জুয়েল সরকার
ঘটাং!!!
এক তীব্র যান্ত্রিক শব্দে চোখে লেগে থাকা আলগা ঘুমটা টুপ করে ঝরে গেল। আমার উল্টোদিকের বিছানায় সুকেশ ‘হাঁ’ করে ঘুমোচ্ছে। মোবাইল-ঘড়ি বলছে- সকাল ৮.৩০। বাড়িতে থাকলে এই সময় ঘুম জড়ানো চোখে কোলবালিশ হাতড়াতাম। তারপর কাছে টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুতাম।
পাশের বিছানাগুলোয় চোখ পড়তেই অবাক! শুভ, সায়ন, আসিম, নিয়াজ…এমনকী মুকুলও মিসিং! ‘সোনার কেল্লা’র পরে হয়তো এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ‘মুকুল মিসিং”! ব্যাপার কী!! ঘুমের রেশে ভেবে উঠতে পারছিলাম না। খানিক পরে ‘মিসিং-পার্সন’রা একে একে উপস্থিত হল। ‘কোথায় গেছিলি’- সায়ন বড় মুখ করে উত্তর দিল-‘ চা খেতে।’ ওর বড় মুখ চিরে কুমিরের মতো করে দিতে ইচ্ছে করছিল। আমায় ফেলে বাবুরা গেছে চা খেতে!
আপশোস হচ্ছে…খু-উ-ব আপসোস হচ্ছে। নদীর পাড়ে বসে ধোঁয়া ওঠা চা খাওয়ার সুযোগ মিস করেছি তো!
গতকাল প্রায় সারারাত মাঝ নদীতে কাটাবার পর, আজ ভোরবেলায় লঞ্চ ছেড়েছিল। খানিকক্ষণ আগে এখানে থেমেছে। স্থান সাতজেলিয়া। লঞ্চ ছাড়বার আগে সবাই নদীর জলেই মুখ ধুয়ে নিলাম। জলের স্বাদ তিতকুটে নোনতা। ততক্ষণে ঘুম চোখের সেই ঘটাং শব্দটা আবিষ্কার করেছি। আমাদের লঞ্চের সঙ্গে পাশের লঞ্চের ধাক্কা লেগেছিল। ঢেউয়ের দোলায়।
বিছানা গোছাতে গোছাতে দেখলাম পাড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। লঞ্চের গতি যখন কিছুটা বাড়ল, সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠে এলাম সবাই। এক আকাশ সকালের আলোয় এবার ভাল করে দেখলাম চারপাশটা। এখানে অনেকটা খোলা জায়গা, স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়ানো যায় রেলিং ধরে। একপাশে কিছু চেয়ার জড়ো করা রয়েছে বসার জন্য। যে যার নিজের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল। কেউই তেমন কথা বলছে না। বুঝলাম, ইতিমধ্যে মনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে সকালটা।
পাড় থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। এখানে নদী আরও চওড়া। আরও স্রোতস্বিনী। নদী পাড়ের বাড়ি-ঘরগুলো কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত দেখাচ্ছিল ঝুলনের খেলনার মতো। এখন সেগুলো মিলিয়ে গেছে সবুজে। এই রঙ চোখকে বড় আরাম দেয়। একটানা চলতে থাকা হাওয়া, বিলি কেটে দিচ্ছে মাথার চুলে। রোদের আলোর কুচিগুলো শরীর পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মনের সেইসব অন্ধকার ঘরগুলিতে, যেখানে দীর্ঘশ্বাস খেলা করে।
নাহ। এবার চা ছাড়া অসহায় লাগছে। চায়ের আবেদন করতেই যাব, দেখি লঞ্চের গতি কমে এল। উঁচু করে বাঁধানো পাড়ের দিকে চোখ পড়তেই, লক্ষ্য করলাম সাইন-বোর্ডটা। তাতে বড় হরফে লেখা- ‘WORLD’S ONLY MANGROVE TIGER LAND’। আপনা থেকেই শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। কিছু আছে এই লেখায়, যা সবাইকে স্থবির করে দেয়। শুভ চটপট গোটা তিনেক ছবিও তুলে ফেলল ওটার। ও সাবজেক্ট মিস করে না, সাধারণত।
জায়গাটি সজনেখালি পাখিরালয়। শুনলাম, এখানে গাইড ভাড়া নিতে হয়। এই কমপালসারি গাইডের দাম ৪০০ রুপিয়া। এঁকে ছাড়া পরবর্তী জায়গাগুলিতে যাওয়ার অনুমতি নেই। শুভ আর সায়ন ঢুকেছে অফিসে, অসীমও গেছে। নিয়াজ আর সুকেশের সঙ্গে সামনের লনের বাগান ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। কিছু বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, ছত্রাক আর পাখির ছবিওয়ালা সাইনবোর্ড ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। সব একে একে পড়ে যখন শেষ করলাম, ততক্ষনে গাইড এসে উপস্থিত।
আমাদের ভ্রমণ কাহিনিতে গাইড মহাশয় এক নতুন চরিত্র। সত্যজিৎ রায় বলেছেন- ‘রচনায় যখন নতুন কোনও চরিত্রের আবির্ভাব হয়, তখন প্রথমেই তার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে রাখা উচিত। তা না হলে, পাঠক নিজে থেকেই তার সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেন। পরে লেখকের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে পাঠকের কল্পনা মেলে না’। গাইড মহাশয়ের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, পরনে নাইলনের ফুল হাতা জামা, ট্রাউজার। পিঠে বাচ্চাদের স্কুলব্যাগ (ব্যাগটি চেহারার সঙ্গে যথেষ্ট বেমানান)। খুব চটপটে কথার বলন। চলাফেরায় একটা তাড়াহুড়ো আছে।
গাইড প্রথমেই আমাদের নিয়ে উঠলেন ওয়াচ টাওয়ারে। প্রায় চারতলা সমান উঁচু এই ওয়াচ টাওয়ারের মাথা থেকে সমস্ত জঙ্গলটা অনেকটাই চোখের নাগালে চলে আসে। টাওয়ারে কয়েক মিটার দূর থেকেই জঙ্গলের শুরু। সীমানাগুলি উঁচু লোহার-নেট দিয়ে ঘেরা। টাওয়ারের থেকে কিছুদূরে জঙ্গলের ঘনত্ব বেড়েছে। তার মাঝেই রয়েছে এক বিশাল জলাশয়। গাইডের কথায় লক্ষ্য করলাম, জলার পাশেই একটি প্রায় নেড়া গাছের ডালে বসে ঝিমোচ্ছে একটি বড় মদনটাক। উচ্চতায় পাখিটি প্রায় আমার কোমর সমান হবে। তাই এতো দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। টাওয়ার থেকে নামতে নামতে শুনলাম, ওই বড় জলায় অনেক জন্তু-জানোয়ার তৃষ্ণা মেটাতে আসে। আমি অবাক হলাম না। কারণ টাওয়ারে থাকাকালীনই জলার কাছ থেকে একটি গোসাপকে সুড়ুৎ করে জঙ্গলে ঢুকে যেতে দেখেছি।
সজনেখালি পাখিরালয়টি বেশ বড়। পার্কের মত করে সাজান চারপাশ। রয়েছে একটি বড় পুকুর। এবার গাইডের বলার আগেই দেখতে পেলাম পুকুরের জলে ভেসে থাকা কুমিরগুলো। মাথার সামনের ভাগই শুধু জলের ওপরে উঠে আছে। চোখের দৃষ্টি নিষ্পলক। প্রথম দর্শনে, ভেসে থাকা কাঠের টুকরো বলে ভুল হতে পারে। পুকুরের পাশেই এক্সিবিশান গ্যালারি। বিভিন্ন প্রাণীর ছবির পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ছোট ইতিকথা, সবই ম্যাপের আকারে ঘরে সাজান। গ্যালারির বাইরে কাঁকড় বেছানো পথ চলে গেছে সরকারি বাসভবনের দিকে। পাশে ব্যক্তবীজী উদ্ভিদের সারি।
অফিসের এলাকার মধ্যেই রয়েছে বনবিবির মন্দির। মন্দিরে তালা ঝুলছে। তবুও বাইরে থেকে দেখা যায় তার বহু পুরনো বিগ্রহ। এ অঞ্চলের একমাত্র আরাধ্য দেবী। মূলত মউলি আর মৎস্যজীবীদের উপাস্য। কথিত আছে, ইনি বাঘের হাত থেকে মধু সংগ্রাহক আর মৎস্যজীবীদের রক্ষা করেন। তবে এই লৌকিক দেবীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ইনি হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই পুজো পান। বাদুড়িয়া আর গোরক্ষার বাড়াবাড়ি পর্বে বনবিবির মাহাত্ম্য প্রচার করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।
এখানকার গুরুত্বপূর্ণ সব গাছগুলিতেই লাগান আছে তাদের বিজ্ঞানসম্মত নামের ফলক। সুন্দরী গাছ সম্পর্কে এতদিন বইয়ে পড়েছি। এই প্রথম সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করলাম। শ্বাসমূলগুলো পাথরের মতো শক্ত। আন্দাজ করা যায়, যেখানে এ গাছের ঘন জঙ্গল আছে, সেখানে পায়ে হেঁটে চলা প্রায় অসম্ভব। হোঁচট খেয়ে আঘাত পাওয়ার ভয় থাকে।
বেলা বেড়েছে। আমাদের গাইডকে নিয়ে লঞ্চে উঠলাম। ঘড়িতে বেলা ১০.৩০। চা আর ডিম সেদ্ধ এল সবার জন্য। দোবাকি ওয়াচ টাওয়ার এখনও অনেক দূরে। নদীর বুকে সাদা ফেনা তুলে সেদিকে এগিয়ে চলেছে আমাদের লঞ্চ-‘মা বিনতা’। নদীর কাদামাখা পাড়ে, পরস্পরের গা ঘেঁষে সুন্দরী গাছের ভিড়। শ্বাসমূলের ডগাগুলো বেশ তীক্ষ্ণ। কোথাও সরু ঠেসমূলে ভর করে মাকড়শার মত দাঁড়িয়ে লবণাম্বুরা। দু’পাড়ে যত দূর চোখ যায়, সবদিকে জমাট বাঁধা সবুজ। ‘লাবণী’ বিছিয়ে রেখেছে তার নাগপাশ।
আমাদের সবার জন্য ভাত আর মুরগির ঝোল রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে অসীম। রান্নাঘরে একবার ঢুঁ মেরে এলাম। বেশ গরম, তাতে বসেই চুপচাপ রান্নার কাজ সারছে আর মাঝে মাঝে খুপরি জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছে। যেন জানলাটা ওর চৌকো পৃথিবী।
ভাবমূর্তি! এ এক বিচিত্র জিনিস। আমাদের অজান্তেই কাছের মানুষগুলির কাছে আমাদের ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে যায়। আর সেই পরিচিত ভাবমূর্তি ভেঙে বেড়িয়ে আসতে চাইলেই সব সম্পর্কগুলি কেমন যেন পালটে যেতে থাকে। তাই, বাইরের বিরোধ যার যত কম, ভাবমূর্তি রক্ষার দায় তার তত বেশি।
ভাবমূর্তি রক্ষার্থে নয়, অসীম নিজে থেকেই রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে তা বুঝি। আরেক হল নিয়াজ। এই প্রাণীটি ভয়ঙ্কর অলস, এককালে ভাল ক্রিকেট খেলত। তবে আমরাই আজ ওর চারপাশে ফিল্ডিং দিচ্ছিলাম। ও যেভাবে ঝিমোচ্ছে, তাতে জলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কোনও কাজ বললে মুখের ভাবখানা এমন করছে যেন, এক টিপ নস্যি নাকে দিতে গিয়ে, ভুল করে মুখে ঢুকিয়ে ফেলেছে।
দু’পাশের বনের গভীরতা যত বাড়ছে, নদীর প্রস্থ ততই কমে আসছে। নদীর দু’পাশে ছোটো ছোটো খাঁড়ি দেখা দিতে শুরু করেছে। জোয়ারের সময় এই ছোট খাঁড়িগুলিতে নৌকো বা লঞ্চ ঢুকে আশ্রয় নেয়। ফলে বিপদের আশঙ্কা অনেক কমে। এপ্রিল মাসে এখানে পর্যটকদের ভিড় তেমন থাকে না। তবে কিছুদূর এগোতেই দেখা পেলাম একটি লঞ্চের। আমাদের পথেই চলেছে এটি। গাইড বললেন, এটি সরকারি লঞ্চ। দক্ষিণা প্রায় হাজার তিরিশেক। টাকার কথাতেই সবার চোখ পড়ল ওটায়। সত্যিই আধুনিক। বাতানুকূল লঞ্চে রয়েছে বেতার যোগাযোগ। ভেতরের ঘরগুলিতে এলাহি আয়োজন। ওপরের ডেকে গুছিয়ে টেবিল পাতা, আছে জলের ফিল্টার। ডেকের এক কোণে এক বিদেশিনী তার মেয়ের সঙ্গে খেলছেন। তাদের মাথায় সোনালি চুল। ইনিই লঞ্চের পর্যটক, তা বলা বাহুল্য। অতিথি আপ্যায়ন করতে কতটা প্রস্তুত এ রাজ্য, তার প্রমাণ পেলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই পাশ কাটিয়ে এলাম তাদের।
