অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

অনেক কাশ, স্বপ্নের আকাশ আর ট্রেনের জানলায় জীবন— শেষ পর্ব

দীপক দাস

দুমকা স্টেশনে পা দিয়ে বুঝতে পারলুম গরম কাকে বলে। এতক্ষণ প্রকৃতিতে মজে ছিলুম। তার সঙ্গে ট্রেনের ঘেরাটোপ। সূর্যদেবের আসল রূপটা টের পাইনি। পেলেও বা। কবেই বা ওই প্রাচীন অগ্নিবলয় আমাদের আটকাতে পেরেছে? গত বছর পুজোর সময়ে এরকমই গরম ছিল। ঘামতে ঘামতে ক্লান্ত হয়ে ট্রেনে ঘুমতে ঘুমতে ভূতুড়ে স্টেশনে গেছি তিন শঙ্কর মিলে।

গরম ভুলে প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা জুতো নিয়ে খিল্লি শুরু হল। ইন্দ্র বেড়াতে বেরলে সবসময় স্টাইলের চূড়ান্ত করে। ঝাঁ চকচকে বুট, নতুন জিনস, পাট ভাঙা টি-শার্ট, একটা চুলও এদিক ওদিক না হওয়া মাথা। ব্যাগে সাজগোজের হাজারো এটা-সেটা। কিন্তু হাওয়াই চপ্পল টাইপের কিছু নিতে বাবুর মন ওঠে না। প্রত্যেক সফরে এলাকায় ঘুরতে যাওয়ার সময়ে অন্যের চটি গলিয়ে হাঁটা লাগায়। প্ল্যাটফর্মের চপ্পলটা ওকে কুড়িয়ে নিতে বললুম। কন্ডিশন ভালই। এখন এক পাটি থাক। আরেক পাটি কুড়িয়ে পেলেই কাজ শেষ। দু’পাটি আলাদা হলেই বা ক্ষতি কী! বুটের বাঁধন থেকে বাঁচা নিয়ে তো কথা। ইন্দ্র চপ্পলটা নিতে ভারী আপত্তি করল।…

স্টেশনটা খারাপ লাগল না। বড়সড়। কিন্তু এখনও ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে ভাল ব্যাপার, স্টেশন থেকে পাহাড় দেখা যায়। কোনও রেলস্টেশনের কাছে পাহাড় আছে, এটা ভাবলেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। ঝালদা, বেগুনকোদর দেখে যেমন মন ভরে গিয়েছিল। মন ভাল হয়ে যেতেই পটপট করে ক’টা গ্রুফি তুলে ফেললুম। চড়া রোদে চামড়া সেঁকতে সেঁকতে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে হেঁটে গিয়ে।

দুমকা স্টেশন থেকে।

প্ল্যাটফর্মের শেডে ফিরে এসে চোখে মুখে ঘাড়ে জল দিয়ে ঠান্ডা হওয়া। তারপর গন্তব্য ঠিক করা। বেঞ্চে বসেছিলেন এক তরুণ। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করা গেল। বাসস্ট্যান্ড, বাস রুট আর কোথায় কী দেখার আছে। জিজ্ঞাসাবাদে বেরল চায়ে-পানি জঙ্গলের কথা। আমরা জঙ্গল দেখতে চাই। আর চাই সারসডাঙ্গার হাট দেখতে। এবার বোধহয় তরুণের একটু সন্দেহ হল। জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে আসছি। সুদূর হাওড়া থেকে হাট আর জঙ্গল দেখতে দুমকা চলে এসেছি শুনে আমাদের ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলেন। সন্দেহ হওয়ারই কথা। আমার পরনে বারমুডা। গালে, গায়ে কাশফুলের টুকরো ভর্তি। সঙ্গীদের গায়েও তাই। প্রকৃতির এমন দান! ফেলতে বারণ করেছিলুম সঙ্গীদের। ওরা কথা রেখেছে।

তবে সন্দেহ করলেও তরুণটি ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে।…

স্টেশন থেকে বেরিয়েই অটো। চালক ভদ্রলোক বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না। আমাদের ছ’জনকে দেখে ভুরু দু’টো একবার ওপর-নীচ নাচালেন। মানে, কোথায় যাবে বা যাবেন? আমি সংকেত ভাষা জানি নে। ফলে চেঁচাতে হল, বাসস্ট্যান্ড। অটোওয়ালার মাথাটা একবার ডানদিক থেকে বাঁদিকে ঘুরল। মানে, উঠে বসো বা বসুন। বসলুম। এবং ঝকঝকে রাস্তায় দুমকা বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে গেলুম। তখন প্রায় ২টো বাজে। খিদে পেয়েছে। ট্রেনে তো কচি খিদে মারার জন্য লজেঞ্জুস খাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ওকে রেশনের চিড়ে খাইয়ে ঠান্ডা করা হয়েছে।

দুমকা স্টেশনে আমাদের গ্রুফি।

আমাদের কথা শুনে অটোর নতুন দুই ছোকরা যাত্রী সাহায্যের চেষ্টা করেছিল। ভাল হোটেল, বিরিয়ানির সন্ধান দিতে চাইছিল। কিন্তু অটোওয়ালা তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। উনি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, এই বাঙালি ছোকরাদের দুপুরে ঠিক কী প্রয়োজন। আবার অটোয় উঠে বসতে বললেন। মাথা পিছু পাঁচ টাকা অতিরিক্ত দিতে হল। ভাল মানুষ উনি। নিজেই বললেন, ‘ফেরার সময়ে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসবেন।’ তারপর একটা দারুণ হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ ভাল। ভাতের সঙ্গে এত আইটেম যে প্রায় ভূরিভোজ হয়ে গেল।…ও একটা কথা বলে নিই। দুমকায় আমরা কখনও হিন্দি বলার চেষ্টা করিনি। অটোওয়ালা, হোটেলের কর্মী সবাই হিন্দিভাষী। কিন্তু আমরা অবাধে বাংলা চালিয়ে গিয়েছে। আর ওঁরাও বাংলায় ফিরে এসেছেন।

দুমকা শহরটা বেশ জনবহুল। প্রচুর বাঙালি থাকেন। রাস্তাঘাটে প্রচুর দোকান। আর এখানেও ফুটপাথ বিক্কিরিওয়ালাদের দখলে। জুতো, জামা, খাবারের দোকান, ফল, ঠাকুরের মূর্তি সবই রাস্তার পাশের অস্থায়ী দোকানে। হাঁটছি…হঠাৎ দেখি, কচি হাসছে। ‘কী রে, হাসছিস কেন?’ কচি বলল, ‘পুলিশটা জুতো কিনছে।’ এই রে! এ তো সেই বাচ্চাদের অমোঘ প্রশ্ন। রাস্তায় এক পুলিশকে জল খেতে দেখে, বাচ্চাটি তার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মা, দেখো পুলিশটা জল খাচ্ছে।’ শুনে পুলিশকর্মীটি নাকি রেগে গিয়েছিলেন। পুলিশ বলে কি জল খাবে না? আমারও কচিকে এক প্রশ্ন। কচি যা বলল তার মর্মার্থ, জুতো কেনাতে অসুবিধা নেই। বাইক চড়ে এসে পুলিশ ফুটপাথ থেকে জুতো কেনাতেই ওর আপত্তি। সরকারি চাকরি করে। দোকান থেকে জুতো কিনবে! কার যে কোথায় আপত্তি, বোঝা মুশকিল।

একদিকে কচির হাসি। অন্যদিকে শুভর হিন্দির জ্বালায় হাঁটতে হাঁটতে অস্থির। ও এখন গোবলয়ের বাসিন্দা। ফলে দেবনাগরীতে ওর একচ্ছত্র অধিকার, এরকম হাবভাব। রাস্তায় হিন্দিতে যা বোর্ড, ফ্লেক্স, দেওয়াল লিখন দেখছে টপটপ করে পড়ে ফেলছে। ওর আবার একটা মুশকিল আছে। যা বলবে সেটা সবাইকে শুনতে হবে এবং প্রতিক্রিয়া দিতে হবে। ফলে পড়ছে আর শোনাচ্ছে। হঠাৎ শুনি, ‘রাজনাথ সিং কে হাজারো দিন’। শুভ যে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা দেখে আমি অবাক। সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিতে সংস্কৃত পড়ার স্মৃতি এবং কলেজে ক্লাস কেটে বিস্তর হিন্দি সিনেমা দেখার দৌলতে দেবনাগরী একটু একটু পড়তে পারি। বোর্ডে লেখা, ঝাড়খণ্ডে বিজেপি সরকারের ১০০০ দিন পূর্ণ হচ্ছে। সেই সমারোহে রাজনাথ সিং আসছেন, দুমকায়। বোর্ডে রাজনাথের ছবিও দেওয়া আছে। শুভকে চেপে ধরলুম, ‘কী রে রাজনাথ সিং কোথায় পেলি?’ শুভর হাসতে হাসতে উত্তর, ‘ভরপেট খাওয়া হয়েছে তো। চোখটা লেগে এসেছিল। তাই ছবি আর লেখা গুলিয়ে গেছে।’ শুনে চমকে উঠি আর আক্ষেপ করি, হায় রে বাঙালি! পেটে ভাত পড়তেই চোখে ঘুমও চলে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে ঘুমচ্ছে! ওকে টেনে নিয়ে দলের মাঝে ঢোকাই। ঘুমতে ঘুমতে কখন কোন গাড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করবে।…

সারসডাঙ্গালের হাটে।

বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস কন্ডাক্টরকে ধরে আরেক প্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ। বিস্তর আলাপ আলোচনার পরে চায়ে পানির জঙ্গলই ঠিক হল। টিকিট কেটে বাসের আসন দখল করলুম। ইন্দ্র আর শুভ ঠান্ডা পানীয়ের খোঁজে গেল। আর দীপু ভেবেচিন্তে চায়ে পানির অসুবিধা বলতে শুরু করল। বাস ছাড়বে পৌনে ৪টে। চায়ে পানি পৌঁছতে প্রায় ৫টা। সেখানে জঙ্গল খুব বেশি দেখা হবে না। কারণ সারসডাঙ্গার হাট ৬টায় শেষ হয়ে যায়। জঙ্গল নতুন নয়। হাটটা আমাদের কাছে একেবারেই আনকোরা। সুতরাং…। যুক্তি আছে। মেনে নিয়ে বললুম, কন্ডাক্টর উঠলে টিকিট বদলে নেব।

এর মধ্যেই ইন্দ্র-শুভ ফিরে এল। ইন্দ্র ফোঁসফোঁস করে বলল, ‘জানো, কোল্ড ড্রিংকের সঙ্গে ফ্রি জলের বোতলটা দিচ্ছিল না। ভেবেছে, বাঙালি বলে বোকা। চাইতে দোকানদারের মুখটা কেমন হয়ে গেল।’ বিভুঁইয়ে এসে এইসব জাতিবিদ্বেষী কথাবার্তা! আমরা বাঙালিরা বিহার-ঝাড়খণ্ডের লিট্টিখোর লোকেদের মেধা নিয়ে হামেশাই প্রশ্ন তুলি। ওরাও নিশ্চয় ভেতো বাঙালিদের নিয়ে যা তা ভাবে! এখন বাসে সেই ভাবনাচিন্তা নিয়ে লড়াই বাঁধলে আমরাই হেরে যাব। বাসস্ট্যান্ডের দোকানগুলো থেকে লিট্টি জোগাড় করে ছুড়ে মারলে মাথায় আলু গজিয়ে যাবে। কিন্তু ভাত ছুড়ে মারলে দু’চারটে কাক এসে জুটতে পারে। বিপক্ষের তেমন কিছু হবে না। তাই চুপ করে রইলুম।

ঠিক সময়ে বাস ছাড়ল। টিকিট বদলালুম। তারপর জানলার দিকে চুপ করে চেয়ে রইলুম। দীপুর ভাষায়, সব কিছু চোখে ভরে নিতে হবে। ভরেই নিচ্ছিলুম। দুমকা শহর ছেড়ে ধীরে ধীরে কম বসতের রাস্তায় এগোচ্ছিল বাস। বৃষ্টি নামল তারপরই। প্রচণ্ড গরমে দারুণ স্বস্তি। বাসের জানলা বন্ধ হচ্ছিল একটা একটা করে। আমি জানলা খোলাই রেখেছিলুম। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে পড়ছে টি-শার্টের হাতায়। চোখে-মুখে ছিটকে আসা বারিবিন্দু। আরাম লাগছিল। কিন্তু আমাদের দেশেরই এক মহাজন সেই কবে বলে গিয়েছেন, ‘আরাম হারাম হ্যায়’। বড়দের কথা না শোনার ফলটা হাতেনাতে টের পেলুম। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। ততক্ষণে টিমের সকলেই ঢুলতে শুরু করেছে। আবার যখন পাতাগুলো হালকা হয়ে ওপরে উঠল তখন বাসে বেশ হল্লা চলছে। এক যাত্রী ছাগল তুলেছেন বাসে। অজ মহারাজকে জায়গা দিতেই ঠেলাগোঁজা। আর প্রায় অবোধ্য হিন্দিতে বাতচিত। এই অঞ্চলে বাসে হাস-মুরগি ছাগল নিয়ে ওঠা যায়। যাত্রীরা আমাদের এলাকার মতো ‘এটা কি মালগাড়ি’ বলে চিৎকার জোড়েন না।

আমাদের সহযাত্রী, অজ মহারাজ।

ছাগল পর্ব মিটতে আবার জানলার দিকে মুখ। বাস ছুটছে। তারই মাঝে মাঝে প্রকৃতি-জীবনের খণ্ডচিত্র দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে। ট্রেনের জানলার পরে এবার বাসের জানলায় সেই ঝাঁকিদর্শন। বৃষ্টিটা খামখেয়ালি। মাঝে মাঝেই ঝরঝরাচ্ছে। দেখলুম, সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একদল, কিশোর, তরুণ এক প্রাচীন বনস্পতির নীচে দাঁড়িয়ে। সম্ভবত করম গাছ। তাঁদের হাতে লাঠি, তরবারি। বোধহয় মহরমের মহড়া। এক জায়গায় ছোট্ট একটা হাট। বিকিকিনির পালা শেষ। গোছগাছ চলছে। দরদামও। শেষবেলার হাটেও কত রং। কারণ ক্রেতাদের মধ্যে বেশিরভাগই মেয়ে। তাঁদের রংবেরংয়ের পোশাকে অল্প জংলা, অল্প বসতের এলাকা উজ্জ্বল।

রাস্তার বেশিরভাগ অংশ বীথি। দু’পাশে এত গাছ প্রায় জঙ্গলই বলা চলে। সেই গাছে মোড়া রাস্তায় ছিটকে ছিটকে আসছিল ছবিগুলো। এক জায়গায় প্রচুর গরু। গোধূলিবেলায় গৃহমুখী। বাসের পথ রোধ করে আপনমনে চলেছে। একজায়গায় ছোট্ট একটা বাজার। দুই কিশোর জমা করা স্টোনচিপের উপর উপুড় হয়ে বসে শালপাতার ঠোঙায় মুড়ি মেখে খাচ্ছে। পাশেই চপ-ঘুগনির দোকান। মাঝে মাঝে খাটিয়া পাতা ধাবা বা গাড়ি সারানোর গ্যারেজ। লোকজন প্রায় নেই। ছবিগুলো সরতে সরতে একসময় বাস একটা বাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে পড়ল। শিকারিপাড়া। এখানে বাস কিছুক্ষণ থামবে। সিট থেকে না উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলুম। সিট ছাড়লে ইন্দ্র জানলার ধারটা দখল করে নিতে পারে।

রাস্তার পাশে খাবারের দোকান।

ততক্ষণে দলের বাকিদের ঘুম ভেঙেছে। শুরু হয়েছে টিপ্পনীও। আমি সিট ছাড়লুম। ইন্দ্র যদি বসে পড়ে ফিরে এসে প্রচুর ঝামেলা করব। বাসের বাঁদিকে পরপর দু’টো খাবারের দোকান। জিলিপি, বোঁদে, গজা, এইরকম সব মিষ্টি বড় বড় বারকোশে সাজানো। এখানে বাঙালিদের মতো রসে সাঁতার কাটা মিষ্টি খুব একটা চোখে পড়েনি। দু’একটা দোকানে ছোট গামলায় রসগোল্লা আর পান্তুয়া দেখেছি। ওহ! পান্তুয়া নয়। গুলাব জামুন সেগুলো। দোকান দু’টোর চেহারায় কোনও জৌলুস নেই। বাঁশের খুঁটি দিয়ে খাড়া করা ছাউনিই বলা যায়।

দ্বিতীয় দোকানের সামনে এক আদিবাসী বুড়ি পাঁচ, ছ’টা ছাতু নিয়ে বসে আছে। ছাতু মানে মাশরুম। মানে গ্রাম বাংলায় যাকে কোরক বলে। অনেক সময় মাটির বাড়ি ফুঁড়েই ওঠে এই ব্যাঙের ছাতাগুলো। তরকারি করে খেতে দারুণ লাগে। হয়তো বুড়ির বাড়িতেই দেখা দিয়েছিল তারা। দীপুরাও উঠে দেখে এল। বললুম, ‘কিনে নেব?’ দীপু বলল, ‘বড্ড বেশি ফুটে গেছে। বাড়ি পর্যন্ত টিকবে না।’ বাকিরাও সায় দিল।

সারসডাঙ্গালের হাটে।

বাস ছাড়ার পরে কন্ডাক্টরকে মনে করিয়ে দেওয়া হল, চায়ে পানির জঙ্গল এলে যেন আমাদের একটু জানান। যে কন্ডাক্টরের কাছে টিকিট কেটেছিলুম তিনি আর নেই। আমাদের ঘুমে ঢলে পড়ার সময় হয়তো নেমে গিয়েছেন। তাঁর সহকারীই এখন দায়িত্বে।…

কন্ডাক্টর কথা রেখেছিলেন। চায়ে পানির জঙ্গল দেখে মন ভরে গেল। জঙ্গলের ভিতর দিয়েই রাস্তা। দু’পাশের হালকা জঙ্গল ধীরে ধীরে গভীর হয়েছে। তারপর টিলা, পাহাড়। জঙ্গলের মধ্যে বসতও আছে। যেখানে জঙ্গল হালকা সেখানে কিছু বিশাল বিশাল পাথর চোখে পড়ল। কোথাও কোথাও সেগুলো আপনা থেকেই অবয়ব তৈরি করেছে। এক জায়গায় কতকগুলো পাথর দেখে মনে হল, শায়িত বুদ্ধ। ভাগ্যিস নামিনি। সন্ধের আগে এই জঙ্গলে ঢোকা মুর্খামি। তাছাড়া দেখা হতো না কিছুই। এই জঙ্গলে ছানবিন চালাতে অনেকটা সময় লাগবে।

হাটের সবজি মান্ডি।

সারসডাঙ্গা আসার আগে কন্ডাক্ট আমাদের সতর্ক করলেন। আমরা আবার আলোচনা শুরু করলুম। নামা হবে তো? এরপর দু’টো বাস আছে। রামপুরহাট ফিরতে অসুবিধা হবে না। আলাপ আলোচনা করে নেমেই পড়লুম শেষপর্যন্ত।

সন্ধ্যা তখন বেশ নেমেছে। আলোআঁধারির সারসডাঙ্গায় আমরা ছয়মূর্তি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে। কারণ একাধিক। হাট ঘোরার ইচ্ছে ষোল আনা। কিন্তু ফেরার উপায় নিয়েও চিন্তা হচ্ছে। শেষ বাস যদি কোনও কারণে না আসে তাহলে গেছি। বীরভূম, পুরুলিয়ায় বাসের জন্য অপেক্ষা করে অহল্যাকে হারিয়ে দিয়েছি অনেকবার। মানে রামচন্দ্র একসময় এসে শেষপর্যন্ত অহল্যাকে উদ্ধার করেছিলেন। আমাদের উদ্ধারে বাস আসেনি। এখানেও না এলে হাটেই রাত কাটাতে হবে। এদিকে আমার ব্যাগটা একটা চেন কেটে গিয়েছে। ফলে ব্যাগপ্যাকের একটা খোপ হাঁ হয়ে রয়েছে। ওর হাঁ মুখ বোজানোর জন্য কিছু সেফটিপিন দরকার।

বাকি দলটা হাট দেখতে প্রস্তুত। লাফিয়ে লাফিয়ে নামল তো। তার মানে ফেরা নিয়ে সংশয় নেই ওদের। আমার বয়স হয়ে গেছে মনে হয়। একগাদা সেফটিপিন দিয়ে চেন বন্ধ করে পাঁচ তরুণকে অনুসরণ করলুম। বাস হাট ছাড়িয়ে গিয়ে থামে। ও একটা কথা, এই এলাকার নাম সারসডাঙ্গাল। সারসডাঙ্গা নয়।

সবজিমান্ডি ২।

হাটে তো যাব। কিন্তু প্রথমে কোথায় ঢুকব? আগেই শুনে নিয়েছি, এই হাটে প্রচুর হাঁড়িয়া আর পচুই মেলে। হাঁড়িয়া নামটা শুনলেই মনে কেমন যেন একটা লেখক লেখক ভাব জাগে। কবি-সাহিত্যিকেরা আঞ্চলিক এই পানীয় নিয়ে এত শব্দ খরচ করেছেন। এবার চেখে দেখব ঠিক করলুম। কী জাদু হাঁড়িয়ায়? বাকিরা আমার জন্য লজ্জা পেতে পারে। সেজন্য বলে দিলুম, ইচ্ছে হলে তোমরাও চেখে দেখতে পারো। ওরা সম্মত হল না। তবে কচি বলল, এক বোতল নিয়ে যাবে। ওর বন্ধু রত্নকুমারের জন্য। আহা! কী বন্ধুপ্রীতি! মন ভাল হয়ে গেল। যদিও মনে মনে বললুম, ওই দেবদাসের জন্য বোতলে করে কলকাতায় হাঁড়িয়া নিয়ে যাবি? তোকে চুনিলাল বলবে যে লোকে! কিন্তু চেপে গেলুম। বন্ধুত্বে বিষ ঢুকিয়ে কী লাভ!

কিন্তু হাঁড়িয়া মিলল না। মূল হাটের উল্টোদিকে রাস্তার পাশে সার সার আদিবাসী মহিলা-পুরুষ বসে। স্টোনচিপের ওপরে। রাস্তার পাশে উবু হয়ে। কিন্তু কোথাও হাঁড়িয়া নেই। পচুই আছে যদিও। পচুই মানে চোলাই। ওটা ঠিক পোষাবে না। তাছাড়া বিভুঁইয়ে এসে চোলাই খেয়ে মরলে পরিবার দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। চোলাই যদি কোনওদিন খাই, এলাকাতেই খাব।

মণিহারী।

একটা ছাউনি ঘেরা জায়গায় তেলেভাজা ভাজছিল। জোর কমে আসা কাঠের উনুনের আগুনে দু’চারটে বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখলুম। আবার হাঁড়িয়ার খোঁজ। উত্তরে আবার সেই পচুই। তখন হাঁড়িয়ার নাম শুনেই নেশা ধরে গেছে আমাদের। একজন একটা হাঁড়ি নিয়ে বসেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল। উনি বললেন, ‘ডিম, ঘুগনি।’ ধুর! হাঁড়িয়ার চাট তখনও দু’চারজনের কাছে রয়েছে। তাই খেয়ে অর্ধভোজন করব কিনা ভাবছিলুম।…

হাঁড়িয়ার হাঁড়ি খুঁজে না পেয়ে হাটে প্রবেশ। বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে হাটটা। এবং সুবিন্যস্ত। এক জায়গায় কাঁচা সবজি নিয়ে বসে আছেন পরপর বিক্রেতা। ভাগা দেওয়া সবজি, আদা, রুসুন, পেঁয়াজ। আরেক এক জায়গায় কাপড়ের দোকান। সেখানেই একজন সেলাই মেশিনে সেলাই করে চলেছেন। একটু এগোলে মণিহারির দোকান, পরপর। এক আদিবাসী মহিলা বইখাতা পেনের দোকানে কিছু কিনছেন। পাশেই সাজগোজের দোকান। লিপস্টিক, পাউডার, মালা, টিপ কত কী। খুদে এক ক্রেতা উপুড় হয়ে গভীর মনোযোগে পুঁতির মালা বাছছিল। খাবারের দোকানগুলো আরেক এক জায়গায়। নানা ধরনের শুকনো মিষ্টি। কোথাও তেলেভাজা, পকোড়া ভাজা চলছে। এক জায়গায় হাতপাখা, ঝাড়ু। কলকাতার বড়বাজার হলে ছোট ছোট ভাগগুলোর নাম হয়তো হতো, সবজি মান্ডি, কাপড় পট্টি, খাগড়াপট্টি। হাটের বাইরের দিকে এক জায়গায় গরু বাঁধা আছে। গরুও কেনাবেচা হয় এই হাটে।

মণিহারী ২।

এখানে হাট সোম আর বৃহস্পতিবার। সোমবারে বড় হাট। রাত পর্যন্ত চলে। আর বৃহস্পতিবারে সন্ধ্যে গড়ালেই শেষ। আমরা বৃহস্পতিবার এসেছি। ভাঙে হাটের রূপ দেখে আন্দাজ করা গিয়েছে হাটবারে কী হয় এখানে। আমরা যারা বাজার কালচারে অভ্যস্ত তারা হাটের মহিমা বুঝব না। হাট এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অক্সিজেন। সপ্তাহের রসদ এই দু’দিনেই জোগাড় করতে হয়। আমাদের ওদিকে হলে সাইকেল নিয়ে টুক করে ঘুরে এলুম বাজারে। আনাজপাতি নিয়ে। কাজ থেকে ফেরার সময়ে রোজ সবজি কিনে ফিরতে পারে বাবা। এখানে তা সম্ভব নয়। তবে বাজার কালচার চালু হলে হাটের মতো প্রাচীন রোমান্টিকতা শেষ হয়ে যাবে।

তেলেভাজার বিক্রিবাটা শেষ।

হাট ঘুরে আবার বাসস্টপেজে। একটা পুজো হচ্ছে বেশ জাঁকিয়ে। মাইকে পুজোর নির্ঘণ্ট ঘোষণা হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের এক অখ্যাত গ্রামে বাংলায় ঘোষণা শুনতে খারাপ লাগছিল না। চা খেয়ে বাসস্টপের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলুম। হঠাৎ মনে হল, এসেছি যখন একবার পুজোটা দেখেই যাই। ভক্তি থেকে দর্শনের সাধ জাগেনি। বাংলার বাইরে দুর্গাপুজোর একটা অভিজ্ঞতাও হবে, এই আশায়। কিন্তু ইন্দ্রকে রাজি করানো গেল না। ওর গোঁড়ামিটা মাঝে মাঝে বিরক্তিকর অহংকারে পৌঁছে যায়। গদগদ হয়ে দেখতে কে বলেছে রে হতভাগা? ওকে বললুম, ‘তুই বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাক। বাস এলে আটকে আমাদের ফোন করবি।’

জেদ আর গোঁড়ামির দেওয়ালে অনেক পাওয়া আটকে যায়। জীবন দিয়ে বোঝা। এখানেও তাই হতো। ঠাকুরটাকুর দেখার পক্ষপাতী নই আমিও। কবে শেষ ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি মনে নেই। কিন্তু পুজোকে কেন্দ্র করে জীবনবৃত্ত দেখতে আমার কোনও গোঁড়ামি নেই। পুজোয় এলাকার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। টুকরো জীবন কুড়িয়ে পাওয়া যায়। তার লোভ যে বড়।

সেই পুজো। সারসডাঙ্গাল।

টুনিলাইটের তুমুল আলোকসজ্জা পেরিয়ে মণ্ডপে পৌঁছলুম আমরা। পুজোটা বেশ প্রাচীন। পাকা এবং প্রাচীন রীতির দুর্গামন্দির তার প্রমাণ। মন্দিরের সামনে তখন আদিবাসী নৃত্য চলছে। বেশ সাজগোছ করেছেন আদিবাসী তরুণেরা। মাথায় পাগড়ির মতো করে কাপড় জড়ানো, তাতে ময়ূরের বা অন্য পাখির পালক গোঁজা, নতুন ধুতি কাছা দিয়ে পরা। কারও লুঙ্গির মতো কটিবস্ত্র। গায়ে বিভিন্ন ধরনের পোশাক। মাদল বাজছে দিম দিম দিম। সঙ্গতে খঞ্জনি, করতালের মতো বাদ্যযন্ত্র। অদ্ভুত মাদকতাময় সেই সুর।

পারফর্মার।

মাইকে স্থানীয় ভাষায় গান বাজছে। ভাষা বুঝতে পারছি না। কিন্তু মনে হল, সেই গানের সঙ্গেই সঙ্গতি রেখে বাদ্যযন্ত্রে সুরলহর তুলেছেন তাঁরা। নাচের তালে আর বাজনার সুরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎ চোখ পড়ল তাঁর দিকে। নৃত্যরত তরুণদের নেতার দিকে। তিনি এক বৃদ্ধ। পরনে নতুন ধুতি, পাঞ্জাবি। এক হাতে উত্তরীয় আরেক হাতে এক গোছা ময়ূরের পালক নিয়ে তিনি নাচের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সমান তালে, একই ছন্দে। অফুরান দম। বয়স তাঁকে দমাতে পারেনি। আগে-পিছে-ডায়ে মুড়-বাঁয়ে মুড়- সবই ছন্দে ছন্দে। তাল ভঙ্গের কোনও সুযোগই নেই। এইরকমই নেতা চেয়েছি বরাবর। অদম্য। বুক চিতিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। যে কোনও প্রতিকূলতায় ডানহাতটা হৃদপিণ্ডের ওপরে রেখে বলবেন, ‘আ দেখে জরা…’। মনে মনে প্রণাম জানালাম নাচের দলের নেতাটিকে।

নাচ শেষ। দলটা ছুটে গিয়ে মন্দিরে উঠল। প্রতিমার সামনে কোনও প্রদর্শন হবে হয়তো। কিন্তু আমাদের আর সময় নেই। বাসস্টপেজের দিকে দৌড় লাগালুম। পৌঁছে দেখি, বাস এসে গিয়েছে। ইন্দ্র আকুল হয়ে দৌড়ে আসছে। আমাদের দেখে শান্তি পেল। তারপর একটু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘ফোনে পাচ্ছি না। কন্ডাক্টরকে বলে বাস থামিয়ে রেখে ডাকতে যাচ্ছিলাম।’…

নেতা নাচিয়ে।

বাস তখন সারসডাঙ্গালের আলো ছাড়িয়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছে। আমি বসতে জায়গা পেয়েছি। বয়স হলে এই এক সুবিধে। বসা, খাওয়া, শোয়ার ব্যবস্থা করে তরুণেরা। তাদের উদারতা বা সক্ষমতা দেখানোর জন্যই, বোধহয়। বৃষ্টি নেমেছে তখন। চারপাশ নিকষ অন্ধকার। মাঝে মাঝে হয়তো একটা ঝুপসি গাছের নীচে দোকানের আলো। কখনও অন্ধকার থেকে ছুটতে ছুটতে হইহই করে বাস থামিয়ে একদল যাত্রীর ওঠা বা বাসের পেট থেকে সাইকেল বের করে নেমে যাওয়া কোনও যাত্রী।

সেসব একে একে পিছনে ফেলে ছুটছিল বাসটা। ভেজা পথে ভিজতে ভিজতে। ছয় ছন্নছাড়ার মনে খুশির পরত ফেলতে ফেলতে।

 

ছবি— দীপশেখর দাস, শুভ (কচি) বৈদ্য এবং ইন্দ্রজিৎ সাউ

 

সমাপ্ত

 

Rampurhat to Dumka train travel

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *