দীপশেখর দাস
এক হিমালয় কন্যা তীর্থনের রূপ দর্শন সেরে পা বাড়ালাম অন্য কন্যার কাছে। নাম তার স্যাঞ্জ। নামটি মোটেই নজরকাড়া নয়। তবুও ‘আয়া হু তো দেখ করহি যাউঙ্গা’ মনোভাব নিয়েই চলেছি তার উদ্দেশ্যে। রোল্লা ফরেস্ট ক্যাম্প থেকে সকাল সকাল রওনা দিয়ে সাইরোপা ফরেস্ট গেস্ট হাউসে পৌঁছেছিলাম দুপুর ২টো নাগাদ। গেস্ট হাউসে ক্ষুধা নিবারণ করে টাটা সুমোয় চড়েছি। গৌতমজিরা বিদায় নিলেন গেস্ট হাউস থেকেই। স্যাঞ্জ নদী অন্যের ডেরায় পড়ে।
ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চায়। কিন্তু ঘুম সহজে আসে না। দু’পাতা এক হলেই তীর্থনের নীল জলের ছবি ভেসে ওঠে। পাথর চুঁইয়ে নেমে আসা বারিস্রোত পরম প্রশান্তি এনে দেয় তখন। গাড়ির আচমকা ব্রেক তন্দ্রা ছোটায়। ছোট এক বোল্ডার পথ অবরোধ করেছে। হয়তো কোনও দাবি ছিল। কিন্তু বেদরামজি কোনও বিনা বাক্যব্যয়ে উৎখাত করে তাকে। এ পথে বেদরামজি আমাদের ড্রাইভাররূপী গাইড। আবার গাড়ি এগিয়ে চলে মসৃণ পথে একপাশে পাহাড় আর একপাশে নদীকে সঙ্গী করে। কিন্তু এ কোন নদী! এতো তীর্থন নয়। তীর্থন যে সচল, বিদ্যুৎগতির। কিন্তু এ যে প্রায় চলৎশক্তিহীন। কোনও দুঃখভার নিয়ে পথ চলেছে যেন। বেদরামজি জানালেন, এ-ই স্যাঞ্জ।
তীর্থন আর স্যাঞ্জ-এর উৎপত্তি একই সঙ্গে। শুধু এদের চলার পথটাই যা আলাদা। হিমালয়ের এই জাতীয় অরণ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে এই দুই ভগিনী। দুই উপত্যকাতেই গড়ে উঠেছে মনুষ্য সভ্যতা। কিন্তু এক ভগিনী সুয়োরানী আর একজন দুয়োরানী। এমন কেন? প্রশ্নটা রয়েই যায় মনে।
রোপা গেস্ট হাউসে পৌঁছতে সন্ধ্যা। আগমনী বার্তা পেয়ে আগেভাগেই ঘর খুলে দিয়েছিলেন গোবিন্দরামজি। রোপা গেস্ট হাউসের দেখভালকারী। মাটির মানুষ তিনি। থাকার সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন আমাদের পৌঁছানোর আগেই। গৃহপ্রবেশের আগেই চায়ের প্রস্তাব। পরে জেনেছিলাম, গেস্ট হাউসে ওঁর ডিউটি শুধু দিনে। কিন্তু রাতের ছেলেটি রান্না পারে না। তাই রাতটুকুও থেকে যান এখানে। মাত্র ৭-৮ কিলোমিটার দূরে হলেও গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়ে উঠে না তার দিনের পর দিন।
সকালে ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। জানালার পাল্লা ফুঁড়ে সকালবেলার সেই গান এখানেও বাস্তব। পর্দা সরিয়ে এক ঝলক দেখে নিই তাদের। এই কদিনের পথচলা বেশ ক্লান্ত করেছে সকলকেই। তখনও আমার ঘরসঙ্গী লেপের আড়ালে গভীর শ্বাসের শব্দ। এদিকটায় বেশ ঠান্ডা। শীত পোশাক চাপিয়ে বাইরে এলাম। এবং স্থির হয়ে গেলাম। এ কাকে দেখি! ওই যে দূরে। বরফের চাদরে মোড়া ও-ই তো হিমালয়। যেমনটা পড়েছিলাম বইয়ের পাতায়। যার ছবি এঁকেছিলাম মানসপটে। প্রতিজ্ঞা করলাম এবার ছোঁবই তোকে।
একটু বেলায় বেড়িয়েছিলাম গাইডের খোঁজে। কিছুটা দূরেই গ্রাম। নদীর নামে নাম- স্যাঞ্জ। তবে এঁদের কাছে এটাই শহর। রাস্তাঘাট পাকা, বাঁধানো দোকান, সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শহরই তো। গাইড জোগাড় হল। নাম জগদীশ ঠাকুর। গাইডবাবুই গাড়ির বন্দোবস্ত করবেন ঠিক হল। দুপুরের ভূরিভোজ স্যাঞ্জেই সারলাম। রবিবার। তাই খাসির মাংসে ক্ষতি কী?
বিকেলে গিয়েছিলাম স্যাঞ্জের ওপারে। গোবিন্দরামজিকে সঙ্গে নিয়ে। খানিক পাহাড় চড়ে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়েছিলেন দূরের এক গ্রামকে। ছবির মতো সুন্দর, সাঙর। ওঁর গ্রাম। ক্যামেরা জুম করে ছবি নিয়েছিলাম একটা। নিজেই চোখ ফেরাতে পারিনি।
পরের দিন সকাল সকাল রওনা দিলাম আমার আসল হিমালয় ছুঁতে। জগদীশজি গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন সময় মতোই। অত্যন্ত সময় মাপা লোক তিনি আগেই জানিয়েছিলেন আমাদের। ড্রাইভার ঠাকুর সিং। ওঁর বাবা-মা শোলের ভক্ত ছিলেন কিনা বলতে পারিনা।
গাড়িতে এক ঘণ্টা লাগল নীরহানি পৌঁছতে। পথে জেনেছিলাম স্যাঞ্জ নদীর রুগ্নতার কারণ। জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম বাঁধ দিয়ে গতিরোধ করেছে তার। বুঝলাম, মানুষই নদীর চিরকালীন দুঃখের কারণ, প্রকৃতি নয়।
নীরহানি থেকে আমাদের হাঁটা পথের শুরু। এবার পথ হাঁটছি স্যাঞ্জের তীর বেয়ে। স্যাঞ্জ এখানে মোহময়ী, কল্লোলিনী। তীর্থনের মতোই। তফাৎ শুধু জলের রঙে। তীর্থন নীলাভ। স্যাঞ্জ সবুজ। আর তার শোভা বৃদ্ধি করছে পথের পাশের লাল রডোডেনড্রন।
ঘণ্টাখানেক পথ চলে পৌঁছলাম বাহ গ্রামে। জাতীয় অরণ্যে প্রবেশের আগে শেষ গ্রাম এটি। গাইডবাবু তার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে খাঁটি দুধের লস্যি খাওয়ালেন আমাদের। ওই ঘরোয়া লস্যির স্বাদ আজও জিভে জল আনে। পিপাসা মিটিয়ে আবার শুরু হল পথ চলা। পথের ঢাল ক্রমশ বর্ধমান। তীর্থন উপত্যকার থেকে অনেক বেশী। এগিয়ে চলেছি যত চাদর মোড়া হিমালয় এগিয়ে আসে তত। পথের ক্লান্তি ভুলে যাই একবার তার দিকে তাকিয়েই। বাহ থেকে জাতীয় অরণ্যে প্রবেশ করে থমকেছিলাম এক জায়গায়। রাস্তা এখানে চড়াই নয়। বরং সমতল বলা যাতে পারে। ধান তোলার পর নাড়া ভরা জমিতে চলার ফলে যেমন পথের সৃষ্টি হয়, ঠিক সেইরকম। পর্যটকেরা তাঁবু ফেলেন এখানে। ফেলবেন নাই বা কেন? স্যাঞ্জ যে এখানে সবথেকে রূপমতী। এলাকাটি সমতল হওয়ায় তার গতি স্তিমিত। কিন্তু প্রবাহমান। নদীর অবরুদ্ধ গতি ঝিলের সৃষ্টি করেছে এখানে। জগদীশজি জানান, কয়েক বছর আগেও এই ঝিলে ট্রাউট পাওয়া যেত। স্রোতের বিপরীতে ভেসে এসে আস্তানা নিত ঝিলে। কিন্তু জলবিদ্যুতের বাঁধ পথ অবরুদ্ধ করেছে তাদের।
এখানে বয়ে চলেছে জাতীয় অরণ্য আর অভয়ারণ্যের মাঝ দিয়ে। নাম স্যাঞ্জ অভয়ারণ্য। তীর্থন উপত্যকায় কোনও গ্রাম না থাকলেও এ পথে আরও দুটি গ্রাম আছে অভয়ারণ্যের মধ্যে। প্রথমে আসে শক্তি। পরেরটি মারুর। আমাদের আজকের গন্তব্য মারুর। সেখানের ফরেস্ট ক্যাম্পে ঠাঁই নেব আমরা।
শক্তি গ্রামে পৌঁছলাম বিকেল ৫টায়। সারাদিন জল ছাড়া কিছুই জোটেনি। পেটে ডন দিতে থাকা ইঁদুরগুলোকে থামাতে গাইড কাম কুক জগদীশজি ম্যাগি বানাতে কোনও এক পরিচিতের বাড়ি। গেলেন তো গেলেন, আসেন আর না। জানতাম ম্যাগি দু’মিনিটে তৈরি হয়। অথচ আধ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও ম্যাগির দেখা নেই। ক্ষিদে বাড়ছে, সঙ্গে বিরক্তি। কিন্তু যখন তিনি এলেন মন উৎফুল্ল। সব বিরক্তি উধাও। ম্যাগি তো এসেছেই, সঙ্গে এসেছে গরম গরম ভাত। আহ! আর কী চাই।
রওনা দিলাম। ভাত ঘুমের সময় নেই। তবুও পথেই সন্ধ্যা ঘনাল। তখনও প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট চলা বাকি। একটু অসুবিধা হয়েছিল। টর্চের আলোয় পার করলাম বাকিটুকু। রাত ৮টায় মারুরে।
পরের দিন সকালে মারুর দর্শন। তিনদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আর একদিকে পথ চলেছে আরও উপরে। ক্যাম্পের দেওয়ালে লেখা এস্থানের উচ্চতা ২৫৪৭ মিটার। ক্যাম্পের পশ্চিমের পাহাড় বেশ রুক্ষ। গাছপালাও কম সেখানে। উত্তরেরটারও একই অবস্থা। কিন্তু দক্ষিণেরটা হৃদয়হরণের পক্ষে যথেষ্ট। সবুজ বনানী ঘিরে রেখেছে পাহাড়টাকে। আর ঠিক যেখানে বনের শেষ সেখান থেকে পাহাড় সাদা বরফের চাদর মুড়ি দিয়েছে। সকালের সূর্যকিরণ ঠিকরে বেরোচ্ছে বরফে ধাক্কা খেয়ে। যেন হাজার ওয়াটের আলোর ঝলকানি ওখানে।
চটজলদি বেরিয়ে পড়লাম পারকাচির উদ্দেশ্যে। মারুর থেকে পারকাচির দূরত্ব বড়জোর ৮ কিলোমিটার। কিন্তু চড়াই ঢের বেশি। তাই সময় হাতে নিয়েই বেরোলাম। এখন যে পথে চলেছি সে পথের রূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। বিভূতি স্যারের চাঁদের পাহাড় পড়েছি। কিন্তু এই চাঁদের বর্ণনা করি কীভাবে? ভূর্জপত্র আর পাইনের বনের মধ্যে দিয়ে পথ। মাঝে মাঝেই জল জমে আছে পথের উপর। কিছুদিন আগেও রাস্তা বরফে ঢেকেছিল বেশ বোঝা যায়। কখনও পথ চলেছে পাহাড়ের উপর দিয়ে। পরক্ষনেই নেমে আসছে সে নদীর চড়ায়। চড়া, উপত্যকা, পাথর, পাহাড় আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বরফ ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ স্বর্গের সৌন্দর্য নিয়ে এসেছে যেন।
আরও কিছুদূর চলার পর স্বপ্নপূরণ। বরফের আস্তরণে মুখ লুকিয়েছে পথের বেশ কিছুটা অংশ। এই প্রথম আমার বরফ দেখা। বলা ভাল বরফ ছোঁয়া। আবেগ না আনন্দ কী কাজ করেছিল জানি না। তবে সঙ্গীরা পরে বলেছিল পাগলপ্রায় আচরণ করেছি তখন। আরও খানিক এগিয়ে এক সাঁকো। সাঁকোটা বাঁশের না হলেও সে দুলেছিল। এপাশের পাহাড় চূড়া থেকে এক প্রবল জলধারা নেমে এসেছে স্যাঞ্জের দেহে। আর সেই জলধারার ওপরেই এই সাঁকো। সরু তিনটি গাছের গুঁড়ি, তাও আবার আলাদা করে বাঁধা। এক এক করে পাড় হল সবাই। আমি রইলাম সবার শেষে। একটু ভীতু আমি। তাই বাকিদের আগে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে নিলাম সাঁকোর শক্তি। কিন্তু পা বাড়াতেই বিপত্তি। এক প্রবল আর্তনাদ ছাড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে আমার সাথীরাও। ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলাম। আর্তনাদকারীকে ছেড়ে দ্বিতীয় জনের ঘাড়ে চাপলাম। এ বেশ শক্তিশালী। সাঁকো পেরিয়েই লম্বা চড়াই। আর চড়াই পেরিয়েই পারকাচি।
পারকাচির ফরেস্ট ক্যাম্প এ আস্তানা নিয়েছি আমরা। তবে এ ক্যাম্পের অবস্থা আগেরগুলোর মতো নয়। ক্যাম্পের দরজা আর চাল আস্ত আছে ঠিকই। কিন্তু জানালা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। তবে পারকাচির প্রাকৃতিক দৃশ্যটা বড়ই মনোরম। অনেকটা আইজলের স্টেডিয়াম যেন। এই স্টেডিয়ামেই মোহনবাগান ম্যাচ হেরে সদ্য আই লিগ খুইয়েছে। একদিকে পাহাড়। আরেক দিকে গভীর খাদ। মাঝে গালিচা বিছানো খোলা ময়দান। বিকেল থেকেই আকাশের আজ মুখ ভার। সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া ধেয়ে আসছে ওইসব বরফ পাহাড় থেকে। ঠান্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে আমরা একেবারেই স্পর্শকাতর। রাতবিরেতে শুরু হল প্রবল ঝঞ্ঝা। যেমন ঝোড়ো হাওয়া তেমন বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে পরে থাকা ভাঙা টিন, ছেঁড়া বস্তা দিয়ে জানালা ঢাকার চেষ্টা। যতটা বাঁচানো যায় নিজেদের। শেষপর্যন্ত আর কোনো উপায় না দেখে স্লিপিং ব্যাগের চেন টেনে ঘুম।
রাত বাড়ে বৃষ্টির দাপটও বাড়ে পাল্লা দিয়ে। হাড়হিম করা ঠান্ডায় আমরা তখন জমাট। সবাই যতটা পারে ঘেঁষাঘেষি করে শয়নরত, জাগ্রত। প্রত্যেকেরই মনে উদ্বেগ। ছাউনির চালাটা শক্তপোক্ত নয় যে মোটেই। বৃষ্টি থামল অনেক রাতে। কে যেন মোবাইল দেখে বলল- দুটো পঁয়ত্রিশ।
সকালটাও ঠিক আমেজে হল না। আকাশে তখনও জমকালো মেঘেদের আনাগোনা। সুয্যিমামা মুখ ঢেকেছে তাদেরই আড়ালে। হিমালয়ে সুয্যি উঠা দেখা হল না আজও। মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম আকাশ পানে চেয়ে। পাশে কখন যে দীনেশদা এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। ইনি আদতে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা। কর্মসূত্রে বর্তমানে কলকাতায়। এমন আবহাওয়া তার ঢের দেখা। খানিকক্ষণ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে বললেন – এমন চললে বরফ পড়বে। আমার তো হাতে চাঁদ পাবার অবস্থা। যদি এমনটা হয় তবেই সুর্যোদয় হারানোর দুঃখটাকে ভোলা যায়।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালো আকাশ আরও কালো হতে থাকল। সদ্য মেঘ হয়ে উঠা জলকণাগুলো পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে মিশতে থাকল তাদের অগ্রজের সঙ্গে। ফলে আকাশ হয়ে উঠল আরও ভয়াবহ। এই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও কেন জানি না গুনগুনিয়ে উঠেছিলাম, “গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা”।
বরষাই বটে। একটু বেলা থেকে শুরু করে মুষলধারা চলল বিকেল পর্যন্ত। অবিরাম। বিকেল সাড়ে চারটের পর থেকে বারিধারার সঙ্গী হল শিলাবৃষ্টি। প্রবল তার দাপট। ক্যাম্পের টিনের চালে হাজারটা ঢাক একসঙ্গে বাজছে যেন। বা একসঙ্গে অনেকগুলো কাঁসার থালা শান বাঁধানো মেঝেতে আছাড়ে ফেলছে কেউ, আর সে থামছে না। ফেলেই চলেছে এমন এক অনুভূতির সম্মুখীন আমরা। দেখতে দেখতেই ক্যাম্পের সামনের সবুজ গালিচাটা সফেদ চাদরে ঢেকে গেল। ঝোড়ো হাওয়ার কাছে হেরে গিয়ে ক্যাম্পের দরজা বন্ধ করলাম আমরা।
এইভাবে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। টিনের চাল এখন অনেক শান্ত। এরপর হঠাৎই সব নিশ্চুপ। প্রকৃতি একদম শান্ত। যেন সারাদিন দাপিয়ে বেড়ানো দুরন্ত শিশু মাতৃক্রোড়ে আশ্রয় নিয়েছে। দীনেশদা হঠাৎ স্লিপিং ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে একলাফে দরজার বাইরে। গিয়েই হাঁক দিল, “দীপ আজাও”।
সেই প্রথম আমার তুষারপাত দেখা। সূক্ষ্ম শিমূল তুলোর মতো বরফ কণাগুলো নেমে আসছে মাটিতে। নিঃশব্দে। কারও সঙ্গে কোনও বিবাদ নেই। আপন খেয়ালে নেমে আসছে তারা হাওয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে। সেই শুরু। এরপর শুধুই তুষার আর তুষার। অবিশ্রান্ত তুষারপাত চলল সারারাত ধরে। সকালে যখন বাইরে এলাম জায়গাটা চিনে নিতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। সবুজ গালিচার চিহ্নমাত্র নেই। সবই সাদা। তুষারের মায়ায় রঙিন হিমালয় তখন একটা সাদাকালো ফ্রেম। অসাধারণ, অপার্থিব, অকল্পনীয়। অল্প সময়ে প্রকৃতির এই রূপ বদল জীবনে আর পাব কিনা জানা নেই। সুতরাং শুধু দেখ, দেখ, আর দেখ। মনে মনে বলি- এলাম, দেখলাম ও জয়ী হলাম।…
বরফ পড়া থেমেছে। দীনেশদা অভিজ্ঞ লোক। বললেন সকাল সকাল না বেরোলে পথে মুশকিলে পড়ব। সকালের শক্ত বরফে পা পিছলে যাবার ভয় কম। বরফ গলতে শুরু করলে সে পথে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। আমদের রসদও বেশি নেই। আকাশের যা মুখ ভার আজও হয়তো একই পরিস্থিতি থাকবে। তাই ফিরে যাওয়াই দস্তুর। চটজলদি ব্যাগ গুছিয়ে হাতে লাঠি ধরলাম। বরফে চলার সবথেকে ভালো অবলম্বন ওটাই।
ফিরে চলার পথ বড়ই মনোরম। যে পথ সবুজের প্রলেপ দিয়েছিল নয়নে তা আজ চকচক করছে শুভ্রতায়। পাইনের ডালগুলো বরফের ভারে নুয়ে পড়েছে রাস্তায়। একটু অসুবিধা হলেও সুবিধাই বেশি হয়েছিল তাতে। চলতে চলতে গলা ভেজাতে জলের খোঁজে যাইনি। গাছপাকা বরফ খেয়েই তৃষ্ণা মিটিয়েছিলাম।
সেদিন-ই ফিরে এসছিলাম মারুর। ওখানে একরাত বিশ্রাম নিয়ে পরেরদিন ফিরেছিলাম রোপা গেস্ট হাউসে। পথে দেখেছিলাম যাবার পথে না দেখা শক্তিদেবের ঝর্না। প্রায় একশ ফুট ঝাঁপিয়ে স্যাঞ্জের সঙ্গে মিলেছে সে।
বাসে দিল্লি আসার পথে আলাপ হয়েছিল এক বাঙালি ভদ্রোলোকের সঙ্গে। জানতে চাইছিলেন কোথায় এসেছিলাম? কেন এসছিলাম? কী বৃত্তান্ত? কাজ সফল হল কিনা? ইত্যাদি।
জবাবে শুধুই বলেছিলাম, “ছুঁয়ে এলাম তাকে”।
সমাপ্ত