আমাদের গাইড লোকটি বেশ শান্ত। ডেকের ওপর বসে আছেন বটে। তবে তার চোখের তারাগুলি লাইট হাউসের আলোর মতও জঙ্গলের দিকে পাক খাচ্ছে। হঠাৎ বলে উঠলেন-‘ওই দেখো’! তাঁর আঙুল লক্ষ্য করে জঙ্গলের দিকে ফিরতেই, লক্ষ্য করলাম আমাদের থেকে প্রায় দু’শো মিটার দূরে হেঁটে বেড়াচ্ছে একটি জংলি শুয়োর। মনে মনে বাহবা জানালাম, নজর আছে বলতে হবে! ঝোপের আড়ালের এই চলমান প্রাণীটিকে শনাক্ত করা বেশ কঠিন ছিল।…
দোবাকি পৌঁছলাম সাড়ে বারোটা নাগাদ। এখানের ওয়াচ-টাওয়ার থেকে জঙ্গল দেখলাম বটে, কিন্তু কোনও বিশেষ প্রাণীর দেখা পেলাম না। নামার সময় দেখলাম, একদল বাঁদর পাশের গাছে ভয়ঙ্কর উৎপাত শুরু করেছে। এরাই আমাদের সান্ত্বনা।
সুধন্যখালি যেতে এখনও অনেকটা রাস্তা। পথে পাঁচনদী মুখ, সেখানে নদীর জলে স্নান সারলো সবাই।
রোদ বেশ তীব্র হয়েছে এখন। তবুও দূরে ভেসে চলা নৌকোটা দেখতে অসুবিধে হল না। এই নির্জন এলাকায় নদী পাড়ের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে অবাক হতে হল। নৌকোয় প্রায় একটি ছোট সংসার নিয়ে চলেছেন চালক। জীর্ণ জামাকাপড়ের স্তূপ। কিছু বাসনপত্র, রান্নার ছোটো স্টোভ। একটি মশারি, বিরাট আকৃতির দু’টো হাঁড়ি আরও কত কী যে রয়েছে তাতে! ওপরে ছাউনির কাঠামো আছে তবে তা উন্মুক্ত। পাছে বৃষ্টি আসে, তার জন্য পাশে একটি ত্রিপল ডাঁই করে রাখা। চালক অক্লেশে কিন্তু প্রবল প্রাণশক্তিতে টেনে নিয়ে চলেছেন নৌকো। গাইডের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি জবাব দিলেন-‘এরা মউলি। এখানে মধু, মোমের জন্য আসে’। জঙ্গলে অনেক সময় এঁদের কয়েকদিন কাটাতে হয়।
জীবিকা অর্জনেই এই মউলিদের কত ঝুঁকি নিতে হয়। প্রতি বছর বাঘের পেটে যান কতজন। বনবিবির হাতও রক্ষা করতে পারে না তাঁদের। তার ওপর আছে ডাকাত। গতকালই একদল ডাকাত কোনও এক হতদরিদ্রের ওপর লুঠ চালিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রাণপণ করে সংগ্রহ করা মধু-মোম। কী করুণ এই ‘মাৎসান্যায়’। পরশ্রম লোভী বাটপারদের জ্বালায় জঙ্গলেও স্বস্তি নেই। তবে শারীরিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষ যে মানসিক ভাবে দুর্বল না-ও হতে পারেন। তার চরম উদাহরণ আমার সামনে। তবে শুনলাম, সাধারণত দল বেঁধেই এরা বনে যান। কিছু দূর এগিয়েই দেখলাম, কাদার মধ্যে কিছু সদ্য তৈরি হওয়া পায়ের ছাপ। হয়তো ওঁরই সাথী এঁরা! মন দ্রবীভূত হল যেন কিছুটা।
একাকীত্ব, প্রিয় মানুষের দেওয়া আঘাত- আমাদের সৃজনশীল বানায়, কাজে ডুবিয়ে দেয় মন। তাই যদি সত্যি হয় তবে, যিনি পরম ধৈর্য নিয়ে এই নোনাজলের জলছবি এঁকেছেন তার মনের খবর কার কাছে পাওয়া যাবে?…
ডেকে বসে থাকা যাচ্ছিল না। ঘন ঘন নাকে গন্ধ আসছে মাংসের। রান্না নিশ্চই শেষের মুখে! খুচরো কয়েক টুকরো হাতানোর চেষ্টা করছি, এমন সময় ফিসফিসানি শুনতে পেলাম। গাইডের হাতের এক ইশারায় পুরো লঞ্চে পিন ড্রপ সাইলেন্স। ব্যাপারটা চালক মনোরঞ্জনদাও লক্ষ্য করেছেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে কমিয়েছেন গতি। নদীর একেবারে পাড়ে, আমাদের থেকে হাত দশেক দূরে একটি চিতল হরিণ। আমাদের অস্তিত্ব স্বীকারই করতে চায় না। এত শান্ত প্রাণী আগে দেখিনি। রবি ঠাকুর যথার্থ বলেছেন- ‘পৃথিবীর পরম আশ্চর্য ব্যাপারগুলিই পরম নম্র। সহজে চোখে পড়তে চায় না’। যেমন ভাবে এসেছিল, ঠিক তেমনই নির্লিপ্ত ভাবে বিদায় নিল চিতলটি।…
সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছেছি। এখান থেকে দূরে জঙ্গলে আরও কিছু হরিণের দেখা পেলাম। দূরের জলার কাছে, কাদার ওপরে অনেক রকমের পায়ের ছাপ বলে দেয় এখানের জীববৈচিত্র। যদিও মন সারাক্ষণ বলে চলেছে-‘ বাঘ, বাঘ…বাঘ কই’? গাইড হয়তো আমার মনের কথা পড়ে ফেললেন। শুধু ইশারায় বোঝালেন, বাঘ দেখার জন্য চাই কপাল!…
ডেকের ওপর টেবিল পাতা হয়েছে। চারপাশে চেয়ার নিয়ে গোল করে আমরা… শরীরে ক্লান্তি, পেটে খিদে আর সামনে ফাঁকা থালা নিয়ে বসেছি। অসীম ভাতের ডেকচি টেবিলে রাখতেই, সব ভাগাভাগি হয়ে গেল। মোটা চালের লালরঙা ভাত। অতুলনীয় স্বাদ। দেখেই পেটের খিদেটা ডিগবাজি খেলো। মাংস টেবিলে এসে পৌঁছতেই, ম্যারাথন শুরু! বেড়ে রেঁধেছে অসীম, যুগ যুগ জিও।
‘খেতে পেলে, শুতে চায়’- কথার সার্থকতা খুঁজে পেলাম একটু পরে। যখন দেখলাম পেট জয়ঢাক করে সবাই নিদ্রায় মগ্ন। ডেকে আমায় সঙ্গ দিতে রয়ে গেল রিটায়ার্ড ক্রিকেটার। ফিরতে অনেক সময় লাগবে, কিছু চোখে পড়লেও পড়তে পারে। একেবারে খুঁটি পুঁতে বসে রইলাম। তবে চোখ ভার হতেই নিয়াজ পালাল। বাড়ির রাস্তায় নেমে গেলেন গাইডও। ‘মিত্র’হীন ডেকে ‘মদন’ হয়ে বসে রইলাম। একা।
হারিয়ে যাওয়া ঘরবাড়িগুলি একে একে ফিরে আসছে দূরের সীমারেখায়। দূরে কাদা মাখা পাড়ে বাঁশের ঠেকনা দিয়ে ওল্টানো রয়েছে একটা বিরাট নৌকো। জোয়ার এলে ওকে ভাসানো হবে হয়তো। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক টিয়া। আমাদের মতোই ঘরে ফিরছে।
শহরে এমন হওয়া, কল্পনার অতীত। সন্ধ্যের প্রকৃতি যেন আগল খুলে দিয়েছে নিস্তব্ধতার, শীতলতার- এ যেন সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা। হয়তো এরাই মনকে দুর্বল করছে! কী জানি? হয়তো দুর্বল হতেই আসি আমরা! এই দুর্বলতাই কি গোপনে শক্তি জোগায়? ঘর ছেড়ে, আনমনে পালাতে প্ররোচনা দেয় কি এরাই? মনে দলা পাকানো প্রশ্নগুলোকে আলটপকা ফেলে দিলাম ওই ঘোলা জলে। এখন যার কাছে পৌঁছব তিনি ভালবাসবেন আমাদের। ধুলো হাতে কাছে টানবেন…জলের অক্ষরে কথা বলবেন। তিনি তো নারী, সব রূপেই সুন্দর।
লোকে তাকে বলে কলকাতা…আমরা বলি তিলোত্তমা।
যাব? যাব কি তার কাছে? ঘোলাটে মন রিনরিনিয়ে উত্তর দিল –
মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা
পাগল তোরা, যথা ইচ্ছা তথা যা!
ছবি— শুভ বৈদ্য
(সমাপ্ত)