দীপশেখর দাস
গোবিন্দঘাটে গাড়িটা পৌঁছতে একটু স্বস্তি পেলাম যেন। শ্রীনগর থেকে তিনটে গাড়ি বদলাতে হয়েছে। শেয়ার ট্যাক্সিতে ব্যাগে-মানুষে ঠাসাঠাসি করে আসা। সিট পেয়েছিলাম সুমোর পিছনে। নড়ার জায়াগাটুকুও নেই। কোমর বলে কিছু একটা আছে বুঝতে পারছি। অস্বস্তিটা ওখানেই হচ্ছে যে বেশি।
হাওড়া থেকে দুদিন আগে দুন এক্সপ্রেস এবং দেরাদুন। সেখান থেকে একদিনের জন্য খুঁটি পোঁতার কথা শ্রীনগরে। কাশ্মীরের নয়, উত্তরাখণ্ডের শ্রীনগর। দেরাদুন থেকে সরাসরি শেয়ার ট্যাক্সি চেপে পৌঁছনো যায়। কিন্তু বিসমিল্লায় গলতি। ট্রেন আড়াই ঘণ্টা লেট। অগত্যা সময় বাঁচাতে হরিদ্বার থেকে দুটো গাড়ি বদলে গন্তব্যে পৌঁছনো।
বেরিয়েছি ফিল্ড ট্যুরে। সঙ্গী টিম লিডার উদ্ভিদবিদ্যায় ডক্টরেট, উত্তরাখণ্ডেরই দীনেশ রাওয়াত। আর বিহারের পরিবেশবিদ্যায় স্নাতক, নিকেশ কুমার। রিস্পানা থেকে ট্যাক্সি ধরে চলেছি শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। একে একে পার হয়ে গেল রাজাজি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বিখ্যাত হর কি পৌড়ি। আর ওই বিশাল শিবমূর্তি।
ট্যাক্সি চলেছে অলকানন্দার তীর বেয়ে। অলকানন্দা এখন বড়ই শান্ত মেয়ে। ঘোলা জলের স্রোত গঙ্গার উদ্দেশ্যে চলেছে ধীরে ধীরে। দেখে বোঝাই যায় না প্রবল বর্ষার দিনে এই শান্তিপ্রিয়াই হয়ে উঠে ভয়াবহ। লন্ডভন্ড করে দেয় সব কিছু। বঙ্গে দামোদর সারাবছর সুদিন আনে আর বর্ষায় আনে দুর্দিন। উত্তরাখন্ডে অলকানন্দাও তাই। ধীরে ধীরে উত্তরাখণ্ডের রূপ মাধুর্যের আকর্ষণ বাড়তে থাকল। মাঝে ঘোলাজলের অলকানন্দা, দুই পাশে সবুজ পাহাড় আর উপরে নীল আকাশ। এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। যদিও বর্ষাকালের সাদাটে মেঘপুঞ্জ নীল আকাশকে কিছুটা নিষ্প্রভ করেছে। তবে এতটুকুও রূপমাধুর্যে খামতি হচ্ছে না তাতে।
গাড়ি চড়ছে উপরে, আরও উপরে, আরও…ক্রমশ চড়ছে সে। প্রবল বেগে। মেঘেল পরিবেশের হিমেল হাওয়ায় ট্রেন জার্নির ক্লান্তি এখন উধাও। সবাই চনমনে। এখন শুধু প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার সময়। চেটেপুটে নেবার সময়। ডক্টর সাব, অর্থাৎ দীনেশদা উত্তরাখণ্ডের লোক হওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছে আমাদের। রাস্তার প্রত্যেকটা মোড়, প্রত্যেকটা পাহাড়, প্রতিটি নদী তাঁর চেনা। তাঁর ধারাবিবরণীতে উত্তরাখণ্ডকে চিনে নিচ্ছি আমরা দুই বাঙালি আর বিহারী। অলকানন্দা উত্তরাখণ্ডকে শস্য-শ্যামলা হয়তো করতে পারেনি কিন্তু জীবন দিয়েছে তাকে। অলকানন্দার টলটলে শরীরে এসে মিশেছে এক এক নদী। গড়ে তুলেছে সঙ্গম। এদের কথায় প্রয়াগ। দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগ আর নন্দপ্রয়াগ। একেকটি প্রয়াগ ঘিরে গড়ে উঠেছে এক এক তীর্থ। তীর্থ ঘিরে শহর। মানুষ পেয়েছে জীবিকা।
বিকেল ৩টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম শ্রীনগরে। পথমাঝে এক ধাবায় আহার সারা হয়েছিল। দীনেশদার চেনা শহর এই শ্রীনগর। এখানকার গাঢ়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তার ডক্টরেট হওয়া। স্বভাবতই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত সে। দীনেশদারই চেনা হোটেলে ঠাঁই নিলাম আমরা। এই যুগেও ২৫০ টাকায় ঘর পাওয়া যায়! খাওয়া আগেই হয়েছিল। তাই হোটেলে গিয়ে স্নান করেই টানা ঘুম।
শেষ বিকেলে শ্রীনগর দর্শনে। জমজমাট গমগমে মার্কেট এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম অলকানন্দার পাড়ে। নদীর শীতল জলে পা ডুবিয়ে সমস্ত ক্লান্তি দূর করতে। আসলে শ্রীনগর উত্তরাখণ্ডে হলেও পার্বত্য ঘাঁটি হওয়ায় এলাকাটা বেশ গরম। তাই অলকানন্দার শীতল জল প্রবল স্বস্তি এনেছিল শরীরে। সন্ধ্যা হতেই উঠে পড়লাম পাড় থেকে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। খুব সকালে উঠে রওনা দিতে হবে গোবিন্দঘাটের উদ্দেশ্যে।…
গোবিন্দঘাটকে আমার ছোট্ট শহর বলেই মনে হল। গুরুদ্বারকে কেন্দ্র করে বেশ জমাটি ব্যাপার একটা। গোবিন্দঘাট নামের উৎপত্তিটা সহজেই অনুধাবন করতে পারলাম। গাড়িস্ট্যান্ড একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ। শিখেরা পাঞ্জাব উজাড় করে এসেছেন তীর্থে। দীনেশদা ঘোড়েল লোক। যদিও একটু বেশিই টেনশন করেন মাঝে মাঝে। গাড়ির ভিড় দেখেই বললেন-“রাত সায়েদ রাস্তা মে কাটানা পারেগা।”
আশেপাশের সব হোটেল বুকড। আমরা আগে থেকে কখনওই ঘর বুক করি না। আসলে ওই তকতকে ঝকঝকে অনলাইন ঘরে আমরা ঠিক মানিয়ে উঠতে পারি না, মন আর পকেট দুদিক থেকেই। কিন্তু এখন মহাবিপদ। সন্ধ্যাতেই তাপমাত্রা মাপকযন্ত্র জানান দিচ্ছে ১২ ডিগ্রি। রাত বাড়লে তো…ভেবেই একটা শিরশিরানি অনুভূত হল। খানছয়েক হোটেল দেখে ক্ষুধা, ক্লান্তি ভরা শরীরে উপস্থিত হলাম স্ট্যান্ডের একমাত্র ধাবা মেহতাজির ধাবা। আমাদের পিঠের রুকস্যাক দেখেই অভিজ্ঞ মেহতাজি বুঝেছিলেন আমরা উপরের যাত্রী। আর ব্যাগব্যাটরা সমেত ধাবায় প্রবেশের কারণটাও অনুধাবন করেছিলেন সহজেই। খাওয়া শেষে কিছু বিল মিটিয়ে কিছু বলার আগেই দোকানের এক ছোকরা কর্মচারীকে দেখিয়ে বললেন- “ঘর নেহি মিলা না? ইসকে সাথ যায়িয়ে। সায়েদ উঁহা এক ঘর মিল যায়েগা।” এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া। কোনও কথা না বাড়িয়ে আমরা ছোকরার পিছু নিলাম।
হোটেলের রিসেপশনিস্টকে আমাদের দেখিয়ে ছোকরা বলল- “মামুনে ভেজা। রেট ঠিক লাগানে কো বোলা হ্যায়।” রিসেপশনিস্ট ছোকরাকে কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর আমাদের জানাল ঘর একটাও খালি নেই। সব আগে থেকেই ভর্তি। আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত। তিনজনেই বিহ্বল। এই ঠান্ডায় যদি গাড়ি স্ট্যান্ডে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয় তাহলেই তো ট্যুর কালই শেষ।
এখন কী হবে এই আলোচনা করছি। এমনসময় হোটেল মালিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বোধহয় ভিতর থেকে ‘মামু’ কথাটা শুনেছিলেন। মালিক আমার থেকে বছর কয়েকেরই বড় হবে কেবল। হোটেল মালিক বলতে ভুঁড়িওলা নধরচরিত্রের নন। আসলে সিজনে এই হোটেল ব্যবসাই এদের জীবিকা। এর আয়েই সারা বছর চলে এদের। বললেন- “সির্ফ আজ রাত কে লিয়ে এক ঘর দে সাক্তা হুঁ। কাল শুভা হি ছোড় দেনা পরেগা। কাল সে আলাগ পার্টি কা বুকিং হে। চলে গা?” ইয়ে চান্দ আয়া মুঠঠি মে। এক কথায় রাজি আমরা। ঘরের ভাড়া জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি আর।
পরেরদিন সাতসকালেই ঘোড়ার পিঠে লটরবহর তুলে আমরা চললাম পদযোগে। উদ্দেশ্য ঘংঘরিয়া। গোবিন্দঘাট থেকে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এখন শিখদের তীর্থের সময়। সদলবলে চলেছে হেমকুণ্ড সাহেবের উদ্দেশ্যে। সেখানে যেতে হলে ঘংঘরিয়াতে আস্তানা নিতে হবে। আগেরদিন মেহতাজির ধাবায় নৈশভোজের সময়ই তাঁকে আমাদের কাজের কথা শুনিয়েছিলাম। মেহতাজিই আমাদের জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উপরে একটা ঘরের ঠিকানাও দিয়েছিলেন। যদিও ফিল্ডে এলে ফরেস্ট গেস্টহাউস আমাদের জন্য বরাদ্দ থাকে। তাই বেশ চিন্তামুক্ত হয়েই বেরিয়েছিলাম আমরা। যাত্রাপথের ভিড় দেখে তবুও মনে একটু আশঙ্কা জাগল।
গোবিন্দঘাট থেকে ঘংঘরিয়া যাবার রাস্তাটা বেশ চওড়া। পাহাড় কাটা ট্রেকিং রুট যেমনটা হওয়া উচিত ঠিক তেমন নয়। গোবিন্দঘাট থেকে পুলনা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার পিচ ঢালা পাকা রাস্তা। তা শেষ হতেই আবার সিমেন্ট বাঁধানো ঢালাই রাস্তা। তার একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে বসতি। প্রকৃতির স্বরূপ এখানে বোঝাই যায় না প্রায়। পাশ দিয়ে বয়ে চলা পুষ্পবতীর জলতরঙ্গের একটা সুর কানে বাজতে থাকে শুধু। পুরো পথটা ঘোড়সওয়ারি করে বা হেলিকপ্টার সওয়ারিতেও পার করা যায়।
পুলনা থেকে কিলোমিটার দুয়েক চলার পর একটু বিশ্রাম। সামনেই একটা খাবারের দোকান। সকালে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। দোকান দেখেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল যেন। তিন প্লেট ম্যাগি আর চায়ে কিছুটা সতেজ হলাম। কিন্তু রেস্তোরাঁর বিলেই ঘায়েল করল। চা ২০ টাকা কাপ। আর ম্যাগি ৫০ টাকা প্লেট। উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম বাড়ছে খাবারের।
বসতি ছাড়িয়ে খানিক উপরে উঠতে প্রকৃতি খোলতাই হল একটু। রাস্তার দু’পাশেই এখন গাছ আর পাহাড়ের মিশেল। আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা পুষ্পবতী আপন রাগে গেয়ে চলেছে। খানিক এগিয়ে দেখি খাড়াই এক পাহাড় নেমে এসেছে পথের ধারে। পথ থেকে বেশ কিছুটা উপরে পাহাড়টা ভূমির দিকে বেঁকে গিয়ে এক প্রাকৃতিক ছাদ তৈরি করেছে। আর সেই ছাদের আশ্রয়ে বাসা বেঁধেছে অসংখ্য মৌমাছি। কর্মী মৌমাছির মৌনৃত্যের তালে আশ্চর্য রকম হিল্লোল উঠেছে মৌচাকে।
ঘটনাবিহীন পথে চলতে চলতে ক্লান্ত শরীরে তিনজনে ঘংঘরিয়া যখন পৌঁছলাম তখন ৪.৩০টা। কিন্তু ঘংঘরিয়া প্রথম দর্শনেই ফ্লপ। বেস ক্যাম্পে ঢোকার মুখেই আস্তাবল। ঘোড়া-খচ্চরের নিত্যকর্মে জায়গাটা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এক পরিচিত গন্ধে চারিদিক ছেয়ে আছে। বলাই বাহুল্য এই গন্ধের সঙ্গে আমার পরিচয় কলকাতার হেস্টিংসে।
ঘোড়া আমাদের ব্যাগপত্র নিয়ে আগেই পৌঁছেছে। ঘোড়ার সঙ্গে আসা ছোকরা দু’জনকে মালপত্তর ফরেস্ট গেস্টহাউসে রাখতে বলেছিলাম। গোবিন্দঘাট থেকেই একটা চিঠি লিখে ওদের হাতেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ফরেস্ট গেস্টহাউসে ব্যাগ রাখার অনুরোধ করে। সব কাজ প্ল্যানমাফিকই সমাধা হয়েছে। কিন্তু বিপদ হয়েছে অন্য জায়গায়। গতকালই এখানে ৩০ জন আইএফএস ট্রেনি সহ কয়েকজন অফিসার এসে পৌঁছেছেন। সুতরাং অন্য কোথাও বন্দোবস্ত করতে হবে। ব্যাগপত্তর সব গেস্টহাউসে রেখেই ছুটলাম ঘর খুঁজতে।
পৃথিবীর উজাড় করে সব এসে জুটেছে ঘংঘরিয়ায়। হোটেলের রিসেপশন থেকেই ফিরতে হচ্ছে। ১০-১২টা হোটেল দেখা হয়ে গেছে। অগত্যা কপিলজির ঠিকানা দেয়া ‘ভিতরের দিকে’র শ্রীরাম হোটেলের খোঁজ শুরু করলাম। গুরুদ্বারের উল্টোদিকে দু’টো দোকানঘরের মাঝখানের গলি দিয়ে ভিতরে ঢুকে হোটেলের খোঁজ পেলাম। রিসেপশন ফাঁকা। টেবিলে ঘর খালি না থাকার বোর্ড। একটা আশঙ্কা বেশ জমাটবদ্ধ হচ্ছে মনের মধ্যে বুঝতে পারছি। কিন্তু এখানে একটা ঘর জোটাতেই হবে। মরিয়া হয়ে মালিকের খোঁজ লাগালাম।
বাইরের খাবারের দোকানে কাজ করা এক নেপালি ছেলে ভিতর থেকে মালিককে ডেকে নিয়ে এল। আমরা দিন দশেকের বাসিন্দা আর মেহতাজি আমাদের পাঠিয়েছে শুনে বললেন- ‘এমনিতে তিনদিন কোন ঘর খালি নেই। তবে একটা ঘর আছে একদম নীচে। পরিষ্কার করে দেব। যদি পারেন ওখানে তিনদিন থেকে যান।’ ঘর খালি হলে আমাদের উত্তরণ ঘটবে, জানালেন মালিক। রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। নেই মামার থেকে একটা কানা মামা থাকলেও মায়ের বাপের বাড়িকে মামাবাড়ি বলার আনন্দ মেলে।
ঘরটা একদম স্যাঁতস্যাঁতে। একদিকের দেওয়াল জল শুষে রেখেছে। বর্ষাকাল হওয়ায় ঘরের বাইরের দালানের পরেই জল জমে আছে। কলকাতা হলে লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গি মশার আঁতুড়ঘর হতো। নেহাত ঠান্ডা এলাকা তাই এডিস ইজিপ্টাই মশা সমতলে বা ইজিপ্টেই ফিরে গিয়েছে মনে হয়। বেশ বুঝলুম, এ ঘরে রোদ্দুর পৌঁছনোর উপায় নেই। ফরেস্ট গেস্টহাউস থেকে ব্যাগপত্তর এনে গুছিয়ে নিলাম। কাল যাব হেমকুণ্ড সাহেব।
ছবি— লেখক
প্রচ্ছদের ছবি— অলকানন্দা
(চলবে)