দীপক দাস
ছোটবেলায় শুনেছিলুম গ্রামের নামটা। বহুদিন আগে একবার কাজের সূত্রে গ্রামের উপর দিয়ে গিয়েছিলুম। এই সেদিন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর ২৯ তারিখে, ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের উদ্যানভোজনে গিয়ে চাক্ষুস করলুম।
গ্রামের নাম ছোট কলকাতা। হাওড়া জেলার পশ্চিমদিকে দামোদর নদের তীরে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধ জনপদ রসপুর। সেই জনপদেরই একটি গ্রাম ছোট কলকাতা। আগে বলা হতো ছোট কলিকাতা। এখন ‘বড়দাদা’ হলফনামা দিয়ে নাম পরিবর্তন করায় ছোটভাইও কলিকাতা থেকে কলকাতা হয়েছে।
সে হোক, কিন্তু কেন হঠাৎ রাজধানী থেকে এত দূরে কলকাতার নামে একটা গ্রাম গজিয়ে উঠল? তখন উদ্যানভোজন শেষ। কাচ্চা-বাচ্চা, মাঝারি, ধাড়িদের গাড়িতে উঠতে বলে আমি আর ইন্দ্র বাইক নিয়ে গেলুম সরেজমিন দেখতে। গাছগাছালি ভরা সাজানো গ্রাম। দামোদর নদের তীরে অবস্থিত গ্রাম। আর দামোদরের যা সুনাম! সেই ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, ‘দুখের নদ’ দামোদর। প্রতি বর্ষায় বাসিন্দাদের বাঁচাতে গ্রামের মাঝখান দিয়ে বড় বাঁধ। সেই বাঁধই যোগাযোগের প্রধান সড়ক। পাকা সড়ক। বেশ কয়েকটি পুরনো বড় বাড়িও চোখে পড়ল। সেইরকমই একটি বাড়িতে এক বিউটি পার্লারের বিজ্ঞাপন। ঠিকানার জায়গায় লেখা ছোট কলিকাতা। বাঁধের উপরে গাড়ি রেখে ইন্দ্র ছবি তুলল। একটা পাঠাগার এবং এক ওষুধের দোকানের পরিচয় ক্যামেরা বন্দি করা হল।
ইন্দ্র ছবি তুলছিল। আর আমি লোকজন ধরে ধরে জানতে চাইছিলুম নামের উৎস। কিন্তু প্রথমজনকে জিজ্ঞাসার পরেই বুঝেছিলুম সর্বনাশ করে ফেলেছি। সেই মহাশয় হেঁটে ফিরছিলেন। জিজ্ঞাসা করতেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে স্টাইলে বলে উঠেছিলেন, ‘এটাই নাম। ইংরেজ আমল থেকে চলে আসছে।’ আসলে ভদ্রলোক রসিকজন। সেদিন বেশ ঠান্ডা। ডিসেম্বরের শেষে হিমেল হাওয়াটা বেশ উপভোগ্য। সব মিলিয়ে আবগারি আবহাওয়া। সেই হাওয়ার স্রোতে ভেসেছিলেন ভদ্রলোক। ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে বাইক উঠে পড়েছিলুম আমরা। পরে গল্পটা যখন আমাদের গ্রুপের সদস্য সৌগত ওরফে শুভকে বলা হল ও বলল, ‘ভাও খাবে না! তোমরা সব গাঁইয়া। আর ও খোদ কলকাতার বাসিন্দা। একটু তো রেলা দেখাবেই।’ যুক্তি শুনে আমি চুপ। গাঁইয়া বলে, দূরে বাড়ি বলে রাজধানী থেকে দূরে বাড়ি বলে অফিসের অনেক সহকর্মী-বাবুমশায়েরাই ফ্র্যাঙ্কফুটে (মানে ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ) ফ্রন্টফুটে খেলতে শুরু করে। তাঁদের বেশিরভাগের বাড়িই অবশ্য বৃহত্তর কলকাতায়।
ছোট কলকাতা তার পরিচয় গোপনই রাখল আমাদের কাছে। কারও কাছ থেকেই সদুত্তর মিলল না। আমার এক শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলুম। তাঁর আমতায় বাড়ি। তিনি দু’টি শব্দে ফেসবুকের ইনবক্সে জানালেন, ‘জানি না’। অনেক স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ল, বহুদিন আগে কে যেন বলেছিলেন, এখানকার বহু বাসিন্দা কলকাতায় কর্মসূত্রে থাকতেন। এত বেশি লোক থাকতেন যে লোকে বলত, ‘এ তো রীতিমতো ছোট কলিকাতা’। সিঙ্গাপুরের একটি এলাকা যেমন ‘লিটল ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত। বহু ভারতীয়ের বসবাস সেখানে। একসময় ইন্দোনেশিয়াকে যেমন বলা হতো, ‘দ্বীপময় ভারত’। সেইরকমই।
শুভর মামার বাড়ি আমতার কাছে। ওর দাবি, ও শুনেছে, ব্রিটিশ আমলে কলকাতার ব্যবসায়ীদের কাছে যে সব পণ্য পাওয়া যেগুলো ছোট কলকাতাতেও মিলত। দামেও নাকি কলকাতার সমান। তাই এমন নাম। তবে পরে রসপুরে দামোদর মেলার আয়োজক এবং ওই এলাকার বিএড কলেজের কর্ণধার তপন মণ্ডল একবার কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, এখানে একসময় কলিচুন তৈরি হতো। আর সেই চুন যেত সুতানুটি, গোবিন্দপুর এলাকায়। কলিচুনের কাতা বা আড়ত থেকেই নাকি এই নামের উৎপত্তি। এখানে চুনুরি পাড়া রয়েছে। এই চুনুরিরাই শামুক পুড়িয়ে চুন তৈরি করতেন।
তপনবাবুর তথ্যের একটু সংশোধন প্রয়োজন। তিনি ঠিকই বলেছেন। কলিচুন তৈরি হত কলকাতায়। তবে রাজধানী বড় কলিকাতা আর আমতারটি ছোট, এমন শ্রেণিবিভাগের কোনও ভিত্তি নেই। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে ‘হাওড়া-ছোট কলকাতা’ নামে একটি অধ্যায় লিখেছেন। সেই অধ্যায়ে তিনি স্পষ্ট করেছেন, ‘কলিকাতা’ নামের একাধিক গ্রাম ছিল বিভিন্ন জেলায়। এমনকী ঢাকা জেলার লৌহজঙ্গ থানা এলাকাতেও একটি কলিকাতা পাওয়া যায়। চব্বিশ পরগনাতেও এই নামে একটি গ্রাম ছিল। তিনি জানাচ্ছেন, দেওয়ালে চুনকাম করাকে ‘কলি দেওয়া’ বা ‘কলি ফেরানো’ বলে।কলিচুন আর কাতা মিলিয়ে একাধিক কলিকাতা তৈরি। ইংরেজদের বদান্যতায় এক কলিকাতা হঠাৎ বড় হয়ে যায়। আরেক কলিকাতা ক্ষয় পেতে থাকে।
সমাপ্ত