দীপঙ্কর ঘোষাল
কাজের ফাঁকে ঘোরা! সে কী করে সম্ভব! কাজে ফাঁকি দিয়ে ঘোরা যায়। তবে কিনা ক্রিকেট ম্যাচ কভার করতে গিয়ে ফাঁকি দেওয়াটাও বেশ কঠিন কাজ। দক্ষিণ আফ্রিকার সেঞ্চুরিয়ানের পিচে ভারতীয়দের ব্যাটিংয়ের মতো। কেন? দেখা যাক বোঝাতে পারি না কিনা!
আমি বিছানাপ্রেমী। মানে সুযোগ পেলেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিই। ঘুম আসুক না আসুক, বিছানায় বসন্ত। চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবতেও বেশ লাগে। তৈরি করা ভাবনা হলেও ক্ষতি নেই। অ্যাসাইনমেন্টে বাইরে গেলে পুরোপুরি আলাদা। প্রতিটা মুহূর্তে কাজে মন। রাস্তার চারপাশ থেকে কপির জন্য কিছু বিষয় বেছে নেওয়া। দীপকদা’র সঙ্গে যখন এই লেখা নিয়ে কথা হল, একটা জিনিস বুঝে গিয়েছিলাম, আমার পক্ষে শুধুমাত্র ভ্রমণ কাহিনী লেখা সম্ভব নয়। তবে ডায়েরি লেখা যেতেই পারে। সেটাও আগোছালোভাবে। যাই হোক…।
ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে এখনও অবধি আমার চারটে সফর। বেঙ্গালুরু, ভাইজাগ, হায়দরাবাদ, কটক। ভ্রমণের জন্য কোনটা আদর্শ জায়গা জানি না। তবে আমার কাছে সেরা ভাইজাগ। কলকাতায় থাকলেও দীঘায় গিয়ে সমুদ্র দেখা হয়নি। জীবনের প্রথম সমুদ্র দেখা ভাইজাগেই। প্রথম সফর অবশ্য বেঙ্গালুরু। সংক্ষিপ্ত সফর। ভিআইপি’দের ‘ঝটিকা’ সফরের মতো। অচেনা শহরে যাবার আগে মানসিক প্রস্তুতি, অস্বস্তি, ধুকপুকানি সবই থাকে। পৌঁছে গেলে সব মেক-আপ হয়ে যায়। স্টেজে মেরে দেওয়ার মতো ব্যাপার।
শুরুটা করছি বেঙ্গালুরু দিয়ে। মাত্র তিনদিনের সফর হলেও স্মরণীয়। প্রথমত টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশ ঐতিহাসিক ম্যাচের সাক্ষী থাকতে পারা। দ্বিতীয়ত ‘দ্য ওয়াল’ দর্শন। ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ বিষয়ে গুগলে খোঁজ করলে সবচেয়ে বেশি যেটা নজরে পড়বে, তা হলো মুশফিকুর রহিমের দাঁত মুখ খিঁচোনো সেই ছবি কিংবা ভিডিও। সদ্য ভারতীয় ক্রিকেটের লাইম লাইটে আসা হার্দিক পান্ডিয়ার বলে বাউন্ডারি মেরে এই অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন। হার্দিক মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন। রাহুল দ্রাবিড়ের ছত্রছায়া থেকে আসা এবং দলে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ ধোনির সান্নিধ্য। হার্দিক মাথা ঠান্ডা রাখবেন সেটাই যেন স্বাভাবিক। ম্যাচটা শেষ অবধি ভারতই জিতেছিল। আমার কাছে ম্যাচের চেয়েও স্মরণীয় ‘দ্য ওয়াল।’
সম্প্রতি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত। পর্দার আড়ালে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কিন্তু রাহুল দ্রাবিড়। তাঁর দায়বদ্ধতা, শৃঙ্খলা, সহনশীলতা সম্পর্কে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে পড়ে। ক্রিকেট বিশ্বে ‘দ্য ওয়াল’ নামে খ্যাত। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে দ্রাবিড়ের সম্মানে তৈরি দেওয়ালটি ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অবশ্যই দর্শনীয় স্থান। দ্রাবিড়ের সমস্ত কীর্তি এই দেওয়ালে খোদাই করা। মানসিক অবসাদ কাটিয়ে দিতে পারে এই দেওয়াল। বছর কয়েক আগে দ্রাবিড়ের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। পুরো সাক্ষাৎকারটি মনে নেই। এক টুকরো অংশ ওই দেওয়ালের ইঁটের মতোই মনের মধ্যে খোদাই করা রয়েছে। সম্ভবত চাওয়া-পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্নের উত্তরে দ্রাবিড় বলেছিলেন, ‘ইফ দেয়ার ইজ নো হোপ, ইউ ক্যান ইনভেন্ট হোপ।’ কথাটা শুনতে হয়তো খুব সহজ, উপলব্ধি করতে পারলে জীবনটা আরও সহজ হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
আমার দ্বিতীয় সফর ভাইজাগ। এখানে বারবার যেতে বললেও সমস্যা নেই। ভাইজাগে যাওয়া ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট কভার করতে। ভাইজাগ স্টেশন। সকালের দিক। সব কিছুই ঠিকঠাক। নতুন সফরের রোমাঞ্চ। ট্রেন থেকে নামার পরই অস্বস্তিটা শুরু হলো। কি যেন বলেছিল ঠিকানাটা!। আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নেওয়া প্রয়োজন। কলকাতার সিনিয়র এক সাংবাদিককে ফোন করলাম। জানা গেল, আমাদের থাকার জায়গা হয়েছে আর কে বিচ (রামকৃষ্ণ বিচ), হলিডে হোমে। এইটুকু ঠিকানায় বোঝা মুশকিল। অন্তত আমার মতো আনকোরার কাছে। হোটেলে যোগাযোগের নম্বর দেওয়া হয়েছিল। কোনও এক সুরেশবাবুর। তাঁকেই ফোন করলাম। উনি বোঝালেন। আমি বুঝলাম না। স্টেশনে দাঁড়িয়ে দেরীর মানে হয়না। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোতেই প্রচুর অটো। ‘সাব, অটো চাহিয়ে। কাহা জায়েঙ্গে।’ চাই না যে তা নয়, তবে ভাড়া সম্পর্কে সবসময়ই খুঁতখুতানি থাকে বাইরে গিয়ে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়, লুটে নিচ্ছে। অটোওয়ালাকে ভাড়া জিজ্ঞাসা করতে বললেন, দেড়শো টাকা। আর কে বিচের কথা বলতেই, জানালেন, বিশাল বড় এলাকা, আরেকটু ভালো করে জানতে।
অটো চলতে শুরু করল, সঙ্গে আমার ফোন। গুগল ম্যাপ দেখেও নিখুঁত লোকেশন পাওয়া গেল না। ভরসা ফের সুরেশবাবু। নতুন তথ্য পাওয়া গেল। জায়গাটার নাম পাণ্ডুরঙ্গাপুরম। বড় একটা হোটেল (নামটা মনে পড়ছে না), তার কাছেই। কাছাকাছি পৌঁছলে খুঁজে নেওয়া যাবে। স্টেশন, ফ্লাইওভারের বহু চেনা রাস্তাগুলো পেরিয়ে তুলনামূলক কম যানজট রাস্তায় চলছে অটো। কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ কানে আসতে লাগল। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না তখনও। অটো সামনে এগোচ্ছে, শব্দটা বাড়ছে। আরও খানিকটা এগিয়ে রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমেছে। ঠিকানা খোঁজার তাড়া উধাও। সামনে ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য। যতদূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল। অটোওয়ালা ততক্ষণে আরও কাছে নিয়ে গিয়েছে।
টিভিতে, বহু সিনেমায় মেরিন ড্রাইভ দেখেছি। বন্ধুদের ছবি কিংবা ভিডিও অ্যালবামে দেখেছি দিঘা-পুরী। আমার প্রথম সমুদ্র দর্শন ভাইজাগে। অ্যাসাইনমেন্টের দিক দিয়েও ভাইজাগের ম্যাচ আমার কাছে সমুদ্র। একজন ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে টেস্ট খেলার। যতই টি-২০ কিংবা রঙিন ক্রিকেট থাকুক না কেন, টেস্টের আনন্দটাই আলাদা। গৌরবও। দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের মতো। সাংবাদিকদের কাছে টেস্ট কভার করাও তেমনি। ঘরের মাঠ ইডেনে ততদিনে টেস্ট অভিষেক হয়ে গিয়েছে। বাইরে প্রথম টেস্ট, তা-ও এমন মনোরম জায়গায়। অভাবনীয়। টেস্টে কতটা মন লাগবে সন্দেহ থেকেই যায়। চমকের আরও বাকি ছিল।
যাই হোক, অবশেষে আমাদের হলিডে হোম খুঁজে পেলাম। আদতে একটা বাড়ি। প্রথম তিন তলায় ফ্ল্যাট হিসেবে, চতুর্থ তলায় হোটেলের মতো ভাড়া দেওয়া হয়। চার তলায় চারটে ঘর, সামনে একটা বড় ব্যালকনি। সকালে পৌঁছে বাড়িটাকে একেবারেই ভাল লাগেনি। বাইরে এসে বাড়ির স্বাদ একেবারেই পছন্দ নয়। এসব ভাবার মতো সময় তখন ছিল না। দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে হবে। কলকাতা থেকে বাকিরা এলেই মাঠে যেতে হবে। আমাদের থাকার জায়গা থেকে মাঠের দূরত্ব অনেকটা। অটোতে ৩৫-৪০ মিনিটের কাছাকাছি।
দুপুরের কিছু আগে ঘর ছেড়ে স্টেডিয়ামের পথে রওনা হলাম আমরা তিনজন। অটোটা গলির রাস্তা থেকে এবার বড় রাস্তায়। সমুদ্র ও আমার সহাবস্থান। অটো এগোচ্ছে। ডানদিকে সমুদ্র। কিছুটা এগিয়ে পার্ক, হোটেল। আরও কিছুটা এগিয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য। সামনে পাহাড়। ডানদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা। তার ডানদিকে সমুদ্র। তার ডানদিকে ফের পাহাড়। আমাদের দেশের মধ্যে এমন অপূর্ব জায়গা রয়েছে! না এলে তো বঞ্চিত রয়ে যেতাম চিরকাল। একদণ্ড দাঁড়িয়ে যে দেখব তার উপায় নেই। থামার উপায় ছিল না। কলকাতা কপি পাঠাতে হবে। একটাই ভাল বিষয়, কপি রঙিন করতে বিষয়ের অভাব হবে না।
প্রথম দেখাতেই ভালো লাগতে বাধ্য ভাইজাগ ক্রিকেট স্টেডিয়াম। অনুশীলনের নেটগুলি স্টেডিয়ামের বাইরে। সামি, উমেশ যাদবরা বোলিং করছেন, পিছন দিকটায় দেখা যাচ্ছে একটা পাহাড়। স্টেডিয়ামের মূল গেটও বেশ সাজানো গোছানো। আমার যেমন অ্যাওয়ে টেস্টে অভিষেক তেমনি ভাইজাগ স্টেডিয়ামের এটি অভিষেক টেস্ট। কয়েক মাস আগেও হুদহুদ সাইক্লোনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই স্টেডিয়ামে। টেস্ট অভিষেকের সময় অবশ্য দেখে বোঝার উপায় ছিল না, এর উপর দিয়ে এত ঝড় গিয়েছে।
আমরা যে ঘরে জায়গা পেয়েছিলাম, সেই বিল্ডিংয়ে রান্নার ব্যবস্থা নেই। খাবারের জন্য সমু্দ্রের পাশে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেগুলো চোখ বন্ধ করে ভরসা করার মতো। খাবারে স্বাদও আছে, পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন আবার দামও খুব বেশি নয়। খাবার অর্ডার দিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে সৈকতে বসে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে হারিয়ে যেতে মানা নেই। পরদিন থেকে খাবার প্যাক করে রুমে আনা শুরু হল। এখানেও আনন্দটুকু খুঁজে নিতে সমস্যা হল না। ব্যালকনি থেকে দুটো বাড়ির মাঝ বরাবর একটা চার ফুটের ফাঁক। সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ার শব্দ শুধু শোনাই নয়, দেখাও যেত। রাত গভীর হলে, বসতির চাঞ্চল্য কমলে ঢেউয়ের আওয়াজের তীব্রতা বাড়ত।
ভগবানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয়। কেউ কারও সঙ্গে দেখা করি না। কখনওসখনও বাধ্য হয়েই দেখা করতে হয়। প্রার্থনায় অরুচি নেই আমার। টেস্টের তৃতীয় দিন থেকেই প্রার্থনা শুরু হল তাই। পিচের পূর্বাভাস ছিলো, দ্বিতীয় দিন থেকেই বল ঘুরবে। মনে মনে হিসেব কষতে শুরু করলাম। বল ঘুরবে, জাদেজা-অশ্বিন ইংরেজ ব্যাটসম্যানদের ক্রিজ ছাড়া করবে, চারদিনেই ম্যাচ শেষ। আমরা স্বাধীনতা পাব। বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস নিয়ে আরাকু ভ্যালি বেড়াতে যাব। ট্রেনের টিকিট নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। ভাইজাগ স্টেশনের জনসংযোগ আধিকারিকের সঙ্গে ততক্ষণে আমি সংযোগ স্থাপন করে ফেলেছি। তাঁকে অনুরোধ করলে নিশ্চিত কাজ হবে। সব প্রার্থনার ফল মেলে না। ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই ভাল খেলতে শুরু করলেন। কিছুদিন আগে আইপিএলের নিলামে সবচেয়ে বেশি দাম পাওয়া বেন স্টোকস ছিলেন নাটের গুরু। ম্যাচ পঞ্চমদিন গড়াল। আরাকু ভুলে, কপি লেখার লড়াকু মানসিকতা তৈরি করতে শুরু করেছি। পঞ্চম দিন মধ্যাহ্নভোজ অবধি ম্যাচ শেষ হওয়ার নামগন্ধ নেই। গাছাড়া ভাব নিয়ে ম্যাচ দেখছি। মধ্যাহ্নভোজের পর ঝপাঝপ উইকেট পড়তে শুরু করল। দেড়টার মধ্যে ম্যাচ শেষ। না ইধার কা, না উধার কা।
ফেরার টিকিটও ট্রেনের থাকলেও শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলে বিমানে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত। সকালে ঘন্টাখানেক বাড়তি সময় থাকায় কাছেই ঋষিকোন্ডা বিচে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। আধ ঘণ্টার জন্য বিচে কাটাতে যাওয়া। সকাল তখন ৮-৯টা। স্থানীয় কয়েকজন ছাড়া বাড়তি কোনও লোক নেই। পোজ দিয়ে কয়েকটা ছবি তোলা, চারপাশটা দেখে নেওয়া। প্রথম সমুদ্র হলেও অনলাইনে দেখা মালদ্বীপের সমুদ্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। বিমান থেকে ভাইজাগের সমুদ্র আরও মনোরম লাগে। আমার অন্তত লেগেছে। বিমান উঁচুতে উঠতে শুরু করলে ধীরে ধীরে সমুদ্রটা পরিণত হয় নীল রাস্তায়। সুযোগ পেলে বারবার ‘ভাইজাগে ভবঘুরে’ হতে আপত্তি নেই।
বাকি দু’টো সফরে সময় আরও কম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, হায়দরাবাদে পেট পুরে বিরিয়ানি খাওয়া এবং কটকের ছানাপোড়া। ও হ্যাঁ, প্রবাল নামের একটি রেস্তোরাঁয় পাঠার মাংস খুব ভালো করে। কচি পাঠার ঝোল, গরম ভাত, সবমিলিয়ে ১৬০ টাকার মতো।
ছবি—লেখক
কভারের ছবি— চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে রাহুল দ্রাবিড়ের সম্মানে তৈরি দেওয়াল।
(সমাপ্ত)