সুপ্রতিম কর্মকার
জীবন আসলে যাপনের চিত্র। যাপনের সঙ্গে যুক্ত থাকে জীবন ধারণ। আর সেই জীবন ধারণের এক একটি সোপান নির্মাণ করে জীবনের বিকাশকে। ঠিক যেন এক সূত্রে গাঁথা এক মালা; জীবন ধারণ, জীবন যাপন, জীবন বিকাশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের পড়াশোনার বাইরে যখন নদী পাড়ের মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন শিখলাম জীবনের এক সহজ পাঠ। যে সহজ পাঠে সহজ সরল ভাষায় নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, এই প্রকৃতিটা আমার পাঠশালা। আমি ছাত্র। আর নদী পাড়ের সাধারণ মানুষেরা আমার শিক্ষক। ভাবনার বাস্তবতাকে ছুঁলাম, বলা ভাল শিহরণ জাগানো স্পর্শ পেলাম। কীভাবে? তা বলতেই তো এতগুলো কথার অবতারণা।
‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র সঙ্গে পরিচয়টা নেহাতই কমদিনের নয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাতে হাত ধরে সৃষ্টিসুখের উল্লাসের মতো প্রকৃতিকে খোঁজার উল্লাস পেতে এক সঙ্গে পথ হাঁটলাম। ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮ সালের মঙ্গলবারের শীতের দুপুরবেলার উষ্ণতাকে গায়ে মেখে। যেরকম করে আতরের গন্ধ মাখতে ভালবাসে সৌখিন মানুষেরা। অবশ্য বলে নেওয়া ভাল, সৌখিনতার দিক থেকে নেহাতই ছাপোষা আমি। তবে হৃদয়ের ভালবাসায় যে জায়গাটা বারবার ছুঁয়ে যায় তা হল নদী।
চার চাকা গাড়ি ছুটল। ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। মাইকের তারস্বর চিৎকার। তার মধ্যেই পথ খুঁজে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া গন্তব্যে। জায়গাটা হাওড়ার ডোমজুড়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দর্শনের মতো আমি এবং কয়েক-এক-জন। ‘যথা ইচ্ছা’র সদস্য শুভ, ইন্দ্র আর দীপক।
বাংলার ছোটবড় নদী বাংলার ইতিহাস রচনা করে। এই শিক্ষা দিয়েছিলেন ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’এর রচনাকার নীহাররঞ্জন রায়। উত্তরবঙ্গের তুরতুরি হোক বা দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবনের কাছে দুর্গাদুয়ানি। এরা সবাই বাংলার ভূগোলকে ভেঙেছে ও গড়েছে। ডোমজুড়ের সরস্বতীও এই একই কাজে ব্রতী ছিল। ভাগীরথীর মূল স্রোতধারা একসময় সরস্বতীর পথ ধরেই সাগরে মিলত। কোলব্রুক সাহেবের মানচিত্রেও সরস্বতীর ধারাটি স্পষ্ট। কিন্তু চোখের সামনে যখন সরস্বতীকে দেখলাম তখন শরীরটা গুলিয়ে উঠল। মাথাটা বনবন করে ঘুরে উঠল। পূতগন্ধময় একটা মৃত শরীরের সামনে যেন আমাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নদীর শরীরটাকে খাবলে খাবলে খেয়েছে মানুষেরা। নদীর জীবন মানে নদীর জল। আর সেই জল ছুঁতেই ঘেন্না লাগল। তবুও আগ্রহের টানে বাঁ হাতের বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙুল দু’টো চিমটার মতো করে আমার বুক পকেট থেকে বের করে আনল ph পেপার। গেরুয়া রঙের পেপারটি সরস্বতীর জল ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে ফেলল রং। বিষাক্ত জলের স্পর্শে ph পাওয়া গেল ৮। অর্থাৎ এ জল জল নয়। নদীর বুকে বয়ে চলা ক্ষারের স্রোত।
কঙ্কালসার নদীটার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায় ইন্দ্র আর শুভ। পাশ থেকে মাঝারি বয়সের একহারা চেহারার একটা মানুষ ঝুপ করে এসে পড়েন। ঠিক যেমন নদীর ধারে গোধূলির পরে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। চোখগুলো গর্তে বসা। আঙুলগুলো শীতের পরশে কুঁকচে গিয়েছে। পায়ে অপরিচ্ছন্ন বুট জুতো কালো রঙের। কিছু না বুঝবার আগেই প্রথম প্রশ্ন, ‘কে আপনি? কেন তুলছেন ছবি?’ তারপরে অযাচিতভাবেই বলে চলেন, ‘এক রাজনৈতিক মদতপুষ্ট মানুষের কীর্তিকলাপের গৌরচন্দ্রিকা। অবশ্যি সেটা নদীর নাকি নদীয়ালি মানুষের নাকি টাকার সে কথাটা হলফ করে বলবার বোধহয় পাঠকের কাছে প্রয়োজন নেই।
আর ভাল লাগছিল না ওখানে দাঁড়াতে। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে সটান পশ্চিমে। আমাদের গাড়ির চালক কৃষ্ণবর্ণের একহারা চেহারার বছর সাতাশের এক যুবক। নামটি বড় মিষ্টি, কালো। বড় মজার ছেলে সে। সরস্বতীর পুজোর পরের দিনে স্কুলের বাচ্চা মেয়েরা শাড়ি পরে দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাই দেখে কালোর উবাচ, ‘সব সরস্বতীগুলোকে একসাথে গাড়িতে তুলতে কেমন হয়, দাদা?’ কথা বলে নিজের দাঁত দিয়ে জিভটাকে ফুলকুঁড়ির মতো কেটে নিজেই বলে ওঠে, ‘বিয়ে করেছি। তাই আর জ্যান্ত সরস্বতীর দিকে নজর দেব না।’
সাপ লুডোর মতোন অনেক গাড়ি ও মানুষকে পাশ কাটিয়ে আমাদের গাড়ি গিয়ে থামল কৌশিকীর তীরে। জনপদের এক সমৃদ্ধশালী নদী। শিবানন্দবাটির কাছে কৌশিকীকে দেখে একটু মুগ্ধই হলাম। আমরা যারা নদীকে ভালবাসি বা ভালবাসার চেষ্টা করে চলেছি তাদের কাছে নদীর সংস্কার মানে জীবনের সংস্কার। বেঁচে থাকার রসদ।
রাজ্য সরকার থেকে কৌশিকী নদীটি সংস্কার করা হচ্ছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা ভাল, এই নদীটাই স্থানীয় মানুষেরা ডাকে কানা নদী বলে। শীতের দুপুরে নদীর পাড়ে লুঙ্গি পরে একটা প্রায় মাটি রঙের গেঞ্জি গায়ে পিঠে রোদ লাগাচ্ছিলেন ছাপ্পান্ন ঊর্ধ শ্রীকান্ত পাল। তিন পুরুষ ধরে কানানদীর পাশে তার বাস। বাবা ছিলেন সবজি বিক্রেতা। পেটের তাগিদে নদীর সঙ্গে সখ্য গড়া হয়নি তাঁর কখনও। আজ শ্রীকান্ত জরিশিল্পী। বিষণ্ণতার ছাপ ফেলা মুখে চোখের পাশের বলিরেখাগুলো তার স্পষ্ট। ১০ দিন কাজ করলে তার আয় হয় ২০০-২৫০ টাকা। শিবানন্দবাটি মহাশ্মশান উন্নয়নের কাজের জন্য নদী সংস্কার হলেও সেই সংস্কারকে সে ভাল চোখে নেয় না। নিজেকে আলাদা রাখতে চায় নদীর থেকে। নদী সংস্কার মানেই নদীর বুকে অনেক জল। বর্ষার সেই নদীর জলেই তার সংসার ভাসবে। তাই নদী যেন তার কাছে আহাম্মক।
দীর্ঘদিনের অধ্যাবসায়ের ফলে আমাদের পিতৃপুরুষেরা শিখেছিলেন, প্লাবন সেচ বা ওভারফ্লো ইরিগেশনকে। যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গেছেন নদী বিজ্ঞানী উইল কক্স। বন্যার সঙ্গে বেঁচে থাকার আমাদের সহজাত প্রবৃত্তিকে আমরা ক্রমশ মেরে ফেললাম। কারণ পশ্চিমী কৃৎকৌশলকে নিয়ে আমরা সভ্য থেকে অতি সভ্য হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে প্রতিযোগী হয়ে উঠলাম। আর এই ভাবেই হারিয়ে গেল প্রকৃতির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে আমাদের সখ্য-আমাদের মিত্রতা।
এখানে দেখা শেষ হল। কালো গাড়ি ঘুরিয়ে চলল আরেক নদীর খোঁজ নিতে।
ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ এবং সৌগত পাল
কভারের ছবি- সংস্কার হওয়া কৌশিকী বা কানা নদী। মুন্সিরহাট, শিবানন্দবাটি।
(সমাপ্ত)