি বিদীর্ণ হয়ে উঠে এলো বৃষরূপী মহাদেবের দেহ। সেই বৃষের পিঠের কুজ রইল কেদারনাথে, জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে। তাই কেদারনাথের শিবলিঙ্গ দেখতে বৃষের পিঠের কুজের মতন। বৃষের নাভি প্রকাশিত হল মধ্য-মহেশ্বর বা মদ মহেশ্বর রূপে। দুহাত প্রতিষ্ঠিত হল তুঙ্গনাথে। মুখ রুদ্রনাথে, ও জটা প্রকাশিত হল কল্পেশ্বরে। কেদারনাথ, মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর এই পাঁচ তীর্থস্থান নিয়ে হল পঞ্চকেদার।
গল্প শুনতে শুনতে চলে এসেছি অনেকটা পথ। একটা লোহার সেতু পেরিয়ে আমরা পৌছালাম কুণ্ডচটিতে। এখন থেকে মন্দাকিনী আমাদের ডানদিকে। পথে পেরিয়ে এসেছি আরও একটা অগস্ত্যমুনি নামের জনপদ, এবং সৌড়ি নামের পাহাড়ি শহর। মন্দাকিনীর ঠিক ওপারে রয়েছে আরেকটি শহর। নাম উখিমঠ। উখিমঠ থেকে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে চোপ্তা হয়ে গোপেশ্বরে। যারা কেদারনাথ থেকে সরাসরি বদ্রীনাথ যায়, তারা এই পথে গোপেশ্বর হয়ে বদ্রীনাথের মূলপথে ওঠে। এছাড়া চোপ্তা থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছানো যায় তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথে।
চোপ্তাভ্যালি অসাধারণ সুন্দর, একে গাড়োয়ালের সুইজারল্যান্ড বলা হয়। সবুজ ঘাসের গালিচা বেছানো বুগিয়াল, ইতিউতি ছড়িয়ে আছে গোল্ডেন রোডডেন্ড্রন গাছ। দূরে দেখা যায় চৌখাম্বা, নন্দাদেবী, ত্রিশুল, সুমেরু, বন্দরপুছ, নীলকণ্ঠ প্রভৃতি চিরতুষারমণ্ডিত হিমালয়শৃঙ্গের প্যানোরমিক ভিউ। উখিমঠেই আছে বিখ্যাত ওঙ্কারেশ্বর মন্দির। শীতকালে তুষারপাতের জন্য যে চার-পাঁচ মাস পঞ্চকেদারের পূজা তাঁদের নির্দিষ্ট স্থানে হতে পারে না, সে সময় তাঁদের পূজা হয় এখানে। ফেরার পথে আমরা দেখে নিয়েছিলাম উখিমঠ ও চোপ্তা। উখিমঠ থেকে দেখা চৌখাম্বা পিকের দৃশ্য ভোলার নয়।
কুণ্ড থেকে গুপ্তকাশী মাত্র সাত কিলোমিটার, পৌছালাম যখন তখন বেলা প্রায় দু’টো। রুদ্রপ্রয়াগ ছাড়ানোর পর থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। গুপ্তকাশী পৌঁছে দু এক ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করল। খানিক বাদেই বেগ বাড়ল বৃষ্টির। রাজুদা বলল উপরে (অর্থাৎ, গৌরীকুণ্ড কেদারনাথ ইত্যাদি জায়গায়) মৌসম আরও খারাপ হবে। আমরা তখন গায়ে জ্যাকেট জড়াতে ব্যস্ত। এমনসময় রাজুদা করল কি, গাড়ির সবকটা জানালার কাচ নামিয়ে দিল। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে পড়তে লাগল আমাদের গায়ে। তারপর ওরই কথায় ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের গায়ে এসে পড়ছে খুব ছোট ছোট বরফের কুচি। তুষারপাত বলা যায় না একে, আবার শিলও নয়। সে যাই হোকনা কেন, প্রথমবার বরফের ছোঁয়া পেয়ে আমাদের আনন্দ তখন বাঁধভাঙা। রাজুদার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠলাম, ‘জয় সিয়ারামকী’।
পথে পড়ল কালিমঠ, এখান থেকেই দ্বিতীয় কেদার মদমহেশ্বর যাওয়ার রাস্তা। কালিমঠ পেরিয়ে এলাম নালাচটিতে। একটা পাহাড়ি ঝর্নার ধারে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের কোলের নিবিড় স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম খানিক। বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে।
নালার পরবর্তী চটির নাম ফাটা। এই ফাটা চটি থেকেই কেদারনাথ যাওয়ার হেলিকপটার যাতায়াত করে। ভাড়া যাতায়াতের ৭০০০ টাকা মতন, একপিঠ বোধহয় ৫০০০ টাকা। আমরা যাব পায়ে হেঁটে কাজেই হেলিকপ্টারের ভাড়া নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। তবে ফাটায় আমাদের একটা জরুরি কাজ করে নিতে হল। ২০১৩র বন্যার পর থেকে কেদারনাথ যাত্রার সময় বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশান করা ও মেডিকেল চেক আপ করে ছাড়পত্র নিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক। ফাটাতে আমাদের এইকাজটা সেরে নিতে হবে।
আমার, অতনুর আর কৃষ্ণর ছাড়পত্র মিলে গেল সহজেই। সমস্যা হল জেঠুকে নিয়ে, তার বয়স সত্তর, আর প্রেসার একটু হাই। কাজেই ডাক্তার কিছুতেই তাকে ফিট সার্টিফিকেট দিল না। আমরা বোঝালাম যে জেঠু এর আগে অনেকবার কেদারনাথ এসেছে, এবং এখনো নিয়মিত প্রতি বছর ট্রেক করে; জেঠু আমাদের তিনজনের থেকে অনেক বেশি ফিট। কিন্তু ডাক্তার নাছোড়বান্দা। শেষপর্যন্ত প্রেসারের গুটিকয় ওষুধ দিয়ে ডাক্তার বলল এই ওষুধ খেয়ে কাল সকালে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে আরেকবার প্রেসার চেক করে নিলে ছাড়পত্র মিলতে পারে। কি আর করি, আমরা কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়েই রওনা দিলাম রামপুরের দিকে। কেদারনাথ দর্শনে এসে এই প্রথম আমরা ধাক্কা খেলাম একটা।
ফাটা থেকে রামপুর ১০ কিলোমিটার। রামপুরের মূল জনপদ ছাড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে বেশ নির্জন একটা জায়গায় রাজুদা গাড়ি থামাল। সামনে একটা ছোটখাটো থাকার জায়গা, নিউ শিবশক্তি লজ। ঘড়িতে তখন বেলা তিনটে। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে তখন, ব্যাসীর সেই আলুর পরোটা যেন অন্য কোন জন্মের কথা। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ভাত, রুটি কিচ্ছু পাওয়া যাবে না এখন। কেক, বিস্কুট আর চা পাওয়া যেতে পারে। খিদের মুখে যা পাই তাই সই। খেয়ে দেয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে আমরা ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। লজের প্রবেশপথ তিনতলায়। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে থাকার জায়গা দোতলায় ও একতলায়। আমরা একতলায় ঘর নিলাম। ঘরের সামনে ব্যালকনি, সামনেই মন্দাকিনীর নদীখাত।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই যা দেখলাম তাতে আমাদের কারও মুখে কথা সরেনা। সামনেই গভীর খাত, তার পর তিনটে পাহাড়চূড়া। খাদের দুইপারের পাহাড়ের গা বনে বনে নিবিড়। আর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনীর দুধসাদা জলধারা। তার তীব্র গর্জনে এতদূর থেকেও নিজেদের কথাও শোনা দায়। সেদৃশ্য বর্ণনা করার সামর্থ্য ঈশ্বর আমায় দেন নি।
ঘরে ঢুকেও মনটা আরেকবার খুশি হয়ে গেল। বেশ তোফা ব্যবস্থা। তুলতুলে গদি, নতুন কম্বল, গরম জল, পর্যাপ্ত প্লাগপয়েন্ট আর কি চাই। লোডশেডিং হলে এমার্জেন্সি চার্জার লাইটের ব্যবস্থাও নাকি আছে। সবচেয়ে অবাক হলাম এয়ারটেলের সার্ভিস দেখে। কলকাতায় উঠতে বসতে গালি দিই এয়ারটেলকে। কিন্তু যখন দেখলাম এখানে এয়ারটেল ৩জি সুন্দর স্পিড দিচ্ছে তখন সত্যি সত্যিই আনন্দ হল। কয়েকটা ছবি তুলে ফেসবুকের মাধ্যমে পৌঁছে দিলাম বন্ধুদের কাছে। বেলা চারটের সময় ঠিক করলাম যেহেতু কাল অনেক হাঁটাহাঁটি আছে, তাই বিকালে অল্প খানিকটা হেঁটে রামপুরের আশপাশটা দেখে নিলে হয়।
চারজনে বেরোলাম রামপুর এক্সপ্লোর করতে। এতো আনন্দের মধ্যেও একটা দুশ্চিন্তা কাঁটার মতন গলায় বিঁধে ছিল। জেঠুকে কালও যদি ছাড় না দেয় তবে কি হবে? আমাদের এতো স্বপ্ন, এত পরিশ্রম সব কি আটকে যাবে?
উত্তরটা দিল জেঠু নিজেই। জেঠু আর চেক আপ করাবে না। কিন্তু এতোদুর এসে আমরা ফিরেও যাবনা। আমাদের তিনজনকে কেদারনাথ যেতে হবে নিজেদেরই, জেঠুকে ছাড়াই। আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু কৃষ্ণ ও অতনুর বাড়ি থেকে ওদের এই ট্রেকের অনুমতি দিয়েছে শুধুমাত্র জেঠুর উপর ভরসা করেই। ২০১৩য় বন্যার পর ২০১৪য় নতুন রাস্তা প্রথম খোলে, কিন্তু একবছর পরও সে রাস্তার হাল নিয়ে দুশিন্তার যথেষ্ঠ কারণ আছে। তাছাড়া কৃষ্ণ এই প্রথম এসেছে পাহাড়ে। অতনু আর আমি হিমালয়ে আগে এলেও ট্রেকিংএর অভিজ্ঞতা বলতে মনসা পাহাড় আর চণ্ডীপাহাড়। কেদারনাথের ১৬ কিলোমিটার ট্রেকের কাছে তার কোন তুলনাই চলে না। তাই জেঠু যে এত সহজেই আমাদের একা একা যাওয়ার পারমিশান দিয়ে দেবে সেটা ভাবিনি। যাইহোক, এখন খানিকটা হলেও নিশ্চিন্ত। ঠিক করা হল ফিরে আসার আগে কেউ বাড়িতে ঘুণাক্ষরেও বলবনা যে জেঠু আমাদের সঙ্গে যায়নি।
নিউ শিবশক্তি লজ থেকে দক্ষিন পুর্বে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রামপুর গ্রাম। এই পথটুকু আমাদের সঙ্গে আসতে লাগল কয়েকটা পাহাড়ি কুকুর। লোমশ, লাল-কালো গায়ের রঙ, তাগড়াই চেহারা। গলায় বকলসের জায়গায় একটা করে মোটা লোহার পাত পরানো রয়েছে। পরে রাজুদার কাছে শুনেছিলাম এই কুকুরগুলো অনেকসময়ই দলবেঁধে চিতাবাঘের সাথে লড়াই করে। চিতা যাতে গর্দানে কামড় দিতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
রামপুর গ্রামে ঢুকতেই অনেকগুলো লজ। তারই একটার নাম শিবশক্তি লজ (আমরা যেটিতে উঠেছি সেটি ‘নিউ শিবশক্তি লজ’)। তার নিচে একটা চায়ের দোকান। দোকানীর বয়স ৯০ ছাড়িয়েছে। রাজুদা আমাদের এর কথা আগেই বলেছিল। এর নাম ছোটিয়া সিং রাওয়াত। এর দুই ছেলে, দুজনেরই হোটেলের ব্যবসা। ছোটছেলের লজে উঠেছি আমরা, বড়ছেলের লজের নিচেই এই চায়ের দোকান। যদিও ছোটিয়াজী এদের কারোর লজেই থাকে না। সে এই ৯০ বছর পার করে দিয়েও রোজ ৬-৭ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ভেঙে তার গ্রামের বাড়ি থেকে যাতায়াত করে। বুড়ো সদাহাস্যময়। আমাদের সাথে আলাপ হতেই প্রত্যেকের হাতে এককাপ করে চা ধরিয়ে দিল। মোষের দুধের চা, এককথায় অপূর্ব তার স্বাদ।
চা খেতে খেতে দেখছিলাম রাস্তার ঠিক উলটো দিক থেকে পাথর দিয়ে বাঁধানো চড়াই পথ উঠে গেছে সামনের পাহাড়ি গ্রামে। গ্রামের মাঝামাঝি একটা বাড়িতে রঙ্গিন কাপড় টাঙিয়ে তাঁবুর মতন কিছু একটা তৈরি করেছে, রঙবেরঙের পোশাক পরে নারী পুরুষেরা দল বেঁধে চলেছে সেখানে। ছোটিয়াজীর নাতি ছিল পাশেই, সে বলল ওই গ্রামে আজ বিয়ে আছে। গ্রামে পৌঁছানোর চড়াই পথ দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেদারনাথজীর পথে কি এইরকম চড়াই’? সে হেসে বলল, ‘এরচেয়ে অনেক বেশি’। আমার ইচ্ছা হল এই পথ বেয়ে গ্রামে যাই, চড়াই ভাঙার অভ্যাসও হবে খানিক, আবার বিয়েবাড়িটাও দেখা হবে। ছোটিয়াজী শুনে বলল গ্রামে গিয়ে কাজ নেই, বরং এখান থেকে মাইল খানেক দূরে আছে দুর্গামন্দির। আজ মহাসপ্তমী, কাজেই মায়ের দর্শন করে এলেই ভালো। প্রস্তাবটা সবারই মনে ধরল।
ছোটিয়াজীর নাতি আমাদের খানিকদুর এগিয়ে এসে পথ দেখিয়ে দিল। মূল রাস্তা ছেড়ে মাইল খানেক পথ। আকাশ মেঘলা ছিলই, পাহাড়ি পথে আধমাইলটাক যেতে না যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। পড়িমরি করে দৌড়ে সামনে একটা চালাঘর দেখতে পেয়ে আমরা তাতে আশ্রয় নিলাম। এদিকে বৃষ্টি ছাড়ার নাম নেই। যত সময় যায় ততই তার বেগ বাড়ে। এর সঙ্গে শুরু হল তুমুল বজ্রপাত। আমরা ভয়ে জড়সড়, বিশেষ করে আমার আবার বাজ পড়ায় বেশ আতঙ্ক আছে। আধঘণ্টা কেটে গেলো, আবহাওয়ার কোন উন্নতি নেই। পাশের পাহাড়ের গায়ে বাজ পরে ধোঁয়া উড়তে দেখলাম। প্রাণপনে দুর্গতিনাশিনীকে ডাকছি। বাজ পড়া একটু কমতেই বরফকুচি পড়া শুরু হল। সেকি বরফ, দেখতে দেখতে মাটির উপরে সাদা বরফকুচির আস্তরণ পরে গেল।
ষষ্ঠ পর্ব
তখন সন্ধ্যা হয় হয়, দূরের পাহাড়চূড়ার কাছে আগুনে রঙের মেঘ দেখা গেল। জেঠু বলল, এবা্র দুর্যোগ কেটে যাবে। পাহাড়ে এইরকম আগুনে মেঘ দেখা গেলেই নাকি আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করে। হিমালয়ের পথে জেঠুর অভিজ্ঞতা যে কতখানি তার প্রমাণ মিলল শিগগিরিই। মিনিট দশেকের মধ্যেই বৃষ্টি ছেড়ে গেল। পাহাড়চূড়ায় রোদ দেখা গেল। বহুদূরের কয়েকটা পাহাড়ের চূড়ায় দেখলাম সদ্য সদ্য বরফ পড়েছে। বিকালের পড়ন্ত আলোয় ঝিকমিক করছে সেইসব চূড়া। ঘড়ি বলছে তখন সন্ধ্যা ৬টা। পাহাড়ে সূর্যাস্ত হয় দেরিতে, তাই এখনও আলো আছে।
আমাদের আস্তানা রামপুর গ্রামের উত্তরে ১ কিলোমিটার, আর আমরা এসেছি রামপুরের দক্ষিণে প্রায় দেড় কিলোমিটার। সুতরাং আমাদের ফিরতে হবে প্রায় আড়াই কিলোমিটার, তবে এই ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায়, সন্ধ্যের ঝিম হয়ে আসা আলোয় হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। ভাবছিলাম, আজ সারাদিনে আমাদের অভিজ্ঞতার তালিকাটা কত বর্ণময়। সকালে হরিদ্বারে যখন ঘুম থেকে উঠেছিলাম তখন কোন ধারণাই ছিল না যে আজ কি কি পেতে চলেছি। একটু বাদেই রাত নামবে, রামপুরের পাহাড়ি লজে নির্জন রাত্রিটাও একটা বড় প্রাপ্তি হতে চলেছে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রামপুর গ্রামে চলে এসেছি, এমন সময় দেখি রাজুদা গাড়ি নিয়ে হাজির। সন্ধ্যা হতে চলল আমাদের ফেরার নাম নেই, তার উপরে এমন দুর্যোগ, তাই রাজুদা আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। ছোটিয়াজীর কাছে আমরা দুর্গামন্দিরে গিয়েছি শুনে সেদিকেই যাচ্ছিল। আমাদের গাড়িতে উঠতে বলল রাজুদা, কিন্তু আমরা রাজি নই। এই রাস্তাটুকু হেঁটে যেতেই বেশি আগ্রহ আমাদের। অগত্যা রাজুদা গাড়ি নিয়ে ফিরে গেল, বলল। ‘তোমরা তাড়াতাড়ি এসো, আমি গিয়ে চা বানাতে বলি’।
নিউ শিবশক্তি লজে যখন আমরা পৌঁছালাম তখন প্রায় সাতটা বাজে। দেখলাম রাজুদা চায়ের গ্লাস হাতে লজের ছাদের দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও এক একটা চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিলাম। আগেই বলেছিলাম রাজুদা রসিক মানুষ, এখন দেখলাম ভাবুকও বটে। বলল, ‘খুলে ফেলো জ্যাকেট-টুপি, প্রাণ ভরে শ্বাস নাও। এমন ফ্রেশ অক্সিজেন কলকাতায় তো পাবেই না, হরিদ্বারেও পাবে না’। এরপর ছাদের কিনারায় গিয়ে আমাদের ডেকে যা দেখাল সে এক অবাক করা দৃশ্য।
বাতাসে আর্দ্রতা ছিল যথেষ্ঠ, কারন খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। নদীখাতের দু’পাশের পাহাড়ের কোল বেয়ে আর্দ্র বাতাস নেমে যাচ্ছে মন্দাকিনীর বুকে, তারপর ঠান্ডায় ঘনীভূত হয়ে চাপ চাপ কুয়াশার মতন মেঘ তৈরি করছে। সেই মেঘের টুকরো উঠে যাচ্ছে আবার পাহাড়ের অন্য গা বেয়ে। এসব দেখতে দেখতে আর গল্প করতে করতে কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে আলোর মালা সেজে উঠেছে। বেশিক্ষণ বসা হল না, যাই এবার ব্যাগ গোছাতে হবে কালকের জন্য।
আমাদের প্রত্যেকের সাথেই একটা করে পিঠে নেওয়ার ছোট ব্যাগ ছিল। তাতেই আমাদের দু’দিনের প্রয়োজনীয় যাকিছু নিয়ে নিতে হবে। নেওয়ার বেশি কিছু নেই। আমাদের প্রত্যেকের গায়ে থাকবে একটা করে উলিকটের ইনার, জামা, জ্যাকেট, পরনে থাকবে জিনস। উপরে যথেষ্ঠ ঠান্ডা হবে, কাজেই এই পরিচ্ছদ খোলার কোন সম্ভাবনাই নেই ফেরার আগে। এছাড়া মাঙ্কি ক্যাপ নিয়ে নিয়েছি, প্রত্যেকের একটা করে জলের বোতল, কিছু লজেন্স, খেজুর, বাদাম। আর আমার ব্যাগে থাকছে ওষুধের একটা পোঁটলা, বমির, জ্বরের, পেট খারাপের ওষুধ তো থাকছেই এছাড়া নিয়েছি কোকা-৩০ আর ডায়ামক্স; মাউন্টেন সিকনেসের ওষুধ।
ব্যাগ গোছানো শেষ হতে না হতেই কারেন্ট অফ। ব্যালকনিতে বেড়িয়ে এলাম, পাহাড়ের গা থেকে উঁকি মারছে আধখানা চাঁদ। মনে পরে গেল কাল মহাঅষ্টমী। বাড়িতে মা, বাবা, দিদি, দাদা, তাতাই (আমার ভাইপো) সবাই মিলে দলবেঁধে হয়ত এখন ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছে। মনে পড়ল আমাদের গ্রামের নন্দীবাড়ির মা দুর্গার মুখখানি। আমার জীবনে ছুটি কম, একটানা ৭-১০ দিন ছুটি পুজোর সময় ছাড়া পাওয়া অসম্ভব। তাই পুজোয় বাড়িতে থাকার আনন্দ আর বেড়ানোর আনন্দ দুটোই একসাথে আমার নেওয়া সম্ভব হয় না। তবে তাতে আমার বিন্দুমাত্র খেদ নেই। কাল সকালেই গৌরীকুণ্ডে গিয়ে মায়ের দর্শন করে তারপর রওনা দেব কেদারনাথের পথে। এখন বাড়িতে একটা ফোন করা যাক।
ফোন শেষ করে ঘরে এসে দেখি রাজুদা এসেছে। জেঠুকে প্রস্তাব দিয়েছে হেলিকপ্টারে যাওয়ার। জেঠু কিছুতেই রাজি হলনা, আমাদের কথাতেও না। এর আগে যতবার গেছি, পায়ে হেঁটে গেছি, এবার না হয় না হবে, কিন্তু গেলে আবার পায়ে হেঁটেই যাব। জেঠুর জেদের কাছে হার মেনে রাজুদা এবার পড়ল আমাদের নিয়ে। খুব ভয় দেখাতে লাগল। পায়ে হাঁটা কত কষ্টকর, আগে রাস্তা সহজ ছিল তাই পায়ে হেঁটে অনেকেই যেত, কিন্তু এখন প্রায় কেউই যায় না পায়ে হেঁটে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর পরামর্শ হল অন্তত তিনজনের জন্য একটা ঘোড়া ভাড়া করতে। ওর চেনা জানা ঘোড়াওয়ালা আছে। কম খরচে হয়ে যাবে। কিন্তু আমরাও বললাম পায়ে হেঁটেই যাব, ঘোড়া নেওয়ার প্রশ্নই নেই। ইতিমধ্যে ডাক পড়ল খেতে যাওয়ার।
খাবার জায়গা দোতলায়। দুটো টেবিল পাতা আছে, কিন্তু আমরা বসলাম পাশের চৌকিটায়। আমাদের ডানদিকে একটা কাঠের উনুনে রুটি বানাচ্ছে দুটো অল্পবয়স্ক ছেলে, অঙ্কুশ আর অর্জুন। বয়স পনেরো ষোল হবে, গুনগুন করে গান গাইছে। রাতের খাবার হল রুটি, ছোলার ডাল আর ঝালঝাল সবজি। খিদের দমকে রুটি পাতে পড়া মাত্র উবে যাচ্ছিল। ডাল আর সব্জির স্বাদও মুখে লেগে থাকার মতন। এক একজন ৮-১০ টা করে রুটি খেয়ে ক্ষান্ত হলাম। জেঠুর ফোনে রিংটোন সেট করা ছিল কোকিলের ডাক, সেটা অঙ্কুশের খুব পছন্দ। লাজুক মুখে আমায় এসে বলল রিংটোনটা ওর ফোনে দেওয়ার জন্য। ব্লুটুথ অন করে রিংটোনটা দিয়ে দিলাম ওকে। কতবার যে ধন্যবাদ দিল এর জন্য, কে জানে।
খাওয়া দাওয়ার পাট মিটলে দেখি তখন সবে সাড়ে আটটা। এখন ঘুম আসবে না, তাই আরও ঘণ্টা খানেক গল্প করা হল। জেঠুর প্রথমবার কেদারনাথ আসার কথা, ২০১৩ র বন্যার কথা, আরও কত কথা। ঠিক হয়েছে কাল সকাল পাঁচটায় আমরা রেডি হয়ে বেরোব। প্রথমে রাজুদার গাড়িতে ৪ কিলোমিটার দূরে সোনপ্রয়াগ, সেখান থেকে সরকারি শেয়ারের জীপে আরও ৪ কিলোমিটার দূরে গৌরীকুণ্ড। সেখানে গিয়ে গৌরী মায়ের দর্শন করে হাঁটা শুরু করব। জেঠু এখানেই থাকবে। যদি আমরা কাল দুপুর দুটো – তিনটের মধ্যে কেদারনাথ দর্শন করতে পারি তবে ফিরে আসার চেষ্টা করব, নয়ত পরেরদিন ফিরব।
সাড়ে নটা বাজতেই আমরা শুয়ে পড়লাম। একটু বাদেই দেখলাম বাকি তিনজনে ঘুমিয়ে কাদা। আমার আর ঘুম আসে না। সেই কোন ছোট্টবেলাকার স্বপ্ন আজ পূরণের মুখে। গৌরীকুণ্ড থেকে রামবাড়া, রামবাড়া থেকে গরুড়চটী, তারপর দেওদেখানি থেকে সমতল পথ, ঘাসের বুগিয়ালের মধ্যে দিয়ে। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। বড় হয়ে পড়েছি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘পঞ্চকেদার’, চিন্ময় চক্রবর্তীর ‘শিবভূমি হিমালয়’, প্রাণেশ চক্রবর্তীর ‘হিমালয় সাথী’, কিরীটের ‘দুর্গম গিরিতীর্থে’। মনে মনে কল্পনার রঙে আঁকা হয়ে আছে কেদারনাথ উপত্যকার একটা সম্পূর্ণ ছবি, কাল সেটা মিলিয়ে দেখার পালা।
ঘুম কি আসে সহজে? তার উপরে একটু একটু ভয়ও কাজ করছে মনে। আমরা তিনজনেই ট্রেকিং এ একেবারেই অনভিজ্ঞ, জেঠু থাকবে না আমাদের সাথে। পথ আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি কঠিন, এ শুধু রাজুদার ভয় দেখানো কথা নয়, এখানে আসার আগে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নতুন পথের যে কয়েকটা বিবরণ বেরিয়েছে, এবং ইউটিউবে যে ক’টা ভিডিও দেখেছি, তার সবগুলোতেই এই একই কথা শুনিয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটা ভয়ের কারণ ছিল। কলকাতা থেকে রওনা দেওয়ার আগে থেকেই আমার একটা শুকনো কাশি ছিল। এখানে এসে ঠান্ডা পেয়ে বিকেল থেকেই সেটা খুব বেড়েছে। চড়াই ভাঙার সময় কাশি হলে খুব তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে যাব। জ্যাকেটের পকেটে নিয়ে নিয়েছি এক কৌটো লবঙ্গ, কাশির দমক এলে সেটাই ভরসা।
যাই হোক, বেশি চিন্তা করে লাভ নেই। আজকের এই রাতটা আমার কাছে কুড়িয়ে পাওয়া পনেরো আনা। জনপদ থেকে দূরে, পাহাড়ের খাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই নির্জন পাহাড়ি আস্তানায় আজ যাত্রী বলতে শুধু আমরা চারজন। এত নির্জনে রাত্রি কাটানোর সৌভাগ্য ক’জনের হয়? কনকনে ঠান্ডা, কোনরকমে নাকটা বের করে রেখেছি কম্বলের তলা থেকে। হিমালয়ের অতল গাম্ভীর্য মেশা নৈঃশব্দকে খান খান করে ভেঙে দিয়ে গমগম শব্দে বয়ে চলেছে আমার প্রিয় মন্দাকিনী। যদিও জানালা বন্ধ, তবুও তার পদশব্দে আমাদের ঘর ভরে আছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো, এবারে ঘুমাই।
সপ্তম পর্ব
অতনুর ডাকে ঘুম ভাঙল। তখন ভোর সাড়ে চারটে। হাতমুখ ধুয়ে, প্রাতঃকৃত্য সেরে আমরা রেডি হয়ে গেলাম ঠিক পাঁচটার মধ্যে। উপরে উঠে দেখি রাজুদা স্নানটান সেরে কপালে তিলক দিয়ে রেডি। আমরা এক কাপ করে চা খেয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম।
গাড়ি ছাড়ার আগে জেঠু বলে দিল, ‘তিনজন সবসময় একসঙ্গে থাকবে, তিনজন তিনজনের উপরে নজর রাখবে, খাদের কিনারায় যাবে না। যেখানে গিয়ে মনে হবে আর পারছি না, সেখান থেকেই ফিরে আসবে। ফোন করবে’। জেঠুর টেনশনটা অজান্তে আমাদেরও একটু চেপে ধরেছিল, তাই সবাই মিলে ‘হর হর মহাদেব’ ‘জয় কেদারনাথ জী’ ‘জয় দুর্গা মাঈকি জয়’ ইত্যাদি জয়ধ্বনি দিয়ে মনে মনে চাঙ্গা হয়ে নিলাম।
রামপুর ছেড়ে কিছুদুর গিয়েই সীতাপুর। তারপর সোনপ্রয়াগ। সোনপ্রয়াগে গিয়ে রাজুদা আমাদের ‘জয় সিয়ারামকী’ বলে বিদায় জানালো। আমরা এগিয়ে গেলাম জিপের স্ট্যান্ডের দিকে। জিপে ওঠার আগে আমাদের প্রত্যেকের বায়োমেট্রিক কার্ড চেক করা হল। জিপে আমরা ছাড়াও আরও চার পাঁচজন যুবকের একটা দল রয়েছে, ওরাও পায়ে হেঁটে যাবে কেদারনাথ। সবাই মিলে একসঙ্গে জয়ধ্বনি দিতেই গাড়ি স্টার্ট দিল। ভাড়া মাথাপিছু কুড়ি টাকা।
সোনপ্রয়াগ ছাড়াতেই বাঁদিকে নজরে এলো সোনগঙ্গা, সোনগঙ্গার সঙ্গে মন্দাকিনীর সঙ্গম এই সোনপ্রয়াগে। একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম কেন এখানে সরকারি জিপ ছাড়া কোন প্রাইভেট কার চলার অনুমতি নেই। রাস্তা বলে প্রায় কিছু নেই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হেলেদুলে চলেছে আমাদের জিপ। ডানদিকে মন্দাকিনীর ধবংসলীলার নমুনা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম।
গৌরীকুণ্ডে পৌছালাম সকাল ছটায়। মন্দাকিনীর তীর থেকে খানিকটা জায়গায় ঢালাই করে তৈরী করা হয়েছে নতুন পার্কিং লট। আগে নাকি মন্দাকিনীর ওপারে বিশাল বাসস্ট্যান্ড ছিল। এখন সেখানে শুধু ছড়ানো ছিটানো আছে বড়বড় বোল্ডার, বাসস্ট্যান্ডের চিহ্নমাত্র নেই।
এখান থেকেই গোটা গৌরীকুণ্ড শহরটার একটা ধারণা পাওয়া গেল। গৌরীকুণ্ড শহরটা মোটামুটি তিনটে স্তরে গড়ে উঠেছিল। একদম নীচের স্তরের বাড়িঘর প্রায় পুরোটাই হয় বন্যায় ভেসে চলে গেছে, নয়তো আধভাঙা হয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় স্তরের কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, কিছু অক্ষত। গৌরীমায়ের মন্দির এই দ্বিতীয় স্তরে, মন্দির অক্ষত আছে। তৃতীয় স্তর প্রায় সম্পূর্ণ অক্ষত, এখান থেকেই কেদারনাথ যাবার পায়ে চলা পথ শুরু হয়েছে। গৌরীকুণ্ডে আগে একটা উষ্ণপ্রস্রবণ ছিল, তার নামেই নাম গৌরীকুণ্ড। কুণ্ডটি বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে পাথরের ফাঁক দিয়ে গরম জল এখনো বের হয়।
আমরা প্রথমেই একটা দোকান থেকে একটা একটা করে লাঠি নিয়ে নিলাম। বাঁশের লাঠি, ডগায় একটা করে লোহার মুখ লাগানো, দাম দশ টাকা; ফিরে এসে ফেরত দিলে নাকি আবার পাঁচ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। লাঠি নিয়ে আমরা গেলাম মা গৌরীর দর্শন করতে।
গৌরীকুণ্ডকে ঘিরে দুটি পৌরাণিক কথা প্রচলিত আছে। প্রথমটি অনুসারে হিমালয়কন্যা পার্বতী এখানেই কঠোর তপস্যা করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন এবং তাঁকে পতি হিসাবে পান। এখান থেকে কিছুদূরেই ত্রিযুগীনারায়ণ নামক স্থানে (সোনপ্রয়াগ থেকে ১২ কিলোমিটার যেতে হয়) নারায়নের উপস্থিতিতে তাঁকে সাক্ষি মেনে হর-পার্বতীর বিবাহ হয়েছিল। দ্বিতীয় কথাটি গণেশের জন্মকথা। গৌরীকুণ্ডের উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করার সময় মাতা পার্বতী তাঁর গায়ে মাখার হলুদ থেকে কৌতূহল বশত একটি শিশুপুত্রের পুতুল বানান, এবং তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে গণেশের জন্ম দেন।
গৌরীমায়ের মন্দিরটি প্রাচীন। টিনের ছাদওয়ালা ছোট্ট মন্দির, রঙ সাদা। প্রবেশদ্বারের মুখে ডানদিকে শিবলিঙ্গ, বাঁদিকে মাতা পার্বতী এবং গনেশের মূর্তি। ছোট্ট নাটমন্দির, এখানে হোমকুণ্ড আছে। তারপর গর্ভমন্দির, এখানে মাতা গৌরীর মূর্তি বিরাজমানা। মাকে প্রণিপাত জানিয়ে এবং আসন্ন যাত্রার সাফল্যের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করলাম। জগতজননী মায়ের অনুমতি নেওয়ার পর আমার গর্ভধারিণী মায়ের আশীর্বাদ নিতে বাড়িতে একবার ফোন করলাম। তারপর যাত্রা শুরু। ঘড়ি বলছে তখন ঠিক সকাল সাড়ে ছটা।
আগেই যেমন বলেছিলাম, গৌরীমাতার মন্দির শহরের দ্বিতীয় স্তরে, আর কেদারনাথের পায়ে চলা পথ শুরু হয়েছে তৃতীয় স্তর থেকে। কাজেই প্রথমেই শুরু হল সিঁড়ি ভাঙা। উঠছি তো উঠছিই, সিঁড়ি আর ফুরোয় না। স্লোপ করা পাহাড়ি পথে চড়াই ভাঙার চেয়ে একটানা সিঁড়িভাঙা অনেক বেশি কঠিন। এখানেই অর্ধেক শক্তি খরচ হয়ে গেল। প্রায় ১০-১২তলা বাড়িতে ওঠার মতন সিঁড়ি ভেঙে অবশেষে দেখতে পেলাম সামনেই রয়েছে পাথরে বাঁধানো কেদারনাথ যাওয়ার পায়ে চলা পথ। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, কেদারনাথ – ১৬ কিমি, রামবাড়া -৭ কিমি ইত্যাদি।
সামনে কয়েকটা দোকান, কয়েকজন ঘোড়াওয়ালা শেষবারের মতন ঝোলাঝুলি করল। এখান থেকে কেদারনাথ যাওয়ার জন্য ঘোড়া ছাড়াও ডাণ্ডি ও কাণ্ডি পাওয়া যায়। ডাণ্ডি চারজনে বয়, যাত্রী একটা হাতল দেওয়া আধা–চেয়ার আধা-পালকিতে আধশোয়া অবস্থায় বসে থাকেন। কাণ্ডি একজনে বয়, বাহকের পিঠে একটা ঝুড়ির মতন চেয়ারে বসে থাকেন যাত্রী। এর অসুবিধা হল যাত্রী পথের শোভা দেখতে পান না খুব একটা, কারণ তাঁর মুখ থাকে আকাশ পানে। ঘোড়া, ডাণ্ডি বা কাণ্ডি এখন সবকিছুরই ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে, বেশি কম নেওয়ার উপায় নেই। যাইহোক, আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।
গৌরীকুণ্ডের শেষ কয়েকটা দোকানঘর পেরিয়ে একটা বিশাল অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে পথ, প্রায় আধ কিলোমিটার। হালকা চড়াই, দিব্যি টুকটুক করে এগিয়ে চলেছি। আমাদের রাস্তায় এখনও রোদ এসে পড়েনি, পাশের পাহাড়ের ছায়ার জন্য। এখান থেকে রামবাড়া ৭ কিলোমিটার, এই পর্যন্ত আমরা যাব মন্দাকিনীকে ডানপাশে রেখে।
এটাই কেদারনাথ যাওয়ার পুরনো পথ। অর্থাৎ এই পথেই হেঁটে কেদারনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধ কুমার সান্যালের মতন মানুষেরা, যাঁদের কলমের যাদুতে হিমালয়কে ভালবাসতে শিখেছি। রামবাড়ার পরে পুরনো রাস্তা চলে যেত একইভাবে মন্দাকিনীকে ডানহাতে রেখে। গরুড়চটি হয়ে ৬ কিলোমিটার হাঁটার পর আসত দেওদেখানি বা দেবদর্শনী। এখান থেকেই প্রথম কেদারনাথের মন্দির চোখে পড়ত। শেষ এক কিলোমিটার রাস্তা ছিল সমতল, সবুজ, নরম ঘাসের বুগিয়ালের মধ্যে দিয়ে, একদম শেষে ছোট্ট সেতুর উপর দিয়ে মন্দাকিনী পার হয়ে কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছান যেত।
২০১৩ র ১৭ই জুনের পর থেকে রামবাড়ার পর থেকে এই রাস্তাটা আর নেই। এখন রামবাড়াতেই একটা লোহার পুল পেরিয়ে নতুন পথ চলে গেছে মন্দাকিনীর অপর পাড়ে, এরপর মন্দাকিনীকে বাঁদিকে রেখে রাস্তা চলে গেছে কেদারনাথ মন্দির পর্যন্ত। পথে তিন কিলোমিটার ও ছয় কিলোমিটার দূরে দুটি চটি আছে, লোয়ার ও আপার লিঞ্চোলি। তারপর আরও দু’কিলোমিটার বাদে আসে রুদ্রাপয়েন্ট, নতুন পথের দেওদেখানি বা দেবদর্শনী। অর্থাৎ এখান থেকেই প্রথম মন্দির নজরে আসে। এখান থেকে মন্দির এক কিলোমিটারের একটু বেশি। রাস্তা প্রায় সমতল, ঘাসের বুগিয়ালের মধ্যে দিয়ে। এখানে আসার আগে নতুন পথের যেখানে যেটুকু বর্ণনা পেয়েছি গোগ্রাসে গিলেছি, ইউটিউবে যা ভিডিও পেয়েছি দেখে দেখে মুখস্ত করেছি, তার থেকেই জেনেছি নতুন পথের এই হাল হদিশ। এখন নিজে দেখার পালা।
অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকটা পেরোতেই সামনের গাছপালা, ও পাহাড়চূড়ার আড়াল থেকে একটুকরো সোনালি আলোর ঝলক এসে চোখে পড়ল। কেদারনাথ উপত্যকার চিরতুষারাবৃত শিখর কেদারডোম বা সুমেরু পর্বতে সকালের রোদ এসে পড়েছে। চিরতুষার ঢাকা হিমাদ্রি রেঞ্জ দেখা আমার জীবনে এই প্রথম। এ অনুভূতি লেখা যায় না, বলা যায় না; শুধু হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়ে আনন্দের স্বাদ নেওয়া যায় মাত্র। আমরা তিনজনেই করজোড়ে প্রণাম জানালাম সেই সুন্দরের উদ্দেশ্যে, বিশালের উদ্দেশ্যে, হিমালয়রূপী মহাদেবের জটার উদ্দেশ্যে। ওই পর্বতচূড়ার ঠিক পাদদেশেই আমাদের যাত্রাপথের সমাপ্তি।
এগিয়ে চললাম, পথ কোথাও এঁকেবেঁকে চলেছে, কখনও একটানা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে, মাঝারি চড়াই। মাঝে মাঝেই সাইনবোর্ডে লেখা সতর্কবাণী, ‘সাবধান! উপর থেকে পাথর পড়তে পারে’।
অষ্টম পর্ব
সাড়ে সাতটার সময় পৌছালাম হনুমানচটি। নামেই চটি (পাহাড়ের পথে আস্তানা), একটাও দোকান পাসারি নেই। শুধু পথের বাঁপাশে পাথরের একটা ছোট্ট মন্দিরে সংকটমোচন হনুমানের মূর্তি রয়েছে। আমরা প্রণাম করে এগিয়ে চললাম।
পথের পাশে পাশে কত নাম না জানা গাছ, ছোট ছোট একপ্রকার বাঁশের ঝাড়, মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে কেদারশিখরের শ্বেতশুভ্র বিশাল দেহ। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। কখনও তাকে দেখা যাচ্ছে, কখনও শুধু তার চলার শব্দে আমরা বুঝতে পাচ্ছি যে সে চলেছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই। কত যে ঝর্না বয়ে চলেছে ঝিরঝির করে তার গোনাগুণতি নেই, জল এত ঠান্ডা যে হাত দিলে হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছে। পথের ধারে দু তিনশ মিটার অন্তরে রয়েছে পানীয় জলের ব্যবস্থা, তবে ঝর্নার জলও খাওয়া যায়। এক আধ কিলোমিটার অন্তর রয়েছে বসার জায়গা, আর ঘোড়ার জল খাওয়ার জন্য চৌবাচ্ছা। পায়ে হাঁটা যাত্রী সত্যিই খুব কম, বেশিরভাগই যাত্রীই ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। কিছুদুর অন্তর অন্তর ঝাড়ু হাতে লোক দাঁড়িয়ে আছে, ঘোড়ার মল পরিস্কার করে চলার পথটাকে পরিছন্ন করে রাখছে, আগে নাকি ঘোড়ার বর্জ্য পদার্থে পথ সবসময় কাদামাখা হয়ে থাকত।
দেখতে দেখতে চলে এলাম পথের প্রথম বিশ্রামস্থল জঙ্গলচটি, গৌরীকুণ্ড থেকে চার কিলোমিটার, সময় লাগল ঠিক দু’ঘণ্টা। পথের একটা বাঁকে, কয়েকটা দোকানঘর, একটা মেডিকেল ক্যাম্প আর রাত কাটাবার কয়েকটা তাঁবু। সবকিছুই হয় সরকারী, নয়তো সরকার অনুমোদিত, সমস্ত কিছুর দাম বাঁধা।
জঙ্গলচটিতে এসে আলাপ হল আমাদেরই বয়সী এক যুবকের সাথে। বাড়ি লখনউয়ে, সেও চলেছে পায়ে হেঁটে। আমরা যখন চায়ের দোকানে এসে বসছি, সে তখন দাম মিটিয়ে চলার উদ্যোগ করছে, পরে আবার দেখা হবে এই বলে তাকে বিদায় জানালাম।
এইখানে এসে আমি দুটো ভুল করলাম। জেঠু পইপই করে বলে দিয়েছিল চলতে চলতে এসে হঠাত করে বসে না পড়তে, বিশ্রাম নিতে হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বিশ্রাম নিতে। আমি জঙ্গলচটিতে একটা চায়ের দোকানে এসেই পাহাড়ের খাদ ঘেঁষে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। দ্বিতীয় ভুলটা এই যে কনকনে শীতের মধ্যে গরম গরম চা না খেয়ে, আমি লোভে পরে একটা ঠান্ডা পানীয় খেয়ে ফেললাম। ফলে জঙ্গলচটি থেকে রওনা দেওয়ার খানিক পরেই বিপদটা টের পেলাম। বাড়ি থেকে আসার সময়েই আমার বুকে একটু সর্দি বসেছিল, একটু একটু কাশিও ছিল। এখন সেই পুরোন কাশি একেবারে বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমায় কাবু করতে। শরীরও অবসন্ন হতে শুরু করল। এক কিলোমিটার যেতেই শরীর আর বয় না। দু’এক পা যাই আর বসি, বারবার বসে বসে ক্লান্তি আরও বেড়ে গেল।
জঙ্গলচটি থেকে ভীমবলি ২ কিলোমিটার রাস্তা, চড়াই মাঝারি; কিন্তু এই রাস্তাটুকুতেই সবচেয়ে বেশি কাহিল হয়ে পড়লাম আমি। সামনে রামবাড়া থেকে আপার লিঞ্চোলি পর্যন্ত বুকফাটা চড়াই, সেখানে গিয়ে কি করব কে জানে? মনে বেশ ভয় ভয় লাগছিল, তবে কি পারব না? ঠিক করলাম ভীমবলিতে গিয়ে মেডিকেল ক্যাম্প থেকে কাশির ওষুধ নিতে হবে, কাশি না থামলে হাঁটা অসম্ভব। তারপর কিছু খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিলেই হয়ত অনেকটা বল পাওয়া যাবে। আর তাতেও না হলে, রামবাড়া থেকে ঘোড়া নিয়ে নেব আমি।
কৃষ্ণ আর অতনু আমায় ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছে প্রতিপদে। অতনু বলল, ‘আমাদের তো কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি যে আজকেই পুরোটা উঠতে হবে। দরকার হয় লিঞ্চোলিতে গিয়ে আজ থেকে যাব, বাকিটা পথ কাল যাব’। এ কথায় এক ধাক্কায় মনোবল বেড়ে গেল অনেকটা। সত্যিই তো, পুরনো রাস্তায় অনেক যাত্রীই তো রামবাড়ায় এসে একরাত থেকে পরেরদিন বাকিটা যেত। কষ্ট হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আবার নতুন উদ্যমে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
ভীমবলি এসে পৌছালাম সাড়ে দশটার কাছাকাছি। ভীমবলি চটিটি একেবারেই নতুন, ২০১৪য় তৈরী। দেখলাম এখানে মন্দাকিনীর উপর নতুন সেতু তৈরী হচ্ছে, সেতুর ওপারে নতুন রাস্তার কাজ চলছে। পরের বছর থেকে হয়ত আর রামবাড়া যাওয়ার দরকার পরবে না, এখান থেকেই সেতু পেরিয়ে নতুন রাস্তা চলে যাবে লিঞ্চোলির দিকে।
আমি আর অতনু ঠিক করলাম, এখানেই দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেব। কারণ এরপর খাওয়া জুটতে পারে সেই আপার লিঞ্চোলিতে, এখান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। কৃষ্ণ বলল ও কিছু খাবে না। আমরা অনেক বোঝালাম, যে খেয়ে নে, নয়তো কখন খাওয়া জুটবে তার ঠিক নেই, না খেয়ে হাঁটলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কৃষ্ণ কিছুতেই খাবে না। এককাপ চা খা অন্তত? তাও না। যাইহোক আমরা সরকারী ভোজনালয়ে খেতে বসলাম।
রুটি, সোয়াবিনের তরকারি, আর চাপচাপ ছোলার ডাল, ভরপেট খাও মাত্র সত্তর টাকায়। চা ১০ টাকা। খেতে খেতে অন্য যাত্রীদের কথা শুনছি, নিজেরাও গল্প করছি এমন সময় দেখি ভিড়ের মধ্যে পরিচিত দুটো মুখ। রামপুরের সেই অঙ্কুশ আর অর্জুন। জিজ্ঞাসা করতে বলল ঘোড়ার সহিস হয়ে যাত্রী নিয়ে চলেছে কেদারনাথ। দর্শন করিয়ে নিয়ে আজ বিকালেই ফিরবে, ফিরে আবার চাচাজিকে (অর্থাৎ জেঠুকে) রুটি বানিয়ে খাওয়াবে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটলে মেডিকেল ক্যাম্পে গেলাম ওষুধ আনতে। ডাক্তার কাশির ওষুধ, আর সঙ্গে দুটো অ্যান্টিবায়োটিক ধরিয়ে দিল। দুটো ওষুধ তখনই খেয়ে নিলাম। তারপর একটা গ্লুকন ডি কিনে আমার জলের বোতলটায় গুলে নিলাম।
এখন আমরা আবার চলার জন্য রেডি। কৃষ্ণকে আরেকবার সাধাসাধি করলাম খাওয়ার জন্য, লাভ হল না। অগত্যা চলতে শুরু করলাম। রামবাড়া ভীমবলি চটি থেকে ১ কিলোমিটার, চড়াই একটু কম। গৌরীকুণ্ড থেকে এপর্যন্ত আমরা যে পথে এসেছি, ২০১৩ র আগেও সেটাই মূল রাস্তা ছিল। চওড়া রাস্তা, খাদের দিকে লোহার রেলিং দেওয়া, রাস্তা একদমই অক্ষত আছে। ভীমবলি ছাড়াতেই চোখে পড়তে লাগল ক্ষতির বহরটা। জায়গায় জায়গায় রেলিং ভাঙা, কিছু জায়গা নতুন করে বানানো। খাদের দিকে গাছপালা নেই বললেই চলে, সব ভেসে গেছে বন্যায়। ভীমবলি থেকে রামবাড়া এই পথটুকু মন্দাকিনীর নদীগর্ভের একদম কাছাকাছি। তাই ক্ষতির পরিমাণও বেশি।
রামবাড়া পৌঁছে প্রলয়ের রূপ দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মন্দাকিনীর নদীখাত এখানে বিশাল চওড়া, বিশাল বিশাল বোল্ডারে ভরা। এখানে যে কোনদিন কোন শহর ছিল একথা বিশ্বাস করা সত্যি সত্যিই অসম্ভব। অথচ মাত্র দুবছর আগে কেদারনাথের পথে সবচেয়ে বড় জনপদ ছিল এই রামবাড়া। নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু ছবিতে দেখেছি, ভিডিওয় দেখেছি পাহাড়ের কোলের সেই সুন্দর শহরটাকে কতবার। প্রায় ১৫০টা দোকান, ৫টা বড় বড় হোটেল, এক নিমেষে সবকিছু চাপা পরে গেছে ১০ ফুট বালি আর পাথরের আস্তরণে। এখন রামবাড়া বলতে শুধু একটা পুলিশ ক্যাম্প। ক্যাম্পের পরই সেতু, আমরা সেতু পেরিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। এখানে আমরা বসব আধঘণ্টা।
এরপরেই শুরু হবে এপথের সবচেয়ে ভয়াবহ চড়াই। নীচ থেকে সামনের পথের চেহারা দেখে শিউরে উঠেছি মনে মনে। এ চড়াই ওঠা কি সম্ভব? কিন্তু উঠতে তো হবেই, আমরা দৃঢ়সঙ্কল্প, ফিরেও যাবনা, ঘোড়াও নেবনা। কৃষ্ণ আর অতনু দুজনেই ফিট, আমিই যা একটু কাহিল হয়ে পড়েছি।
তিনজন বসে আছি তিন জায়গায়। আমি একটা বেঞ্চে, অতনু একটা পাথরের উপর, আর কৃষ্ণ আমাদের চেয়ে খানিকটা উপরে আরেকটা পাথরে। কৃষ্ণ আর অতনু মুগ্ধ হয়ে দেখছে পাহাড়ের শোভা, অতনু নেমে গিয়ে মন্দাকিনীর জলে হাতমুখ ভিজিয়ে এল। আমিও দেখছি হিমালয়কে, আর প্রানভরে ডাকছি শক্তি রূপিণী মহামায়াকে। মায়ের ইচ্ছা না হলে আর আমার কেদারনাথ দর্শন হবে না। প্রার্থনা করছি হিমালয়ের কাছে, কেদারনাথের কাছে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকখানি সময়। ইতিমধ্যে অঙ্কুশ আর অর্জুন ঘোড়া ও সওয়ারী নিয়ে এগিয়ে গেছে। এবার আমাদেরও উঠতে হবে।
হাঁটা শুরু করলাম আবার, বেলা তখন বারোটা। জেঠুর পরামর্শ মাথায় রেখে পায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে চড়াই ভাঙছি। একটু একটু উঠছি আর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। এতে করে আমাদের চলার গতি কমেছে ঠিকই কিন্তু ক্লান্তি অনেক কম হচ্ছে। রামবাড়ার পর থেকে রাস্তার পুরোটাই ২০১৪ সালে বানানো, অপেক্ষাকৃত সরু, রেলিং নেই। কাজেই খাদের ধার বাঁচিয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে এগিয়ে চলেছি। এক কিলোমিটার চড়াই ভাঙার পর দেখলাম ভীমবলি থেকে যে রাস্তাটা তৈরী হচ্ছে, সেটা এখানে এসে আমাদের পথের সাথে মিশে গেছে।
এখন আমাদের ঠিক সামনেই ঝকঝক করছে কেদারডোম শৃঙ্গ। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। আমার ক্যামেরাটা কৃষ্ণকে দিয়ে দিয়েছিলাম আগেই, কত যে ছবি তুলছে ও, তার ইয়ত্তা নাই। নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে দেখতে পাচ্ছি পুরনো রাস্তার খানিক খানিক বেঁচে থাকা অংশ, বেশিরভাগটাই বন্যায় ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে। কিন্তু যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতেই বোঝা যায়, কত সহজ ছিল সেই পথ। বেলা দেড়টা নাগাদ চড়াই পথের একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল কয়েকটা চালাঘর। ওটাই কি লোয়ার লিঞ্চোলি? বিশ্বাস হচ্ছিল না, যে সবচেয়ে কঠিন পথের অর্ধেকটা পেরিয়ে এসেছি আমরা। পথ ফিরতি যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, মনের ভুল নয়, আমরা সত্যিই এসে গেছি লোয়ার লিঞ্চোলিতে।
নবম পর্ব
কয়েকটা তাঁবু, পুলিশ ক্যাম্প, মেডিকেল ক্যাম্প নিয়ে গড়ে উঠেছে লোয়ার লিঞ্চোলি। কৃষ্ণর উপর এবার আমাদের রাগ হল, বেটা কিছুই খায় না। অথচ এই দুরন্ত চড়াই খালি পেটে ভাঙলে যে কোন মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পরতে পারে। বললাম, অন্তত কয়েকটা খেজুর খা, নাহলে এই আমরা বসলাম, আর যাব না। কৃষ্ণ খানিকটা বাধ্য হয়েই কয়েকটা খেজুর খেল। এখানে আলাপ হল মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা একদল যাত্রীর সাথে। ওদের সাথে বাঁশের লাঠির বদলে একটা করে লোহার পাইপের টুকরো, সেটাকেই লাঠির মতন ঠুকতে ঠুকতে চলেছে, শব্দ উঠছে ঠং ঠং করে। ওরা মূল রাস্তা ছেড়ে পাকদণ্ডী বা শর্টকার্ট ধরবে, তাতে নাকি অনেক তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। জেঠু আমাদের বারণ করেছিল পাকদণ্ডী নিতে, তাই আমরা ঘুরপথেই চড়াই ভেঙে এগোতে লাগলাম।
আপার লিঞ্চোলি আরও তিন কিলোমিটার এখান থেকে। বেলা বাড়তেই সাদ সাদা মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে কেদারনাথের তুষারশৃঙ্গকে। কিন্তু আমাদের চলার পথে রোদ বাড়ছে। টুপি অনেক আগেই খুলে ফেলেছিলাম, এখন জ্যাকেটও আর গায়ে রাখা যাচ্ছে না। পথ চলার পরিশ্রমে বেশ গরম লাগছিল। খানিকদূর গিয়ে দেখলাম ফিরতি পথে নামছে একদল বাঙালী। কেদারনাথের পথে এই প্রথম আমরা কোন বাঙালির মুখ দেখলাম। দু-তিনজন ভদ্রমহিলা, কয়েকজন ভদ্রলোক আর একটি বছর দশ বারোর ছেলে। অনেক গল্প হল তাঁদের সাথে, ওনারা দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, গতকাল উঠেছিলেন কেদারনাথে। গতকাল আবহাওয়া নাকি খুব খারাপ ছিল (সেটা অবশ্য আমরা রামপুরে বসেই টের পেয়েছিলাম)। বৃষ্টিতে ভিজে ওদের বেশ নাকানি চোবানি খেতে হয়েছিল। কথার ফাঁকে জিজ্ঞাসা করে নিলাম যে আগে চড়াই কেমন, প্রত্যেকেই বলল যে আপার লিঞ্চোলির পর নাকি আর তেমন চড়াই নেই, শুধু বাচ্চা ছেলেটি বলল এরপর চড়াই নাকি আরও বেশি।
ওদের বিদায় জানিয়ে আবার চড়াই ভাঙতে শুরু করলাম আমরা। চড়াই, চড়াই, আর চড়াই। এর যেন শেষ নেই। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ঘোড়ায় চড়া যাত্রীরা। ঘোড়াগুলোর স্বভাব বড় অদ্ভুত, রাস্তা যতই ফাঁকা থাকুক ওরা যাবে ঠিক খাদের কিনারা ঘেঁসে। জানিনা যাত্রীরা কিভাবে নির্ভয়ে বসে থাকে ঘোড়ার পিঠে, আমার তো ওদের দেখেই ভয় লাগছে। তিনটের সময় দেখা গেল আপার লিঞ্চোলির ঘরবাড়ি। সামনের রাস্তা বেশ ভাঙাচোরা। রাস্তা ভেদ করে মন্দাকিনীর বুকে নেমে গেছে একটা বরফের ধারা। ধুলোর আস্তরণে ঢাকা যেন বরফের একটা নদী, বরফ গলে গলে টুপটুপ করে জল পড়ছে। বুঝলাম এটা ছোট একটা গ্লেসিয়ার, শীতের সময় বরফ জমে তৈরী হয় আবার গরমে গলতে শুরু করে। আমরা যেটা দেখছি সেটা গত বছর শীতে জমা বরফ। গ্লেসিয়ার পেরিয়ে আমরা লিঞ্চোলিতে পৌছালাম। এখানে এসে কৃষ্ণ আমাদের অবাক করে দিয়ে নিজে থেকেই খেতে চাইল।
এখন আর কি খাওয়া যায়, একটা দোকানে বলেকয়ে গরম গরম পরোটা ভাজার ব্যবস্থা করা হল। এই ফাঁকে খানিকটা রেস্ট নিয়ে নিই। একটা ব্যাপার খেয়াল হতে অবাক হলাম, পথের সবচেয়ে কঠিন অংশ পার করতে আমার সত্যি তেমন কষ্ট হয়নি, যতটা হয়েছিল জঙ্গলচটি থেকে ভীমবলি আসতে। এটাই কি মায়ের করুণা, কেদারনাথের কৃপা? কি জানি…
এদিকে গৌরীকুণ্ড ছাড়াবার পর থেকেই BSNL আর এয়ারটেল দুজনেই কাজে জবাব দিয়েছিল। লিঞ্চোলিতে এসে প্রথম ফোনে টাওয়ার পেলাম। এখানে অস্থায়ী মোবাইলের টাওয়ার বানানো হয়েছে একটা। সুযোগ পেয়েই ফোন লাগালাম জেঠুকে। ‘আমরা আপার লিঞ্চোলিতে পৌঁছে গেছি, আর দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে কেদারনাথ পৌঁছে যাব, আজ আর ফেরা হবে না। কাল ফিরব’। জেঠু উদ্বিগ্ন ছিল, আমাদের ফোন পেয়ে নিশ্চিন্ত হল খানিকটা।
সাড়ে তিনটের দিকে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এরমধ্যে যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি সেই আশ্বাস দিয়েছে যে সামনে আর চড়াই তেমন নেই, কেদারনাথ এই তো…এসে পড়ল বলে। কিন্তু লিঞ্চোলির ঘরবাড়ির আড়াল ছাড়িয়ে সামনের পথ বেড়িয়ে আসতেই দেখলাম চড়াই যেন আরও বেড়ে গেছে। মনে মনে খুব গালি দিলাম তাদের সবাইকে, যারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল। দেখা গেল একমাত্র কলকাতার সেই বাচ্চা ছেলেটিই সত্যি কথাটা বলে দিয়েছিল।
চড়াই বলে তো আর বসে পড়া যায় না, ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। আমরা ইতিমধ্যে ১০০০০ ফুট উপরে উঠে এসেছি, অক্সিজেন বেশ কমে গেছে, তাই চড়াইয়ের কষ্ট এখন আরও বেশি। আকাশে মেঘ জমেছে, ঠান্ডা বাড়ছে। জ্যাকেটটা আবার গায়ে জড়িয়ে নিলাম। বেশ খানিকটা গিয়ে একটা ছাউনির তলায় দেখলাম ফ্রিতে চা দেওয়া হচ্ছে। লিঞ্চোলিতে আমি আর অতনু কিছু খাইনি, তাই এখানে একগ্লাস করে চা খাওয়া হল।
আমাদের ঠিক উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে আগেকার পথের শেষচটি গরুড়চটি। জনপদের ঠিক মাঝামাঝি প্রায় দোতলা বাড়ির সাইজের একটা বোল্ডার (যেটাকে দূর থেকে দেখে আমরা প্রথমে কেদারনাথের মন্দির বলে ভুল করেছিলাম), এছাড়া পুরো জনপদটি অক্ষত। শুধু জনপদে আসার ও যাওয়ার দুদিকের রাস্তাই গায়েব, মন্দাকিনী যেন নিপুন হাতে মুছে দিয়েছে। এককালের যাত্রীসঙ্কুল ঋদ্ধ জনপদ এখন নির্জনতায় ডুবে তাকিয়ে আছে এপারের নতুন জনপদ লিঞ্চোলির দিকে।
চা খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করে দিলাম। বেশ ক্লান্ত লাগছিল আমার, অতনুও বেশ কাহিল। কৃষ্ণ কিন্তু এখনও চাঙ্গা, চড়চড় করে উঠে যাচ্ছে একটানা, তারপর অপেক্ষা করে থাকছে আমাদের জন্য। এভাবে প্রায় দু কিলোমিটার পথ যাওয়ার পর আমাদের সামনে কেদারনাথের শেষ চড়াইটুকু নজরে এলো। সামনে সিকি মাইল পথ সমতল বলা চলে, কিন্তু সেখানে রাস্তা বলে প্রায় কিছু নেই। আগের মতই একটা গ্লেসিয়ার রাস্তা কেটে নেমে গেছে মন্দাকিনীর বুকে। যদিও আমরা এখন মন্দাকিনীর নদীখাত থেকে অনেক অনেক উপরে, খাদের কিনারায় গেলে তাকে দেখা যায় হয়ত, কিন্তু তার গর্জন প্রায় কানে আসছে না বললেই চলে। গ্লেসিয়ার পার করেই আবার কঠিন চড়াই। সাপের মতন এঁকেবেঁকে উঠে গেছে রুদ্রা পয়েন্টের দিকে। রুদ্রা পয়েন্টেই চড়াই শেষ। শেষবেলায় এসে এই চড়াই দেখে আমার সত্যিই কান্না পেল। আর পারা যাচ্ছে না, অতনুরও চোখমুখ তাই বলছে। গ্লেসিয়ারের পাশেই একটা বড়সড় পাথর দেখে বসে পড়লাম।
মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও যেন পড়ল গায়ে। মেঘের জন্য সন্ধ্যাও নামতে আর বেশি দেরি নেই। বেশিক্ষণ বসলে চলবে না। কিন্তু শরীর চাইছে না। আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে অজস্র নাম না জানা ফুল ফুটে আছে, ফুরফুরে বাতাসে তাদের বুকে যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। এখানেই বসে থাকিনা কেন যতক্ষণ ইচ্ছা, শরীর মন দুজনেই তখন একই কথা বলছে। এই সময় আসতে দেখলাম একদল মহিলাকে, তাঁরা প্রৌঢ়ত্ব ছাড়িয়ে বার্ধক্যের পথে পা বারিয়েছেন। একমনে হরিনাম করতে করতে তাঁরা উঠে গেলেন রুদ্রা পয়েন্টের দিকে। এঁরা নিশ্চয় আমাদের পরে গৌরীকুণ্ড থেকে রওনা দিয়েছিলেন। এঁরা যদি বিশ্বাসের জোরে পারেন আমরা কেন পারবনা। নতুন করে উতসাহ এলো মনে। উঠে দাঁড়ালাম আবার।
কৃষ্ণ দেখল সবার মধ্যে আমিই বেশি কাহিল, তাই ও একরকম জোর করেই আমার কাঁধের ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে নিজে বইতে লাগল। ঠিক করলাম শেষ চড়াইটুকু আর ঘুরপথে যাবনা, এটুকু কষ্ট করে পাকদণ্ডী দিয়েই চলে যাব। করলাম ও তাই, একটু একটু করে পাকদণ্ডী বেয়ে উঠি আর একটু একটু করে দাঁড়াই। এইভাবে পাঁচ ছয় দফায় চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম রুদ্রা পয়েন্টে। সামনে প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা সমতল। কিন্তু দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে, আমাদের তাড়াতাড়ি বেসক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে।
কিন্তু চলতে গিয়েই আবার ঘোর বিপত্তি। পাকদণ্ডীতে পায়ের উপর প্রচুর অত্যাচার হয়েছে, ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, দুপায়ের পেশিতে ক্র্যাম্প ধরেছে। অতনুও পারলে বসে পরে। কোনরকমে কৃষ্ণর কাঁধে হাত রেখে এগোতে লাগলাম। কিছুদুর গিয়েই বুঝলাম কৃষ্ণও এবার হাঁপিয়ে উঠেছে, তখন প্রমাদ গুনলাম।
কিছু কিছু সময় বিপদের মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত সাহায্য এসে তার আস্তিক্যবুদ্ধি বাড়িয়ে দিয়ে যায়। আমাদের সঙ্গেও এখন ঠিক তাই হল। তিনজনেই যখন কষ্টে শিষ্টে কোনরকমে এগিয়ে চলেছি, পা আর চলে না, ঠিক তখন সামনে দুজন মানুষ এসে হাজির। একজন হিন্দিতে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনারা কি বাঙালি’? বললাম হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের ঘরে, শান্ত চেহারা। পরিচয় দিয়ে বললেন, যে উনি কেদারনাথ মন্দিরের তীর্থপুরোহিত। আমরা পরে ওনাকে শুক্লাজী বলে ডেকেছি। আমাদের অবস্থা কাহিল দেখে উনি নিজেই আমাদের সঙ্গে নিয়ে চললেন বেসক্যাম্পের দিকে। বেসক্যাম্প এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। শুক্লাজী নানা কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন। শারীরিক কষ্ট উনি লাঘব করতে পারবেন না ঠিকই, কিন্তু ওনার উপস্থিতিই যে আমাদের কতখানি ভরসা যুগিয়েছে, মনের বল কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে, সেকথা হয়ত আমরা ছাড়া কেউ কোনদিনই বুঝবে না।
দশম পর্ব
শুক্লাজীর সাথে আমরা বেসক্যাম্পে পৌছালাম তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। এখানে দুটি সংস্থার পরিষেবা পাওয়া যায়। নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং (NIM) আর গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগম (GMVN)। খরচ ও পরিষেবা দুটোতেই সমান। তাঁবুতে জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা, তবে তাঁবুতে থাকলে বাইরে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া আছে প্লাইউডের তৈরী ঘর, জনপ্রতি ভাড়া ৩০০ টাকা, অ্যাটাচড্ বাথ সহ। আমরা GMVN এর প্লাইউডের ঘরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছয়জনের থাকার ব্যবস্থা এক একটা ঘরে, হয় ছয়জনের ভাড়া দিয়ে পুরো ঘর ভাড়া করতে হবে, নয়তো শেয়ার করতে হবে। আমরা শেয়ার করতে রাজি ছিলাম, কিন্তু যাত্রীর সংখ্যা কম থাকায় তিনজনের ভাড়া দিয়েই গোটা রুমটা আমরা পেয়ে গেলাম। শুক্লাজী ক্যান্টিনে বলে দিলেন আমাদের চা খাওয়াতে, তারপর নিজেই ঘর অবধি আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেলেন।
১২ নম্বর ঘরটা আজ আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে, ভাড়া রাতে খাওয়ার সময় মিটিয়ে দিলেই চলবে। ছিমছাম সুন্দর ঘর, মেঝেতে ছখানা পরিছন্ন বিছানা পাতা রয়েছে। আমরা কোনরকমে জুতোজোড়া খুলে এক একটা বিছানায় ‘প্রপাত চ’। শুক্লাজী আমাদের প্রত্যেককে তাঁর ভিজিটিং কার্ড একটা করে দিয়ে দিলেন। আগামীকাল মন্দিরে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা হবে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন যে রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে থাকবে, অক্সিজেন কমে যাবে, তাই চিত হয়ে না শুয়ে একপাশ ফিরে শুতে, এতে শ্বাসকষ্ট হবে না।
শুক্লাজী চলে গেলেন, আমরা জড়পদার্থের মতন পড়ে আছি বিছানায়। আমার পায়ে আবার ক্র্যাম্প ধরেছে, অমানুষিক যন্ত্রণা। অতনু আর কৃষ্ণ দুজনে আমার দুটো পা ধরে টানতে লাগল। একটু আরাম হলে ব্যাগ থেকে আর্নিকা জেল বের করে বেশ করে পায়ে মালিশ করলাম। ম্যাজিক দেখাতে অভ্যস্ত এই হোমিওপ্যাথিক ওষুধটি, লাগানোর পর থেকে আর একবারের জন্যও আমার পায়ে ক্র্যাম্প ধরেনি। আটটার সময় কৃষ্ণ ডাকল, ডিনারের সময় হয়ে গেছে, সরকারী ক্যান্টিনে যেতে হবে।
খাওয়ার ইচ্ছা বিন্দুমাত্র ছিল না, এক পা-ও আর চলার শক্তি নেই; তাই বললাম ‘তোরা খেয়ে নে, আমি আর খাবনা কিছু’। কিন্তু ওরা দুজনেই নাছোড়বান্দা, আমি না খেলে ওরাও খেতে যাবে না। অগত্যা যেতেই হল। রুটি, সবজি, ডাল ভরপেট খাওয়া ৭০ টাকা। আমি দুটো রুটি আর ডাল নিলাম। ঝাল ঝাল ছোলার ডাল, খেতে মন্দ লাগল না। ক্যান্টিন থেকে আমাদের ঘর গজ পঞ্চাশেক দূরে। খেয়ে দেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেলাম।
আকাশের মেঘ কেটে গেছে, তারায় তারায় আকাশ ভরে গেছে, আর আমাদের ঠিক সামনে অন্ধকার আকাশের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে তুষারশুভ্র কেদারনাথ শৃঙ্গ। নবমীর চাঁদের জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে করছে তার দেহ। এদৃশ্য পৃথিবীর দৃশ্য হতে পারে না। আমরা নির্ঘাত পথ ভুলে চলে এসেছি কোন অজানা গ্রহে, অথবা যক্ষরাজ কুবেরের অলকাপুরীতে। এদৃশ্য ক্যামেরায় ধরা যায়না, বর্ণনায় আঁকা যায় না। এশুধু দ্রষ্টার নিজের, একান্ত নিজের সম্পদ। কৃষ্ণকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম, ও জোর করে খেতে না নিয়ে এলে এদৃশ্য দেখা হত না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম অপার্থিব সেই শোভা, তারপর নিঃশব্দে ফিরে চললাম ঘরের দিকে।
ঘরে এসে যে যার বাড়িতে একবার করে ফোন করে নিলাম। তারপর লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম, শরীর খুবই ক্লান্ত, জমিয়ে ঘুম দরকার। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আজ সারাদিনের কথা। সকালে রামপুর থেকে রওনা দেওয়া, জেঠুর উদ্বিগ্ন মুখ, গৌরীকুণ্ড, ভীমবলি, রামবাড়ার পুলের পাশে বসে থাকা, লিঞ্চোলির চড়াই… ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি টেরই পাইনি।
ঘুম ভাঙল মাঝরাতে, খুব বমি পাচ্ছে। কোনরকমে বাথরুমে গিয়ে বমির চেষ্টা করতেই সন্ধ্যায় খাওয়া রুটি আর ডাল উঠে এল। অতনু আর কৃষ্ণও জেগে উঠেছে, ওদের দুজনেরও সমস্যা হচ্ছে। অতনুর মাথার যন্ত্রণা, কৃষ্ণর শ্বাসকষ্ট। বুঝলাম তিনজনেরই সমস্যার কারণ একটাই, অক্সিজেনের অভাব। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১১৭০০ ফুট উপরে রয়েছি আমরা, তার উপর তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে (বাড়ি ফিরে গুগল করে দেখেছিলাম, কেদারনাথ উপত্যকায় সেরাত্রের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস)। এমত অবস্থায় অক্সিজেনের অভাব হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আমরা শুক্লাজীর পরামর্শের কথা মাথায় রেখে একপাশ ফিরে শুয়ে পরলাম। পরিশ্রান্ত দেহে আবার ঘুম নামতে দেরি করল না।
কৃষ্ণর ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে। গতরাতে বমি হয়ে যাওয়ায়, আর গাঢ় ঘুম হওয়ায় শরীর অনেকটাই ঝরঝরে। মন্দিরে যেতে হবে, ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দেরি হলেই ফড়িং আসা শুরু হয়ে যাবে। মন্দিরে ভিড় বেড়ে যাবে।(ফড়িং অর্থাৎ হেলিকপ্টার, চার সিটের এই পুঁচকে হেলিকপ্টারগুলোর আমরা নাম দিয়েছি ফড়িং)। যাইহোক, আমরা রেডি হয়ে নিলাম। আসার সময় বাড়ি থেকে ধুপের প্যাকেট এনেছিলাম সেটা নিলাম। অতনুর বাড়ি থেকে একটা নারকেল দিয়েছিল ট্রেনে আসার সময় মুড়ি দিয়ে খাওয়ার জন্য , ও সেটা না খেয়ে রেখে দিয়েছিল কেদারনাথের জন্য, এখন সেই নারকেল সঙ্গে নিয়ে নিল। ঘরের বাইরে বেরিয়েই চমক, দরজার সামনে বরফের স্তুপ, কাল রাতে জমা হয়েছে। এখান থেকে কেদারনাথ মন্দির নয় নয় করে এক কিলোমিটার, সমতল রাস্তা। বেসক্যাম্প থেকে বেরিয়ে মুলরাস্তায় উঠতেই নজরে এল কেদারনাথের মন্দির, প্রথমবারের জন্য। আমাদের তিনজনেরই হাত শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় মাথায় উঠে এল।
এগিয়ে চললাম আমরা, আস্তে আস্তে। জোরে হাঁটার কোনও ইচ্ছাই নেই, কারণ চারপাশে যা দেখছি তা জীবনে বারবার দেখার সুযোগ আসবে না। দুপাশে নরম ঘাসের গালিচা পাতা রয়েছে, গাড়োয়ালের ভাষায় এর নাম বুগিয়াল। বাঁপাশ দিয়ে গমগম করে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। দুপাশের শ্যামল, সবুজ পাহাড়ের মাথার উপর ঘননীল আকাশ আর আমাদের সামনে রাজাধিরাজের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে কেদারডোম শৃঙ্গ। গতরাতে পরা শিশিরকণা, ঘাসের উপর জমে বরফের ফুল তৈরী করেছে, কি বিচিত্র তার বাহার। দুপাশের পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে কেদারনাথ ভ্যালিতে তখনও রোদ এসে পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু সকালের রোদে ঝলমল করছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশছোঁয়া কেদারডোম, বরফের চাদরে রোদ ঠিকরে পড়ছে। পুরো কেদারনাথ উপত্যকা যেন হাসছে। সেদৃশ্য ক্যামেরায় ধরে রাখার বৃথা চেষ্টায় বেশি সময় নষ্ট না করে দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছি যতটা পারা যায়।
কেদারনাথ জনপদে (এখন আর শহর নেই একেবারেই) ঢোকার ঠিক আগে ডানদিকের পাহাড় থেকে একটা জলের ধারা এসে পড়েছে মন্দাকিনীর বুকে, তার নাম সরস্বতী। সরস্বতীর উপর ছোট্ট একটা পুল দিয়ে পার হয়ে কেদারনাথ মন্দিরের দিকে যেতে হয়। এই পুলের কাছে এসে শুক্লাজীর সাথে দেখা হয়ে গেল। পুজো দেওয়ার ব্যাপারে ওনার সাথে কথা বলে নিলাম। ৫০ টাকা থেকে পূজা শুরু, বেশি খরচ করেও পূজা দেওয়া যায়। আমরা প্রত্যেকেই যে যার মতন ১০০ টাকার পূজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠান্ডায় গলা খুশখুশ করছিল, শুক্লাজীকে সেকথা বলতেই উনি কোথা থেকে এককাপ গরম জল এনে আমায় খাইয়ে দিলেন।
অদ্ভুত নির্জন এই সকালের কেদার উপত্যকা। এখন সকাল আটটা বাজে, দুপাশে কয়েকটা আধভাঙ্গা বাড়িঘর আগেকার জমজমাট শহর-কেদারনাথের স্মৃতিটুকু বয়ে বেড়াচ্ছে। যে কয়েকটা বাড়ি অক্ষত, তাদেরও একতলায় ভর্তি পাথর আর বালি। সরকার থেকে এখানে স্থায়ী বাড়ি বা দোকানঘর বানানোর অনুমতি দেয়নি এখনও। আমাদের ঠিক সামনেই কেদারনাথের প্রাচীন মন্দির, প্রলয়ের তাণ্ডব প্রতিহত করে দাঁড়িয়ে আছে তার যুগ যুগান্তের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে বুকে নিয়ে। মন্দিরের সামনে কয়েকটা দোকান, দোকান বলতে একটা করে টেবিলে পূজার সামগ্রী নিয়ে সাজানো পসরা। তারই একটায় শুক্লাজী ১০০ টাকা দিতে বললেন, এই ১০০ টাকার মধ্যেই পূজার সামগ্রীর দাম ও শুক্লাজীর দক্ষিণা ধরা আছে। থালায় করে দিল নকুলদানা, মকাইদানা, ঘি, একটু দুধ, গঙ্গাজল, লাল চেলি, প্লাস্টিকের মালা।
মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বারের ঠিক সামনেই পাথরের বিশাল নন্দী শুয়ে আছে। বন্যার সময় অনেকে এই নন্দীর গলা জড়িয়ে থেকে প্রানে বেঁচেছিলেন। পূজার থালা নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম কেদারনাথের মন্দিরে। মন্দিরে তিনটে প্রকোষ্ঠ। প্রথম প্রকোষ্ঠে ঢুকেই ডানদিকে দরজার পাশে মা দুর্গার মূর্তি এবং চারদিকের দেওয়ালে কৃষ্ণ, পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপ্রদীর মূর্তি। দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ হল নাটমন্দির, এখানে কোন দেবদেবীর মূর্তি নেই, আছে পিতলের তৈরি ছোট একটি নন্দী। নন্দীর ঠিক সামনেই গর্ভমন্দিরের দরজা।
এই দরজা দিয়ে ঢুকতে গা শিরশির করে উঠল। পঞ্চপাণ্ডব থেকে আদি শঙ্করাচার্য়, আদিকাল থেকে কত ভক্তজন, মহাপুরুষ এসে কৃতার্থ হয়েছেন এই গর্ভগৃহে। ইলেকট্রিক আলো জ্বলেনি, প্রদীপের মিটমিটে আলোয় আলো-আধারির পরিবেশ তৈরি করেছে। ধুপ, ধুনো, ঘি, চন্দনের মিশ্রিত সুবাসে ম ম করছে মন্দির। মন্দিরের ঠিক মাঝখানেই বৃষের পিঠের কুজের আকৃতির প্রস্তরময় জ্যোতির্লিঙ্গ। আদি শঙ্করাচার্য় সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বারোটি জায়গায় ভগবান আশুতোষের বিশেষ উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন। এই বারোটি জায়গার শিবলিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়। কাশীর বিশ্বনাথ, উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বরে মামলেশ্বর, দেওঘরে বৈদ্যনাথ, সেতুবন্ধে রামেশ্বর ইত্যাদি। হিমালয়ে অবস্থিত একমাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ হলেন এই কেদারনাথ।
কেদারনাথ লিঙ্গের ঠিক পিছনের দেওয়ালে একটি কুলুঙ্গিতে পিতলের মহাদেবের ধ্যানমূর্তি। শীতকালে এই মূর্তিটিকেই শোভাযাত্রা করে উখীমঠে নিয়ে যাওয়া হয়, পূজার জন্য এবং অক্ষয় তৃতীয়ার দিন আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় কেদারনাথে। এই যাত্রার নাম ডোলিযাত্রা। অক্ষয় তৃতীয়া থেকে ভাই দ্বিতীয়ার দিন পর্যন্ত কেদারনাথের পূজা হয় এই মন্দিরের জ্যোতির্লিঙ্গে। পশ্চিমের দেওয়ালে আরও ছোট একটা খুপরির মধ্যে জ্বলছে অনির্বান শিখার প্রদীপ। শীতে মন্দির বন্ধের আগে প্রদীপে পর্যাপ্ত ঘি ঢেলে যাওয়া হয়, গ্রীষ্মে মন্দির খুলে দেখা যায় প্রদীপ একইভাবে জ্বলছে।
একাদশ পর্ব
জ্যোতির্লিঙ্গের পূর্বপাশে আমাদের বসার জায়গা করে দিলেন শুক্লাজী। উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রের নিখুঁত উচ্চারন সহযোগে, হাতে ধরে আমাদের পূজা করাতে শুরু করলেন তিনি। কেদারনাথের কোন শুচিবাই নেই। যে কেউ, স্নান করে হোক বা না করে, কেদারনাথকে স্পর্শ করতে পারে, আলিঙ্গন করতে পারে। আমরা মহানন্দে পূজা করতে লাগলাম। জ্যোতির্লিঙ্গের গায়ে ঘি মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, তাঁকে মালা পরানো হল। অতনুর বাড়ি থেকে আনা নারকেল এখানে কাজে লেগে গেল। পূজা শেষে আমরা প্রত্যেকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলাম কেদারনাথকে। তারপর দক্ষিনাবর্তে প্রদক্ষিণ করলাম কেদারনাথকে। প্রদক্ষিণ শেষে প্রধান পুরোহিত চেয়ে নিলেন আমার হাতে থাকা ধুপের প্যাকেটদুটি। একটা প্যাকেট এখনই জ্বালানো হবে, আরেকটা রেখে দেওয়া হবে সন্ধ্যারতির সময় জ্বালানোর জন্য। এরপর আমরা বেরিয়ে এলাম গর্ভগৃহ থেকে। সামনেই পিতলের নন্দী, শুক্লাজী বললেন নন্দীর কানে কানে আমাদের মনোবাঞ্ছা জানাতে।
মনোবাঞ্ছা জানিয়ে আমরা এলাম বাইরের প্রকোষ্ঠে, এখানে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদির মূর্তি দর্শন করলাম। শেষকালে এলাম মা দুর্গার কাছে। আজ বিজয়া দশমী, মায়ের আশীর্বাদ নেওয়ার শ্রেষ্ঠ দিন। প্রণিপাত জানিয়ে করুণাভিক্ষা করলাম মায়ের কাছে। তারপর তৃপ্ত হৃদয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম।
মন্দির চত্বরে প্লাস্টিকের ম্যাট পাতা রয়েছে, সেখানে বসে রয়েছেন অনেক সাধু সন্ন্যাসী। শুক্লাজী আমাদের বললেন যে এইখানে বসে ইচ্ছা মতন ধ্যান করতে পারি। আমরা যে যার নিজের মতন করে ঈশ্বরচিন্তা করতে লাগলাম।
কেদারনাথ মন্দিরে এসেছি একঘণ্টা হল। প্রায় আধঘণ্টা ধরে নিজের হাতে পূজা করেছি কেদারনাথের। এ অভিজ্ঞতা কোন তীর্থস্থানে আমার আগে হয়নি। ভগবান এখানে অনেক বেশি কাছের, নিজের। অতনু আরেকবার গেছে গর্ভমন্দিরে। আমি আর যাইনি। মন্দির চত্বরে বসে বসে হিমালয়ের শোভা দেখছি।
কি নির্জন এই কেদারনাথ উপত্যকা, সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক মানুষ আছেন এইমুহূর্তে। অবশ্য একটু বাদে হেলিকপ্টার আর ঘোড়ার দল এসে পড়লেই ভিড় বাড়বে, কিন্তু সেও আর কতজন? দুবছর আগেও এই নির্জনতা কেদারনাথে কল্পনাও করা যেত না। ২০১৩ র ১৭ই জুনের শিবতাণ্ডব কেদারনাথ উপত্যকাকে যেন একশো বছর পিছিয়ে নিয়ে গেছে। ১৮৮২ সালে জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার তোলা কেদারনাথ মন্দিরের একখানা ছবি দেখছিলাম, নির্জন উপত্যকায় একা দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরখানি, পাশে ছোট ছোট ঝোপে ফুটে আছে নাম না জানা পাহাড়ি ফুল। আজ সকালের এই জনবিরল কেদারনাথ উপত্যকায় বসে বসে মনে পরে যাচ্ছে সেই ছবির কথা। ইতিহাস যেন উল্টো পথে হেঁটে আবার চলেছে ১৫০ বছর আগের সেই মুহূর্তে। জানিনা আবার কবে আসতে পারব এখানে, যদিও বা আসি ততদিনে হয়ত আবার আগের মতন শহর হয়ে উঠবে কেদারনাথ। তাই এই নিরালা কেদারনাথ মন্দিরের পবিত্র পরিবেশ চোখ, কান, নাক সবকিছু দিয়ে যেন লুটে নিচ্ছি।
মন্দির থেকে ভেসে আসছে নাগচম্পা ধুপের সুবাস, এগন্ধ আমার অতি পরিচিত, কারণ এ ধুপ আমাদেরই আনা। মন্দিরের মাথায় লাগানো ছোট্ট লাউডস্পিকারে বেজে চলেছে শিবমহিম্ন স্তোত্র। সেই সুরে সুর মিলিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ করে চলেছেন এক সন্ন্যাসী।
“রুচীনাং বৈচিত্র্যাদ্দৃজুকুটিলা নানাপথজুষাং
নৃনামেকোগম্যত্বমসি পয়সামর্ণব ইব”
রুচির বৈচিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সাধনপথে এগিয়ে চলেছে, তার কোনটা সহজ সরল, কোনটা বা আঁকাবাঁকা জটিল পথ। কিন্তু সকলের অন্তিম গন্তব্য, পরম লক্ষ্য সেই তুমি।
শিবমহিম্ন স্তোত্র আমি আগেও শুনেছি অনেকবার, বেলুড় মঠের ট্র্যাডিশনাল সুরে। এখানের সুরটি ভিন্ন, কিন্তু অসম্ভব শ্রুতিমধুর। হিমালয়ের রূপ, দেবালয়ের পবিত্রতা, মহাদেবের তুষারশুভ্র জটা স্পর্শ করে আসা হিমশীতল বাতাস সবমিলিয়ে যেন একটা স্বপ্ন। অসামান্য এই পরিবেশ, এ পরিবেশ আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। আশুতোষ মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করি এ মুগ্ধতা আমার সারাজীবন বজায় থাকুক।
অতনু ফিরে এসেছে এরমধ্যে। এবারে তিনজনে মিলে মন্দিরের আশপাশটা দেখে নিতে শুরু করলাম। ডানদিকের পাহাড়ের গায়ে বেশ খানিকটা উপরে ভৈরবনাথের মন্দির। বাঁদিকে পাহাড়ের গা দিয়ে উঠে গেছে বাসুকিতালের পথ। এবার এদুটোর কোনটাই যাওয়া হবে না, ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে ঘুরে আসার। মন্দিরের ঠিক পূর্বপাশেই আগে ছিল আদি শঙ্করাচার্য়ের সমাধিস্থল, সেটা এখন আর নেই। মিলিটারি ক্যাম্পের একটা ঘরে বসানো রয়েছে শঙ্করের একটা মূর্তি। কথিত আছে শঙ্কর ৩২ বছর বয়সে কেদারনাথে আসেন, এখানেই রচনা করেন বিখ্যাত দক্ষিণামূর্তিস্তোত্র, তারপর এখানেই সমাধিযোগে নির্বান লাভ করেন। মন্দিরের সামনে তবু দুয়েকটা বাড়িঘর এখনও টিকে আছে, পিছনের দিকে একেবারেই কিচ্ছু নেই। শুধু বড়বড় বোল্ডার আর বালির স্তর।
মন্দিরের ঠিক পিছনেই একটা বিশাল পাথর, এর নাম ভীমশিলা। পাহাড় থেকে নেমে আসা বন্যার স্রোতকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল এই পাথর, আর ভাগ হয়ে যাওয়া স্রোতের মাঝখানে রক্ষা পেয়েছিল কেদারনাথের মন্দির। সামনেই সুবিশাল কেদারডোম শৃঙ্গ (উচ্চতা ২২৭৭০ ফুট অর্থাৎ ৬৯৪০ মিটার)। এরই পাদদেশে ছিল চোরাবালিতাল (নামান্তরে গান্ধী সরবোর) নামের এক সরবোর, ২০১৩ র ১৬ই জুন ক্লাঊডবাস্টে চোরাবালিতালের জলস্তর ধারন ক্ষমতা অতিক্রম করে যায়। যার ফলে ১৭ই জুন চোরাবালিতালের দক্ষিণ দিকের পাড় ভেঙে যায় এবং প্রবল বন্যা নেমে আসে কেদারনাথ উপত্যকায়। বন্যা নেমে আসার পথ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এখনও। মন্দিরের চারদিক দেখে নিয়ে আমরা গেলাম বদ্রি-কেদার মন্দির কমিটির অফিসে, এখানে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য শুকনো প্রসাদের প্যাকেট পাওয়া যায়, তাই কিনে নিলাম সবাই।
এবারে ফেরার পালা। রোদ বাড়তে শুরু করেছে, যাত্রীর সংখ্যাও। হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন হল। সরস্বতী নদীর উপর সেই ছোট পুলটার কাছে এসে শুক্লাজীকে খুঁজে পেলাম। তিনি ধ্যান করতে বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন আর দেখতে পাইনি। এত সুন্দর পূজা করা গেছে, আমরা তাঁকে কিছু প্রণামী দিতে চাই। শুক্লাজী কিছুতেই নেবেন না, তাঁর এক বক্তব্য, পূজার ১০০ টাকার মধ্যেই তাঁর প্রণামী ধরা আছে, বেশি টাকা নিলে অন্যায় হবে। শেষপর্যন্ত একরকম জোর করেই তাঁকে কিছু প্রণামী দেওয়া গেল। এই ২৫ বছর বয়সে নয় নয় করে অনেক তীর্থস্থানে গেছি আমি, কিন্তু শুক্লাজীর মতন সৎ, নির্লোভ ও আন্তরিক তীর্থপুরোহিত (পাণ্ডা বলতে আমার বাঁধছে) আমি সত্যিই দেখিনি। তাঁকে বিদায় জানালাম এবার, ভবিষ্যতে আবার কেদারনাথ এলে নিশ্চয়ই তাঁর সাথে দেখা করব। মিনিট পনেরো হেঁটে বেসক্যাম্পে ফিরে এলাম, বেলা তখন এগারোটা।
তাড়াতাড়ি ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আজই ফিরে যেতে হবে রামপুর। ১৬ কিলোমিটার উতরাই নামতে হবে, কাজেই দেরি করা যাবে না। সাড়ে এগারোটায় লাঞ্চ করে নিলাম ক্যান্টিনে। তারপর দেবদর্শনিতে এসে আরও একবার প্রণাম জানালাম কেদারনাথের উদ্দেশ্যে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম কেদারনাথ উপত্যকাকে। ঘাসে ঢাকা বুগিয়াল, দুপাশের সবুজ পাহাড়, উচ্ছলা তন্বী মন্দাকিনী, রাজকীয় কেদার ও কেদারডোম পিক, চোখে মেখে নিচ্ছিলাম প্রাণভরে, আরও একবার। কৃষ্ণ তাড়া দিল, ‘চল চল ১২টা বেজে গেছে’। আমরা চলা শুরু করলাম। বিদায় কেদার উপত্যকা। জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল কয়েকটা ঘণ্টা ফেলে যাচ্ছি তোমার কাছে, তোমার গহন বুকে তুমি তা যত্ন করে রেখে দিও।
রুদ্রাপয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তা সমতল, তারপর উৎরাই শুরু হল। শুধুই নামা, আজ আমাদের কোন পরিশ্রম নেই। কোনও তাড়াও নেই, সন্ধ্যার আগে গৌরীকুণ্ড পৌছালেই হল। তাই কাল চড়াই ভাঙার কষ্টে যেসব নিসর্গদৃশ্য উপভোগ করা বাকি থেকে গিয়েছিল, সেগুলো এখন নামার সময় উশুল করে নিতে হবে। আমরা একটু একটু নামছি, একটু করে দাঁড়াচ্ছি, প্রচুর ছবি তুলছি। কখনও বা ঝর্নার পাশে একটা পাথর দেখে বসে বসে খানিক গল্প করে নিচ্ছি। বেসক্যাম্পে আমাদের ঘরে আমাদের তিনজনের তিনটে লাঠি ছাড়াও একটা বাড়তি লাঠি ছিল, হয়ত আগের কোন যাত্রী ফেলে গেছে। কৃষ্ণ সেই লাঠিটা সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে। দুহাতে দুটো লাঠি নিয়ে মহানন্দে নেমে চলেছে কৃষ্ণ।
দুপুর একটার মধ্যে আপার লিঞ্চোলি এসে পড়লাম। এখানে একটা চায়ের দোকানে একটু বসলাম, অতনু আর কৃষ্ণ নিল একটা করে আমূল কুল, আমি একটা মিরিণ্ডা। মিরিন্ডায় চুমুক দিতে দিতে দোকানীর সাথে গল্প করছিলাম। ভদ্রলোকের জীবন খুবই দুঃখের। বন্যার আগে রামবাড়ায় তাঁর ব্যবসা ছিল, দুটো দোকান, একটা লজ। আয় মন্দ ছিল না। অভিশপ্ত ১৭ই জুন সকালের দিকে তিনি তখন দোকানেই ছিলেন, শুনলেন বন্যা আসছে। মন্দাকিনীর প্রবল গর্জনে বাইরে এসে দেখেন তখন হাতে আর সময় নেই। কোনরকমে প্রাণহাতে করে পাশের পাহাড়ে উঠতে থাকেন, দোকান বাঁচানো তো দূর, ক্যাশবাক্সের টাকাটুকুও নেওয়ার অবকাশ পাননি। তারপর চোখের সামনে রামবাড়াকে মুছে যেতে দেখেছিলেন। সর্বশ্রান্ত তো হয়েই ছিলেন, হারিয়েছিলেন নিকট আত্মীয়দেরও। এখন সরকারী সাহায্যে এই চায়ের দোকানটুকু তৈরি করেছেন, এটাই জীবন ও জীবিকা দুই। সচ্ছল জীবন থেকে একলহমায় বলা যায় পথে এসে দাঁড়িয়েছেন, তবুও কথা বলতে বলতে একবারের জন্যও ভেঙে পড়লেন না, বা ভাগ্যকে দোষ দিলেন না; উপরন্তু প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছেন সেজন্য বারবার ধন্যবাদ দিলেন কেদারনাথজীকে।
পাহাড়ি মানুষের স্বভাব সমতলের মানুষদের চেয়ে একেবারেই ভিন্নধারার। এরা অনেক বেশি বিশ্বাস করতে জানে, আবার অন্যের বিশ্বাসের মর্যাদাও রাখতে জানে অনেক বেশি। জেঠুর মুখে শুনেছি, কতবার কত মূল্যবান জিনিসপত্র সমেত ব্যাগ সামান্য একটা চায়ের দোকানে রেখে দিয়ে নিশ্চিন্তে চড়াইয়ের পথে চলে গেছে। কোনদিনও কোনকিছু খোয়া যায়নি। অবাক হয়ে দেখেছি রামপুরের ছোটিয়াজীকে, শুধুমাত্র নতুন আলাপ হয়েছে বলে প্রথমবারে কিছুতেই চায়ের দাম নেয়নি, সেটা নাকি লজ্জার বিষয় হবে। এরা মানুষকে সহজেই আপনার ভেবে নিতে পারে, কিন্তু উলটো দিক থেকে আমরাও কি পারি এত সহজেই তাদের আপন বলে স্বীকার করে নিতে? তার উত্তর কে জানে?
দ্বাদশ পর্ব
আমরা আবার নামতে শুরু করি। আকাশের রঙ যে এত গাঢ় নীল হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পিছন ফিরে তাকালে এখনও রুদ্রাপয়েন্টের লালরঙের মেডিকেল ক্যাম্পটা দেখা যাচ্ছে, ওর ঠিক পিছনেই কেদার উপত্যকা, যার মাথায় ছাতা ধরে আছে শ্বেতশুভ্র কেদার ও কেদারডোমের যমজ শৃঙ্গদুটি। বেলা বাড়তেই পেঁজা তুলোর মতন সাদা সাদা মেঘের টুকরো এসে ভিড় করেছে তাদের চুড়ার কাছে, আর ঘণ্টাখানেক বাদেই হয়ত ঢেকে দেবে পুরোটাই।
নামার সময় আমরা সুযোগ পেলেই পাকদণ্ডী ব্যবহার করছি, সেগুলোতে খাড়াই অনেক বেশি, কাজেই খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কিন্তু ঘুরপথের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছি আমরা। আপার লিঞ্চোলি থেকে লোয়ার লিঞ্চোলি নেমে এলাম মাত্র ৪৫ মিনিটে। লোয়ার লিঞ্চোলি থেকে রামবাড়ার সেতুটা দেখা যাচ্ছিল। আমরা ঠিক করলাম তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে রামবাড়ার সেতুর পাশে খানিক বসব, তারপর পথে আর কোথাও না দাঁড়িয়ে একটানা নেমে যাব।
লিঞ্চোলি ছাড়িয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক উঠে আসছেন চড়াই বেয়ে, বয়স বছর পঞ্চাশেক। হাতের ব্যাগটিতে বাংলা লেখা দেখে বুঝলাম ভদ্রলোক বঙ্গজ। তিনি কিন্তু বুঝতে পারেননি যে আমরাও একগোত্রীয়। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন যে কেদারনাথ আর কতদুর। হেসে বললাম, আপনি বাঙলায় কথা বলতে পারেন আমাদের সাথে। কেদারের পথে বাঙালি পেয়ে খুব খুশি ভদ্রলোক। জমিয়ে গল্প শুরু করলেন।
ওনার নাম গোপাল, পেশায় স্কুল মাস্টার, স্কুলের নাম শুনে বুঝলাম তিনি আমার মামার সহকর্মী। সেকথা বলতেই তিনি একেবারে আহ্লাদে আটখানা, পারলে এখনি আমায় ভাগ্নে বলে ডাকতে শুরু করেন। গোপালবাবুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, ও শ্যালিকা চলেছেন কেদারনাথে। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে তাঁরা পিছিয়ে পরেছিলেন, কাজেই প্রথমে তাঁদের দেখতে পাইনি। এখন তাঁরাও এসে গল্প জুড়লেন, কি নাম, কোথায় থাকি, কি করি, এইসব।
পথশ্রমে তিনজনেই ক্লান্ত, কিন্তু গোপালবাবুর শ্যালিকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এঁদের কেউই লাঠি নেন নি গৌরীকুণ্ড থেকে, ভেবেছিলেন লাঠি আর কি কাজে লাগবে। লাঠির মাহাত্ত্য যখন বুঝলেন তখন আর লাঠি কেনার উপায় নেই। কৃষ্ণর কাছে দুটো লাঠি ছিল, তার একটা দেওয়া হল ওঁদেরকে। গোপালবাবুকে বললাম, কেদারনাথ এখনও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার, কিন্তু তার মধ্যে চার কিলোমিটারই বুকফাটা চড়াই, কাজেই সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যান। গোপালবাবুরা উঠতে লাগলেন, আমরা লাগলাম নামতে।
মাঝে মাঝে খাড়াই এত বেশি যে দেখে শিউরে উঠছি, এই চড়াই কাল আমরা উঠেছিলাম কিভাবে! রামবাড়া এসে পৌছালাম বেলা আড়াইটের সময়। মন্দাকিনীর সেতুর উপর বেশকিছুক্ষন সময় কাটালাম। মন্দাকিনীর প্রবল স্রোত, ততোধিক গর্জন। কৃষ্ণ ফটাফট ছবি নিয়ে চলেছে ক্যামেরায়। অতনু বসে আছে একটা পাথরের উপরে, আর আমি চেয়ে আছি ফেলে আসা পথের দিকে। ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে লোয়ার লিঞ্চোলির বাড়িঘর। মন বলছে আবার ফিরে আসব এ পথে, নিশ্চয় আসব।
সন্ধ্যার আগেই গৌরীকুণ্ড ফিরতে হবে, নাহলে সোনপ্রয়াগ যাওয়ার শেয়ারের জীপ পেতে অসুবিধা হবে। কাজেই আবার চলা শুরু করলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম, ভীমবলিতে আর দাঁড়ালাম না। এখন পা চালিয়ে নামতে হবে। নামছি, নামছি, আর নামছি। আজ পুরো পথটাই প্রায় নামা। মনে হয় নামতে বুঝি তেমন কষ্ট নেই। কিন্তু উৎরাই পথে হাঁপিয়ে যাওয়া, বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা না হলেও একটানা নামারও পরিশ্রম আছে। আমরা সেটা এখন টের পাচ্ছি ভালই। কাজেই পথে আর কোথাও বসব না ভাবলেও জঙ্গলচটিতে এসে আমাদের খানিক বসতেই হল।
একজায়গায় নিম্বুপানি পাওয়া যাচ্ছিল। একগ্লাস করে নিম্বুপানি খেলাম আমরা। মনে পড়ে যাচ্ছিল ওঠার সময়ে জঙ্গলচটিতে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া, এবং তারপরে ভীমবলি পর্যন্ত আমার শোচনীয় অবস্থার কথা। নিম্বুপানি খেয়ে আবার নামা শুরু।
জঙ্গলচটি থেকে গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত রাস্তাটা পুরোটাই বনভূমির মধ্যে দিয়ে। দুপাশের পাহাড়েই অসংখ্য গাছপালা। নামতে নামতে অতনুর সাথে আলোচনা করছিলাম যে সত্যিই এপথে পদযাত্রীর সংখ্যা এখন খুব কম। ওঠা নামা এই দুদিন মিলিয়ে খুব বেশি হলে জনা তিরিশেক মানুষকে দেখেছি হেঁটে যেতে। ঘোড়ায় চড়া যাত্রীর সংখ্যা তারচেয়ে অনেক বেশি ঠিকই, কিন্তু তাও পুরনো পথের বর্ণনা যা শুনেছি, বইয়ে পড়েছি, বা ভিডিওয় দেখেছি তার তুলনায় এ কিছুই নয়। কেদারের পথে যাত্রী সত্যিই অনেক অনেক কমে গেছে, বিপর্যয়ের পর।
হনুমানচটি পেরিয়ে গেলাম, আমরা এখন গৌরীকুণ্ডের একদম কাছে এসে পড়েছি। আমাদের বাঁদিকে পাহাড়ের মাথায় চাঁদ উঠেছে, বিজয়া দশমীর চাঁদ। আমরা নিঃশব্দে হেঁটে চলেছি। একটানা প্রায় ষোল কিলোমিটার উৎরাই পথে নেমে আমরা এখন খুব ক্লান্ত। পথ ফুরোলেই বাঁচি। অবশেষে সাড়ে পাঁচটার সময় সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকে এসে পৌছালাম, ওই যে দেখা যাচ্ছে গৌরীকুণ্ডের দোকানপাট।
গৌরীকুণ্ডে এসে প্রথমেই গেলাম গৌরীমায়ের মন্দিরে। আমরা পেরেছি মা, তোমার কৃপায় কেদারনাথ দর্শন করে এসেছি। নাটমন্দিরে ঢুকে আভূমি প্রণিপাত জানালাম মাকে। বিজয়া দশমীর দিনে পশ্চিমবাংলা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গহন কোলের মধ্যে আমরা হিমালয়-দুহিতা উমারূপী-দুর্গার দর্শন পেয়ে ধন্য হলাম।
মায়ের দর্শন সেরে আমরা চললাম জীপস্ট্যাণ্ডে। কিন্তু তার আগেই একবিপত্তি। গৌরীকুণ্ডে এসে অবধি একবারের জন্যও ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। এদিকে রাজুদাকে বলতে হবে যে আমরা এসে গেছি, সোনপ্রয়াগে গাড়ি নিয়ে আসতে। কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাই না। ফোন দুয়েকবার রিস্টার্ট করলাম, তাতেও লাভ হলনা। ফোন না করতে পারলে, সোনপ্রয়াগ থেকে রামপুর পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে ফেরা ছাড়া গতি নেই। অথচ হাঁটার কথা ভাবলেই এখন দেহমন অবশ হয়ে আসছে। কি আর করি, যা আছে কপালে বলে জীপস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ালাম।
স্ট্যান্ডে এসে দেখি জীপ রয়েছে একটাই, যাত্রী ভর্তি হলে তবে ছাড়বে। অগত্যা বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অদ্ভুত ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন দেহ, আচ্ছন্ন মনও। তবে মনের একদম গভীরতম প্রদেশে একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দও যেন কাজ করছে। জীপের পিছনের সিটে বসে বসে সন্ধ্যা নামা দেখছিলাম। পাহাড়ের মাথায় মাথায় রোদের লেশটুকু লেগে আছে এখনও, কিন্তু নীচের এই উপত্যকা এখন আলোআঁধারির রহস্যময়তায় ডুবে গেছে। অনেকদূরে দেখা যাচ্ছে কেদারনাথ যাওয়ার পথ, তাতে দুয়েকটা গাধা মালপত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে, তাদের গলার ঘণ্টি টুংটাং শব্দ করতে করতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে জমাট নৈশব্দে।
আধঘণ্টা বসার পরে কয়েকজন যাত্রী এলেন। এবার জীপ ছাড়বে। জীপ ছাড়ার ঠিক আগে হঠাৎ দেখি মোবাইলে সিগনাল এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগালাম রাজুদাকে। যাক এবার নিশ্চিন্ত, আর অন্তত হাঁটতে হবে না আজকে। সোনপ্রয়াগ এসে পৌছালাম যখন তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। জীপস্ট্যাণ্ড থেকে বেরিয়েই দেখি জেঠু দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আনন্দে। আমরা গিয়ে প্রণাম করতেই আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরল জেঠু, ‘যাক, তোমরা পেরেছ’।
রাজুদা আসেনি আমাদের নিতে, অন্য আরেকজন ড্রাইভারের সাথে জেঠুকে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাইহোক, আমরা তার গাড়িতে চেপে আধঘণ্টার মধ্যে চলে এলাম রামপুরে, ‘নিউ শিবশক্তি লজে’। লজে এসে পৌঁছাতেই দেখলাম রাজুদা, অঙ্কুশ, অর্জুন, লজের মালিক সবাই সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় উঠে এসেছে আমাদের অভিনন্দন জানাতে। প্রত্যেকে আমাদের সঙ্গে আলিঙ্গন করল, আমাদের চেয়ে ওদের আনন্দও যেন কোন অংশেই কম নয়।
রাজুদা একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, এমনিতে ও মদটদ একেবারেই খায় না তবে নেহাত আজ দশেরা, তাই একটু ‘দারু’ পান করে ফেলেছে, সেজন্যই নিজে আমাদের আনতে যেতে পারেনি। তার এই অক্ষমতার জন্য ক্ষমাটমা চেয়ে একশেষ। রাজুদা এমনিতেই বকবক করতে ওস্তাদ, তার উপর আজ আবার পেটে দুপাত্তর পড়েছে, কাজেই আজ একেবারে ফুলঝুরি ছুটছে। ইতিমধ্যে এক রাউন্ড চা দিয়ে গেছে অঙ্কুশ। কত কথাই না হল, কিছু কথার অর্থ বুঝলাম, কিছুর অর্থ বোঝার চেষ্টাও করলাম না। শেষকালে আমায় বলল আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারাটা একবার দেখতে। আমার নাকটা নাকি ‘লিচির’ মতন লাল হয়ে গেছে। রুমে এসে আয়নায় দেখি সত্যিই নাকটা ঠান্ডায় পুড়ে গিয়েছে, রঙ হয়েছে টকটকে লাল।
রুমে ঢুকতেই টের পেলাম যে তুলতুলে গদি আর গরম কম্বল এখন আমাদের চুম্বকের মতন টানছে। জামাকাপড় ছেড়ে কোনরকমে হাতমুখ ধুয়েই কম্বলের তলায়। আধশোয়া হয়েই গল্প। আজ আবার বিজয়ে দশমী, কাজেই বাড়িতে ফোন করে বিজয়ার প্রণাম জানালাম। তারপর জেঠুর সাথে জমিয়ে গল্প। এই দুদিনের সমস্ত অভিজ্ঞতা যেন ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে। গল্প আর ফুরোয় না।
আটটার সময় অঙ্কুশ এসে ডেকে নিয়ে গেল, খাবার রেডি। সেই মোটা মোটা রুটি, চাপ চাপ ডাল, আর ঝালঝাল সবজি; সেই অপূর্ব স্বাদ। খেতে খেতেই বুঝতে পারছিলাম শরীর আর বইছে না, সুতরাং খেয়েদেয়ে ঘরে এসেই শুয়ে পড়লাম আমরা। আজ আর গল্প নয়। দুদিন ধরে প্রচুর পরিশ্রম হয়েছে, এখন নিঝুম ঘুম দরকার।
এবারের মতন কেদারনাথ পর্ব এখানেই শেষ। কাল সকালেই রওনা দেব উখিমঠের দিকে, সেখান থেকে চোপ্তাভ্যালী দেখে ফেরার পথে রাত্রিবাস করব দেবপ্রয়াগে। পরেরদিন সেখান থেকে হরিদ্বারে। তারপর ঘরে ফেরা। যা পেতে এসেছিলাম কেদারনাথে, ফিরে যাচ্ছি তারচেয়ে অনেক অনেক বেশিকিছু নিয়ে।
আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় কিছু মুহূর্ত রেখে যাচ্ছি এখানে। কিন্ত হে হিমালয়, তুমিও বাঁধা পড়েছ আমার চেতনায়। আমার চেতনা জেগে থাকবে তোমার বুকে, আমি থাকি বা না থাকি। মন্দাকিনীর তীরের এই নির্জন লজে সে রাত্রিবাস করবে, রামবাড়ার সেতুর উপর বসে বসে চেয়ে থাকবে তোমার দিকে। তার সজাগ চোখের সামনেই কেদারনাথ উপত্যকায় জমবে শিশিরের কণা। তারাভরা আকাশ, আর জ্যোৎস্নায় স্নাত তুষারচুড়ার পানে চেয়ে চেয়ে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করবে অনন্তকাল ধরে।
ফিরে আসব বারবার তোমার কাছে, আরও ঋদ্ধ হব তোমার সান্নিধ্যে, আরও গভীর হবে তোমার সাথে আমার ভালোবাসা। আপাতত বিদায়, হে প্রিয়সখা, বিদায়!
সমাপ্ত
শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনার লেখা “নতুন পথে কেদারনাথ” পড়ে মনে হল আমি নিজেও আপনাদের তীর্থভ্রমণসংগী হয়েছি। আপনার লেখা বর্ণনায় আমি মুগ্ধ। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা কেদারনাথ-বদ্রিনাথের দর্শন করি, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠছে না। আপনার মনমুগ্ধকর লেখাটি পড়ে আমার যাবার ইচ্ছাটি আরও তীব্র হয়ে উঠল। এই সুন্দর লেখাটি উপহার দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সুব্রত বাবু, প্রথমেই আপনাকে আন্তরিক ধনবাদ। আপনার এ লেখা ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ পেলাম। কেদারনাথের কৃপায় আপনার ইচ্ছা শীঘ্রই পূর্ণ হোক এই প্রার্থনা করি।
খুব ভালো লাগলো
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন।
আমি মুগ্ধ হয়েছি রাত জেগে আপনার কেদারনাথ যাত্রার কাহিনি পরলাম যথেষ্ট ধৈর্যশীল আপনি এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন মনে হল আমি নিজেই যা। তবে কেদারনাথ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি দৃঢ়তার সাথে। অনুগ্রহ পূর্বক জানাবেন কি মুসলিমদের সেখানে যেতে কোন নিষেধ আছে কি-।
আমি মুগ্ধ হয়েছি রাত জেগে আপনার কেদারনাথ যাত্রার কাহিনি পরলাম যথেষ্ট ধৈর্যশীল আপনি এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন মনে হল আমি নিজেই যাচ্ছি। তবে কেদারনাথ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি দৃঢ়তার সাথে। অনুগ্রহ পূর্বক জানাবেন কি মুসলিমদের সেখানে যেতে কোন নিষেধ আছে কি-না।
লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম। কেদার যেতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোনো বাধা নেই। আমি যতদূর জানি মুসলিম হলেও মূল মন্দিরেও প্রবেশ করতে কোনো বাধা নেই। আমার মুসলিম বন্ধু নিজে কেদার গিয়েছিল ২০১৭ সালে, তার কোনোরকমের কোনো অসুবিধা হয়নি। আপনিও স্বচ্ছন্দে ঘুরে আসুন। শুভেচ্ছা রইল।
আমি মুগ্ধ হয়েছি শ্রীধর । কি অপূর্ব প্রকাশ করেছেন ।
শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসাধারণ লেখাটি পরে আরও কিছু সংযোজন হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘রুদ্র-ছায়ায় কেদার’। প্রকাশক ‘নীহারিকা’।
আমি কি আপনার সাথে একটু পারসোনাল ভাবে যোগাযোগ করতে পারি?
sridharbanerjee91@gmail.com
এই ঠিকানায় সরাসরি আমাকে লিখতে পারেন।
আপনারা যে দাদা-বৌদির হোটেলে খেয়েছিলেন সেই দোকানের দুটো দোকান পরে কি শর্মাজ্যেঠুর চায়ের দোকান…???
ঠিক তাই। দাদাবৌদির হোটেল থেকে দু’টি দোকান পরে। ভোলাগিরির ধর্মশালার ঠিক উল্টোদিকে।
আমি ভাষা হারিয়েছি। চোখে জল। তোমার ভালোলাগা আমাকে বলাচ্ছে সার্থক তোমার বর্ননা।
মনে হচ্ছিলো আমিও তোমাদের সাথেই ছিলাম। আজো চোখ বুজলেই দেখি গাড়নীল আকাশ,জোৎসনা, তুষারাবৃত হিমালয় সহ কেদারডোম। বারবার হাতছানি দেয়। কে যেন বলে আসবিনা।আয় আয়।
জয় কেদারনাথ। জয় বাবা এিকালেশ্বর। প্রনাম।
আপনার এই ভালোলাগাটুকুই আমার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। জয় কেদার…
এবছর ২০২৩ এর ২০ আগস্ট কলকাতার একটি ট্যুর ক্লাবের সাথে চারধাম যাত্রায় যাবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আমরা দু’জন অংশগ্রহণ করবো বাবা কেদারনাথ এর কৃপায়। এরই প্রস্তুতিমুলক অংশ হিসেবে আপনার কেদারযাত্রা মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। আসলে পড়া শেষে মনে হলো আমরা দুজনে আপনার সাথেই হেঁটেছি হিমালয়ের পথে। গল্পটা শেষ করতে ইচ্ছে করছিলো না। কেদারনাথ ট্রেকিং এর জন্য অনেক নতুন কিছু জানতে পারলাম। আপনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ। বাবা কেদারনাথ যদি তাঁকে দর্শন করার সুযোগ করে দেন তাহলে আমাদের ট্রেকিং এর সময় আপনার এ অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগবে।