পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

দল বেঁধে দলমায়

ইন্দ্রজিৎ সাউ

‘চল দলমা যাবি।’ হঠাৎই প্রস্তাব সুব্রতর। নতুন বছর শুরুর চারদিন আগে।

কোথায় যাবি, কীভাবে যাবি, আর কে কে যাবি? আমার হাজারো প্রশ্ন। তার আগে দলমার নাম শুনেছি মাত্র। শুনেছি মানে পড়েছি। খবরের কাগজে প্রতি বছরই তো খবর হয়, দলমার দামালেরা ঢুকে পড়ে বাঁকুড়া, মেদিনীপুরে। হাতি…হাতি!

তবে দলমার হাতি দেখার উত্তেজনার থেকে বেশি চিন্তা হচ্ছিল সুব্রতর শরীরের অবস্থা নিয়ে! প্রায় দেড় বছর হল ওর ডায়ালিসিস চলছে। দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। উপযুক্ত ডোনারের অভাবে প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে না। ছেলেটার মনের জোর দেখে অবাক হয়ে যাই। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুই পারবি এই অবস্থায় পাহাড়ে উঠতে?’ আমাকে এক প্রকার তুড়ি মেরে উড়িয়েই দিল। বলল, ‘তুই না গেলে কি আমি যাব না? আর পুরো রাস্তা গাড়িতে যাব হাঁটার কোনও ব্যাপার নেই।’ দীপকদা কথায় কথায় আমাকে গোঁয়ার বলে থাকে। সেই আমিও সুব্রতর কাছে ফেল। এমন প্রাণশক্তির কাছে হেরেও সুখ।

জঙ্গলের পথ।

৩০ রাতে আমাদের সফর শুরু হল। গাড়িতে উঠেই তো মেজাজ গেল বিগড়ে। সেভেন সিটের গাড়িতে ন’জন। ড্রাইভারকে ধরলে দশজন। কথা ছিল টাটা সুমোয় আমরা মোট আটজন (ড্রাইভারকে ধরে) যাব। জানা গেল, আমাদের ড্রাইভার রাজার টাটাসুমো ব্রেকডাউন করাতেই ছোট গাড়ি আনতে হয়েছ। কী আর করা! যেতে তো হবেই। ফেভিকলের অ্যাডের সেই বিখ্যাত গাড়ির মতো আমরা একে অপরের গায়ের সঙ্গে সেঁটে বসলাম। গেট বন্ধ করতে শিলু মানে আমাদের শিলাদিত্যকে মিন্টুদার কোলে উঠতে হল। ট্রাভেরা নড়ে উঠল শুরু হল যাত্রা।

কিন্তু পথে যে অপেক্ষা করছে বিপত্তি। গাড়ির ভিতরে ঘন হয়ে বসে থাকা যাত্রী। গাড়ির বাইরে ঘন কুয়াশা। এতটাই ঘন যে মাঝে মাঝে এক হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। ধীরে, কখনও অতি ধীরে প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টা পর ন্যাশন্যাল হাইওয়ে ১১৬ এ উঠলাম। ড্রাইভার চোখ বড় বড় করে রাস্তা দেখছিল।

দলমার পাহাড়ে মন্দির। নীচে পর্যটকদের গাড়ির মেলা।

এতক্ষণে কুয়াশা থেকে মুক্তি। রাত ১.৪৫। কোলাঘাট। খাওয়াদাওয়া সারা হল সেখানেই। কোলাঘাট থেকে গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল একে অপরের পেছনে লাগা। তপনদা অসিতদাকে খোঁচা মেরে বলল, ‘একটু সরে বস না, তুই তো সব জায়গা নিয়ে বসে আছিস।’ আমি কোনওরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের অবস্থানটা দেখলাম। অসিতদার পাশে গৌতমদা উঠে থেকেই আলুর বস্তার মতো লাট খেয়ে পড়ে আছে। আর সাধন সিট থেকে এগিয়ে গেটে সেঁটে বসে আছে। তা সত্ত্বেও অসিতদা সাধনকে বলে চলেছে, ‘সাধন তুই একটু সর না! তোর কেন বেশি জায়গা লাগবে?’ ওদের মধ্যে সাধনই একটু যা রোগা। ওরা থামতেই মিন্টুদা শুরু করল, ‘বাবা শিলা, তোমার কোনও অসুবিধা হলে তুমি আমার দিকে সরে আসবে ইন্দ্রর যেন না কোন কষ্ট হয়।’ পিছন থেকে আওয়াজ এল, ‘বাবা শিলা নাকি মা শিলা?’ মিন্টুদার পাশে দুলালদা। সুব্রত সামনে। বেলদা, খড়্গপুর, ঝাড়গ্রাম পেরিয়ে আমরা ঝাড়খণ্ডে ঢুকলাম।

সুব্রত আর শিলাদিত্য।

এখান থেকে শুরু হল ডাইভারশন। পুরনো রাস্তা ভেঙে নতুন ওয়ান ওয়ে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। গাড়ি তো চলল হেলতে দুলতে। মাঝে বেশকয়েক জায়গায় থামতে হল বেঁকে যাওয়া কলকব্জা সোজা করার জন্য। ঘাটশিলা, জামশেদপুর পেরিয়ে দলমা যখন পৌঁছলাম তখন বাজে সাড়ে ৭টা। নেমেই বড় ধাক্কা আমাদের অনভ্যস্ত চোখে। দেখলাম, এক জায়গায় ছাগল কাটা হচ্ছে। সবাই তো যারপরনাই আনন্দে, মাংস নেওয়া হবে। কিন্তু কাছে গিয়ে মাংস কাটা দেখে সকলেরই খাওয়ার ইচ্ছেটা উবে গেল। এখানে ছাগল কাটার পদ্ধতিটাই আলাদা। হাওড়া-কলকাতায় ছাগলের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তারপর মাংস বিক্রি হয়। এখানে ছাল ছাড়ানোর কোনও বালাই নেই। শুধু গলাটা কাটা হয়েছে। ছাল থেকে শুধু লোম চেঁছে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা যে ভাবে সেলুনে দাড়ি কাটি সেই ভাবে। এমন কী রক্তটা একটা বাটিতে ধরে রাখা আছে। শুনলাম, জমাট বেঁধে গেলে ওটাও বিক্রি হবে।

বনের বাঁদর।

আসার সময় লক্ষ্য করেছি, জায়গাটা পুরো আদিবাসী অধ্যুষিত। খুবই গরিব এলাকা। সুব্রত বলল, ‘কী করবে এরা? এতই গরিব যে মাংসের কিছুই ফেলে না।’ আমার মনে পড়ছিল ডিসকভারি চ্যানেলে দেখা আফ্রিকার মরুভূমিতে বসবাসকারী বুশম্যানদের জীবন। একটা হরিণ শিকার করলে তার কিছুই ফেলে না ওরা। রক্ত গায়ে মাখে। খায়। বাদ দেওয়াটা যে বিলাসিতা সেটা চোখের সামনে দেখতে পেলাম।

কিন্তু আমাদের মাংস খাওয়ার কী হবে? আমাদের মঙ্গলবারের আড্ডায় ফিস্ট করে মুরগির ছাঁট খেয়েছি। ছাল-নাড়িভুঁড়ি, পা, সব। কিন্তু ছাল সমেত ছাগলের মাংসে একটু চাপ লাগছিল। স্থানীয় একজনের কথায় জানতে পারলাম, সামনেই একটা বাজার আছে। প্রত্যেক রবিবার দুপুর ২টো থেকে ওখানে হাট বসে। কিন্তু হাটে গিয়েও বিশেষ লাভ হল না। ১২টার আগে মুরগি কাটা হবে না। শুধু ডিম কেনা যেতে পারে। ডিমই সই।…

দলমা পাহাড় ৩০৬০ ফুট উচ্চতার। পাহাড়ে যাওয়ার পথে একটা গেট তৈরি হচ্ছে। দলমার শুরু সেখান থেকেই। পাহাড় চুড়ো পর্যন্ত মোট উনিশ কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তা কিছু জায়গায় ঢালাই হচ্ছে। কিছু জায়গায় পাহাড়ের নুড়ি-পাথর ফেলা। চললে মোরামের মতো অনুভূতি। হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ ছাড়াও বেশ কিছু প্রাণী রয়েছে এই পাহাড়ের জঙ্গলে। ভীষণ নির্জন। পর্যটকদের খুব একটা ভিড় হয় না। এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। চারিদিক ঘন গাছগাছালিতে ভর্তি। অসম্ভব শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। লোকালয় ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন পাখির আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। আমরা চেক পোস্টে ১৫০ টাকা দিয়ে পাস নিয়ে এগিয়ে চললাম।

কাঠ কেটে গ্রামে ফেরা।

যত উপরে উঠছি জঙ্গল ততই ঘন হচ্ছে। ঘন গাছপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে প্রবেশ করছে। ঘন জঙ্গলে কিছুটা উঠেছি হঠাৎ দেখি, একটি হরিণ নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাচ্ছে। নিমেষের মধ্যে উধাও। ক্যামেরা বের করা তো দূরের কথা। চোখের পলক ফেলার আগে অদৃশ্য। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লাম। যদি বাকি দলটা দেখা যায়। কিন্তু কোনও চিহ্ন নেই। ওই ব্যাটা বোধহয় লেট লতিফ ছিল।

মনোরম প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে আমরা পাহাড়ের মাথায় পৌঁছলাম। রান্না চাপানো হল। সবচেয়ে অবাক হলাম, এত উঁচুতেও জলের পাতকুয়ো দেখে। কী সুস্বাদু জল। খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ করে বিকেল ৪টের মধ্যেই আমরা ওখান থেকে রওনা দিলাম। যদিও দলমায় রাত কাটানোর পরিকল্পনা করেই গিয়েছিলাম। কিন্তু জায়গা মেলেনি। বন বিভাগের দু’টো বাংলো আছে। কিন্তু সেগুলো রাঁচির ডিএফও অফিস থেকে বুক করতে হয়। স্পষ্ট বুকিং হয় না।

ময়ূরী আর মালকিন।

ফেরার সময় দেখলাম, সাঁওতাল রমণীরা কাঠের বোঝা নিয়ে ফিরছে। নামার সময় কয়েক জায়গায় থামতে হল। এতই মনোরম দেখাচ্ছিল উপর থেকে নীচে এবং আশেপাশের ঘন সবুজ ঘেরা পাহাড়। বড় রাস্তায় নামতে দেখি, ময়ূর চড়ে বেড়াচ্ছে। ভাবলাম, জঙ্গলের ময়ূর। কিন্তু হঠাৎ দেখি, সে হাঁটা লাগাল। গিয়ে দাঁড়াল মালকিনের কাছে। ময়ূর নয়, আসলে সেটা ময়ূরী। তার আগে অবশ্য বেশ কিছু হরিণ দর্শন হয়ে গিয়েছে। তবে সবই হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের। ঘেরাটোপের হরিণ। ডাকলে হাতের নাগালে এসে আদর খেয়ে যায়।

হরিণ প্রজনন কেন্দ্র।

ফটোসেশন চালাতে চালাতে চললাম আদিবাসীদের হাট দেখতে।

ছবি- লেখক

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *