সৌমিত্র
মায়া নেমে আসে পৃথিবীতে এই সময়টায়। এই হিমে, শিশিরে, কুয়াশায়, ফসলের গন্ধে-বর্ণে, সাদা ধুলোয়, খড়-কুটোয়, শুকনো পাতায়, হাঁসের ডানায় এবং অবিরল রৌদ্রের সংরাগে বড় মায়াময় হয়ে ওঠে পৃথিবী এই লগ্নে; আমাদের বাংলার অসংখ্য গ্রামে এই সময় এই মায়ার সংসার রচিত হয়।
পাকা ধানের রঙে হলুদ হয়ে থাকা মাঠ, যা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ফ্রেসকোর সেই অ্যাডামের মতো যেন ছুঁয়ে থাকে ঈশ্বর-আকাশের সতত দূরস্থিত সুনীল আঙুল, অবারিত; এবং, হ্যাঁ অপরূপ ধূসর! সেই হলুদ ক্যানভাসে নরম শুকনো তুলো-ওড়া অলৌকিক রোদ্দুরের স্রোতে উড়ছে বক, হাঁস; সরু আলপথের দু’পাশে ধানের খেত ছাড়াও রয়েছে কিছু শীতফুলের মরসুমি বাগান; সেই ফুলেল বাগানের সীমারেখা রচনা করে দিয়েছে কিছু বুনো গুল্ম এবং তাল-বাবলা-খেজুর-নিম-নারিকেল এবং এবং এবং কিছু অবাককরা গুবাকতরুর সারি।
স্বচ্ছ পাতলা একটা নীলাভ শান্তি ছেয়ে রয়েছে চরাচর, নৈঃশব্দ্যের অকৃত্রিমতায়— এই হেমন্তকেই প্রত্যক্ষ করে এলাম (হ্যাঁ, এইভাবেই, তবে, এতটা কাব্যিক সুষমায় নয় হয়তো, কিন্তু দৃষ্টির অশেষ নন্দনে ভাব এবং ছবি তো বাকপ্রতিমার জন্মও দেয়, অন্তত সেই অর্থেও কাব্যিক ধরলে), হাওড়া জেলার এক প্রত্যন্তে, আমার গ্রাম, কাঁঠালদহে।
হেমন্তের প্রান্ত ধরে এসে শীতের অবিকল্প মূর্তির সমীপে পৌঁছনোর অব্যবহিত মুহূর্তেই আমার মনোমধ্যে চেপে বসল এই নিরুচ্চার হেমন্ত, কার্তিকের উদাস-বাউল এবং অগ্রহায়ণের দুখী-দরবেশ; মিলেমিশে হিম-হিম শিশিরের ছেঁড়াকাঁথা-স্মৃতিরেণুর উজ্জ্বল বনানী মধ্যে, নীল, কেবলই নীল, যেমন হয় আর কী, স্মৃতি-রং, তেমনই, অন্তরে; তবে, বহিরাকাশে তো বৈরাগ্যেরই সকরুণ হলুদ বিস্তার, অপার, অজর, অক্ষয়…! প্রণম্য শোকও আছে, হেমন্ত তো অশোক নয় (তবে, তার রং অজানা)!
সেই হেমন্ত আমাকে শহরের নিত্য ঘষটানির মধ্যে ছিঁড়ে যাওয়া চামড়া (ত্বক নয়), উঠে যাওয়া নুনছাল-নখের যন্ত্রণা-বিরক্তির বিপ্রতীপে মহীয়সী শুশ্রূষা এনে দিল; বরাবরই দেয়। আমার এই গাঁয়ে (আমরা কলকাতা থেকে আসার সময় বলি ‘দেশে যাচ্ছি’, তো সেই), এই দেশে, এবারে অনেক-অনেকদিন পর দিনরাত্রিমাখা টানা ঘণ্টাকয়েকের বাস, যে বসবাস এই হেমন্তদিনের ধুলোপথের ছায়াময়তায়, পাখিডাকা সকালের চঞ্চলতায়, পথিকের চলে যাওয়ায়, ফেরিওয়ালার আহ্বানে আমাকে ফিরিয়ে দিল, বাড়িয়ে বলছি না, অপরূপ স্বপ্নমগ্নতা, বলাই বাহুল্য, বহুদিন পর!
হ্যাঁ; এই অগ্রহায়ণ, এই বাংলার অপরূপ শান্ত নীল হেমন্ত সরু পথ চিরে চলে গিয়েছে কুয়াশাকুটিল দিগন্তে, দু’পাশে অতুল স্বর্ণবৈভব এবং দ্যুতি— পর্যাপ্ত শুভ্র নয়, তবে, বর্ণিল; উত্তুঙ্গ সূর্যজাগরণের নির্মল কল্লোলে পাতা-খসা অজর-অমর মধ্যাহ্নের নদীপার্শ্বে চিরচেনা এই ধুলোর অকিঞ্চিৎকরতায়, এই ঘাসে, খড়ে, স্মৃতিনির্জন নীড়ের নিভৃতেই, হায়!
তালপাতার খাঁজকাটা হলুদমাঠ, তরুছায়ালাঞ্ছিত অঢেল ধানখেত, ধান কেটে বয়ে নিয়ে যাবে বলে আলপ্রান্তে অপেক্ষারত পাটারিকশওয়ালা, সকালের শিশুরৌদ্রে স্নাত গ্রাম্য মহিলা, গবাদিপশু এবং পাখিও অশেষ— শহরের ক্লান্তিকে মুছিয়ে দেয় যত্নে, স্পর্ধায়, দ্রুত:অমিত্রাক্ষর ছন্দে, কারুণ্যে। এবং গন্ধে। নানারকম। খড়ের তো বটেই!তাছাড়া শুকনো পাতার, আকাশের ডানার, নীলের, হলুদের এবং বড় বড় আঁচে এদিক-ওদিক জুড়ে জ্বাল দেওয়া খেজুররসের, প্রাণজুড়োনো, ঘ্রাণকাঁদানো… হে মধুর!
খুব দ্রুত হারিয়ে-যাওয়া সূর্যের নীচে, সহসা-শীত-শীত-করা গোধূলিসন্ধ্যার পুরনো কাঁথা-কম্বলের আদরে স্থিত হয়ে অনেকদিন-পরে-আবার-ঠোঁটের-কাছে-ফিরে-পাওয়া প্রিয় পেয়ালার প্রাচীন অচিন প্রান্তে একটু কড়া চায়ের আস্বাদ এবং ঘরবন্দি কিছু সংলাপের গহিনে যখন চুঁইয়ে নামে বাইরের গাছপালার অন্তর্বর্তী কাঁপুনি, হিমবাতাসের চোরা ছুরি, তখন হেমন্তের অন্য রূপ খোলে— এই গ্রামেই, এই দেশঘরে, এই গাঁয়ে, আমার স্মৃতির কাঁঠালদহে, চমৎকার কী জীবন!
রাত খুব ধারালো। নিকষ। স্তব্ধ। তারাভরা (নক্ষত্রখচিত বললেই ভাল), পাখি-ডাকা, অচঞ্চল, অকৃত্রিম, হিমপতনের শব্দবিহ্বল, নিগূঢ় অন্ধকারমথিত বিপুল, হে অনন্ত শান্তি, বিপুলই তো! প্রচুর অনেক এ আঁধারে শীতপূর্ব গ্রামবাংলা হাঁস-হাঁসিনীর ত্রস্ত চলনছন্দে রমণীয়, হে শীত, প্রচণ্ড দারুণ খুব ম্লান ও মদির।
দীর্ণ দ্রাক্ষাবীথিপথে রৌদ্রে কোন দূর ছায়াতলে বসে আছেন কোন সুদূরঅজানিত কবি তাঁর অলিখিত পঙ্ক্তিটি ধারণ করে— এই হেমন্তের অপরূপ রূপ তাঁকে ভাষা দিক, হে সুন্দর! সার্থক হোক সূর্য এবং নক্ষত্র, হিম এবং শিশির যুগপৎ! আমিও যেন হেঁটে যাই, যেন এরকমই হেঁটে যেতে পারি এই হেমন্তপথরেখা ধরে বর্ষে বর্ষে অনিবার অটল অনন্ত কুয়াশাভাঙা সকালের অমল অমোঘপাখি ও শাশ্বতফসলের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে, বলতে… বলতে… বলতে…
ছবি-লেখক
(সমাপ্ত)