দীপক দাস
বিভুঁইয়ের কত তুচ্ছ জিনিস যে ভাল লেগে যায়! গেঁথে যায় মনে। বেগুনকোদর স্টেশনে একটা লোক মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। অযোধ্যা যাওয়ার পথে দেখেছিলাম, কতকগুলো বাচ্চা একটা চাপাকল ঘিরে খেলছে। কিংবা ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এক আদিবাসী বধূর দাঁত মাজা!
চাতাল যাওয়ার পথে ভাল লেগে গেল দুই মহিলাকে। একপাল ছাগল নিয়ে জঙ্গলের পথে হেঁটে চলেছেন। হাতে বিশাল লগা। শাড়িটা একটু উঁচু করে পরা। একজনের কাঁধে গামছা। অন্যজন রোদ আটকাতে গামছাটা মাথায় দু’দিক দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। বসন খানিকটা মলিন। তবুও ভাল লেগে গেল। কেন? বলতে পারব না। হয়তো তাদের জীবনের পথে চলা দেখে। হয়তো এই মনভোলানো প্রকৃতির মাঝে তাদের দেখে।…
ভ্যানো দুই মেয়ে মোজেসকে পার করে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলল। এখানেও রাস্তার দু’পাশে কচির ক্যামেরার সাবজেক্টের অভাব নেই। ওর শাটার টেপার ক্লিক ক্লিক শব্দের মধ্যেই আমরা চাতালে পৌঁছলাম। চাতাল শব্দটা এখন কি খুব পরিচিত? নয় বোধহয়। গ্রামের দিকে হলেও হতে পারে। কিন্তু শহরে বাড়ি বলতে এখন ফ্ল্যাট বোঝায়। তাতে চাতালের নাম-নিশান নেই। কিন্তু পুরনো দিনের বাড়িতে চাতাল থাকাটা মানুষের মুখে নাক থাকার মতোই স্বাভাবিক ছিল। চলতি ভাষায় যাকে রোয়াক বলে। চাটুজ্জেদের চাতাল, ইয়ে মানে রোয়াক, না থাকলে টেনিদা জন্মাত!
এতবড় একটা খোলামেলা জায়গা পেলে কী হয়? প্রাণও খুলে যায় গড়ের মাঠের মতো। তার ওপর বনজঙ্গলে ঘেরা। শুরু হল আমাদের হুটোপাটি। এখানকার লোকে তো বলছেন, চাতাল আসলে পরিত্যক্ত রানওয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এখান থেকে যুদ্ধবিমান উড়ত-নামত। আমাদেরও উড়তে ইচ্ছে করল। কিন্তু টেক অফ করাটা অত সহজ নয়। আমি বুড়ো, ইন্দ্র ওবেলিক্স। দীপুর লিগামেন্ট ছেঁড়া। শুভ-বাবলা তো মাঝেই মাঝেই অভদ্রের মতো ওকে পঙ্গু বলে ডাকে। আর বাকি তিনটে সোশ্যাল সাইট প্রজন্ম। ফলে রাত জাগানিয়া এবং বেলা ঘুমোনিয়া। চার কদম দৌড়েই আমাদের দম শেষ। জুয়েল অবশ্য ক্যামেরাম্যান ছিল। শেষের দুই জাগানিয়া গালি ওর জন্য নয়।…
এরই মধ্যে আমাদের সারথি বৈঁচিফলের ঝোপ খুঁজে পেয়েছে। নতুন জিনিস। আমরা হামলে পড়লাম। খেলামও। ঠিক আছে। মোটামুটি স্বাদ। সারথি বলল, এগুলো বাজারে বিক্রি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে দলের প্রায় সবাই বৈঁচি ভুলে ফটোশেসন আর প্রকৃতিতে মগ্ন। কিন্তু…একজন আর কিছুতেই বৈঁচিঝোপ ছেড়ে নড়ে না। এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে ঢুঁ মারতে লাগল। এত বৈঁচি নিয়ে জয়পুরের বাজারে বসবে কিনা কে জানে? কাকে বলছি, বোঝা যাচ্ছে? আচ্ছা, সংকেত দিচ্ছি। অ্যাসটেরিক্স কমিকসের ওবেলিক্স দু’টো গোটা শুয়োরের রোস্ট খেত। আর কোথায় যেন পড়েছি, হাতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টাই খেতে ব্যস্ত থাকে। এটা কিন্তু হাটের মাঝে ফেলা কথা…কার গায়ে লাগবে জানি না।
ছোটাছুটি, বৈঁচি, ফটোশেসনের পরে আমরা জ্ঞানচর্চায় মগ্ন হলাম। আমরা কি রাখালবালক নাকি? শুধু খেলব আর খাব? আমরা কেউই ঘাড়ের উপরের গোলাকার বস্তুটি বয়ে বেড়ানোর বান্দা নই। ছয় মস্তিষ্কের ধূসর বস্তুতে রীতিমতো আলোড়ন চলল। কিন্তু অনেক আলোচনা করেও চাতালের ইতিহাসটা বুঝে উঠতে পারলাম না। জঙ্গলের মধ্যে কেন এমন রানওয়ে তৈরি করা হল। কেনই বা যুদ্ধবিমান নামত এখানে? নিশ্চয় কোনও লিখিত ইতিহাস আছে। খুঁজে দেখতে হবে।…
চাতাল ছেড়ে ফিরে আসছি তখন। হঠাৎ একটা পাখির ডাক শুনে চনমন করে উঠল দীপু। তারপর ফ্লাইক্যাচার ফ্লাইক্যাচার বলে ক্যামেরা নিয়ে লাফ দিল ভ্যানো থেকে। তখনই পাখিটাকে দেখতে পেলাম। উড়ে গিয়ে একটা শাল গাছে বসল। লম্বা সাদা ল্যাজ। মাথার কাছে কালো। এ তো দুধরাজ। ইংরেজিতে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার। দীপু ক্যামেরার জুম ঠিক করার আগেই পাখিটা আরেক উড়ান দিল। ব্যাস! ক্যামেরার চোখ থেকে দুধরাজ হারিয়ে গেল। আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দীপু আর ক্যামেরায় ধরতে পারছে না। ওদিকে পাখিটা অনবরত ডেকে চলেছে। বুঝলাম, দুধরাজের তাড়া আছে। আসলে তাড়না। পাশের জঙ্গল থেকে তার কোনও সঙ্গিনী সাড়া দিচ্ছে যে! দুধরাজ তখন মধুর স্বরে মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। সেই গানটা মনে নেই, ‘মান করেছে সুন্দরী, মান ভাঙাতে আমি কী করি’? প্রেমিকদের যা করতে হয় আরকী! তাই ক্যামেরায় পোজ দেওয়ার মতো সময় দুধরাজের নেই। হবু সঙ্গিনীকে ল্যাজের বাহার দেখাতে ফুড়ুক করে আরেক ডালে আবার উড়ল। এক বলে আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানের মতো কাঁধ ঝুলিয়ে ভ্যানোয় ফিরে এল দীপু। কচি তবু তাড়া করে শিয়ালের ল্যাজ তুলতে পেরেছিল। দীপু দুধরাজের একটা পালকও তুলতে পারল না। ক্যামেরায়!
বন দফতরের হাতিশালের কাছে এসে চমকে গেলাম। দেখি, শম্ভু একা দাঁড়িয়ে শুঁড় গুটিয়ে আগে-পিছে করছে। বাকিদের নিয়ে চলে গেল? শুধু তো শীলাবতীকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল! জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, বাকিদের চান করাতে নিয়ে গেছে। যাহ! এমন দৃশ্য ফসকে যাবে? দ্রুত সকলকে ভ্যানোয় ওঠার নির্দেশ দিলাম। কে যেন বলল, দূরে নয়। এখানেই চান করাচ্ছে। ততক্ষণে কাবেরীকে দেখতে পেয়েছি। ধুলোমাখা ধূসর কাবেরী ধোয়ামোছার পরে মেঘের মতো রং ধরেছে।
সবাই তখন হাতিদের স্নানের জায়গায়। জুয়েল দেখি, শম্ভুর কাছাকাছি বেড়ার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। অরিজিৎ ডাকল, ‘এই জুয়েল, চল।’ জুয়েল ভেঙিয়ে বলল, ‘মুর্খ! তুই মেয়েদের চান করা দেখগে যা।’ সারা সফর জুড়ে অরিজিৎকে ক্ষেপাতে জুয়েল এই শব্দটা ব্যবহার করে চলেছে, ‘মুর্খ’। জুয়েলের কথায় একটু অবাক হলাম। জোরে ডাকলাম, ‘এই বাঁদর! মেয়েদের চান কে দেখতে বলেছে? হাতিদের চান করাচ্ছে।’ জুয়েল উত্তর দিল, ‘শীলাবতী, কাবেরী…কারা এরা?’ ব্যাটা ভিক্টোরীয় শালীনতায় আক্রান্ত। ওদিকে রানির কীর্তি দেখেছিস! তিনি তো কোনও কিছুর ধার ধারেননি। রসুইকরের সঙ্গেও প্রেম করেছেন। সেই রসুইকর আবার ভারতীয়। জুডি ডেঞ্চ আর আলি জাফর অভিনীত সিনেমার বিজ্ঞাপনটা তো এখন সব চ্যানেলে। পাগলকে বেশিক্ষণ সাঁকো নাড়াতে দিতে নেই।
আমরা যখন চানের জায়গায় গেলাম তখন শীলাবতীর চান চলছে। সে বিরাট শিশুর মতো শুয়ে। মাহুতের দল জল ছিটিয়ে, কাপড়, বস্তা ছেঁড়া দিয়ে ঘষে ঘষে তার ওপর স্বচ্ছ ভারত অভিযান চালাচ্ছে। খাকি রঙের হাফ প্যান্ট আর জংলি শার্ট পরা এক মাহুতের কোমরের খাপে খুকরি দেখলাম। আরও কয়েকজনের কোমরেও ছিল। ফুলমতী ওয়েটিং লিস্টে। শীলাবতীর রূপটান শেষ হতে তার প্রসাধন শুরু হল। মাহুত নির্দেশ দেওয়া মাত্র পা মুড়ে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল ফুলমতী। ওর শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে মনে স্যালুট ঠুকলাম মাহুতকে। আসলে সমগ্র মানবজাতিকে। শুধু বুদ্ধির বলে অতবড় জীবকে নিজের দাসে পরিণত করেছে! ক্ষুদ্রায়তন একটা প্রাণী অতবড় প্রাণীটাকে ওঠাচ্ছে, বসাচ্ছে, পাশ ফেরাচ্ছে।
ওদিকে যাদের স্নান হয়ে গিয়েছে, মানে কাবেরী আর শীলাবতীর, তাদের পিঠে একজন করে মাহুত চেপে বসে আছেন। কেন? দীপু বলল, ‘বোধহয় যাতে ধুলো মাখতে না পারে।’ সত্যি, এই জলদ রঙের ওপরে ধুলোর পোচ পড়লে মোটেও ভাল দেখায় না।
ফুলমতীর স্নানপর্বের শেষ দিকে এন্ট্রি নিল আমাদের গল্পের নায়ক। শম্ভু। ফুলমতী তখন ফুলসুন্দরী হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। দূরে দেখা দিল শম্ভু। দুলকি চালে ধুলোভরা বিশাল দেহটা নিয়ে এগিয়ে আসছে চানস্থানের দিকে। এতক্ষণ গজগামিনীদের দেখেছি। এবার গজেন্দ্রগমন দেখলাম। ধুলোমাখা ধূসর দেহখানির সামনে দৃশ্যমান তার দুই গজদন্ত। চলনে পারিপার্শ্ব সম্পর্কে চরম নিরাসক্তি। ‘হাতি চলে বাজার, কুত্তা ভোখে হাজার’ প্রবাদটা কেন তৈরি হয়েছে তার প্রমাণ পেলাম বলে মনে হল।
শম্ভু চানস্থানে এল। এসেই প্রথমে চৌবাচ্চার কাছে গেল। শুঁড় ডুবিয়ে মনযোগ দিয়ে জল খেল। দীর্ঘক্ষণ চান করে বোধহয় ফুলমতীরও গলা শুকিয়েছিল। সে-ও চৌবাচ্চায় শুঁড় ডোবাল। জল খাওয়ার পরেই দেখলাম এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য। শম্ভু তার শুঁড়টা বাড়িয়ে দিল ফুলমতীর দিকে। প্রথমে খানিকটা দ্বিধা। তারপর ফুলমতীও বাড়িয়ে দিল তার শুঁড়খানি। মিশে গেল দুই শুঁড়। আমি যেন এক শুঁড়েলা সঙ্গীত শুনতে পেলাম। যেন ফুলমতী গাইছে, ‘কে প্রথম শুঁড় বাড়িয়েছে? তুমি না আমি?’ ইয়ে হাতির মনের কথা আমি জানব কী করে? সেসব জানেন পার্বতী বড়ুয়া। তাঁর বাবা প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া তথা লালজি-ও জানতেন। গরুমারা বন দফতরের কিংবদন্তী হাতি যাত্রাপ্রসাদকে অসমের জঙ্গল থেকে ধরার পর তিনিই বন দফতরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
আমি নিতান্তই খেলো ছোকরা। আমার মানুষে বুদ্ধিতে হাতির এমন গানই মনে এল। ওরা গান না গেয়ে গদ্যেও কথা বলতে পারে। হয়তো শুঁড়ে শুঁড় ঠেকিয়ে শম্ভু কাছে আসার চেষ্টা করা কলেজ ছোকরাদের মতোই ফুলমতীকে বলেছিল, ‘কাল তুমিও তো এলে…লরিতে করে?’
এরপর আর কথা বলার সুযোগ পায়নি ওরা। মাহুত ফুলমতীকে নিয়ে চলে গেল। শম্ভু স্নানে বসল। আমরাও হাতিশাল, মানে পিলখানা, ছেড়ে চলে এলাম। বাড়ি ফেরার তাড়া আছে।
প্রকৃতির প্রবল রূপ চোখে-মনে মাখতে মাখতে ফিরতে লাগলাম। বলতে ভুলে গিয়েছি। মাচানতলার কাছে জঙ্গলের মাঝে নতুন রেলপথ পাতা হয়েছে। কচি শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরলরেখায় দৌড় লাগিয়েছে রেললাইন। দৃশ্যপট হিসাবে দারুণ। এখনও চালু হয়নি। কিন্তু চালু হলে দলমার দামালদের বিপদ হবে না তো? কিংবা রেসিডেন্ট হাতিদের? জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেখানে যেখানে রেল বা সড়কপথ হয়েছে, সেখানে তো জীবন দিয়ে মূল্য চোকাতে হয় বন্যপ্রাণীদেরই।
ওয়াচ টাওয়ারে ফিরলাম মধ্যাহ্ন পার করে। টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের সারথির পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হল। পরিষ্কার বাংলা বললেও আদতে বিহারের বাসিন্দা। পদবি লোহার। পূর্বপুরুষদের কেউ একজন ভাগ্য ফেরাতে এখানে চলে এসেছিলেন।
আমাদের চান সারা হতে না হতেই হারুবাবুর ফোন। জানিয়ে দিলেন, ঘর ছাড়ার সময় এসেছে। তাতে আমাদের কোনও হেলদোল হল না। গড়িমসি করেই স্নান সারা হল। এইমাত্র হাতির স্নান দেখে এসেছি, হুঁ।…
ওয়াচ টাওয়ারের গেটে তালা দিয়ে চাবিটা তুলে দেওয়া গেল হারুবাবুকে। উনি আবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, ‘ফূর্তিটুর্তি করতে হলে এখানে চলে আসবেন।’ ফূর্তিই তো করলাম! আবার কীসের ফূর্তি? আমরা বোধহয় পাঁকভর্তি মনে ফূর্তি শব্দটার ব্যঞ্জনা বুঝতে ভুল করছি!
টাওয়ার ছাড়ার আগে একটা কথা বলে নিই। প্রতিবার টাওয়ারে ঢোকার আগে এর উদ্বোধনী ফলকটা দেখলে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। টাওয়ারের উদ্বোধন হয়েছিল আগের জমানায়। উদ্বোধন করেছিলেন বন বিভাগের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাসীবালা সহিস। কিন্তু নতুন জমানায় তাঁর নাম বেশ যত্ন সহকারে ঘষেমেজে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের ঘাড়ে চেপে বসা নতুন জমানার প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি! ইচ্ছে করলেই কি সত্য মুছে ফেলা যায়?
এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। আমরা শ্রেষ্ঠায় খেতে গেলাম। তবে খেতে যাওয়ার আগে একবার বনলতার রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মেরে গিয়েছি। গতকাল রাতেই জেনে গিয়েছিলাম, এখানে এমু, টার্কি, কোয়েল, হাঁস, মুরগি সব কিছুর মাংস বিক্রি হয়। অনেক আলোচনা করে এমু খাব বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল দলের। কারণ ইচ্ছে করলেই কলকাতা থেকে টার্কির মাংস আনা যাবে। কিন্তু এমু সহজলভ্য নয়। এক প্লেট এমু আর এক প্লেট কোয়েল নিলাম। দু’শো, দু’শো চারশো টাকা। কেমন খেতে? এমুটা ভাল লাগেনি। বেশ শক্ত। আমার খাসির মাংসের মতো মনে হয়েছিল। পাখি যদি প্রাণী হয়ে যায়, ভাল লাগে? তবে কোয়েলটা বেশ। মিষ্টি মিষ্টি, নরম। কিন্তু ২০০ টাকায় বড়ই কম। এক প্লেটে ছ’পিস দেয়। সে পিস তরকারিতে দেওয়া পনিরের থেকে খানিকটা বড়। সেটাই ভাগাভাগি করে খেলাম।
খেতে খেতে গল্প চলছিল। জঙ্গলেরই গল্প। উল্টোদিকের টেবিলে বসা ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হরিণের দেখা পেলেন?’ সমবেত সঙ্গতে ঘাড় নেড়ে না বললাম। উনি প্রস্তাব দিলেন, পাঁচটার সময়ে ওঁর সঙ্গে যেতে। তাহলে জলযোগের ডোবায় হরিণ-শুয়োরের জল খাওয়া দেখিয়ে আনবেন। কিন্তু কেউই আর দুপুর রোদে বেরোতে চাইল না। এ জঙ্গলে প্রচুর দেখেছি, প্রচুর পেয়েছি। কিছু অপ্রাপ্তি থাক। কে যেন বলেছেন তো, ‘সব পেলে নষ্ট জীবন’।
ফেরার সময়ে বাসটা ভোগাল। এলই না। ৩টে নাগাদ একটা সরকারি বাস ছিল। সোজা কলকাতা। সাড়ে ৩টে বাজার পরেও যখন সে মুখ দেখাল না চিন্তা বাড়ল। বাসস্ট্যান্ডে এলাকার থানা থেকে একটা জলসত্র খোলা হয়েছে। এক মহিলা সিভিক ভলান্টিয়ার পথচারীদের জল দিচ্ছিলেন। তিনি সাহায্য করলেন। ফোনাফোনি করে জানালেন, বাসটি আজ জয়পুরের দিকে যায়নি। ততক্ষণে কোল্ড ড্রিঙ্ক ফুরিয়েছে। দলের অর্ধেক সিপাই ঝিমোচ্ছে। জুয়েল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ইন্দ্র ছবি তোলার চেষ্টা করায় ওর ঘুম ভেঙে গেল। উঠে এসে বাসস্ট্যান্ডের সামনের দিকে বসল। দীপু, অরিজিৎ ঝিমোচ্ছিল।
কচি তো আর থাকতে না পেরে জুয়েলের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। সে আশ্চর্য এবং আধুনিক সাবিত্রী-সত্যবান দৃশ্য। জুয়েল ফোনে কথা বলছে। ওর কোলে ঘুমোচ্ছে কচি। পথচারীরা ওদের দিকে ভক্তিভরে পয়সা ছুড়ে দেয়নি এই সৌভাগ্য।
তারপর? তারপর বাস এল। আমরা বসার জায়গা পাওয়া মাত্রই সেই ডট ডট ডট। মানে ‘দে ঘুমাকে’।
ইয়ে মানে লে ঘুমাকে!
সমাপ্ত