জলযাত্রা

আমার ছোট নদীরা

দেবাশিস চৌধুরী

তখন ডিসেম্বর মাস। তবু বৃষ্টি এলো। আর এলো যখন আমরা বনের পথে চলেছি। মহুয়াটাড়ের জঙ্গলে ঝমঝম বৃষ্টি। কুয়াশা এবং মেঘে ঢাকা দিন। খুব শীত। বাসের কাচ নামানো। তবু সেই ঝর ঝরাৎ শব্দ করে চলা গাড়িটার পেটে বসে হাত-পা সেঁধিয়ে গিয়েছিল পেটের ভিতর। তার মধ্যেই একে একে পার হয়েছি সাতটা ঝোরা। পাহাড়ি জঙ্গলের এক দিক থেকে বেরিয়ে পিচের রাস্তা পার হয়ে তারা জঙ্গলের অন্য দিকে ঢুকে গিয়েছে। তখন জানতাম না। পরে শুনেছি সে ঝোরাগুলি আসলে নদী। সাত ভাই চম্পার মতো তারা সাত সখী সাতরঙা রামধনুর মতো জঙ্গল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাদের সকলে মিলে একটাই নাম, সপ্তপর্ণী।

এমনই আর একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশ সীমান্তের আগে, শিলংয়ের পাহাড়ে। চলি চলি করে পুরো খাসিয়া পাহাড়টা পেরিয়ে এসে সমতলে নামলাম, আর সে, একটু আগে এদিক ওদিক দিয়ে যে উঁকি দিচ্ছিল, আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে কাঁটাতার ডিঙিয়ে চলে গেল অন্য দেশে। যে দেশে আমার বাবার বাড়ি। তার নাম (আহা, সে নাম তো নয় যেন আমার মনের কথা) ইচ্ছেমতী।

সে বার বিয়ের পরে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। আকাশপথে নিজের দেশ ছেড়ে পাশের দেশ, তার পর আবার নিজের দেশে ঢুকে পড়া। বিমান নামার একটু আগে নীচে চেয়ে দেখি নদী। তাকে পেরিয়েই বাঁক নিল বিমান, তৈরি হল নামার জন্য। দূরে দেখা যাচ্ছে পাঁচিল, ধানখেত আর মাঠের গায়ে। ওই ধানখেত বাংলাদেশ। ওই মাঠ বাংলাদেশ। আর ওই পাঁচিল পার হয়ে শুরু যে বিমানবন্দর, সেটা আগরতলায়। আর সেই নদী? সে তো তিতাস।

স্থানীয় নাম কানা নদী। পোশাকি নাম কৌশিকী। একসময় প্রবল ছিল তার বেগ। বয়ে যেত হাওড়া-হুগলির একটি বিশাল এলাকায়। আসলে এটি দামোদরেরই একটি শাখা। এখন মৃতপ্রায়। বর্ষায় অবশ্য পুরনো রূপে মানুষের দুর্দশার কারণ হয়। হাওড়ার জগৎবল্লভপুর ব্লকের শঙ্করহাটি-মুন্সিরহাট এলাকায় তোলা ছবি।

ছোটবেলা ট্রেনে চেপে বহুবার কল্যাণী গিয়েছি। পিসির বাড়ি। যাওয়ার সময় পশ্চিমের জানলা ছিল আমার প্রিয়। কারণ, বেলঘরিয়া, আগরপাড়া, সোদপুর পার হওয়ার সময় সে দিকে পড়ত পরের পর পুকুর আর দিঘি। মাঝে মাঝে হয় বাড়ি, নয় রাস্তা, নয় একটা আস্ত বসত। সেই জল আর বাড়ির ভাগাভাগি দেখে মন জুড়িয়ে যেত। ভাবতাম, পরপর এতো পুকুর কেটেছে কে? কেনই বা কেটেছে? অনেক পরে জানতে পেরেছি, ওগুলো ভেবেচিন্তে কাটা পুকুর বা জলাশয় নয়, আসলে একটা নদী। বরং মাটি ফেলে জায়গায় জায়গায় তাকেই বুজিয়ে গড়েছে বসত। সেই নদী চুরি করে নিয়েছে ওখানকার লোক। সে সোনাই নদী।

অক্টোবর মাস। পুজোর ঠিক আগে গিয়েছি নবদ্বীপ, বন্ধুর বাড়ি। ফেরার পথে ঠিক হল, নদী দেখে যাব। ঘণ্টাখানেক ছিলাম সেই নদীতে। তার কালো জল, পাড়ের কোথাও কাশবন, কোথাও বাড়ি-ঘর-মন্দির। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ছইয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে তাতে ভিজলাম আমরা। তার পর নীল আকাশ, সাদা পেঁজা তুলো মেঘ। কালো জলে তার ছায়া, যেন আয়নার মতো। নৌকা বাইতে বাইতে এসে পড়ল বড় গাঙ। সেখানে জলের রঙ ঘোলাটে। হঠাৎ বিস্ময়, দেখি কালো পিঠ তুলে জলে ডুব দিল গাঙ্গেয় শুশুক! নদী-জোড়ের কাছে তখন আসন্ন উৎসবের মহড়া চলছে যেন। আমরা দেখছি, ঘোলা গঙ্গাজলে ছোট নদীর কালো জল মিশছে না। ঢেউ দিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসছে, জলঙ্গী।

ভোর তখনও ভালোভাবে কাটেনি। নভেম্বর মাস। হিম আর কুয়াশা। আধা শহর ছাড়িয়ে গ্রাম আর দু’দিক খোলা সেতু। তার নীচে শুয়ে আছে সে, আমাদের ছোট নদী। এক দিকে অনেকটা চড়া। অন্য দিকে গরু নাইবার, এমনকী সাঁতার দেওয়ার মতো জল রয়েছে তখনও। সঙ্গীরা সেখানে হট্টগোল। একে ধরো, তাকে সামলাও! মনে হল, এর কাছে তো আগের সন্ধ্যাতেও এসেছিলাম। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু সেতুতে ওঠার গায়ে হ্যাজাক জ্বালিয়ে একটা চায়ের দোকান। আর নদী অবধি পথ দেখিয়ে এনেছে জোনাকি ভরা গাছেরা। সেই হ্যাজাক, জোনাকি বা হাতের টর্চ বাতিতে নদীর কিছুই দেখা যায় না। শুধু শোনা যায় শব্দ। যা শুনে ভয় পেয়ে যায় সঙ্গের বাচ্চারা। আমাদেরও গা ছমছম করে। সেতুর ওপাড়ে কী আছে, ঠাওর হয় না। সেখানেই দিনের আলোয় দাঁড়িয়ে অবাক। এ তো এতটুকু একজন! যার ও প্রান্তে উঁচু পাড়, আর এক ধারে দু’টো মাথা তোলা ঝাঁকরা গাছ। এ প্রান্তে আমাদের ফেলে আসা সরু পিচ রাস্তা, যা ধরে গড়গড়িয়ে নেমে যায় ভোরের সাইকেল। অজস্র গাছের ফাঁক দিয়ে তার চলে যাওয়া সিনেমার মতো মনে হয়। সেই ‘দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি’ নদীটি কোপাই।

গৌরীগঙ্গা। অপভ্রংশে গৌরীগাং। একসময় হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লক এবং সংলগ্ন হুগলির চণ্ডীতলা এলাকায় প্রবাহিত ছিল। প্রবাহ কমতেই শুরু হয় পুকুর চুরি। এখন এই অবস্থা। একসময় যে তার রমরমা ছিল সেটা বোঝা যায় ওই খাতের আশেপাশে প্রচুর পুকুর দেখে। হাওড়ার বড়গাছিয়া অন্নদা-শরৎ গলুই পাঠাগারের কাছে তোলা ছবি।

আর আমার প্রিয়তম নদী সুরমা। যার তীরে আমার বাবার শহর। যার তীরে এখনও ইউরোপীয় ক্লাব, সঙ্গে টেনিস লন। যার পাশ দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা, যে রাস্তার অন্য পাশে গাছপালায় ছাওয়া পরপর পাড়া। যে নদী বেয়ে নৌকা করে অনেক ছোটবেলায় নিজের গ্রামে গিয়েছিলাম একবার। যে নদীতে আজও চলে গুনটানা নৌকা, শুধু আমি দেখতে পাই না। যে নদী পেরিয়ে টুকের ঘাট থেকে আজও আমার গ্রামে যাওয়া যায়। যে নদী আছে বলে আজও স্বপ্নে দেখতে পাই পিতৃপুরুষের ভিটেকে। আর যে নদী পেরিয়ে সোজা উত্তরে গেলে শুরু হয় পাহাড়। শিলঙের খাসিয়া পাহাড়। যেখানে সীমান্ত পেরিয়ে টুক করে ও পাড়ে চলে যায় ইচ্ছেমতী নদী।

(কভারের ছবিতে ইছামতী। ছবি তুলেছেন সৌচব বিশ্বাস)

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *