পাহাড়িয়া বাঁশি

আফাক বা ফাওয়াদ এবং কাশ্মীর

শতাব্দী আধিকারী

দোকা দোকা শিলং যাওয়ার পর আত্মবিশ্বাসের ইয়া বড় বড় পাখনা গজাল। ভাবলাম, এবার থেকে যেদিকে দু’চোখ যাবে বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে চলে যাবো। কিন্তু স্রেফ দু’চোখ চাইলেই তো হল না। ছুটি ফ্যাক্টার, মানি ফ্যাক্টার এসব তো রয়েছেই। তবে আসলে কোনও ফ্যাক্টরই নয়। ইচ্ছেটাই হল গিয়ে মোদ্দা কতা।

২০১৫ বছর আর গোটা ১৪টা সিএল হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দিওয়ানা দিল ভেবে নিল ইসবারভি এক বড়া ট্রিপ মাঙতা হ্যায়। কিন্তু কই যাই, কই যাই তখন আমার একূল ওকূল দশা। সেই সময় মাতৃদেহে মা ভবতারিণী ভর করিলেন এবং আমায় আইডিয়া দিলেন। প্রথমটায় অবশ্যি আইডিয়াটি বিশেষ পছন্দ হয়নি। লেকিন বাদমে দিমাগ কী বত্তি জ্বল গয়ি।

মন বলছে যখন দিল্লি যাব, দিল্লি যাব, তখনই মাতাশ্রীর প্রাথমিক আইডিয়াটি মম জীবনে পদার্পণ করিল। মাতাশ্রী বিছানা গুছোতে গুছোতে বললেন, ‘‘পম্পা মাসির ওখানেও তো যেতে পারিস!’’ এই প্রসঙ্গে দু’টি পাতার মতো আমার দু’টি কথা জানানোর আছে। সেই সময় আমার বড়পিসি সপরিবার আগ্রায় থাকতেন। অন্যদিকে, দিল্লির প্রতি আমার একটা প্রেমসুলভ টানও রয়েছে। তাই ভেবেছিলুম পিসির বাড়িতে থেকে দিল্লি-আগ্রা ঢু মারব। কিন্তু বড়পিসির বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাব মায়ের খুব একটা পছন্দ হল না। অতঃপর গল্পে ঢুকে পড়লেন মাসি।

আমিও ভাবলাম, একা একা একটি মেয়ের দিল্লি ঘুরে বেরানোর বিষয়টি বড়পিসি খুব একটা হজম করতে পারবেন না। শেষে আমার ঘোরাটা কনডাক্টেড ট্যুর হয়ে যাবে (যদিও আমার কপালে শেষেমেষ সেটাই ছিল, তখন তো আর জানতে পারিনি!)। তাই প্রথমে রাজি না হলেও মায়ের দেওয়া মাসির বাড়ির প্রস্তাবটা নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করলাম।

আমার এই মাসিটি থাকেন জম্মুতে। সেখানকার একটি স্কুলে পড়ান। মেসোমশাই জম্মুর সিআসআইআর ইনস্টিটিউটের গবেষক। বোন ক্লাস এইটে পড়ে। মাসির বাড়ি যাওয়ার মানে জম্মু যাওয়া। আর জম্মুই যদি যাই তাহলে লগে হাত কাশ্মীর কেন নয়!

তার পরের ঘটনাক্রম মোটামুটি আন্দাজ করে নেওয়া যায়। জানুয়ারিতে ছুটি বুকিং, এপ্রিলে টিকিট। বাকি রইল শুধু কাশ্মীরে থাকার একখান ঘর।

গত এক দু’বছর ধরে আমাদের বাড়িতে আসে আফাক। হাসিখুশি, তরতাজা কাশ্মীরি তরুণ। মিথ্যে বলব না প্রথম দিকে একটু আধটু ঝারিও মেরেছি। কিন্তু পরে যখন জানলাম, ব্যাটা আমার থেকে বছর কয়েকের ছোট, তখন স্নেহের পাত্রই করে নিতে হল। আফাক আমাদের জন্য আখরোট আর পেস্তা আনতো। মুঠো মুঠো মেঝেয় ঢেলে দিত দরাজ হাতে। বাড়ির গল্প করত। মায়ের কথা, বোনের কথা, ভাইয়ের কথা বলত। আর বলত, ‘‘কভি আনা কশ্মীরমে, বাইকমে পুরা শ্রীনগর ঘুমায়েঙ্গে।’’

কাশ্মীরে থাকার জায়গার খোঁজ শুরু করতে গিয়ে প্রথমেই তাই আফাকের কথা মনে পড়ল। ওর কাশ্মীরের নম্বরে ফোন করলাম। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল এক মহিলা কণ্ঠস্বর। কিন্তু বলব কী! কার খোঁজ করছি! নাম তো জানি না। হাজার বার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও আফাক তখনও পর্যন্ত আমাদের তার নাম বলেনি। যাই হোক কোনওরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললাম ঠিক কার খোঁজ করছি। উনি ছেলের হাতে ফোন দিলেন। প্রথমেই, ধমকে-টমকে জেনে নিলাম সেই ছেলের আফাক নামটা।

যাই হোক। আফাককে জানালাম অক্টোবরে কাশ্মীর যাওয়ার প্ল্যান করছি। অতএব, একটা থাকার জায়গা তাকে ঠিক করে দিতে হবে। সে তো শুনেই চরম একটা দাবি তুলল। শ্রীনগরে গেলে তার বাড়িতেই থাকতে হবে। অন্য কোত্থাও নয়। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে সেটা হয় না। সত্যি বলতে কী একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম। কতটুকুই বা চিনি আফাককে। হুট করে ওদের বাড়িতে থাকাটা কী ঠিক হবে! তার উপর কাশ্মীর। একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। বাবাইও বারণ করল। কিন্তু আফাক কিছুতেই মানল না। ঠিক হলো ওদের বাড়িতে থেকে গুলমার্গ, সোনমার্গ আর পহেলগাঁও ঘোরা হবে। আফাক হোয়াটস অ্যাপে ওদের বাড়ির ছবি পাঠালো খান তিনেক। সেসব স্বপ্নে দেখা দিতে লাগল মাঝে মধ্যে। পরের কয়েক মাস।

এরপর স্ট্রেট ট্রেনে উঠে পড়ার গল্পে চলে আসি। মা এবং আমার এক গার্লফ্রেন্ড সায়নীকে বগলদাবা করে কলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়লুম।টুওয়ার্ডস জম্মু তাওয়ি।আসলে তাওয়ি হচ্ছে জম্মুর প্রধান নদী। জম্মু শহরকে দু’ভাগ করে মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে।সায়নী অবশ্য এবারেও ঠিক আগের মুহূর্তে আমায় দাগা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। তবে ফাঁকা ট্রেন দেখে ফিসফিস করে বাবাইকে বলেছিল, ‘‘কাকু, বাবাকে বলবে না ট্রেনটা এত ফাঁকা ছিল।’’ দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট মানেই আমি স্লিপারক্লাস বুঝি। এসি টু, থ্রি, ফোর এসবকে ধর্তব্যের মধ্যে ধরি না। সায়নীর হাবেভাবে বুঝলাম ওর এই স্লিপার ক্লাস ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হয়নি। যাই হোক, যাত্রায় সেই আমাদের মনোমালিন্যের সূচনা হল।

মা’কে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার একটা মজা আছে। মজাটা টের পেলুম যখন দুপুর ১২টা গড়াতেই পিটারা থেকে একটা বড় স্টিলের টিফিন বক্স আর তার সাঙ্গপাঙ্গেরা বেরলেন।মায়ের হাত ধরে।টিফিন বক্স খুলতে সেখানে পাওয়া গেল ভাত।বাকিগুলো থেকে বেরলো ডিমের তরকারি, ভাজাভুজি এইসব। ভারতবর্ষে দূরপাল্লার ট্রেন যাত্রায় এ যে কত বড় সুসংবাদ তা বলে বোঝাতে পারব না।মাতাজির কৃপায় সেই দুপুরটা আইআরসিটিসি’র বিখ্যাত ট্যালট্যালে ডাল দিয়ে ভাত মেখে খেতে হল না। মজা করে খেলাম। সেলফি-টেলফি তুললাম। তারপর কামরার দরজাটা খুলে পা দানিতে পা রেখে বসে পড়লাম। ট্রেন হুহু করে ছুটলো। মা-ও দিবানিদ্রা গেলেন। সায়নী ম্যাগাজিনে মুখ গুঁজিলেন।

খানিক এই প্রকারেই পরবর্তী দেড়দিন কাটিল। কত কত স্টেশন পেরোলাম ভিনরাজ্যের। কত গ্রাম দেখলাম। অন্যরকম লোক, অন্য রকম ঘরবাড়ি। অদ্ভুত লাগছিল। ভাবছিলাম এই গ্রামগুলোর চরিত্র নিশ্চই বাংলার গ্রামগুলোর থেকে আলাদা। কে জানে কোনওদিন দেখতে পাবো কি না। যেমন ট্রেন যখন বরেলী থেমেছিল, ভারি অদ্ভুত লেগেছিল।বরেলীর কত ব্রিফই না অফিসে বসে লিখেছি।যাই হোক অবশেষে ৭ অক্টোবর, ২০১৫ ’র সকালে ট্রেন জম্মু স্টেশনে ঢুকল। আর একইসঙ্গে ফোন এল আফাকের। জানিয়ে দিলাম পৌঁছে গেছি জম্মু। আফাক বলল, পরের দিন ভোরে আমাদের গাড়ি চলে আসবে, ঠিকানা পত্তর জানিয়ে দিতে। আফাকের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে পম্পা মাসিকে ফোন করলাম। মাসিও স্কুল থেকে রওনা দিলেন স্টেশনের উদ্দেশে, আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে।

বেলা ১২ টা নাগাদ মাসির বাড়ি পৌঁছলাম। সেদিন আর কোথাও যাইনি আমরা। ঠিক করলাম কাশ্মীর থেকে একদিন আগে ফিরে এসে জম্মু ঘুরে নেব। মাসির বাড়ির ছাদ থেকে পাহাড় দেখা যায়। যদিও সেগুলো বেশ অনেকটা দূরে। বিকেলবেলা বোনকে টিউশনে দিতে গেলাম। জম্মুর রাস্তাগুলো একটু উঁচুনিচু। একদম সমতলও নয়, আবার পাহাড়ি শহরগুলোর মতোও নয়। হেঁটে ঘুরলাম আশপাশ। শান্ত, ছোটখাটো জায়গা। রাতে খাবার জন্য মেসোমশাই দু’ধরনের কাশ্মীরি খাবার নিয়ে এলেন। সব ক’টার নামই ভুলে গেছি। ক্ষমা প্রার্থনীয়। একটা প্রিপারেশন তার মধ্যে যারে কয় লজিজ লেগেছিল আমার। মাট্‌ন পেটাই করে মিহি করে নিয়ে, সেগুলো দিয়ে মিট বল তৈরি করে দুধের মধ্যে দেওয়া কিছু একটা জিনিস। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও খেতে দারুণ। খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ করে ঘুম দিলাম।

পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙল আফাকের ফোনে। বলল, গাড়ি পৌঁছে গেছে। গলির মোড়ে অপেক্ষা করছে। ঝটপট তৈরি হয়ে নীচে নামা মাত্রই আমি যারে কয় এক্কেরে থ। গাড়ির পাশে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে অনায়াসেই ফাওয়াদ খানের তুলনা চলতে পারে। আলো-আঁধারি ভোর, সাদা শার্ট, চাপ দাড়ি আর ঘন চোখের পাতা। মনে মনে মুচকি হেসে ভাবলুম জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ের যাত্রাটি মন্দ হইবে না!

