সোহিনী দেবরায়
হোটেলে ঢোকার পর ব্যাগপত্র রেখে সামনের এক পাহাড়ে গেছিলাম। সেখানে উঠে ফটো তুলছিলাম। হঠাৎ এক চমরিগাই আমাকে তাড়া করল। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পাটা ভালোমতন মচকে গেল। প্রচণ্ড পায়ে ব্যথা ছিল। সুকমলস্যার এসে পায়ের অবস্থা দেখে গেলেন। ব্যথার ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আমাদের ঘরে প্রায় প্রত্যেকেরই শরীরের অবস্থা ভালো নয়। কারোরই ঘুম হল না। কালাপোখরিতে এক লম্বা ঘুমহীন রাত্রি কাটল।
কালাপোখরি থেকে সান্দাকফু মাত্র ৬কিমি। কিন্তু এই ৬ কিমিই হল অত্যন্ত খাড়া, হাঁটা তুলনামূলকভাবে কষ্টকর। কালাপোখরি থেকে হাঁটা শুরু করার পর প্রথম দশ মিনিটের ব্রেক নেওয়া হল ভিকেভঞ্জমে। তারপর আবার হাঁটা। ব্যথার ওষুধ খাওয়ার ফলে হাঁটতে একটুও কষ্ট হয়নি। আমি আর কবিতাদি মনের আনন্দে আগে আগে হেঁটেছি, ফটো তুলেছি, ফটো তুলিয়েছি।
চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে পরপর তিনদিন প্রায় ৩৩ কিলোমিটার হাঁটার পর ১৭ মে বেলা ১টা নাগাদ পৌঁছলাম সান্দাকফুতে। এটি পশ্চিমবঙ্গ-নেপাল বর্ডারে সিঙ্গালিলা রেঞ্জে বিরাজ করছে। এটি একাধারে নেপালের ইলাম জেলা ও পশ্চিমবাংলার সর্বোচ্চ অংশ (৩৬৩৬ মিটার)। প্রচণ্ড ঠান্ডা নয় কিন্তু। এই মে মাসে এখানে মাত্র ৪ ডিগ্রি। তবে ঠান্ডার চেয়েও বেশি এখানে সারাদিন তীব্র ঠান্ডা হাওয়া চলে…যা সহ্য করা প্রথম ধাক্কায় বেশ চাপের।
পাহাড়ি বৃষ্টি রোডোডেন্ড্রনের পাতায় পড়লে এক নতুন মাত্রা আনে। সৃষ্টি করে এক নতুন তালের। গোটা একটা দুপুরবেলা জানলায় দাঁড়িয়ে সেই তালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুনগুন করে গান করে কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ দেখলাম পশ্চিম আকাশে সোনালি আলোর আভা। কবিতাদির বোন ছোট্ট শ্রেয়সীকে নিয়ে ছুটলাম সান্দাকফুর সর্বোচ্চ অংশে। কাচের ঘরে ওকে রেখে আমি বেরিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলাম বৃষ্টিভেজা সোনালি আকাশের দিকে।
সূর্যের বিদায়বেলায় মেঘেরা একে একে সরে গিয়ে তাঁর যাত্রাপথ সুগম করে দিয়েছে। আর তারই মাঝে আলোছায়ায় রহস্যময়ী ভাবে আগত হয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার এক টুকরো শিখর। কয়েক সেকেন্ডের চোখের সুখ… সেই মায়াবী দৃশ্য চোখের রেটিনায় আবদ্ধ হয়ে রইল বটে, ক্যামেরাবন্দি করার সুযোগ পেলাম না। তিনি যে মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলায় বড়ই পটু!!
সান্দাকফুতে সরকারি কটেজে ছিলাম। প্রচণ্ড ঠান্ডা। তাই সন্ধ্যে ৭টার মধ্যে ডিনার করে যে যার ঘরে ঢুকে বসে গল্প করতে লাগলাম। রাত্রে ঘুম আসেনি। সান্দাকফুতে দ্বিতীয় ঘুমহীন রাত্রি কাটালাম। পরদিন সকালে সান্দাকফুকে বিদায় জানিয়ে আমাদের দলটি চলতে আরম্ভ করল।
আর ওঠা নয়, এবার নামার পালা। ধীরে ধীরে এবার এগিয়ে যাব সমতলের দিকে, সান্দাকফু থেকে রিম্বিকের দিকে। ব্রেকফাস্ট করে, প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে হাঁটা শুরু হল।
পাহাড় থেকে নামার সময় খুব সতর্কভাবে নামতে হয়। কারণ সমস্ত দুর্ঘটনা নামার সময়েই ঘটে। তাই খুব সতর্কভাবে হাঁটছিলাম। সাগ্নিক হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল- ‘সোহিনীদিইইইইইই….সাপপপপ.. যেও না’…কথাটা বলেই ও দাঁড়িয়ে গেল। আমিও একটু ভয় পেয়ে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমার এক মিটারের মধ্যে সবুজ রঙের এক ফণাধারী সাপ। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। অসীমস্যার আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘আরে দাঁড়িয়ে কেন? হাঁট রে।’ আমরা দুজনেই বলে উঠলাম ‘স্যার সাপপপ।’ স্যার হেসে বললেন, ‘আরে সাপ নয়, সামনে এসে দেখ। তোরা দূর থেকে দেখছিস বলে মনে হচ্ছে। আসলে ওটা স্নেকলিলি।’
তারপর আরও বিভিন্ন জায়গায় দূর থেকে যা সাপ বলে মনে হয়েছে সামনে এসে দেখেছি তা স্নেকলিলি। স্নেকলিলি কচি অবস্থায় সবুজ থাকে। পরিণত হলে মুখটা লাল হয়ে যায়। পাহাড়ের এক অদ্ভুত সৃষ্টি তারা।
তারপর আবার চলা। বছর ষাটেকের অসীমস্যার, আমি, বছর দশেকের সাগ্নিক, বারো বছরের সত্যজিৎ আর পনেরো বছরের জন্টি সবার আগে আগে চলতে লাগলাম। বয়সটা উল্লেখ করার কারণ আমি যখনই একটু দাঁড়াতে চেয়েছি বা বিশ্রাম নিতে চেয়েছি স্যার বলে গেছেন, ‘তোর থেকে বড় আর ছোটমানুষগুলো হেঁটে যাচ্ছে আর তুই পারছিস না?’
স্বাভাবিকভাবেই প্রেসটিজ ইস্যু। তাই হেঁটে গেছি। খুব ক্লান্ত ছিলাম। তবু হেঁটেছি। গুরদং এ একবার কুড়ি মিনিটের ব্রেকে লাঞ্চ করা ছাড়া আর থামিনি। সান্দাকফু থেকে শ্রীখোলা অবধি ১৬ কিমিই শুধু নয়। পরের সাত কিমিও হেঁটেছি। গাড়ির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও হেঁটেছি। স্যারেরা, গ্রুপের প্রায় সবাই বলা সত্ত্বেও গাড়িতে উঠিনি। জল-ঘনজঙ্গল-চড়াই-উৎরাই এর মধ্যে একমনে হেঁটে গেছি আর ফটো তুলেছি।
হ্যাঁ। অসীমস্যার, জন্টি আর সত্যজিতের পাল্লায় পড়ে একদিনে ২৩ কিমি হেঁটেছি। আমরা চারজন ছাড়া আর গ্রুপের কেউ হাঁটেনি। তাই অসীমস্যার আমাদের তিনজনকে ট্রিটও দিয়েছেন।
১৮ মে ২৩ কিমি হেঁটে রিম্বিক পৌঁছানোর পরই এক মোহনবাগানি ভাইয়ের পাঠানো মেসেজটা ফোনে ঢুকল ‘দিদিইইইইই এবার আমরা কলকাতা ডার্বি জিতে গেছি। জয় মোহনবাগান।’ মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলাম। বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, জয় জয় মোহনবাগান। কল করার চেষ্টা করলাম। দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে ফোনটা গেল না। কিন্তু মনটা অদ্ভুত এক খুশিতে ভরে গেল। সব মিলিয়ে ৫৫ কিমি হেঁটে পায়ের ফোস্কা, ক্লান্তি সব কিছুই যেন এই আনন্দে জারিত হয়ে যাচ্ছিল।
রাত্রে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান হল। ছোটো বাচ্চারা নাচগান করল। রাজশ্রী মল্লিকের সেদিন জন্মদিন ছিল। মিষ্টি মেয়েটা সেদিন ১৪তে পা দিল। Ofmt Rfi থেকে ওর জন্মদিন সেলিব্রেশন হল। তনুশ্রীদি (রাজশ্রীবোনুর মা) আমাদের সবাইকে চকলেট খাওয়াল। রান্নায় সাহায্য করত একটি দাদারও সেদিন জন্মদিন ছিল। দু’জনকেই অনেক শুভেচ্ছা জানালাম আমরা।
রাত্রের মেনুতে ছিল ভাত, ডাল, আলুভাজা, তরকারি, চিকেন কষা। খাওয়ার পর গভীর রাত অবধি চলল আমাদের গল্প। সে গল্প আর শেষই হয় না যেন! হবেই বা কেন? সেদিনই ছিল যে পাহাড়ে আমাদের শেষ রাত।
১৯ মে সকালে আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। দশটার মধ্যে লাঞ্চ করে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা শুরু হল। বাস এল প্রায় ১টায়। এদিকে নিউজলপাইগুড়ি থেকে রাত আটটায় ট্রেন। সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লাগার কথা। পৌঁছব কীভাবে?
ড্রাইভারদাদা সময়ের খামতি মেটানোর চেষ্টা করছিলেন। প্রথম থেকেই বাস চালালেন দ্রুতগতিতে। পাহাড়ি বাঁকের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে পিছনে একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছিল সান্দাকফুর পরশ। সান্দাকফুয়ে ফেলে আসা আমার ছ’টা দিন। উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমরা সমতলে ফিরে আসছি!
সূর্য যে কখন পাহাড়ের বুকে মুখ লুকিয়েছিল। দিনের আলো যে কখন ফুরিয়ে এসে কালো এলোচুল বিছিয়ে সমস্ত পাহাড়ি ছোট্ট শহরটাকে ঘিরে ধরেছিল জানা নেই। কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল দেখলাম পথ ফুরিয়ে এসেছে। সাতদিনের এক দীর্ঘ সফর শেষ হয়ে গেছে।
পুনশ্চ: ইয়েস, আমরা ট্রেনে উঠতে পেরেছিলাম। ট্রেন আমাদের ছেড়ে আমাদের শহরে ফিরে আসতে পারেনি। বিপ্লবস্যার চেন টেনে আমাদের জন্য ট্রেন দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
ছবি— লেখিকা
সমাপ্ত