দীপশেখর দাস
“গৌতমজি অউর কিতনা চলনা হ্যায়?” আর পারলাম না। প্রশ্নটা করেই ফেললাম। সকাল ৯টায় শুরু করেছি পথ চলা। এখন বিকেল সাড়ে ৪টে। এই ৬-৭ ঘণ্টা হেঁটে চলেছি একটানা। মাঝে মাঝে শুধু মিলেছে একটু করে জলপানের বিরতি। জবাবে পাহাড় পথের এক বাঁক নির্দেশ করে গৌতমজি জানালেন- “উস মোড় পহুচতেহি দিখ জায়েগা”।
সাইরোপা ফরেস্ট গেস্টহাউস থেকে রওনা দিয়ে গন্তব্য ছিল রোল্লা ফরেস্ট ক্যাম্প। সেই উদ্দেশ্যেই এই পথ চলা। প্রথমে গেস্টহাউস থেকে গৌতমজির ঠিক করা গাড়িতে আধ ঘণ্টা জার্নি করে পৌঁছেছিলাম গুশানীতে। বড় রাস্তার শেষ এখানেই। এখান থেকে পাহাড় চড়তে হয় পায়ের জোরে। গুশানীতে অপেক্ষারত ছিলেন জ্ঞানচাঁদজি আর জীবনলালজি। এঁরাও বনরক্ষী। সঙ্গী হলেন আমাদের। গৌতম-জ্ঞানচাঁদ-জীবনলাল এই তিনপায়ায় ভর করে শুরু হয়েছিল আমাদের অভিযান।
পাহাড় কাটা ‘রাস্তা’ বেয়ে উঠতে শুরু করলাম আমরা। রাস্তা বলতে যা বুঝি এখানে ঠিক তা নয়। বড়জোর এ রাস্তায় দেড়জন পাশাপাশি হাঁটতে পারে। প্রাথমিকভাবে মাটির রাস্তা বলে মনে হলেও পরক্ষণেই ভুল ভাঙে। মাটিটা একটা ভ্রান্তি মাত্র। রাস্তা আসলে পাথর থুড়ি পাহাড়। মানুষের পদধূলির সমন্বয়ে পাহাড়ের প্রান্ত রাস্তার রূপ পেয়েছে মাত্র। মানুষ তার সুবিধার্থে পাহাড়কেই রাস্তা বানিয়েছে। সত্যি কিনা পারে মানুষে! কিন্তু এ পথের ঢাল বড়ই ভয়ংকর। সামনের দিকে যত তাকাই শুধুই চড়াই। ভূতলকে আনুভূমিক ধরে ৩০-৪০ ডিগ্রি কোণ করে একনাগাড়ে উঠে চলেছে সে উপরের দিকে। হিমালয় ছোঁয়ার উৎসাহে এই চড়াইটা যদিও ধর্তব্যে আনিনি।
এক ঘণ্টা টানা হাঁটার পর পৌঁছেছিলাম পাহাড়ি গ্রাম রোপায়। পাহাড়ের এত উপরেও বেশ সাজানো গোছানো গ্রাম। বেশির ভাগ বাড়িই কাঠের তৈরি। তবে বেশ কিছু বাড়ি পাকা। জানলাম, শহুরে লোকেরা পাহাড় দেখতে এলে এসব বাড়িতেই ঠাঁই নেয়। শুধু অবাক হয়েছিলাম, যে পথে হেঁটে দ্বিতীয়বার আসব কিনা ভাবছি সেই পথে এরা রোজ যাতায়াত করে কীভাবে!
রোপায় চা পিপাসা মিটিয়ে আবার শুরু হয়েছিল পথ চলা। যতই এগোচ্ছিলাম রাস্তা ততই সংকীর্ণ হচ্ছিল। পথে দেখা হয়েছিল এক বৃদ্ধার সঙ্গে। ষাটোর্দ্ধ হবেন। পিঠে মস্ত বস্তা বয়ে নিয়ে নামছিলেন। সঙ্গে দুই কিশোরী। তাদের পিঠেও বস্তা। যে পথে মাত্র কয়েকগাছি জামাকাপড় বইতে এই হিমশীতল পরিবেশেও আমাদের গলদঘর্ম অবস্থা সেই পথে এত ভারী বস্তা বয়ে আনছেন এই তিন মহিলা!!! ভেবেছিলাম, পাহাড় চড়ার প্রেরণা আরেকটু বাড়াই এঁদের অভিজ্ঞতার ভাগ নিয়ে। কী আছে বস্তায়? কোথা থেকেই বা আনা হয়? ইত্যাদি গোছের কিছু নিরীহ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু এই নিরীহ প্রশ্নগুলোই যে বিষবাণ হয়ে ফিরে আসবে বুঝতে পারিনি। আমাদের ফরেস্টের লোক মনে করে হিমাচলী ভাষায় উত্তেজিত মন্তব্য (বোধহয় গালি) ধেয়ে আসতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে গৌতমজি পরে জানান, এরা জঙ্গল থেকে একটি বিশেষ গাছের বীজ কুড়িয়ে আনেন। স্থানীয় ভাষায় সেই গাছকে খানোর বা পাঙ্গর বলে। তার বীজ বেচে এঁদের সংসার চলে। ওই বীজ কাপড়কাচার সাবান তৈরিতে কাজে লাগে। এঁরা চাষবাসও করেন কিছু। বাড়ির ছেলেরা শুধুই ফুর্তি করে বেড়ায়। তাদের পয়সা ঘরে আসে না। তাই দু’মুঠো ভাতের তাগিদে অতিমানবিক হয়ে উঠতে হয় এঁদের। আচ্ছা এঁদের কাছে কি নারী দিবসের কোনও খবর পৌঁছায়?
রোপা থেকে আরও ঘণ্টাদেড়েক চলার পর এসে পৌঁছেছিলাম মোবাইল পয়েন্ট। এখানে মোবাইল পাওয়া যায় না। তবে পাহাড়ে মোবাইলের নেটওয়ার্ক ক্ষেত্রের শেষ এখানেই। আরও একটা গুরুত্ব আছে এই পয়েন্টের। এখান থেকেই প্রথম দর্শন পাওয়া যায় তুষারবেষ্টিত তীর্থর। জাতীয় অরণ্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এই তীর্থ। হিমালয়ের প্রথম রূপ দেখি আমরা। মোবাইল পয়েন্ট থেকে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে হিমালয়ের রূপ সংক্ষেপে বর্ণনা করে আবার এগোতে থাকলাম।
চলেছিলাম তীর্থনের পাড় বরাবর। অদ্ভুত এ রাস্তা। একপাশে গভীর খাদ। অপরপাশে সুউচ্চ পাহাড়। সোজা চলতে হবে রাস্তা বরাবর। ডাঁয়ে-বাঁয়ে যাবার উপায় নেই। তবে পথ ছিল বড়ই মনোরম। এখানে শুধুই প্রশান্তি। শহরের জ্যাম নেই, গাড়ির আওয়াজ নেই, কালো ধোঁয়ার কুয়াশাও নেই। সবুজ ঘেরা পথের সবটাই পবিত্র। এই পরিবেশই বোধহয় আমদের পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে রেখেছিল। যে আমি শহরে ১০ মিনিটের পথ হাঁটতে হিমশিম খাই সেই আমি পথ চলেছি টানা ৬-৭ ঘণ্টা ধরে। বেশ গর্ব হচ্ছিল।
আঁকাবাঁকা পথ নদীর তীর বেয়ে এগোচ্ছে। বাঁকে বাঁকে রূপ পরিবর্তন করছিল প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই পাহাড়ি ঝর্ণা এসে মিশেছে তীর্থনের সঙ্গে। কী তাদের রূপ। কী তাদের গতি। মন হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই মায়াবিনীরা বারবার প্রেমে ফেলেছিল আমায়। সবুজ পাথর বেয়ে নেমে এসে হিল্লোল তুলছিল আমার মনে। দুর্ভাগ্য তাতেও কবি হতে পারিনি। হতে পারলে হয়তো লিখেই ফেলতাম কবিতা।
অবশেষে বিকেল ৪টেয় জাতীয় অরণ্যে। জীববিদ্যার বইয়ে পড়া জাতীয় অরণ্যের ছবিটা ঝালিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম একটু। বইয়ের সঙ্গে একটু অমিল ছিল যদিও। জাতীয় অরণ্যের তকমা পাবার আগেই এ স্থান ছিল বিখ্যাত পর্যটনস্থল। তাই পর্যটক আনাগোনার ছাপ স্পষ্ট এখানে। ইতিউতি পড়ে থাকা চিপস-কুরকুরের প্যাকেট কিছুটা হলেও জৌলুস কমায়।
খানিক দূর এগিয়েই পেয়েছিলাম একটা ঘর। গৌতমজি জানিয়েছিলেন, জাতীয় অরণ্যের মধ্যে একমাত্র মনুষ্য বসতি এটি। অবাক হয়েছিলাম। জঙ্গলে পাড়াপ্রতিবেশীহীন একটা বাড়ি! বিস্ময়ের বাকি ছিল তখনও। জানলাম, এ বাড়ির বাসিন্দা এক বৃদ্ধা। বাড়ির সামনের জমিতে চাষ করেন হরেক সবজি। রাজমা-কপি-পাহাড়ি আলু আরও কতকী। পালন করেন মৌমাছি। মৌচাষের সরঞ্জাম দেখেছিলাম বাড়ির দাওয়ায়। তবে ছবি তুলতে নারাজ তিনি। ছবি তুলতে গেলেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। কথার টানে মনে হল বললেন- তোমরা তো আসবে যাবে, আমার তো আর বদল হবে না। ছবি নিয়ে করবে কী! বুঝেছিলাম, মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে অবজ্ঞা পেতে পেতে। লুকিয়ে ছবি তুলেছিলাম একটি। ইনি তো মহিয়সী। ছবি তো রাখতেই হবে।
মহিয়সীর বাড়ি ছেড়ে খানিক এগিয়েই তীর্থনের উপর কাঠের সেতু। এই সেতু পার করেই গৌতমজিকে করেছিলাম প্রশ্নটা। তাঁর কথামতোই বাঁক পেরোতেই দেখা দিল সে। সবুজ-সাদা রোল্লা ফরেস্ট ক্যাম্প। শরীরটা কোনওক্রমে টেনে নিয়ে গিয়ে এলিয়ে দিলাম ক্যাম্পের ধুলোভরা মেঝেয়। শহুরে শরীরে প্রবল ক্লান্তি চেপে বসেছে যে।
ক্যাম্প ঝাড়পোছ করে জীবনলালজি চা উপহার দিলেন আমাদের। পাহাড় চড়ার বাহুল্যে যে ঘাম ঝরেছিল তা এখন হিমালয়ের হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া পেয়ে শিরশিরানি ধরাচ্ছিল। পোশাক পাল্টে গরম চায়ে চুমুক দিতেই পরম প্রশান্তি মন জুড়ে। সন্ধ্যা নেমেছে সবে পাহাড় বেয়ে। এদিক-ওদিক যাবার আর উপায় নেই। অন্ধকার জঙ্গলে ক্যাম্প ফায়ারের আগুনই এখন একমাত্র অবলম্বন। সন্ধ্যা এখানে বড়ই রোমাঞ্চকর। রোম্যান্টিকও বটে। ক্যাম্প ফায়ারের আগুন ক্যাম্পকে আলো দিলেও তার চারপাশের অন্ধকার আরও খানিক বাড়িয়ে তোলে যেন। আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা তীর্থনের প্রবল অথচ মিষ্ট জলস্রোতের শব্দ আমার মতো অরসজ্ঞের মরমেও পশে বৈকি।
জঙ্গলের সকাল বড়ই মধুর। নীচে ফরেস্ট রেস্ট হাউসে কলকাকলির যে ‘ট্রেলার’ শুনেছিলাম এখানে তার পুরোটাই ডলবি ডিজিটালে চলছে। হরেকরকমের পাখি, তার হরেকরকম বোল। নিজেদের জাহির করার জন্য তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন। আমি মনে মনে বলি – তোমরা সবাই জয়ী। এরই মধ্যে একজন দেখি জলে কিনারে বসে। ও হো! বসে তো নেই, সে সময়ে সময়ে তীর্থনের ঠান্ডা জলে ডাইভিং দিতে ব্যস্ত। বোধকরি সকালে স্নান করাটা ওর নিত্য অভ্যাস।
একটু বেলা বাড়তে সদলবলে চললাম জঙ্গল সাফারিতে। পাইন-ওক-দেওদারের বনে বাসা বেঁধেছে অজস্র ছোটো ছোটো গাছ। রংবেরঙের ফুল ফুটিয়ে রঙিন করে তুলেছে জঙ্গলকে। ফুল উপত্যকার গল্প শুনেছিলাম। সেখানে নাকি ফুলের রঙে রঞ্জিত হয় পাহাড়। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার।
এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলাম এমন এক জায়গায় যেখানে রাস্তা উঠে গিয়েছে সোজা উপরের দিকে। অনুভুমির সঙ্গে এর কোণ প্রায় ৭০ ডিগ্রি। গৌতমজি বললেন, ‘এ রাস্তায় চড়লে মোনাল দেখা যায়।’ মোনাল এখানকার বিখ্যাত ফেজ্যান্ট। ফরেস্ট রেস্ট হাউসে মোনালের ছবি দেখেছিলাম। অদ্ভুত তার রূপ মাহাত্ম্য। আমাদের ময়ূরের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে। এতদূর যখন এসেছি মোনাল দেখব না! তাই হয় নাকি। শুরু হল চলা বা চড়া। চড়াই বটে একটা। ১০ মিনিট চললে ২ মিনিট বিশ্রাম। নীচের দিকে তাকালে জঙ্গল ভেদ করে তীর্থনের জল চকচক করে। সরু রাস্তা আর চোখে পড়ে না। একটানা প্রায় ৩ ঘণ্টা চলেছি। মোনালের দেখা নেই। জঙ্গল ক্রমশ গভীর হচ্ছে। উচ্চতা বাড়ছে ধীরে ধীরে।
জিপিএস জানান দিচ্ছে, আমরা আছি ২৯০০ মিটারে। এই উচ্চতা থেকে তীর্থকে দেখতে পাবার কথা খুবই স্পষ্টভাবে। কিন্তু কুয়াশার আচ্ছাদনে তীর্থ মুখ লুকিয়েছে। তবুও এগিয়ে চলেছি আমরা পাহাড়কে পাক খেতে খেতে। এমনই এক বাঁক ঘোরার মুখে হঠাৎ প্রবল ডানা ঝটপটানির শব্দ। পাইন গাছের ডালে একটু নীলের বিচ্ছুরণ খেলে গেল যেন। ডানা মেলেছে হিমালয়ান মোনাল। কী তার রূপ, কী তার মাধুর্য। আমি ময়ূরকে ডানা মেলতে দেখেছি, নাচতেও দেখেছি। কিন্তু এ রূপের কাছে সে দশ গোল খাবে। আঁখি ধন্য আমার। শুধু আফশোস একটাই। পায়ের শব্দ পেয়েই সে ডানা মেলেছিল অন্য কোথাও নিজেকে ঢাকবে বলে। ক্যামেরা বাগালেও আমার মত চুনোপুটির মডেল হতে রাজি হয়নি সে।
মোনাল দেখে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। ব্যাগ গোছাতে হবে সন্ধ্যা নামার আগেই। কাল ফিরব ফরেস্ট গেস্ট হাউসে। সেখান থেকে যাব তীর্থন ভগিনীর রূপ দর্শনে। কত বিস্ময় যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!
(চলবে)
ঘুরতে যাওয়া মানে সেখানকার প্রকৃতির রূপ দেখে ‘আহা কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরের ভুলিব না!’ সন্তোষ নয় শুধু। ঘুরতে যাওয়া মানে সেখানকার মানুষ দেখাও। শিখিয়েছিলেন আমার অন্যতম গুরু অরণিদা। তোর হিমালয়ের লেখার মধ্যে মানুষ আছেন। বস্তাবুড়ি, একাকিনী সাহসিনীর জীবন সংগ্রাম। ভাল লেগেছে। মানুষ ছাড়া কিন্তু কিছুই সম্পূর্ণ নয়। আরও দেখ, লেখ।
Awsome..👍👌👌💐💐