ফাওয়াদ খানের জুড়য়া ভাইয়ের পাশে বসে আমাদের কাশ্মীর যাত্রা শুরু হল। মা আর সায়নীকে পিছনের সিটে পাঠিয়ে দিলুম।বলা বাহুল্য সায়নী তখন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী! আয়াজের ধারে কাছে ওকে ঘেঁষতে দেওয়া যায় না।জম্মু শহরের পরিসীমার কাছাকাছি পৌঁছতেই শুরু হল পিচকালো এলোমেলো সুন্দর রাস্তা।এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে।নরম ভোরের আলো, হাল্কা ঠান্ডা হাওয়া।একটা মোড়ের বাঁক ঘুরতেই আয়াজ আমাদের উল্টোদিকের একটা পাহাড় দেখাল। সেই পাহাড়ের গা বেয়ে সাদা রঙের সাপের মতো এঁকেবেঁকে রাস্তা উঠে গিয়েছে। বলল, ওটাই নাকি বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। মা আমার দিকে ক্রদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আসলে শুরুতেই আমি বৈষ্ণোদেবী যাওয়ার প্ল্যান বাতিল করে দিয়েছিলাম। তার প্রধান কারণ অবশ্যই আমার ক্লস্ট্রোফোবিক নেচার।

ছোটবেলায় গুলসন কুমারের ওই জয় মাতা দি ভিডিওগুলো দেখতাম আর শিউরে উঠতাম। কী ভয়ঙ্কর ভিড় রে বাবা! যে কোনও মুহূর্তে পদপিষ্ট হয়ে যেতে পারি।গুহায় ঢোকার রাস্তাটাও সরু।ওখানে আবার কেউ যায়! আমায় কোটি টুকরো করে ফেললেও আমি ওভাবে অত ছোট জায়গায় ঢুকতে পারব না। আর তাছাড়া, মা অতটা রাস্তা হাঁটতে পারবে কি না, তা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।যাই হোক, আমার সেই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের জন্য মা আমায় এখনও কথা শোনায়। তার নাকি মান থাকে না যখন লোককে বলে, কাশ্মীর গেছে অথচ বৈষ্ণোদেবীর দর্শন করেনি!

সকালের রোদ্দুর আরও কিছুটা মাথাচাড়া দেওয়ার পর গাড়ি থামল রাস্তার ধারে। একটা দোকানের সামনে। চা-যোগ সেরে নেওয়ার পর আবার আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদূর‌ এগোতেই শুরু হল পাকদণ্ডি। প্রত্যেক মোড়ে শার্প‌ ইউ টার্ন। এইধরনের পাকদণ্ডিতে আমি খানিক অভ্যস্ত, কিন্তু মা নয়। মাসি বলেছিল, এই বাঁকগুলো নেওয়ার সময় গাড়ির চাকা নাকি আধইঞ্চি খাদে ঝুলে থাকে। কথাটা আমার অতিকথন লেগেছিল বটে, কিন্তু কথাটি মায়ের কানে উঠে যাওয়ায় খানিক পর থেকেই সেটার প্রতিক্রিয়া শুরু হল।মা এই দফা বসেছিল ড্রাইভারের পাশের সিটে।সেখান থেকে প্রত্যেক বাঁকে, ‘‘আরে আস্তে চালাও!’’ ‘‘আরে! সাবধানে’’ জাতীয় কথাবার্ত বলতে শুরু করল।আর্ত চিৎকার করাটুকুই যা বাকি রেখেছিলেন মহিলা।ওইভাবে চলতে থাকলে আয়াজ না চাইলেও অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলতো।অগত্যা ফের গাড়ি থামিয়ে, মা’কে পিছনের সিটে পাঠিয়ে দিলাম।মা বমি-টমি করতে পারে এই ভেবে গুচ্ছ অ্যাভোবিন নিয়ে গিয়েছিলাম।এই দফা সেই অ্যাভোমিন কাজে লাগতে পারে ভেবে মহিলাকে খাইয়ে দিলাম। আমি আর সায়নীও খেলুম।একটা গোটা করে! এই ভুলের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসাবে খানিক পর দেখলুম মাতাশ্রী ঘুমে ঢুলে পড়েছেন।পাশে সায়নীর চোখও ঢুলুঢুলু।কাচের বাইরে চোখ রাখতে রাখতে হঠাৎ চোখে নেশা ঘনিয়ে এল। তারপর ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য আর কিছু মনে নেই।

ঘুম ভাঙল মুখের উপর বিশ্রী রোদ পড়ে।সঙ্গে কটকটে গরম।কী ব্যাপার, যাচ্ছি তো কাশ্মীর! সেটা তো ঠান্ডা জায়গা বলে শুনেছি।এত গরম লাগছে কেন! চোখ খুলে দেখলাম, বিশাল বিশাল বাদামি, ধূসর, হলুদ রঙের পাহাড়।তা গায়ে খেলনার মতো গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে সার বেঁধে।আশপাশে চোখ বুলিয়ে খানিক ভয়ই পেলাম। ঘুম থেকে সদ্য উঠেছিলাম বলেই হয়ত অতটা অবাক হয়েছিলাম।কিন্তু তা-ও ওমন পাহাড় আমি এজন্মে দেখিনি। দেখেই মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি বুঝি ঘাড়ের উপর এসে পড়বে। সবুজের নামগন্ধ নেই কোথাও। কেন এমন! যেন কোনও রুক্ষ, কড়া বৃদ্ধ। প্রাচীন, অভিজ্ঞ। কাছে যেতে ভয় লাগে। অনিতক্রম্য, অলঙ্ঘনীয়। ঘুমের ঘোর কাটতে বুঝতে পারলাম, সামনে দীর্ঘ ট্র্যাফিক জ্যাম।গাড়ি খুব ধীরে এগোল।আশপাশের ড্রাইভার এবং আয়াজের কথোপকথনে যা বুঝলাম, সামনের রাস্তাতেই ধস নেমেছে তরতাজা।তা এড়িয়েই গাড়ির সারি এগোচ্ছে।এই রুক্ষতার মধ্যে হঠাৎ করেই এক বাঁকে দেখা পেলুম একটা ঝরনার।নিজের সবটুকু নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।যা সম্পদ আছে, যা সম্পদ থাকতে পারে, ওই পরিবেশে, তার সবটুকু নিয়ে।ঝরনা আমার চিরকালের প্রিয়।কিন্তু ওই ঝরনা, কেন জানি না ভুলতে পারব না কোনওদিন।আয়াজ বলল ওখান থেকেই জলের খালি বোতলগুলো ভরে নিতে।সে জলের স্বাদ আর না-ই বা বললাম।

কিন্তু ওমন হুট করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কেন! প্রশ্নটা মা-ই তুলল। আমিও ভাবলাম, সত্যি তো! অ্যাভোমিন ফ্যাক্টরের কথা একদম মাথায় আসেনি। আয়াজই বলল, ‘উয়ো আপনে দাওয়াই লি থি! ইস লিয়ে।’ বোঝো ঠেলা। একটা গোটা অ্যাভোমিন, এমন তো হবেই! নেহাত আয়াজ ভাল ছিল তাই। নহলে হুট করে তিনজন মিলে ঘুমিয়ে পড়াটা আমাদের পক্ষে মোটেও নিরাপদ ছিল না।এই বোকামির জন্য নিজেই নিজেকে খানিক গালমন্দ করে নিলাম।

যাই হোক, একের পর এক পাহাড় পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এখনও পর্যন্ত অমন লেখনি আয়ত্ত করতে পারিনি যে সেইসব রাস্তার বর্ণনা দিতে পারব। শুধু এটুকু বলতে পারি, অনেকেই ওই ১০-১২ ঘণ্টার কষ্টকর জার্নিটা থেকে বাঁচতে ফ্লাইটে শ্রীনগর যায়। কিন্তু কেউ যদি আমায় জিজ্ঞেস করে বলব, এই রাস্তা ধরে কাশ্মীর না গেলে, অনেক কিছু অদেখা থেকে যাবে।শীর্ণ ঝরনার জল খাওয়াবে না কেউ। রাস্তা আটকে ভেড়ার পাল এগোবে না। পাহাড়ের ওওওওই উপরে তিন বন্ধুকে গল্প করতেও দেখতে পাবে না কেউ।পাশে পাবে না নাম না জানা ছোট নদীগুলোকে।

রুক্ষ পাহাডের দেখা পাওয়ার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছিলাম।তার নাম কুদ।বোনের মুখে শুনেছি, ওদের স্কুল থেকে কুদে পিকনিক করাতে নিয়ে যায়।আর আমরা কোথায় যাই, না বলাকার মাঠে! তো এই কুদের বিশেষত্ব হল এখানকার মিষ্টি।অর্থাৎ, শুধু বাঙালি জাতিই মিষ্টি প্রিয় নয়! কাশ্মীরিরাও মিষ্টিপ্রিয়।কুদের পাহাডি রাস্তার দু’ধারে একের পর এক মিষ্টির দোকান।নেমে কিনতেই হতো।তবে সমস্যা হল সব মিষ্টিগুলোতেই প্রচণ্ড ঘি।অত ঘি-ওয়ালা মিষিট খাওয়ার অভ্যেস নেই আমাদের।তা-ও কিনলাম দু’ধরনের মিষ্টি।একটা ক্ষীরের আর একটা একধরনের সোন পাপড়ি।ওদের অবশ্যই স্থানীয় নাম রয়েছে। সে সব দিতে পারলে ভ্রমণকাহিনি আরও জমাটি হতো জানি।কিন্ত স্মৃতিশক্তি আমার বরাবরই দুর্বল।

কুদ থেকেই খানিক এগিয়েই আরেকটা ট্যুরিস্ট স্পট।নাম পটনিটপ। নাম জানতাম। তবে ব্যাপারটার যে দেখা পাওয়া যেতে পারে, সেটা আমি তখনো জানতাম না। আমার যাবতীয় রিসার্চের মধ্যে এটা কী করে বাদ পডেছিল জানি না। তবে অজানা থাকায় মাঝখান থেকে যে লাভটা হল, সেটা হল, পুরোটাই আমাদের কাছে এল গিয়ে সারপ্রইজ প্যাকেজ হয়ে।গোটা রাস্তার থেকে পটনিটপের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। পটনিটপে ঢুকে পড়লেই তাপমাত্রার পারদ বেশ খানিকটা নেমে যায়।চারপাশ খানিক মেঘলা।সবুজ পাইন, দেবদারু।তবে পটনিটপের যেটা বিশেষত্ব সেটা হল, পাহাডের ধার থেকে নীচে উপত্যকার দৃশ্যখানা।খোপ খোপ করে সবুজের কারপেট বিছানো নীচে।সে যে কী অদ্ভুত চোখ জুড়নো অনুভূতি, কী বলব! পটনিটপে বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি। এগিয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু পটনিটপে আমার সেরা অভিজ্ঞতা যদিও তখনও বাকি রয়ে গেল।

পটনিটপ পেরিয়ে যেতেই সবুজ আবার কমতে লাগল। মাঝপথে এক জায়গায় থমলাম, দুপুরের খাওয়ার জন্য। সেখানেও খেলাম ভাত আর একটা কাশ্মীরি পদ। জায়গাটা বোধহয় বাতোত ছিল। তারপর আবার এগোলাম। রাস্তা যত এগোচ্ছে, গাছের পাতা তত হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এই হলুদ হল হলুদ হতে শুরু করার হলুদ। গনগনে নভেম্বরের হলুদ নয়। আরও ঘণ্টাদেডেক যাওয়ার পর এল সেই বিখ্যাত জায়গা। ব্রিফ হওয়ার আরও একটি বিষয়বস্তু। বানিহাল টানেল। আগেই আমি আমার ক্লস্ট্রোফেবিক নেচারের কথা বলেছি। তাই প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা এই টানেল পেরতে আমার কিছু অসুবিধা হবে কি না, সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম।

সায়নী আমার প্রবোধ দিচ্ছিল। বলছিল এটা কোনও ব্যাপারই নয়। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই পেরিয়ে যাবি। এই টানেল দু’টো পাহাডকে আডাআডি ফুঁডে দিয়ে এগিয়ে গেছে। অবশেষে টানেল এল। প্রায় দমবন্ধ করে, কোনও কথা না বলে সেটি পেরোচ্ছিলাম। উল্টোদিকে বিন্দুর মতো আলোর দেখা পাওয়ার পর ফুসফুস অক্সিজেন নিলাম। এত আতঙ্কিত হওয়ার কিন্তু কিছুই নেই। পৃথিবীর বাঘা বাঘা টানেলের কাছে, এ নিতান্তই বাচ্চা। এটা আমি ছিলম বলেই সমস্যা।তবে বানিহাল পেরনোর পর মানসিকভাবে মনে হতে থাকল, পৌঁছে গেছি কাশ্মীর। সেনা এবং সেনার ট্রাকের বহরও বাডল সংখ্যায় এবং আয়তনে।

এরপর যে জায়গাটার কথা মন পডে, সেখান থেকে প্রথম কাশ্মীর উপত্যকার দর্শন পাওয়া যায়। আয়াজ আমাদের বলল, ‘‘উয়ো নীচে, ওয়াহা যানা হ্যায় হামকো’’। নীচের উপত্যকা জুড়ে সিধে হয়ে দাঁডিয়ে থাকা পপলার গাছ। কাশ্মীরের লোকজন যাকে সফেদা বলে। কাশ্মীর উপত্যকাকে প্রথমবার দেখে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। এই উপত্যকা বাকি ভারতের থেকে আলাদা। দর্শনে এবং চরিত্রে।

পাম্পোর পৌঁছলাম যখন আকাশে কমলা রঙ লেগে গিয়েছে। দু’পাশের কেশরের ক্ষেত তখন ফাঁকা। ক্ষেতের শেষে পাহাড়ের পাঁচিল। তাতে শেষ বিকেলের রঙ।গোলাপি।আরেকটু এগোতেই বাঁদিকে একটা সরু নদীর দেখা পেলুম। ঘাটে তার নৌকো বাঁধা। এপার থেকে ওপারে বাঁধা দড়ি। সেই দড়ি ধরে টেনে নৌকোয় নদী পারাপার করছেন এক কাশ্মীরি মহিলা। টানা ১০ ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা সকলেই ক্লান্ত। আফাকের ফোন আসছিল ঘনঘন। পরে আফাকের মুখে শুনেছি, ওরা জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়েকে বেশ ভয় পায়। যখন তথন হাওয়া বদল তো বটেই, বিশাল লম্বা যানজট ওই রাস্তার বৈশিষ্ট। এছাড়া অন্যান্য কাশ্মীরসুলভ সমস্যা তো রয়েছেই। যখন কাশ্মীর ইউনিভর্সিটির উল্টোদিকের গলি দিয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকল, ঘড়িতে ছ’টা বাজে।

দূরে গেট খুলে বেরিয়ে এসেছে আফাক।গায়ে কালো লেদার জ্যাকেট। এই আফাক আলাদা। ওর চোখমুখ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।আমার তো বুকটা দুরুদুরু করতে শুরু করল।বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে হার্টবিট ফাস্ট। কেমন হবে কোনও কাশ্মীরির বাড়িতে থাকা।মাথার ভিতর ‘রোজা’র দৃশ্য!

সন্ধে হয়ে এসেছে। উচুনিচু উঠোন পেরিয়ে একটা তিনতলা বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়ালাম। বাইরের দেওয়ালে লাল-মেরুণ ইট উঁকি দিচ্ছে। কাঠের সুন্দর জানলা। আর জানলায় নতুন কাচ। এখানকার বাড়িগুলো এমনই। রাস্তায় আসতে আসতে দেখেছি। বিশেষ করে যে বাড়িগুলো বন্যায় ভেঙে গিয়েছিল সেগুলো। পরে জেনেছিলাম, এর বেশিরভাগটাই সরকারি অনুদানে নতুন করে তৈরি। দোর পেরিয়ে বাড়ির অন্দরে পা রাখলুম। ভিতরে আলো বলতে ষাট পাওয়ারের হলুদ বাল্ব। দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানহাতে আরেকটা দরজা। পাশাপাশি দু’টো ঘর। আমার উল্টো দিকে একটা। বাঁহাতে সিঁড়ি উঠে গেছে। ডান হাতের প্রথম দরজাটা খুলে দিল আফাক। সে দরজা জুড়ে ফল-পাতার নকশা কাটা। সুন্দর। তবে দরজার পিছনে ঘরটাকে দেখে আরও অবাক হলাম। লম্বা ঢালাও একটা ঘর। মেঝেজুড়ে নকশা করা কারপেট পাতা। ঘরের ডান দিক এবং পিছন দিকের গোটা দেওয়াল জুড়ে জানলা। তবে এই ঘরে খাট নেই। আফাক দুঃখ করে জানাল, কাশ্মীরে নাকি কেউ খাটে ঘুমোয় না। তাই আমাদের জন্যে কারপেটের উপরে মোটা গদি পেতে বিছানা করা হয়েছে। ব্যবস্থা দারুণ। এই তো চাই। কিন্তু সমস্যা একটাই। চোখের সামনে হলুদ বাল্বের আলো জ্বলতে থাকল সর্বক্ষণ। ভাবলাম মাথা না ধরে যায়।

আমরা পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে আফাকের মা এলেন। স্পষ্ট বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবে তো! মিষ্টি না নোনতা? মনটা অনেকক্ষণ থেকেই চা-চা করছিল বটে। কিন্তু নোনতা চা আবার কী!এতক্ষণ জার্নি করে আসার পর চায়ের বিষয়ে রিস্ক নেওয়াটা ঠিক মনে হল না। আন্টিকে বললাম, মিষ্টি চা-ই দিন। এরপরই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল হাল্কা গোলাপি সালোয়ার কামিজ পরা অল্প বয়সি একটি মেয়ে। তার গোটা মুখ সাদা ওড়নায় মোড়া। সাবলীলভাবে ইংরিজিতে আলাপ-পর্ব সারলো আমার আর সায়নীর সঙ্গে। সত্যি বলতে আমি ইংজিরিতে কথা বলতে যথেষ্ট অপটু। মনে মনে বললাম, হিন্দিতে ফিরে এসো বাবা! সঙ্গে কোনও পুরুষ নেই দেখে অবশেষে পর্দার আড়াল খসল বিসমার।

কাশ্মীরি তরুণী বললেই যে সুন্দর চিকন কন্যা মানসচক্ষে ভেসে ওঠে, বিসমা তেমন নয়। যথেষ্ট সুন্দরী হলেও ওর দ্যূতির কারণ মূলত ওর শিক্ষা। আফাকদের পরিবারের সকলের মধ্যে থেকে সহজেই বিসমাকে আলাদা করে নেওয়া যায়। জানলাম বিসমা কাশ্মীর ইউনিভার্সিটিতে উর্দুতে এমএ করছে। বন্যার জন্য ওর এক বছর নষ্ট হয়েছে। বিসমার ইচ্ছে এরপর ও পিএইডি করবে। বিসমাকে দেখে আমার কাশ্মীরি মহিলার সম্পর্কে অবচেতনে লালিত ধারটাণা মুহূর্তে ভেঙে গেল। হ্যাঁ, বিসমা পর পুরুষের সামনে মুখ দেখায় না। বিসমা যখন কলেজে যায় তখন ওর শরীরের নখ পর্যন্ত কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে। শরীরের খোলয় জুড়ে ফোটানো থাকে অজস্র সেফটিপিন। বিসমা প্রতি রবিববার ধর্মের ক্লাসেও যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ও কোথায় যেন আমাদেরই মতন।

আন্টি চা আনার পর জমিয়ে সান্ধ্য আড্ডা বসল। সঙ্গে নারকেলের কুকিজ আর আঙ্কল-সহ অন্যান্যদের জন্য নোনতা চা। আড্ডায় ওরা মাঝেমাঝেই অনর্গল কাশ্মীরিতে কথা বলছিল। তার পরেই সেটা ট্রান্সলেট করে বলছিল হিন্দিতে। বাইরে ইতিমধ্যেই সন্ধে নেমেছে। মনে হচ্ছিল যেন ইরানের মতো কোনও দেশে বসে রয়েছি। এ কী সত্যিই ভারত!

পরের দিন দরজায় কড়া টোকা পেয়ে ঘুম ভাঙল। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো কার্পেটে জড়ামড়ি করে পড়ে আছে। আলস্য নিয়েই দরজা খুললাম। আন্টি চা এবং টা’য়ের ট্রে কার্পেটে রেখে বললেন, তৈরি হয়ে নাও গাড়ি এসে গেছে। ধূমায়িত চায়ের কাপ, নারকেল কুকিজ আর মাখন লাগানো তন্দুরি রুটি দিয়ে আমাদের প্রাতঃরাশ সারা হল। আজ আমরা হাল্কার উপরে থাকব। ঘুরে দেখবো শ্রীনগর। প্রথমেই যাব হজরত বল। রিসার্চ বলছে, কাশ্মীর উপত্যকাকে কেন স্বর্গ বলে তার কারণ নাকি সেখানেই লুকিয়ে।

হজরত বলের মন্দিরের পিছন দিক থেকে গোলাপি পীরপঞ্জল ঘেরা উপত্যকা সহজেই একনজরে ধরা দেয়। পীরপঞ্জল তোমায় ঘুরে থাকে চারদিক থেকে, বৃত্তের মতো। নীচে উপত্যকা চিড়ে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে যায় ঝিলম। ডাল লেকের ভিউও এখান থেকে খুব সুন্দর। তবে যত বেলা বাড়ে পীরপঞ্জল তত ঝাপসা হয়ে যায়। তাই তো সকালে যাওয়া! তারপর একে একে সব মোঘল গার্ডেন ঘুরে শেষে যাও পরীমহল। সেখান থেকে আবার রাঙা আলোয় ভেজা কাশ্মীর উপত্যকা। মাঝে ইচ্ছে হলে একটু শিকারা ভ্রমণ, যদিও সেটা অন্য কোনও সময় করাই ভাল। বিশেষ করে যে রাত হাউসবোটে থাকবে তার পরের দিন সকালে।

এটা যাকে বলে থিয়োরি। প্র্যাক্টিকালটা জাস্ট আলাদা। অন্তত আমাদের ক্ষেত্রে তো তা-ই হল। গাড়িতে উঠলাম তৈরি হয়ে। সামনের সিটে আফাক উঠল। ভাল। আফাক থাকলেই তো ভাল। বেশ। পিছনে আন্টি উঠলেন। এই পর্যন্তও ঠিক ছিল। তারপর গাড়িতে এসে উঠলেন আফাকদের বাড়ির এক ভাড়াটিয়া মহিলা। পারদ চড়তে শুরু করল। বিরক্ত হচ্ছি মনে মনে। আমি তো ভেবেছিলাম, আমরা তিনজনই ঘুরব। এত লোক কেন! বিকট। আফাককে বললাম প্রথমে হজরত বল যাব। ও দৃশ্যতই দ্বিধান্বিত। বলল, আমরা প্রথমে মুঘল গার্ডেনগুলো ঘুরে নিই! পরে যাব। ওকে কারণটা বললাম। ও বুঝল না। বিরক্তি বাড়ল। এরপর স্বাভাবিকভাবেই কোনও মুঘল গার্ডেনের সৌন্দর্য আমায় টানল না।

একে একে ঘুরলাম যদিও। পরীমহলে গেলাম মাঝদুপুরে। কিচ্ছু ছবি পেলাম না। মারাত্মক মাথা গরম। তার উপর সৌজন্যের খাতিরে তিনজন এক্সট্রা মানুষের টিকিটের খরচ গুণতে হচ্ছিল আমাকে। তা-ও আফাক এবং আন্টি ঠিক আছে। কিন্তু ওই মহিলা কেন! চেনাশোনাই তো নেই! এমনকী, ওঁকে গাড়িতে ওঠানোর আগে আমায় জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হয়নি। যেখানে সব খরচটাই আমি করছি। হয়ত এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিষয়টা অজান্তেই ঘাড়ে চেপে যাওয়ায় মেনে নিতে পারছিলাম না।

নিষাত গার্ডেনের কাছে একটু চা-টা খাওয়ার জন্য বসলাম। নিষাতের ঠিক উল্টো দিকে ডাল লেক। কিন্তু বেলা চড়ে যাওয়ায় সেখানেও ছবি হওয়ার কোনও চান্স নেই। মেজাজ কিরকিরা! ইতিমধ্যে কোথা থেকে আফাকদের আরও চেনা লোকজন চলে এল ময়দানে। মানে ডাল লেকের ধারে। নতুন লোকজনেদের সঙ্গে দেখা করতে, তাদের কথা জানতে ভাল লাগে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা চাপিয়ে দেওয়া মনে হচ্ছিল। তারমধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল আফাকের ছোট মামা। আমি আর সায়নী শলা করলাম আমরা এই টাকা মিটিয়ে দিয়ে শঙ্করাচার্য হয়ে বাড়ি ফিরে যাব।

চায়ের টেবিলে ফিরে গিয়ে আফাককে সেই কথা জানালাম। আর যারা প্লেটের পর প্লেট পকোরা অর্ডার করছিল তাদের শুনিয়ে দোকানদারকে বললাম আমাদের আর পকোরা লাগবে না। এতেই আফাক বুঝতে পারল আমি ক্ষুন্ন হয়েছি। শিকারায় চড়লাম না, আফাকের অনেক রিকোয়েস্ট সত্ত্বেও। কারণ দিনের সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথার সূর্যও তখন মধ্য গগনে। তার উপর রাগ লুকোতে আমি কোনওদিনই শিখিনি। সেদিনও পারলাম না। ড্রাইভার দাদাকে কঠিন গলায় বললাম শঙ্করাচার্য যাব। মা কিছুতেই সিঁড়ি ভাঙতে রাজি হল না। আন্টি আর আফাক গেলেন আমাদের সঙ্গে। আর সঙ্গে ওই বিরক্তিকর ছোটমামা। আফাক মন্দিরে ঢুকল না।

আমরা মন্দিরের বাইরে সিঁড়ির উপরে বসলাম, ওখান থেকে ডাল লেক সুন্দর দেখা যাচ্ছিল। আফাক আরও অনেক কিছু দেখাল আঙুল দিয়ে। কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। মন্দির সুন্দর তো বটেই। তবে আমি এ বিশেষ দৃশ্য দেখার আকাঙ্খায় ছিলাম। তা পূর্ণ হল না। আকাশে চড়া রোদপীরপঞ্জলকে ঝাপসা করে দিয়েছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি আবার আসব। আসবই। শুধু এইটুকু দেখতে হলেও।

পুনশ্চ: শ্রীনগর সুন্দর। অলিগলি, ঘরবাড়ি ছবির মতো। তবে ডাল লেক পরিষ্কার করা হয় না আর মোঘল গার্ডেন যে কোনও সুসজ্জিত বাগানের মতো। কিন্তু এক্স ফ্যাক্টরটি হচ্ছে পীরপঞ্জল, যা শহরটাকে আগলে রেখেছে সবটুকু দিয়ে। আর হ্যাঁ, খইয়াম গলিতে কাবাব খেতে যেতে কেউ ভুলো না যেন!

মস্তিষ্কের তাপমাত্রা চরমে রেখেই বাড়ি, থুড়ি আফাকদের বাড়ি ফিরলাম। বিকেলে চা-আড্ডায় অবশ্য সেই তাপমাত্রা ফের তলানিতে নেমে এল। আঙ্কল দুঃখ করলেন শিকারা চড়িনি বলে। বললেন, চলো তোমাদের একটু ঘুরিয়ে আনি। আমরা লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। রোদ তখন পড়ে এসেছে। সারা শহর জুড়ে গোলাপি আভা। আফাকদের বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে একটা বড় রাস্তা পার হয়েই আরেকটা জমাটি গলিতে ঢুকে পড়লাম। এটা মনে হচ্ছে বাজার। তরি-তরকারি থেকে শুরু করে হাতে তৈরি বহু জিনিস বিক্রি হচ্ছে। খাবার দোকানে ইয়া বড় বড় পরোটা, তন্দুরি রুটি আরও কত কী। একটা কালো চকচকে ডাল দেখে অবাক হয়ে আঙ্কলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এটা কী?’’ উত্তর এলো কালি ডাল। রাতের রান্না করে খেয়ে দেখার জন্য সেই ডাল কিনে নিলেন আঙ্কল।

গলি বেয়ে একটু এগোতেই হঠাৎই ডাল লেকের দেখা পেলাম। ডাল লেকও গোলাপি, পিছনের পাহাড়ও গোলাপি, সব গোলাপি। ঘাটে নৌকো বাঁধা ছোট ছোট। দিনের শেষে সবাই তরী বেয়ে লেকের ওপারে নিজেদের আস্তানায় ফিরছে। এখান থেকেই দেখা দিল চার চিনার। বিষয়টা যেন আমার বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে জিটি রোড পেরিয়ে গঙ্গার ধারে যাওয়ার মতো। এই জায়গাটা ছিল আসলে হজরত বলের পিছনের দিক। হজরত বলও ঘোরা হল। যদিও মসজিদের ভিতরে পরে একদিন নিয়ে গিয়েছিল আফাক। যেদিন শ্রীনগরে থাকার শেষ দিন ছিল সেদিন। রাত আটটার (ওখানে রাতই) সময় সেই রাজধানী শহরের ঘুটঘুটে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছিলাম তিনজন। আমি, সায়নী আর আফাক। হাল্কা ঠান্ডায় কনকনে আইসক্রমি খেতে খেতে। সে সব কথা বলতে গেলে শব্দ সংখ্যা বেড়ে যাবে। আর এডিট করতে আমি খুবই কাঁচা।

যাই হোক এর পরের তিনদিন তিনটি জায়গায় গেলাম। প্রথমদিন সোনামার্গ, দ্বিতীয় দিন গুলমার্গ এবং তৃতীয় দিন পহেলগাঁও।

সোনামার্গের দিনও আন্টি এবং ওই মহিলা আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। সোনামার্গে যাওয়ার রাস্তা হচ্ছে কার্গিল যাওয়ার রাস্তা। তাই এদিকের পাহাড়গুলো একটি বেশি ধূসর। সোনামার্গের একটি বিশেষ জায়গা পর্যন্তই শহরের গাড়ি যেতে দেয়। বাকি জায়গা ঘুরে দেখার জন্য স্থানীয় একটা গাড়ি তোমাকে নিতেই হবে। সেই গাড়িও আবার একটা জায়গায় গিয়ে থেমে যায়। বাকি রাস্তা নয় ঘোড়ার পিঠে, নয় হেঁটে। আমি আর সায়নী হেঁটেই উঠেছিলাম একটা অর্ধেক পাহাড়। ও হ্যাঁ, এদিন আমাদের সঙ্গী হয়েছিল আফাকের পুচকে ভাই জিবরান। ভারী মিষ্টি ছেলে। ও তর তর করে পাহাড়ে চড়ে গিয়ে আমাদের জন্য বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিচ্ছিল। বেশ মজা হল। হলুদ পাতায় ঘেরা একটা উপত্যকা। মাঝখান দিয়ে ঝির ঝির করে বয়ে চলা শীর্ণকায় অথচ উজ্জ্বল একটা নদী। নদীর নাম জানি না। জানার চেষ্টাও খুব একটা করিনি। উপত্যকা যেখানে আপাত দৃষ্টিতে শেষ শরীরে হাল্কা বরফ নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা পাহাড়।

এর পর দিন গুলমার্গ। কোনও জায়গারই যাত্রা পথ নিয়ে বিশেষ বিবরণ দিচ্ছি না। যে কোনও মোড়ই যে কারও নজরে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। জায়গাটার নাম কেন গুলমার্গ তা বুঝতে পেরেছিলাম ছায়াচ্ছন্ন দেবদারু ঘেরা সর্পিল রাস্তা বেয়ে ওঠার এক মোড়েই। একটা চেকপোস্টে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। আর্মির সঙ্গে ড্রাইভারের কী যেন কথোপকথন চলছে। হঠাৎই জানলার বাইরে দিয়ে রাস্তার পাশে ঘাসের উপর চোখ পড়ল। উত্তেজনায় গাড়ি থেকে নেমেই পড়লাম হুড়মুড় করে। দেখি রাস্তার দু’পাশের ঘাসজমিতে বেছানো রয়েছে ছোট ছোট সাদা ঘাসফুল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মজার। গুলমার্গে পৌঁছেও ড্রেনের ধারে অবহেলায় গজিয়ে ওঠা সাদা ফুলেদের দেখেছিলাম।

শহরের বড়লোকেরা সে সব ফুল সযত্নে বাগানে পুষে থাকেন। গুলমার্গ তাদেরই দেশ। গুলমার্গের আরেক আকর্ষণ হচ্ছে ইহার রোপওয়ে। দুরুদুরু বুকে আমি আর সায়নী উঠেছিলাম সেটিতে। গুলমার্গ যাওয়ার দিন আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল জিবরান আর ইউনিভার্সিটির দু’টি ছেলে। ওরা দু’জনেই আফাকদের বাড়িতে ভাড়া থাকে। ওদের জন্যই এদিন ওই বন্দি বন্দি ফিলিংসটা হয়নি। ওরা মজার ছিল। প্রচুর গল্প করছিলাম আমরা। এখানেই প্রথম কাশ্মীরের কাওয়া খাই। সবাই মিলে। পরে যদিও আসল কাওয়া খেয়েছিলাম আফাকের মামারবাড়িতে গিয়ে। জ্বরের মুখে সে জিনিস খেলে পরেরদিন ঝরঝরে শরীর নিয়ে অফিস চলে আসা যায়। গুলমার্গে সবাই ঘোড়া নিতে জোরজার করে। তবে, আমার মনে হয় সকাল সকাল পৌঁছে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাই ভাল।

গুলমার্গ থেকে ফিরে শুনলাম পরের দিন থেকে শ্রীনগরের কিছু কিছু জায়গায় কারফিউ পড়ে যাবে। উধমপুরে গোমাংস নিয়ে যাওয়ার গুজবে একটা ট্রাক্টরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে শহরের একাধিক জায়গা উত্তপ্ত। অতএব পহেলগাঁওয়ে যেতে হলে ভোঁর পাঁচটায় বেরতে হবে আমাদের এবং ছ’টার মধ্যে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে।

পহেলগাঁওয়ে থাকার পরিকল্পনাও বাতিল করতে হল না না কারণে। মন খারাপ করেই পরেরদিন সকালে রওনা দিলাম। গুলমার্গে একাধিক জায়গা রয়েছে ঘুরে দেখার। যতদূর জানি একদিন ওখানে থেকে না ঘুরলে অনেককিছুই অদেখা থেকে যায়। পহেলগাঁও যাওয়ার রাস্তায় বেশির ভাগ সময়েই লিডার নদী তোমার আশপাশ দিয়ে বয়ে চলে রূপোলি রেখায়। পহেলগাঁওয়ে পৌঁছে ওখান থেকে ঘোড়া ভাড়া করতে হয়। প্রচুর টাকা চায়। দরদাম করাও মুশকিল। তবে ঘোড়া যে রাস্তা (রাস্তা বলা ঠিক নয়, ওটা কিনারা আর পাশে খাদ) দিয়ে নিয়ে যাবে সেটি ভয়ঙ্কর। সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে শরীরে যতটুকু জল বেঁচে ছিল সেটুকুও শুকিয়ে গিয়েছিল আমাদের। মাঝে মাঝে মা ঘোড়ার পিঠে বসে লালমোহনবাবুর মতো বলে উঠছিল, জয় মাতা দি! জয়মাতা দি! সেটা ভয়ে না ভক্তিতে মাতাই জানেন। ঘোড়ার পিঠ থেকে নীচের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছিল হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে যাব। এর থেকে পায়ে চলা ভাল বলে নেমেও পড়েছিলাম মাঝ রাস্তায়। কিন্তু দেখলাম আমার ক্ষুদ্রকায় পা ধারণ করার পক্ষে সেই রাস্তা বড়ই সরু।

শ্রীনগরে ফিরে শুনলাম পরিস্থিতি উত্তপ্ত। রিস্ক না নিয়ে পরের দিনই জম্মু রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটি অটো জোগাড় করে দিল আফাক। পরের দিল সকালে সেটা করে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে শঙ্করাচার্যকে দৃকপটে রেখে ফেরার গাড়িতে উঠলাম। টাটা শ্রীনগর।

পথে আর্মিদের সঙ্গে ড্রাইভারের ধুন্ধুমার লাগল একবার। চারদিক বড্ড বেশিই থমথমে। এরমাঝে একবার আধো ঘুমে চোখ মেললাম। দেখি কুয়াশা ঘেরা একটা পাহাড়ি রাস্তা। ঝাপসা দেবদারু দু’পাশে। ওহো! সামনেটা ক্রমে আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হুহু করে কী ঢুকছে ওটা কুয়াশা না মেঘ! খুব ঠান্ডা লাগল হঠাৎ। ড্রাইভার দাদা বললেন পটনিটপমে অ্যয়সাহি হোতা হ্যায়।

স্বপ্ন মনে করে চোখ বুজলাম।

পরের দিন জম্মুতে আকাশ কালো করে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি এল।

ভয়ঙ্কর।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *