অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ওয়ান…টু…চা চা চা

দীপক দাস

‘একটু চা বাগান কোথায় পাই বলতে পারেন?’

আধঘণ্টার বেশি ঘুরপাক এবং ঢোকা-বেরনোর জটিলতায় পরিস্থিতিটা প্রায় সুকুমার রায় হয়ে উঠল। শুধু জিজ্ঞাসাটাই শুধু বাকি, ‘একটু চা বাগান কোথায় পাই বলতে পারেন?’

অযোধ্যায় তিনমূর্তি। আরে না, সেই রামও নেই। তিনি এখন ভাগ হয়ে গিয়ে জয় শ্রীরাম হয়েছেন। আর এটা সেই অযোধ্যাও নয়। এ অযোধ্যা পুরুলিয়ায়। সুতরাং তিনমূর্তি মানে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ঘরে ফেরা তিনজন নন। নেহাতই বঙ্গাল নিবাসী ইন্দ্র, শুভ আর আমি। পুজোর সময় অযোধ্যায় চা বাগান খুঁজছি। একবার জঙ্গলে ঢুকছি। আবার বেরচ্ছি। পাগলা দাশুর মতো প্রবেশ-প্রস্থানে হাঁফ ধরেছে…।

সপ্তমী-অষ্টমী আমাদের খোঁজাখুঁজির উপর দিয়েই গেছে। শুরু হয়েছিল বেগুনকোদরে ভূতের খোঁজ দিয়ে (তিন শঙ্করের কাহিনি)। কিন্তু সেখানে ভূতটুতের বালাই নেই। পালিয়ে এসেছিলুম মুরগুমা। রাতে মুরগুমার মোড়ে শুরু হয়েছিল রাতের আস্তানার খোঁজ (ঘুরতে ঘুরতে মুরগুমা)। মুরগুমা থেকে অযোধ্যা। এখানে চা বাগানের খোঁজ চলছে।

সুন্দরী মুরগুমা।

শুরুটা কিন্তু দুর্দান্ত হয়েছিল। হোম স্টে থেকে বেরিয়েই মুরগুমা বাঁধ। জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা সহজঝোরা। পাহাড়ের ওপর থেকে ছবির মতো আকাশ, জল, গাছগাছালি, টিলা দেখে আমাদের মন ভরে গিয়েছিল। তারপর তো ওই বুনো পথে টুকরো টুকরো কত না চিত্রকল্প। এক জায়গায় পাকা রাস্তার ওপর দিয়েই জল বয়ে যাচ্ছে। একটা নাছোড় ঝরনা। ওটাই ওর ভাললাগা পথ। আর আমাদের বাধ্যবাধকতার। গাড়ি নিয়ে পেরতে হবে সেই জলধারা। পেরলাম। আর দেখলাম, রাস্তার পাশে চান করছে দু’টি যুবক। তারা পাথরের ওপরে বসে। আরেকটা পাথরের ওপর রাখা তাদের সাবান, জালি।

বামনি ফলস, তুরগা ফলস ঘুরতে ঘুরতে, ছোট ছোট জীবন ছবি কুড়োতে কুড়োতে অযোধ্যা পাহাড়। বাসস্ট্যান্ডের দেওয়াল লিখন দেখে মাথায় ‘একটা বোধ ঢুকে গেল’। বাসস্ট্যান্ডের কাছের মাঠে ফুটবল খেলা চলছিল। কোনও টুর্নামেন্ট। মহিলা এবং পুরুষ, উভয়ের জন্যই। বেশ বড়সড় টুর্নামেন্ট। দেওয়ালে সাঁটানো পুরস্কার ঘোষণার পোস্টারেই টুর্নামেন্টের বহর বোঝা যায়। বিজয়িনীদের জন্য পুরস্কার ‘১৫-২০ কেজির জীবিত খাসি। সঙ্গে ২০০১ টাকা’ নগদ। বিজয়ীদের জন্য, ‘৪০-৪৫ কেজির জীবিত খাসি। সঙ্গে ১০০০১ টাকা নগদ’। কলকাতা শহরে হলে এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করা যেত না। করতে দিতেন না সোশ্যালাইট নারীবাদীরা। পুরস্কারে কী লিঙ্গবৈষম্য! জীবিত খাসি আর নগদ দু’টোতেই। সমানাধিকারের যুগে এই বৈষম্য চলতে দেওয়া যায়?

দ্রষ্টব্য লিখন।

পুরস্কারের পোস্টারের পাশেই দেওয়াল লিখন। তাতে অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের নাম এবং দূরত্ব। চোখে পড়ল চা বাগান লেখাটা। এবং সেটা কাছেই। তাহলে দেখে নেওয়া যাক। পাহাড়ে গিয়ে কবে চা বাগান দেখা হবে কে জানে! দলের সকলের একসঙ্গে ছুটি মিলবে না। সুতরাং…। তাছাড়া অযোধ্যাও তো পাহাড়। মিল হ্যাজ।

শুরু হল পদব্রজে যাত্রা। ঢালাই রাস্তা ধরে গাঁয়ের ভিতরের দিকে ঢোকা। গাছে ঘেরা ঝুপসি ঝুপসি বাড়ি। অনেক বাড়িতেই পেঁপেগাছ লাগানো। তাতে ছোটখাট কুমড়োর সাইজের পেঁপে ফলেছে। কলকাতায় কাটা ফলের দোকানে লম্বাটে পেঁপে থাকে। এগুলো গোলাকার। ঘন সবুজ। জাতের। মানে অভিজাত। সেসব পেরিয়ে একটা ঘেরা জায়গার সামনে পৌঁছলাম। একটা আশ্রম। বেশ ভিড়। বোঝা যায়, আশ্রমিকের পসার যথেষ্ট। একটু জানার ইচ্ছে ছিল, কী জাদুতে তিনি এত লোককে টানেন? কিন্তু ইন্দ্র দাঁড়াতে দিল না। ওর যুক্তিবাদী মনের অ্যান্টেনা তখন খাড়া হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য! ক্রাউড পুলারদের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে তো! আমি কি ওর মতো মহামানব?

অযোধ্যা পাহাড়।

আশ্রম পেরিয়েই রাইফেলের মুখোমুখি। একটা বাড়ির ছাদে সিআরপিএফ ক্যাম্প। এক জওয়ান রাইফেল উঁচিয়ে বসে। এলাকাটা আগে অশান্ত ছিল রাইফেলের কারণেই। বন্দুকের নল কীসের যেন উৎস। রাইফেল ঠেকাতে রাইফেল। এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। স্থানীয় এক পথচারীকে চা বাগানের সন্ধান জিজ্ঞাসা করতে তিনি নেতাজির মতো আঙুল উঁচিয়ে বলে দিলেন, ‘উই হুতায়।’ তাঁর আঙুলের দিকে চেয়ে দেখি, সেটা একটা জংলা পথের দিকে নির্দেশ করছে। বড় রাস্তা ছেড়ে টুপ করে নেমে পড়লাম ঘেসো জমিতে। তারপর ঢুকছি তো ঢুকছি, ঢুকছি তো ঢুকছি। কিন্তু চা বাগানের দেখা নেই। একটা দূর পর্যন্ত গিয়ে থমকালাম। তিনজনে কপালকুণ্ডলার নবকুমার হয়েছি বোধহয়। আমাদের কারও নাম নবকুমার হলে ঠিক একটা কপালকুণ্ডলা আবির্ভূত হতো। আর জিজ্ঞাসা করত, ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

পথে বহু চলাচল। কাচ্চাবাচ্চা, তরুণ, বৃদ্ধ, গৃহবধূরা দল বেঁধে কোথায় যেন চলেছে। আবার ভিজে কাপড়ে জমির আলপথ ধরে ফিরছে। বেশির ভাগের পরনের পোশাক যথেষ্ট মলিন। একজনকে দাঁড় করিয়ে গন্তব্য জানা হল। ওরা সীতাকুণ্ডে চান করতে চলেছে।

সীতাকুণ্ডের পথে।

সীতাকুণ্ড মানে বুড়বুড়ি। বাসস্ট্যান্ডের গন্তব্য নির্দেশক দেওয়ালে লেখা ছিল। প্রথমে গড়ধাম। তারপর সীতাকুণ্ড। বন্ধনীতে বুড়বুড়ি। আসলে ওই জায়গাটায় একটা পুরনো গড় ছিল। তার কাছেই একটা পুকুর। মাটির নীচ থেকে জল উঠছে। ওই পুণ্যিপুকুরে চান করতে চলেছে দলকে দল। চান করে বিশাল একটা করম গাছকে প্রণাম করে স্নানার্থীরা। জলে চান করলে নাকি রোগ নিরাময় হয়। একটা দলকে জিজ্ঞাসা করা হল, কোথা থেকে আসছেন? এক বৃদ্ধ জানালেন, যাদুগোড়া। শুভ নামটা চিনতে পারল। ঝাড়খণ্ডে। ওখানে ইউরেনিয়াম খনি আছে। অভিযোগ, খনি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে বাসিন্দাদের নানা রোগ হয়। ক্যানসারও। লোকের কতরকমের বিশ্বাস যে থাকে!

বিশ্বাসের কথায় মনে পড়ল, স্থানীয় লোকজন এই অযোধ্যাকেও সরযূ নদী তীরের অযোধ্যার সঙ্গে জুড়ে দেন। কথিত আছে, বনবাসের সময়ে রামচন্দ্র এখানে এসেছিলেন। সেইসময়ে সীতার জলতেষ্টা পায়। কিন্তু কোথাও জল নেই। রাম তখন মাটিতে তির মেরে জলধারা বের করেন। সেই জলধারাই এই সীতাকুণ্ড।

করম গাছ।

সীতাকুণ্ডের বুড়বুড়ি পরে দেখব। চা বাগানটা কোথায়? আবার জিজ্ঞাসা। আবার আঙুল। বুঝলাম, ভুল পথে এসেছি। নতুন করে শুরু করতে হবে। ফরাসি প্রবাদ বলে, ‘রেকুলে পুরো মিয়ো সোতের’। বাংলায়, ‘ভাল করে লাফ দেওয়ার জন্য পিছিয়ে আসা’। জ্ঞানী ভাবার কোনও কারণ নেই। মুজতবা আলি থেকে টোকা।

প্রবাদ মেনে আবার বেরিয়ে রাস্তায় উঠলাম। আবার জিজ্ঞাসা। আবার কিছুটা ঢুকে বেরিয়ে আসা। কিন্তু বাগানটা আর কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় রাস্তার পাশে একটা বাড়ি। ঝুপসি মতোই। ঢোকার মুখে একটা পেঁপেগাছ। সেই বড় বড় পেঁপে। দু’চারটে মুরগি চরছে উঠোনে। দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। আর পথচলতি কাউকে জিজ্ঞাসা না করে ওই বাড়ির লোককে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা। এক মহিলা স্থানীয় টানে যা বললেন তাতে মনে হল, আমরা পথ ভুল করেছি। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে হবে।

ততক্ষণে আমরা দলে ভারী হয়েছি। চা বাগান দর্শনেচ্ছু দু’জন তখন আমাদের সঙ্গী হয়েছে। পিতা-পুত্র। নাবালকটি ক্লাস সিক্স সেভেন হবে হয়তো। দু’জনে হন্য হয়ে চা বাগান খুঁজেছে, আমাদের মতোই প্যান্টসে চোরকাঁটা মেখেছে। কিন্তু সন্ধান না পেয়ে আরেক ব্যর্থ দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ছিলাম তিন। হলাম পাঁচ। হাঁটা শুরু হল। দু’ধারে ঝোপঝাড়। মাঝে ঢালাই রাস্তা। তার কোন ফাঁকে যে চিচিংফাঁকের মতো চা বাগানের পথ লুকিয়ে! মন্ত্রটা যদি জানা থাকত! যেতে যেতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ছ’টি খুদের সঙ্গে। মেয়েগুলো জঙ্গল থেকে কাঠ মাথায় নিয়ে ফিরছে। চারজনের গায়েই স্কুলের পোশাক। বাড়িতে পরার আলাদা পোশাক বোধহয় বাড়ন্ত। দুনিয়াটা ভারী আশ্চর্যের। আমাদের সঙ্গেই এক খুদে বাপের সঙ্গে সেজেগুজে সফরে বেরিয়েছে। হাতে ক্যামেরা। আর এই ছয় খুদে তেল-নুন-লকড়ির খোঁজে রাস্তায়। জওয়ানের রাইফেল, বিপ্লবীদের বাড়বাড়ন্ত আর কাঠ মাথায় খুদেরা— একটা সমীকরণ মাথায় ঘোরাফেরা করছিল। তবে মেলাতে পারিনি। অঙ্কে আমি ভারী কাঁচা। বরাবর।…

জীবনের পথে ছয় বালিকা।

বেশ কিছুটা যাওয়ার পর প্রায় জোর করেই রাস্তা ছেড়ে ডানহাতি জমিতে নেমে পড়লাম। আলপথ পেরিয়ে, জঙ্গল ফুঁড়ে চা বাগানে উপস্থিত হব। আন্দাজেই। জোর প্রতিজ্ঞা। কারণ রাস্তায় জিজ্ঞাসা করার আর লোক মিলছে না। কিছুটা গিয়ে একটা পুকুর চোখে পড়ল। তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ বিচিত্র চিৎকারে একটা বাচ্চা ছেলে এসে পুকুরে ঝাঁপ দিল। এই জঙ্গলে বাড়ি আছে! ঝোপঝাড় ভেদ করেও তো কিছু চোখে পড়ছে না। এটা তো নিশ্চিত, বাচ্চা আছে মানে তার মা-বাবাও আছে। জিজ্ঞাসা করার কেউ তো মিলল। বাচ্চাটার দিকে চেয়ে আমরা হাঁক পাড়লাম, ‘উঠে আয় বাবা, উঠে আয়।’ প্রথমে পাঁচজনের দলটাকে একটু সন্দেহের চোখেই দেখল সে। একটুখানি দ্বিধা। আমরা ওর দিকে খানিকটা এগোলাম। ভরসা পেয়ে বাচ্চাটা উঠে এল।

চা বাগান? বাচ্চাটা আঙুল উঁচিয়ে দেখাল, ‘উইখানে।’ না, এবার আর আঙুলে ভুলছি না। ব্যাটাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। সঙ্গী ভদ্রলোক মিহি করে বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে গিয়ে একটু দেখিয়ে দিবি?’ ছেলেটা রাজি হল। ভিজে এবং আদুল গায়ে, খালি পায়ে আমাদের সঙ্গে চলল। চা বাগানের নেশা এমন চেপে ধরেছে যে লোকের ফসলের ক্ষেতের ওপর দিয়ে হাঁটছি, হুঁশ নেই।

আসবে কী আসবে, আমাদের গাইডের দ্বিধা।

কিছুটা এগনোর পরেই এক মহিলার চিৎকার। কী বললেন উনি বুঝতে পারিনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল ছেলেটা। বুঝলাম, ছেলেটার মাতাজি। একটা অচেনা দলের সঙ্গে ছেলে চলে যাচ্ছে দেখে কোন মায়ের আশঙ্কা হয় না? আরেকটু এগোতে চিৎকারের মাত্রা বাড়ল। বুঝলাম, চা বাগানের গাইডকে আর ধরে রাখা যাবে না। ওর কাছ থেকে ভাল করে বাগানের অবস্থানটা বুঝে নিলাম। কিন্তু সেই আঙুলের খেলা, ওই হোতায় আর হোতায়। এত জঙ্গলে ওর দিকনির্দেশ কোনদিকে কী করে বুঝব! মোটামুটি একটা জায়গা আন্দাজ করলাম। ধরে নিলাম, ওই জায়গাটাই ও দেখাচ্ছে। বালকটিকে গাইডেন্সের মূল্য হিসাবে কিছু দেওয়া হল। মূল্যবান ছেলেটা মায়ের ডাকে সাড়া দিতে দিতে হরিণের গতিতে জমি-আলপথ ধরে ছুট লাগাল।

তবে খুদে গাইডের পথনির্দেশও কাজে এল না। বাচ্চাটার দেখানো জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম। কোথায় চা বাগান! প্রচণ্ড গরমে বেদম হয়ে পড়েছি। আজকেই এখানে আসার আগে নীল জলের লেক দেখতে গিয়ে দমহারা হয়েছিলাম তিনজনে। লেকটা বেশ নীচের দিকে। নামার সময় তো কষ্ট নেই। ওঠার সময়ে হাঁটু খুলে যায় যায়। হৃদপিণ্ডটা বুকের খাঁচা ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে আরকী! এমনিতে কী আর লোকে বলে, মানুষের নামতে কষ্ট নেই। উপরে উঠতেই হেব্বি ঠ্যালা! এখানে আবার সেই কষ্ট। এবার কাকে জিজ্ঞাসা করব? এতটা পথ ফিরে যাওয়া মুশকিল। এগনো যাক। ঝোপঝাড়ের শুড়িপথ পেরোতেই একটা মোষের মুখোমুখি। না, না বুনো নয়। শ্যামল মুড়া মোষ চরাচ্ছে। দু’টো মোষ তার। একটা একটু দূরে ঘাস খাচ্ছে। আরেকটা আমাদের পথ আটকে মাথা উঁচু করে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে। শ্যামল অভয় দিল, ‘কিছু করবে না।’ কিন্তু আমাদের এগোতে সাহস হল না।

নীল জলের লেক।

ঠিক সেই সময়েই শুড়িপথ ফুঁড়ে বেরলো আমাদের সফরসঙ্গী খুদেটি। তাকে দেখেই মোষটা ব্যাক গিয়ার। তারপর ছুট। কী লজ্জা! মোষটা আমাদের পাত্তাই দিল না? বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর হাতে একটা লাঠি। জঙ্গল ঝাপটে এগোবে বলে কোথা থেকে ভেঙেছিল। সেটা দেখে মোষটা ভয় পেয়েছে। শ্যামল মুড়ার হাতেও লাঠি। আরও একটা জিনিস বুঝলাম। আমরা ঘুরেফিরে সেই স্টার্টিং পয়েন্টে এসে হাজির হয়েছি। বুঝতে না পেরে এখান থেকেই ফিরে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠেছিলাম। একটু দূরেই সীতাকুণ্ডে যাওয়া-আসার দল দেখা যাচ্ছে।

শ্যামল মুড়াও আঙুল তুলে দেখাল। ওই তো…আবার হোতায়? একটা তরতাজা, স্বাস্থ্যবান তরুণের মোষ চরানো জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে চা বাগানের দিকে এগোলাম। এবারেও হয়তো জায়গাটা চিনতে না পেরিয়ে যেতাম। কিন্তু ইন্দ্র হঠাৎ ‘এই তো এই তো’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। এটা চা বাগান! ঝোপঝাড়ে ভরা জায়গা। তার মাঝে বড় বড় কিছু গাছ। একটা পাতকুয়া আছে দেখলাম। এই দেখার জন্য এতক্ষণ ধরে ‘কত দূর আর কত দূর’ করলাম?

চা বাগানের আবিষ্কারক।

মাথাটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হল। তখন বোধগম্য হল, এখানে সরকার বা কোনও সংস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষের চেষ্টা করেছিল। বড় বড় গাছগুলো আসলে বাগানের শেড ট্রি। পাতকুয়োটা চা গাছে জল দেওয়ার জন্য। জলের পাইপলাইনও চোখে পড়ল। বাঁকুড়ার তালডাংরায় আঙুর ফলিয়ে কৃষিবিজ্ঞানীরা সফল হয়েছেন। কিন্তু এখানে এত আয়োজন ব্যর্থ। এলাকাটা লোকমুখে চা বাগান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু বাসিন্দারা চা বাগানের আগে পরিত্যক্ত, ব্যর্থ, শব্দগুলো বসাতে ভুলে গেছেন।

আর চা বাগান শুনে আমরা কত কিছু ভেবে নিয়েছি। ভেবেছি, জায়গাটা নিশ্চয় জমজমাট হবে। কুলিলাইন, পিঠে পাতা তোলার ঝুড়ি নিয়ে লেপচা বা ভুটিয়া বা মদেশীয় নারী। ভেসে আসবে মাদল সহযোগে চা বাগানের গান। ‘ধনরাজ তামাং’ বা ‘চামেলি মেমসাব’এর মতো। কোথায় কী! এ যে চা বাগানের মহেঞ্জোদড়ো!

ধনরাজ তামাং (পাল)।

কী আর করা! সেই মহেঞ্জোদড়োতে রাখালদাসের বদলে দীপক দাস ঢুকল। ফটোসেশন চলল। শুভর আবার চা পাতা তোলা শ্রমিক হওয়ার সাধ হল। সেই পোজে ছবি তুলতে বাধ্য করল। ব্যাগে ভরলাম বেশ কিছু পাতা। ইচ্ছে ছিল মঙ্গলবারের আড্ডায় ওই চা পাতা দিয়ে তৈরি চা পরিবেশন করা হবে। নিজস্ব ঘরানার গ্রিন টি। সেই মতো ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়েছিল পাতা। কিন্তু পাতায় কেমন যেন বুনো গন্ধ। গোটা ফ্রিজ সেই গন্ধে গোকুল হয়ে উঠেছে।

কেউ আমাদের সংগ্রহের পাতায় তৈরি গ্রিন টি খেতে রাজি হল না।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *