সৌমিত্র
মেঘ-পাহাড় থেকে হাঁড়িয়া ও হাট
কিন্তু জ্যোৎস্নার কনসার্ট থেকে তো বেরতেই হবে! কেন না, পরের সকালেই যে রৌদ্রের হলুদ মাংস কেটে কেটে চলবে সারাদিনের ধারাল সফর-ছুরি।
অতএব, ঘাসের চত্বর ছেড়ে দ্রুত রাতের বিছানা। অগস্টের রাতও দেখলাম বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা। পাখা চললেও চাদর লাগল। মশার উৎপাত অসহ্য নয় (তবে, পিঁপড়ের দৌরাত্ম্য আমাদের কাহিল করে দিয়েছিল গোটা ট্যুরটাতেই)।
পরদিন সকাল-সকাল রেডি হয়ে আমরা চেপে বসলাম গাড়িতে। গন্তব্য মূলত সুলাইপাত ড্যাম। সঙ্গে আরও কয়েকটি জায়গা।
‘হোটেল বাংরিপোষি’ থেকে বেরিয়ে গাড়ি ধরল ডানদিকের সেই সো-ও-ও-জা ঋজু পথ! চড়াইপথের প্রথমেই বনদেবীর মন্দির। ততক্ষণে গতরাতের বৃষ্টি-রচনার উপসংহার লেখা শুরু হয়ে গিয়েছে।পিছল পথের বাঁকে লালরঙা মন্দির। একটি গাছের মূলে দেবীমূর্তি। গাছটিকে নিয়েই মন্দির। পূজারি পুজোয় বসেছেন। বৃষ্টি তখন গিয়ার চেঞ্জ করে স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে বলে ইচ্ছে থাকলেও অনেকক্ষণ থাকতে পারলাম না মন্দির-এলাকায়। ঝটিতি গাড়িতে উঠে পড়তে হল।
এবং তারপরই শুরু হল শ্রাবণের বিগলিত জাহ্নবী-যমুনার স্রোতঃপথে আমাদের সেই দৃশ্য-আস্বাদন; সবুজ এবং সবুজ সেই পাহাড়পথে অরণ্যের সুরম্য অট্টালিকার ফাঁকে ফাঁকে অপার আকাশের সলজ্জ সঞ্চার, মেঘ এবং মেঘ-ধর্নার মধ্যে দিয়ে সবেগে বয়ে যাওয়া সপ্রতিভ হাওয়ার উচ্চণ্ড মিছিল এবং দূরাগত সড়কের বর্ষাময়, মায়াময় প্রতিরোধ-কুহক!
বনদেবীর মন্দির পেরিয়েই রাস্তায় একটা দারুণ বাঁক, সেখানে দু’পাশে ঘন জঙ্গুলে এলাকায় থিক থিক করছে বাঁদর। তারা খাবারের লোভে চলে আসছে সবেগ গাড়ির দিকেও। এই বাঁদর-বাঁকটির কাছেই ‘বাংরিপোষি ঘাট’। গাড়ির জানলা দিয়ে যা দেখা গেল, জায়গাটি বেশ মনোরম। বড় বড় গাছ এবং পাথরময় একটা ‘ভিউ-পয়েন্ট’ গোছের। এই এলাকাটার পরই শ্রান্ত উতরাই।
তার পরের পথটুকুর মধ্যে তেমন বিশেষত্ব কিছু নেই। কখনও বসতি, কখনও বাজার, কখনও প্রান্তর। দোকানপাট খুব কম। তবে, খুঁজে-খুঁজে এই পথেই রাস্তার ধারের এক দোকানে মুড়িমাখা খেয়ে ‘ব্রেকফাস্ট’ করেছিলাম আমরা। তখনও বৃষ্টি উন্মাদ। ছোট দোকানের চালা বেয়ে অবিরত অবিন্যস্ত জলধারা, সেই ছাঁট আঙুলে নিতে নিতে ঝাল-ঝাল মুড়ি খেয়ে একেবারে সটান সুলাইপাত।
রাস্তা থেকে অনেকটা উঠে সুলাইপাত ড্যাম। সেখানে জল এবং আকাশের অপরূপ বিস্তার। জল যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে পাহাড়ের সংসার ঠিক সেখান থেকেই শুরু। আকাশ মেঘের ক্যালাইডোস্কোপে বিচিত্র, বিচ্ছুরিত আলোর কৌণিকতায় আবিল; বাতাস চাপা উত্তাপে ত্রস্ত; স্থির গম্ভীর জলভার নীল-হলুদ-সবুজের স্বর্গীয় মিশ্রণে অদৃষ্টপূর্ব লাবণ্যময়। দীর্ঘ ড্যামের ওপর দিয়ে অনেকটা হেঁটে গেলে ওপাশের সবুজ বন। ড্যামের তীর ঘেঁষে বসে কতজন যে সেখানে ছিপ ফেলে মাছ ধরছেন! সেই জায়গায় একটা বাঁক রয়েছে। বাঁকটা ঘুরলেই নীচে নামার সিঁড়ি। নীচে খড়কাই নদীর ধারা।
নামলাম। অনেক ধাপ। নেমে সেই শীর্ণ জলধারার তীর ধরে হাঁটতে থাকলাম। অসম্ভব সুন্দর শ্রাবণবেলা। থমথমে। এবং এই জায়গাটায় বেশ হাওয়া রয়েছে। গাছপালার ভাগ বেশি, ছায়াও। সেই জলধারায় এক জেলে তখন মাছ ধরছিলেন। আমরা তাঁকে মাছ ধরতে দেখতে-দেখতেই এগিয়ে গেলাম অনেকটা, গাছ আর পাখি আর প্রকৃতির শব্দহীন লাবণ্যের মধ্যে দিয়ে যতটা যাওয়া যায়!
যখন ওই পথেই ফিরলাম, তখন ধারাটির ঠিক পাশেই, সেখানকার সবচেয়ে উজ্জীবনময় ছবিটি আবিষ্কার করলাম। একটি ছোট্ট টেবিল পেতে এক বয়স্কা ওড়িয়া রমণী সেখানে বিক্রি করছেন হাঁড়িয়া! তাঁর মাথার উপর পলিথিনের ছাউনি, তারও উপর গাছগাছালির পাতার ছাতা। সেই ছাতার ছায়ায় হাঁড়িয়ার হাঁড়ির পাশে রাখা রয়েছে একবাটি মটর। দু’টি ছোট কৌটো— একটিতে বিট নুন, অন্যটিতে ধনেগুঁড়ো। সেখানে বসে তখন একপাত্র হাঁড়িয়া পান করছিলেন এক বৃদ্ধ, ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, ইনি সেই জেলে, একটু আগে যিনি মাছ ধরছিলেন! তাঁর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে আমরাও হাঁড়িয়া নিলাম।
হাঁড়ির মধ্যে ছাঁকনি বসিয়ে রস জোগাড় করে বাটি ডুবিয়ে সেই রস তুলে এনে তাতে ওই নুন এবং ধনেগুঁড়ো মিশিয়ে সে এক অলৌকিক পানীয় তৈরি করে দিলেন মাসি। দিব্য! অবারিত আকাশ, অপরিমিত জল এবং শ্রাবণ বাতাসের গন্ধঘন দুপুরে নির্জন অরণ্যের কয়েকহাত তফাতে বসে এই হাঁড়িয়া পান আর ওই দু’জন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় মনটাকে সহসা কী আনন্দেই না ডুবিয়ে দিল! হাঁড়িয়ার রস ভ্রমণের রস বাড়িয়ে দিল বহুমাত্রায়।
নেশা যে বিশেষ হল, তা নয়। তবে মৌতাত হল জব্বর। বোধহয় সেই ঘোরেই অনেকক্ষণ কাটালাম সেখানে। তারপর গাড়িতে উঠে বাঁকাবল ড্যাম। এই ড্যামটি যেন সুলাইপাত ড্যামেরই কার্বন কপি, কিংবা বলা ভাল, যমজ বোন। এটিও দীর্ঘ। এরও জলের বিস্তার বিপুল। জলরেখা শেষে পাহাড়ের সঘন নীল।তবে, বাঁকাবলের আশপাশে গাছপালার ভাগ একটু কম দেখলাম। তখন আবার দুপুরের চাপা রোদটা ফুটে বেরিয়েছে। বাঁকাবলের পাঁচিলে আমার কন্যাকে বসিয়ে একটা ছবি তুলে রাখলাম।
তপ্ত মধ্যাহ্নের বিরল-টুরিস্ট বাঁকাবলে কী সহজ স্বাভাবিক নির্জনতা! মন চাইছিল অনেকক্ষণ কাটাতে। কিন্তু হাতে সময় ছিল কম।দুপুরেও খাওয়াটাও যে বাকি! সেটি গলাধঃকরণ করেই যেতে হবে পরবর্তী গন্তব্য। বিষয়ীর হাট।
সড়কে এসে একটি ধাবায় খেয়ে নিয়ে তারপর হাট। সে এক হাট বটে! চরিত্রে মোটেই গ্রাম্য নয়। দেহাতি তো নয়ই। বরং একটা অন্যরকম নাগরিকতার ছাপ তার সর্বাঙ্গে। এ পর্যন্ত দেখা স্থানীয় হাটের সঙ্গে তার তেমন মিল পেলাম না। বি-শা-ল বড় চত্বর জুড়ে সেই হাট! এক-একটা জায়গায় এক-একটা জিনিস বিক্রি হচ্ছে। কোথাও শুধুই অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, কোথাও শুধুই জামাকাপড়, কোথাও আবার মিষ্টির পাহাড়, কোথাও সবজির স্তূপ। পাশে মাছও ছিল নানারকম। মাংস বিক্রি হচ্ছে একটি ঘেরা জায়গায়। ছাগল-মুরগি একসঙ্গে। তবে, যে দৃশ্যটি দেখে আমরা সবচেয়ে মজা পেলাম, সেটি হল হাঁড়িয়া বিক্রির ছবি। অন্তত কুড়ি-পঁচিশ জন স্থানীয় মহিলা হাঁড়িয়ার হাঁড়ি নিয়ে পরপর বসে রয়েছেন। সামনেটা কাদায় পিচ্ছিল, লোকে সেইখানেই বসে পান করছেন। ওঁরা হাসিমুখে বিক্রি করছেন। খানিক আগেই আমাদের হাঁড়িয়া-অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে।
ফলে, দারুণ ভাল লাগছিল সেই দৃশ্য দেখে।
হাট আমরা শুধু দেখলামই না। বিকিকিনির হাটে কিছু কেনাকাটাও সারলাম। আমরা সেই রাতে আমাদের সেই ধাবায় রান্না করতেদেব বলে, সবজি-মাংস-চাল-ডাল-তেল-মশলা কিছু-কিছু কিনলাম। পাশাপাশি, যতটুকু পারলাম ঘুরলামও। তবে, বেশি সময় নেই। আকাশের চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম,তখনই সূর্য সন্ধের দিগন্তের দিকে পা বাড়িয়েছে। ফলে, আমাদেরও পা বাড়াতে হবে আবার সেই আঁধারে আবিল জঙ্গলের ভিজে পথে। যে পথ আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের সাময়িক আশ্রয়ে।
সে রাতটি খুবই মধুররূপে এসেছিল। মেঘ একেবারেই কেটে গিয়েছিল। কালো পিচের রাস্তায় কেমন জ্যোৎস্না ফোটে, সে অভিজ্ঞতা ঠিক এইভাবে ছিল না। দূর থেকে ভারী গাড়ির চাকার শব্দ আসছিল, এসে আবার দূরে মিলিয়েও যাচ্ছিল। সেই শব্দ-ছন্দের একপাশে খাটিয়ায় আমরা বসেছিলাম চাঁদ আর পাহাড় আর জঙ্গলের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে, দূরাগত বৃষ্টির গান কানে নিয়ে, সড়কে।
ছবি— লেখক
(চলবে)