জঙ্গল যাপন

মৌবনে আজ চাঁদ জমেছে

সৌমিত্র সেন

বনজোৎস্না এবং মহুয়া গন্ধে আবিল সন্ধ্যারাত্রিগুলি হৃদয়মনের পরতে পরতে জড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও নেশাগ্রস্ত অপরাধীর মতো আপনাকে হাঁটতে হচ্ছে এই বাঙ্ময় শালবীথির পথে, কেননা দিনের আলো কুশলতায় দেখা দূরবর্তী উচ্চাবচ টিলাগুলির প্রতিটি উত্তল-অবতল, প্রতিটি শরীরসন্ধি এই আঁধার মেহফিলেও আপনার কাছে সমান মোহময়ী হয়ে রয়েছে, পৃথিবী যে কত আদিম ও সে আদিমতার গন্ধ যে কতদূর আবেদনমুখর হতে পারে এই অঞ্চলে না এলে আপনি বুঝবেন না।

গ্রীষ্মটুকু বাদ দিয়ে বছরের যে কোনও সময় আসা চলে। তবে বসন্তই শ্রেষ্ঠ। আর ‘অদ্ভুত আঁধার’ মাখা এ অরণ্যতল যে কোনও সপ্তাহেই ভালো লাগলেও, পূর্ণিমা এখানে অন্য জগতের ভিন্ন সুষমার দরবার। বিদেশি ভাষায় কথা বলার মতো সাবধানে তার প্রসঙ্গে আসতে হয়।

ঝাড়গ্রাম স্টেশন।

কাঁকড়াঝোর-অনেক ভাবে আসা যায়। তবে সুবিধাজনক হল হাওড়া থেকে সরাসরি ঘাটশিলা। ঘাটশিলা থেকে টানা গাড়ি বুক করে অথবা রুটের বাসে হুল্লুং এবং হুল্লুং থেকে নদীর আঙুল ছুঁয়ে, জঙ্গল-পথ ভেঙে পাঁচ-সাত কিমির ট্রেকিং। আর যারা অযথা সাবধানী নন, ‘উইন্ডোশপিং’ নয়— ডুব দিতে চান রূপসায়রে, তাঁরা হাওড়া থেকে এসে ঝাড়গ্রামে নামুন। এখান থেকে বাসে যান ভুলাভেদা। ভুলাভেদা থেকে একজন গাইড নিয়ে নেমে পড়ুন আঠেরো কিমি আরণ্যক পথে। এ পথ আপনাকে ভয় দেখাবে, মোহিত করবে, আড়াল দিয়ে লুকিয়ে পালাবে, আবার ধরাও দেবে অপরিকল্পিত ছিনালপনায়। দু’পাশে খাদ এবং গহন ঘন বন। মাঝখানে সিঁদুর মাখা সিঁথির মত পথ। রোমাঞ্চ ভরা। না হেঁটে, এ-পথে জিপেও পার হওয়া যায়। কিন্তু আইসক্রিম গরম করে খেয়ে কী মজা? তবে যাবার আগে একটু খোঁজ তল্লাশ করুন।

পোস্তদানা দুষ্টুমন ছিটকে ওঠে

এখানে থাকার মধ্যে আছে শাল-মহুয়া-পলাশ-আকাশমণি। এসবের ফাঁক-ফোঁকরে বুনো শুয়োর-ভাল্লুক কখনও। হেমন্তে প্রচুর হাতিও আসে এ অঞ্চলে। কাছাকাছির মধ্যে আছে ভৈরব থান ও ভৈরব নদী। মাকুলি নদী ও ঝরনা। অনেকদূরে দলমার রেঞ্জ। সারাদিনের ট্রেকে যাওয়া যায় লাথাইশ্রেনীর দিকে। দারিদ্র্য ও অনুন্নতির ছাপওয়ালা এ ভূমিতলে সাঁওতাল ও মুন্ডাদেরই বাস। রুক্ষ অঞ্চলে চাষ হয় না তেমন। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে জীবন চলে আর বিড়ি পাতার ব্যবসা। তবু এই সামান্যের মধ্যে প্রকৃতি সৌন্দর্যের অসামান্যতা মুগ্ধ করবেই সবাইকে। যদিও কেয়ারি করা, টেলর মেড ট্যুরিস্ট স্পট এটা নয়। এখানে মন কে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘোরা যায়। চাই কি কখনও তেমন হলে ‘হুস’ করে উড়িয়ে দেওয়া যায় তাকে। কোথায় সে চলে যাবে ঠিক নেই। কখন সে ফিরে আসবে লেখা নেই। এই সময় একটা অনাস্বাদিতপূর্ব মন খারাপ আপনাকে বেড়ানোর অন্যতম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবেই। আর তারই মধ্যে ঝিলিক দেবে আপনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই দুষ্টু-দুষ্টু মনটি, আপনি বিস্মিত হবেন, সে আপনাকে ছেড়ে যায়নি দেখে। একটা ছোট্ট পরামর্শ।

স্থানমাহাত্ম্য সবটা অনুভব করতে হলে সরকারি বনবাংলো নয়, থাকুন গোপী মাহাতোর লজে। আগে থেকে বুকিং-এর কোনও ব্যবস্থা নেই। ঝুঁকি নিয়েই যেতে হয়। মিলেও যেতে পারে ঠাঁই। তবে নতুন বাড়িটি নয়, থাকবার জন্য বেছে নিন পুরানো মাটির দোতলা বাড়িটিই। বিছানাব্যবস্থা অতি সামান্য। সূর্য ডুবলে আঁধারমাণিক জ্বলে ওঠে এখানে যুগপৎ আপনার মনে ও মনের কোণের বাইরে।

খাওয়া-দাওয়াও সারতে পারেন এখানেই। আশ্চর্যরকম অতিথিবৎসল এঁরা। পিঁয়াজ লঙ্কা মাখা আলুভাতে, ডাল, মোটা চালের লাল-লাল ভাত আর দেশি মুরগির ঝোল। হাত বদলের স্বাদ যে কতখানি, হাড়ে হাড়ে বুঝবেন। একটু চেষ্টা করলে, এমনকী বনমুরগিও পেতে পারেন।

দু’দিনের জন্য যাবতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও স্বজনসম্বন্ধ থেকে যদি ছুটি নেওয়ার সৎসাহস থাকে, তবে চলুন ব্যাগ গোছানো যাক। বিন্দাস ট্যুর হবে দেখবেন।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *