রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
এমন একটা পেশায় আছি, যেখানে প্রতিদিন নতুনত্ব দরকার। প্রতিদিন অন্যরকম ভাবনা দরকার। প্রতিটা লেখা শুরু করার আগে ভাবতে হয়, এমনভাবে শুরু করতে হবে, যেটা আগে কখনও করিনি। একটু একঘেয়ে হয়ে গেলেই শুনতে হয়, রাজর্ষি লেখাগুলো একটু একরকম হয়ে যাচ্ছে। ভাব বেশি করে। রোজ বাড়ি থেকে অফিস, অ্যাসাইনমেন্ট, কংক্রিটের শহর, মানুষের ছুটে চলা। নতুন ভাবনার জন্য এই একঘেয়েমি রোজকার জীবন থেকে বেরোনোটা সবার আগে দরকার। ঘোরার নেশাটা পেয়েছি বাবার দৌলতে। যত বড় হচ্ছি তত বাড়ছে। মাস দেড়েক পরপরই মনে হয়, কতদিন কোথাও যাই না।
দার্জিলিং থেকে এসেছি এপ্রিলে। জুনের প্রথম থেকেই আবার বিরক্ত লাগা শুরু। ধুর কিছুই ভালো লাগছে না। অসহ্য লাগছে সবকিছু। প্রথমে একটা বকখালি প্ল্যান হয়েও কেঁচে গেলো। তারপর ঘাটশিলা ভাবা হলো, তাও হলো না। ঘাটশিলার সঙ্গে আলোচনার সময়ই উঠে এসেছিলো নেতারহাটের নাম। এমন ডেসপারেট হয়ে গেছিলাম, ঠিক করেছিলাম একাই যাবো। কিন্তু একা যাওয়ার জন্য দম দরকার। যেটা আমার নেই। অতঃপর লোক খোঁজা।
হঠাৎ মনে হল রজতদার কথা। রজতদার সঙ্গে আলাপ ফেসবুকেই। সিপিআইএম-বিজেপি ঝামেলা দিয়ে। তারপর অবশ্য লেখার সূত্রে রজতদার প্রশংসা পেয়েছি বেশ কয়েকবার। রজতদার বাইক ট্রিপের ছবি মাঝেমাঝেই ভেসে উঠেছি ফেসবুকের হোম পেজে। রজতদাকে ইনবক্স করলাম ‘বাইক ছাড়া ট্রিপ করবে?’ উত্তর এল‘বাইক ছাড়া?’তারপর নেতারহাটের কথা বলায় গুগুল দেখে ছবি দেখে পুরো ফিদা। সেইদিনই ফুল প্ল্যান রেডি। বন্ধুর বিয়েতে ৫ তারিখ সকালে দুর্গাপুর আসবে রজতদা। আমি ৫ তারিখ অফিস করে চলে যাবো দুর্গাপুর। কেটে নেওয়া হলো রাতের মোকামা প্যাসেঞ্জারের টিকিট। ৬ তারিখ ভোরে দুর্গাপুর থেকে রওনা দিয়ে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, রাঁচি হয়ে নেতারহাট। আন্দাজ করে কিলোমিটার ধরা হলো ৪০০ মতো। সময় ধরা হলো আট থেকে নয় ঘন্টা। ৫টায় বাইক স্টার্ট দিয়ে সূর্য ডোবার আগেই নেতারহাট। তারপর শুধুই অপেক্ষা। অললাইনে এলবো গার্ড আর নি গার্ডও কিনে নিলাম। মানসিক শান্তি আরকী।
অবশেষে ৫ তারিখ এলো। বাড়ি থেকে ব্যাগপত্তর নিয়ে অফিস। ছুটি নিয়েছিলাম দু’দিনের। ৫ তারিখ অফিস করে সোয়া দশটায় হাওড়া স্টেশন। রাত্রে খাবার বলতে কেক, বিস্কুট, কোল্ড ড্রিংক্স। মোকামা ছাড়লো দশ মিনিট লেটে। মোকামার একটাই রিজার্ভ কামরা। যাই হোক মিডল বার্থে সিট। শুয়ে পড়লাম। কিন্তু টেনশনে ঘুম এলো না। কারণ মোকামার দুর্গাপুর পৌছানোর কথা রাত ২:৪০। তবু চোখটা একবার লেগেছিলো ব্যান্ডলের পর। হঠাৎ শুনলাম কেউ মাইকেল জ্যাকশনের নাম নিয়ে চিৎকার করছে। আমি ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি হয়তো। তারপর ভালো করে শুনলাম একটা ছেলে বলছে, ‘ইয়ে তো জ্যাকশন নেহি হ্যায়, ইসমে কিঁউ রুখা টেরেন।’ অনেকক্ষণ বোঝার পর বুঝলাম। ওটা জংশন।
দুর্গাপুরে যখন নামলাম ভোর তিনটে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রজতদাকে ফোন করলাম ধরে বলল, তুই দাঁড়া, আমি সোয়া চারটের মধ্যে ঢুকছি। রজতদার কথা ইজ কথা। যখন স্টেশনে এসে আমাকে ফোন করল ওটা সোয়া চারটে নয়। পাক্কা সোয়া ৬টা। একা একা তিন ঘণ্টা কাটানো যে কী বিরক্তিকর সেদিন বুঝেছিলাম। চা খেয়ে আর কাঁহাতক সময় কাটানো যায়। যাই হোক রজতদা এসেছিলো দুর্গাপুর স্টেশনের ব্যাকসাইডে। গিয়ে দেখি, রীতিমতো ভিড় বাইক ঘিরে। লোকজন বিশ্বাসই করতে পারছে না অতদূর বাইকে যাওয়া যায়। যাইহোক বর্ম পড়ে, লাগেজ বেঁধে যখন রওনা দিলাম ৬টা ৩৫। ফুল ট্যাঙ্কি তেল ভরে রজতদার WB 60P 0300 ছুটলো বাঁকুড়ার রাস্তায়।
বাইকে বসি কালেভদ্রে। তাই সারাদিন বাইকে বসার মজাটা টের পাইনি কখনও। পেতে থাকলাম আসতে আসতে। দুর্গাপুর ব্যারেজ পেরিয়ে বরজোরা হয়ে বাঁকুড়া যেতে ফাঁকা রাস্তায় সময় লাগলো মিনিট চল্লিশেক। তারপর পুরুলিয়া যাওয়ার বাইপাস রাস্তাটা জেনে নিয়েই আবার গাড়ি ছুটলো। রাস্তা ভালো বেশ। তাই ৭০-৮০-তেই চালানো যাচ্ছিলো অনায়াসে। রাস্তায় নেমে পোজ দিয়ে ছবি তোলাও হলো। মাঝে একবার ছাতনায় বাইক থামিয়ে একটা মিস্টির দোকানে ঢুকে কচুরি আর জিলাপি দিয়ে ব্রেক ফাস্ট সেরে নিলাম। আবার ছুটলো বাইক। পুরুলিয়া শহরটা টপকে একটা জায়গায় বাইক রাখা হলো। ছবি তোলার জন্য। রজতদা হঠাৎ খেয়াল করলো ইঞ্জিনের উপর একটা তার খোলা। কিন্তু তারটা কোথা থেকে খুলেছে কিছুই বোঝা গেলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সামনের গ্রামেই একটা ছোট্ট বাইক সার্ভিসিংয়ের দোকান আছে। সেখানেই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম।
তারটা ঠিক জায়গায় লাগিয়ে নেওয়ার পর রজতদা ওই মেকানিক ভদ্রলোক এবং আমার সঙ্গে একটা সেলফি তুললো। স্মৃতি হিসাবে। আর তারপরই মহা মুশকিল। ছবি তোলায় বছর ২৭-এর ছেলেটির কোনও অসুবিধাই ছিল না। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলতে লাগলেন, ‘আপনারা ছবি তুললেন কেন? কী করবেন এই ছবি দিয়ে? আমার ছেলের কোন ক্ষতি হবে না তো?’ রজতদা, আমি কিছুতেই বুঝিয়ে পারলাম না এটা স্মৃতি রাখার জন্য তোলা। আমরা মাওবাদী সমস্যা, পুলিশ, সিআরপিএফ শব্দগুলো শুধু শহরে বসে জেনেছি। পুরো বিষয়টা নিয়ে যে ওখানকার মানুষের মনে এখনও কতটা ভয় ঢুকে আছে এই ছোট্ট ঘটনাই তার প্রমাণ।
কোনওরকমে পালিয়ে আবার আমাদের রাস্তা ধরলাম। রজতদার বাইক ছুটলঘণ্টায় ৮০ কিমি। মাঝে একবার ঝালদায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার ছুটল বাইক। ঠিক রাঁচি, পুরুলিয়া সীমান্তে এসে হঠাৎ ব্রেক কষলো রজতদা। সামনে বোর্ডে দেখলাম, ‘Thank You For Visiting Purulia’. রজতদা বলল,‘ওই দেখ ভাই ময়ূর, ময়ূর।’ দেখলাম রাস্তার ওপাশে একটা পাঁচিলের উপর একটা ময়ূর বসে আছে। আমি তো বেজায় খুশি। কোনও রকমে চোখের জল আটকে ক্যামেরা নিয়ে ময়ূরবাবুকে তাক করলাম। তিনিও দিব্বি পোজ দিলেন। তারপর ভাবলাম বড় লেন্সটা লাগাই। কারণ সামনে যেতে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। যেই ক্যামেরার ব্যাগ খুলে বড় লেন্স বার করলাম, আমার মনে হল আমার হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলো। লেন্সক্যাপটা খোলা আর লেন্সটা ভাঙা। আমার মনে হলো পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে গেলো। মাথা জাস্ট কাজ করা বন্ধ করে দিলো।
তারপর ভালো করে দেখলাম, ভাঙা অংশটার মধ্যে কাচের আরেকটা অংশ। ভাঙা কাচগুলো সরিয়ে বুঝলাম, না লেন্সটা ভাঙেনি। ভেঙেছে উপরের ইউ ভি প্রোটেক্টরটা। উফফফ! শান্তি। তারপর মনের সুখে ফটোশ্যুট। ময়ূরটার প্রায় ৮১টা ফটো তুলে বাইকে বসলাম। ততক্ষণে প্রায় ৪০ মিনিট নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। রাঁচিই তখনও ৭০ কিমি। আকাশের অবস্থা ভালো না। কী করে নেতারহাট পৌঁছবো! আলোচনা করলাম, সেরকম হলে সেদিন রাঁচি ঘুরেটুরে সেখানেই থেকে যাব। পরের দিন সকালে যাবো নেতারহাট।
বাংলা ছাড়াতেই চারপাশের প্রকৃতি ম্যাজিকের মতো পালটে যেতে থাকলো। ঝাড়খণ্ডে ঢুকলে প্রথমেই মুরি। সেই ছোটবেলায় চারমূর্তিতে ঘুটঘুটানন্দের মুরি। বইয়ের পাতা, আর টিভির পর্দা থেকে এবার চোখের সামনে। মুরি থেকে যত রাঁচির দিকে যেতে থাকলাম চারপাশের দৃশ্যের প্রেমে পড়তে থাকলাম। এদিককার পাহাড়গুলো একটু আগে পেরিয়ে আসা পুরুলিয়ার পাহাড়গুলোর মতো রুক্ষ নয়। ঘন সবুজ।
প্রথম বর্ষার জলে সে সৌন্দর্য লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। দু’দিকেই পাহাড়। সবুজ জঙ্গল। মাঝে দুএকটা ছোট ছোট গ্রাম। আর জঙ্গল পাহাড় চিরে এগিয়ে চলেছে রেললাইন। আমাদের সঙ্গী হয়ে। পিচ ঢালা রাস্তাটার প্রতিটি বাঁকেই যেন অপেক্ষা করছে একটা করে চমক। মনে হয় এখানেই থেকে যাই আজীবন। তখন কোথায় কলকাতা, কোথায় এসপ্ল্যানেডের ভিড়ে ঠাসা কেনাকাটা, আর কোথায় আমার নিত্যনতুন কপির চিন্তা। সব কর্পূরের মতো উবে গেলো। কিন্তু দাঁড়ানোর উপায় নেই। আমাদের যেতে হবে আরও দূরে। ফেরার সময় আবার দেখা হবে। একথা বলেই আমরা এগিয়ে চললাম ঝাড়খণ্ডের রাজধানীর দিকে।
রাঁচি যখন ঢুকছি ঘড়ির কাঁটা বলছে দুপুর সওয়া দু’টো। পেটে কিছু দেওয়া দরকার। একটা ধাবার সামনে বাইক রেখে অর্ডার করলাম, ডিম ভাত। মোটামুটি বুঝলাম, আমরা দুজন ছাড়া সব খদ্দেরই ওখানে ‘জলপুলিশের আন্ডারে’। তা যাই হোক খেতে খেতে জানতে চাইলাম নেতারহাটের রাস্তাটা কোনদিকে। উত্তর এলো, ‘নেতারহাট??? হুরিব্বাপ! উও তো বহুউউউউত দুর হ্যায়।’ বোঝো কী আপদ! বোঝা গেল এখানে খুব একটা সুবিধা হবে না। শুধু জানতে পারলাম, রাস্তা ভাল। আর নিরাপদও।
রাঁচি একটা অদ্ভুত শহর। যে মাইলফলকগুলো আছে তাতে শুধুই ‘রেল স্টেশন, বিধানসভা ভবন, রাজভবন’ এসব কত কিমি তা লেখা। এরা কি শহরের বাইরে বেরোয় না? আর অসম্ভব জ্যাম। ২০ কিমিতে বাইক চালিয়ে যখন রাঁচির জ্যামজট থেকে বেরোনো গেলো তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৪টে ছুঁইছুঁই। জিপিএসের কল্যাণে দেখলাম রাঁচি থেকে নেতারহাট যাওয়ার দু’টো রাস্তা। একটা লোহারদাগা হয়ে, আর একটা গুমলা হয়ে। লোহারদাগা ছোটবেলার ভূগোলে পড়েছিলাম। কী একটা আকরিক টাকরিক পাওয়া যায়। এটুকু জানতাম। লোহারদাগার রাস্তাটা কম। তাই ওটাই নিলাম। তবে আবার বলি ঝাড়খণ্ডের রাস্তায় টুরিস্ট স্পট খুঁজে পেতে জিপিএস ভরসা। কোনও মাইলফলক আশা করবেন না। আর পথচলতি মানুষ ২০ কিমির বেশি দূরের জায়গার নাম শোনেনি। অতএব সঙ্গে থাকা পাওয়ার ব্যাঙ্কের ভরসায় গুগল ম্যাপ খুলে চললাম লোহারদাগার উদ্দেশ্যে।
রাঁচি ছাড়তেই রজতদার বাইকের স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখলাম ১০০ ছুঁইছুঁই। এখানে একটা কথা বলে রাখি, রাস্তা কিন্তু বেশ ভালো। তবে কিলোমিটার ২০ গিয়েই বিপত্তি। আমার বাঁ পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হলো। আগেই বলেছি বাইক চড়া একদমই অভ্যাস নেই। সকাল সাড়ে ছটা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। আর বসে থাকতে পারছিলাম না যন্ত্রণায়। রজতদাকে বললাম বাইক থামাতে। থামানোর পর খুব কষ্ট করে নামলাম। নামার পর মনে হলো আমি এজীবনে আর হাঁটতে পারবো না। জুতো আর মোজা খুলে দেখলাম পা’টা বেশ ফুলেছে। পাশ দিয়ে হু হু করে গাড়ি যাচ্ছে। আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে ব্যথায় চিৎকার করছি। ব্যাগ থেকে ভলিনি স্প্রে বার করে বেশ ভালো করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর ব্যথা কমায় আবার বাইকে বসলাম। তবে ব্যথা হতেই থাকলো।
লোহারদাগা যখন পৌঁছলাম সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো সূর্যের আলো তখনও বেশ চড়া। আমাদের টেনশন অনেকটাই কমলো। লোহারদাগা থেকে নেতারহাটের দূরত্ব ৮৩ কিমি। তখনও আমরা ভাবছিলাম যা রাস্তা সওয়া ঘন্টায় মেরে দেবো। লোহারদাগা থেকে কিছুটা যাওয়ার পর ওই রাস্তার শেষ বড় গঞ্জ পড়বে ঘাঘরা। এই ঘাঘরাতেই রাঁচি থেকে নেতারহাট আসা দুটো রাস্তা একসঙ্গে মিশছে। ঘাঘরা পেরোনোর পরই দু’পাশের লোকালয় আসতে আসতে কমতে শুরু হলো। ওদিকে আলোও কমে আসছে। এর মধ্যে আবার একবার প্রকৃতির ডাক আসায় বাইক থামিয়ে রজতদাকে জলের বোতল সঙ্গে নিয়ে টিলার পিছনে অদৃশ্য হতে হয়েছিল।
দু’পাশে প্রথমে শুরু হল জঙ্গল। তখনও আলো পুরোপুরি মরে যায়নি। দিনের শেষ আলোতেই দেখলাম দুপাশে শুধুই সবুজ পাহাড় আর জঙ্গল। গাড়িটাড়ি কিছু নেই। মাঝে মাঝে দু একটা অটো আমাদের উলটো দিকে যাচ্ছে। এবার শুরু হলো পাহাড়ে ওঠা। আমাদের দুজনের কারোরই ধারণা ছিল না যে শেষ প্রায় ২০ কিমি এতোটা খাড়াই উঠতে হবে। তখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইক পাহাড়ে উঠছে। রজতদা পরে বলেছিলো সেটাই ছিলো রাতে পাহাড়ে বাইক চালানোর ওর প্রথম অভিজ্ঞতা। রাস্তার পাশে একটা মাইলফলক নেই। একদিকে পাহাড় আর একদিকে খাদ। রাস্তা কিছু জায়গায় বেশ খারাপ। বাইকের হেডলাইটের আলো ছাড়া কোন আলো নেই। তাই যখনতখন বাইক গর্তে পড়ছে।
চল্লিশ মিনিট একই ভাবে চলার পর ঘামতে শুরু করলাম। ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো? মোবাইলে জিপিএস অন করতে গিয়ে দেখলাম নেটওয়ার্কই নেই। প্রতিটা বাঁক ঘুরছি আর মনে হচ্ছে একই জায়গায় চলে আসছি। পায়ের যন্ত্রণাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। রজতদাকে বাইক থামাতেও বলতে পারছি না। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে বসে আছি। একটা করে পাহাড়ের বাঁক ঘুরছি, মনে হচ্ছে একই জায়গায় ফিরে এলাম। একফোঁটা আলো দেখতে পাচ্ছি না। যদি সত্যিই ঠিক রাস্তায় চলি তাহলে আলো নেই কেন? উল্টোদিক থেকে মাঝেমাঝে লরি আসছিলো, কিন্তু সেই লরি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছিল না।
এরপর রজতদা যেটা ফিসফিস করে বলল, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ‘ভাই তেল শেষ হয়ে এসেছে। প্রায় রিজার্ভে চলছে।’ তখন আর পায়ের ব্যথার কথা ভাবার সময়ই পেলাম খালি ভাবতে লাগলাম এই অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় বাইকের তেল ফুরিয়ে গেলে করবটা কী? রজতদা যতটা পারল গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে তেল বাঁচাতে লাগলো। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ভারী গাড়ির আওয়াজ। প্রথমে খুব আস্তে, তারপর আওয়াজের তীব্রতা বাড়ল।
ও এইবেলা বলে রাখি। এতক্ষণ যে লরিগুলো আসছিল সবই আমাদের উল্টোদিক থেকে। শেষ দু’ঘণ্টাআমাদের পিছন থেকে কোনও গাড়ি আসতে দেখিনি।
ছবি— লেখক
(চলবে)