জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

বনরূপসি বাংরিপোষি— প্রথম পর্ব

সৌমিত্র

রৌদ্র থেকে বর্ষাজ্যোৎস্নায়

বর্ষামণ্ডলের ছায়াসমুজ্জ্বল আকাশ মাথায় নিয়েই তো যাওয়া! তিনশোর ভাঙাচোরা কল্লোলিনীর সার্পেন্টাইন গলি থেকে বেরিয়ে একেবারে হাজার-লক্ষ–কোটি বছরের পুরনো অবারিত দিগন্তের মুখোমুখি! ভরা শ্রাবণের দিনরাত্রি-দুপুর-গোধূলিমাখা পাহাড়, বন-বনান্ত, নদী!

এবং রাজপথ তো অবশ্যই। সুদূর নিবিড় সড়ক। নিশ্চয়ই খুব বেশিদিনের পুরনো নয়। কিন্তু তার স্পন্দনও যেন বড় অচেনা, বড় মন-কাড়া, বড় মায়া-জড়ানো। কালো পিচরাস্তা ঋজু সো-ও-ও-জা চলে গিয়েছে পাহাড়তলিতে, গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে অরণ্যসংকুল অন্ধকারে। সারাদিন তার ওপর দিয়ে রবারের চাকার চটচটে আওয়াজ— কখনও ভিজে, কখনও শুকনো। সারাদিন, ফিরে আসে চাকা, ফিরে যায়, আবার আসে… আসতেই থাকে। কালোপিচের দশআঙুল পরেই মোটা-মোটা গাছের নীচে খাটিয়ায় ঝরাপাতা এবং বাদলহাওয়ার শামিয়ানায় বসে থেকে থেকে সারাদিন মেঘ, বর্ষা এবং জীবন দেখতে-দেখতে বাংরিপোষির অপরূপ রূপের মধ্যে ডুবে যায় যুগপৎ চোখ ও চাক্ষিক।

ঠিক ধাবা নয়, কিন্তু ধাবার আদলের যে দোকানটিতে বসে বসে চা খেতাম আমরা, শুধু চা-ই নয়, সঙ্গে ঝাল কাঁচালংকা ও মটরঝোল-সহযোগে আলুবড়া-ডালবড়া এবং ‘গুলগুলে’— অসাধারণ এক স্থানীয় ‘ডিশ’ সুজি-ময়দা দিয়ে তৈরি, চাটনি ও লংকাসহযোগে অপূর্ব— সেই দোকানটি পাকারাস্তার একেবারে গলা জড়িয়েই। সারাদিন ধরে সেখানে গাড়িওয়ালাদের আনাগোনা। কত নতুন নতুন মানুষ, বিহারের, মহারাষ্ট্রের আবার পাঁশকুড়ারও, যিনি বাংলা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান— তাঁদের মধ্যে বসে বসে মানুষকে শুনতে-শুনতে, দেখতে-দেখতে সময় কাটে।

আগে ওটিডিসি’র ছিল-এখন-প্রাইভেট-হয়ে-গিয়েছে— এমন একটি রিসর্ট ওখানে আছে। তবু, আমরা  ‘হোটেল বাংরিপোষি’তেই ছিলাম। নামে ‘হোটেল’। তবে সারাদিন সেখানে অদ্ভুত অ-হোটেলোচিত এক গন্ধ! ঘরের দাওয়ার সামনে বাচ্চারা খেলছে, ঘাসে ভরা চৌহদ্দি। রিসেপশনহীন, ‘অ্যাটেন্ড্যান্ট’হীন অকৃত্রিম এক থাকার জায়গা! চাইলে সেখানে খাওয়া যায়। আমরা এক-দু’বেলা খেয়েওছিলাম, বাকি কয়েকবেলা খেয়েছিলাম ‘হোটেল বাংরিপোষি’র ঠিক পাশের ওই ‘ধাবা’য়। সেখানে একটা গোটা ফ্যামিলি দোকান চালায়। কী আন্তরিক! সারাদিন ধরে ওখানে ‘দাদা, আর একটা চা দিন’ করে-করে আমরা কতক্ষণ যে বসে বসে বর্ষা পুইয়েছি, বিষণ্ণ সড়কের আশ্লেষে বিকম্পিত হয়েছি, সুদূর বন-পাহাড়ের দৃশ্যসুখে আবিষ্ট হয়েছি, ইয়ত্তা নেই! ওঁরা বিরক্ত হননি।

যাওয়ার দিন হাওড়ায় সকাল ছ’টার ধৌলি ধরে সাড়ে ন’টা নাগাদ বালেশ্বর, সেখান থেকে সাড়ে দশটা নাগাদ একটি ডেমু ট্রেন ধরে বারিপদা হয়ে বাংরিপোষি। কিন্তু ওই ‘একটি ডেমু ট্রেন ধরে বারিপদা হয়ে বাংরিপোষি’ বললে এ যাত্রাপথের প্রায় কিছুই বলা হয় না! সিঙ্গল লাইন। দু’পাশে খেত আর জঙ্গল।

রূপসা-টুপসা পেরিয়ে একটু ভেতরে যেতে না যেতেই নিভৃত প্রকৃতি হাত বাড়িয়ে কাছে ডেকে নেয়। বিশেষ করে ‘বেটনটি’ নামের স্টেশন থেকে ‘কিষেনচন্দর’ স্টেশন পর্যন্ত পথটায় একটা দারুণ বাঁক, ঘন জঙ্গল এবং বড় বড় ছাতার মতো বর্ষামেঘের পাতায় ছাওয়া! এই করতে-করতে দুপুর দেড়টার বাংরিপোষি স্টেশন।

পিকচার পোস্টকার্ড! মেঘের আস্তর সরিয়ে রোদের কাচ ঠিকরে পড়েছে স্টেশনে। কিন্তু মহাবৃক্ষের পাতাসংসারের ঘরকন্নার মধ্যে দিয়ে ঠিকরানো সেই আলো চুঁইয়ে নেমেছে দুপুরের গা বেয়ে। ভিজে পাতার গন্ধে সোঁদা হয়ে থাকা রেলস্টেশনের অনেক-অনেক দূরে পাহাড়ের আনীল বিস্তার। প্রথম দেখার পক্ষে যথেষ্ট কাব্যিক!

স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো নিয়ে ‘হোটেল বাংরিপোষি’। এক প্রস্ত অকৃত্রিম ঠান্ডা স্নান। দুপুরের খাওয়া সেখানেই। তারপর সারাদিনের পথশ্রমে ক্লান্ত শরীরকে যখন বিশ্রাম দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু অফুরন্ত বর্ষা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল আকাশে-বাতাসে, বনে-পাহাড়ে, দূরের সড়কে, লরির চাকায় এবং আমাদের হোটেল-বাড়ির চালে। অলৌকিক সিম্ফনি থেকে অলীক স্বপ্নমেদুরতা।

আমাদের ঘরের জানলার হাতার কাছেই বড় বড় গাছ, সেখানটা এমনিই অন্ধকার; এই শ্রাবণমেঘের ছোঁয়ায় সেখানে যেন আরও অচল অটুট আঁধার বৃষ্টিকোলাহলের দুঃসহতায় নিজেকে গুটিয়ে গাঢ় করে নিচ্ছে এবং সঙ্গে অভূতপূর্ব বজ্রবিদ্যুৎভর্তি খাতার পাতা উল্টে দিচ্ছে রাগী পাগল হাওয়া! সেই বিপুল বর্ষা দুপুরটাকে যেন নিমেষে মহাপৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আমাদের মনের সামনে হাজির করল! শব্দময়, জলময়, গন্ধময় এক বর্ষাযাপন; বাংরিপোষি প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের অকূল বর্ষায় ভাসিয়ে দিল! মেঘবৃষ্টির দাপাদাপির পর সন্ধেটা একটু অচাঁদ ছিল ঠিকই, কিন্তু রাতের দিকে জ্যোৎস্নার কনসার্টে মাত হয়ে গিয়েছিল বন-রূপসি বাংরিপোষি!

ছবি- লেখক

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *