দীপক দাস
দেখা হয়েছিল অনেকবার। প্রথম দেখা বোধহয় ১৯৯৫ সালে। তখন একাদশ শ্রেণি। কিন্তু চিনতে পারিনি তাঁকে! চিনব কী করে? তখন যে সিনেমা দেখার তাড়া। কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখতে চলেছি দল বেঁধে।
উচ্চমাধ্যমিকের পরে চেনা উচিত ছিল। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস খুঁটিয়ে কে পড়েছে তখন! সবই তো সাজেশন। একটা বড় প্রশ্ন লিখতে হতো। চর্যাপদ আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে থেকে। আমাদের বেলায় বোধহয় চর্যাপদের পালা ছিল। সেটাই পড়ে গিয়েছিলুম। লুই পাদ, কাহ্ন পাদ। বাদ পড়ে গিয়েছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম শক্তিশালী কবি শাহ গরিবুল্লাহ।
চিনতে না পারার পুরো দোষটা আমাকে দিলে মুশকিল। প্রথম দোষটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার। সিলেবাসে থাকলেও আমাকে পড়িয়ে নিতে পারেনি পরীক্ষা ব্যবস্থা। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকস্তর পর্যন্ত। অথচ আমি বাংলার ছাত্র। এমএ ক্লাসেও গরিবুল্লাকে চিনতাম কিনা কে জানে। নেহাতই ‘ইউসুফ জোলায়খা’ আমাদের পাঠ্য ছিল তাই। নম্বর পেতে হবে বলে পড়া। আর তখনই জানতে পারলুম, গরিবুল্লার বাড়ি বলতে গেলে আমাদের বাড়ি থেকে ‘দুই পা ফেলিয়া’।
দ্বিতীয় দোষটা আমার বন্ধুদের। তারাও পড়াশোনা করে না। এবং নিজের এলাকা সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল নয়। সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময় ওই জায়গাটা বেশ টানত। মনে রাখার মতো পরিবেশ। কাছাকাছি এলাকার দু’একজন সহপাঠীকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। তাদের উত্তর, এটা একটা মাজার। এখানে কার্তিক মাসে উরুস হয়। খুব ভিড় হয় আর দেশ-বিদেশ থেকে লোক আসে।
আমাদের চিনতে না পারা এবং লোকজীবন থেকে কবি গরিবুল্লাহের পরিচয় মুছে যাওয়ার পিছনের একটা বড় কারণ কিন্তু এটা। ধর্মপ্রচারক গরিবুল্লাহের বেশি প্রচার হওয়া।
গরিবুল্লাহর পরিচয় দেওয়া যাক। মধ্যযুগে কবিরা একধরনের সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন। যাকে কিসসা সাহিত্য বা প্রণয় কাব্যোপাখ্যান বলা যায়। এই কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন গরিবুল্লাহ। ‘ইউসুফ জোলায়খা’, ‘জঙ্গনামা’, ‘সোনাভান’, ‘আমির হামজা’, ‘সত্যপীরের পুঁথি’ এই ধরনের কাব্য। যাঁর নিবাস ছিল জগৎবল্লভপুর ব্লকের হাফেজপুর গ্রাম। হাফেজপুর পাতিহাল গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। গ্রামগুলোর এই আধুনিক নামে এর মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না। এই গোটা অঞ্চলটা আগে বালিয়া পরগনার অন্তর্গত ছিল। বালিয়ার পাশের পরগনা ভুরশুট। ভুরসুটে জন্ম হয়েছিল মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের। দুই কবি মোটামুটি একই সময়ে সৃষ্টিশীল ছিলেন।
অবশ্য গরিবুল্লাহ বালিয়ার আদি নিবাসী নন। তাঁর বাবা সৈয়দ শাহ আজমোতুল্লাহ এসেছিলেন বাগদাদ থেকে। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। এক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে আজমোতুল্লাহের হাফেজপুরে আসা নিয়ে। তিনি ছোট একটা কিসতি (নৌকা) চড়ে এক রাতের মধ্যে নাইকুলির কাছে কৌশিকী নদীর তীরে অবস্থিত হাফেজপুরে উপস্থিত হন। হাফেজপুরে আজমোতুল্লার মাজার এখনও রয়েছে। সেই কিসতিও রয়েছে। তার মাপ? একটা পা রাখা যায় তাতে। আসলে ধর্মপ্রচারকদের সঙ্গে অলৌকিক কাহিনী কেমন করে যেন জুড়ে যায়।
কিন্তু ঘটনা হল, সুদূর বাগদাদ থেকে কেন এই হাফেজপুর গ্রামে এসেছিলেন? ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। তখন মুসলমান শাসন চলছে ভারতে। সেই সময়ে বহু সুফি সাধক ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতে আসতে শুরু করেন। গরিবু্ল্লাহের বাবাও ছিলেন তেমনই এক সুফি সাধক। কৌশিকী নদীর তীরে বালিয়া-ভুরসুট পরগনায় স্থানে স্থানে সমৃদ্ধ জনপদের পত্তন হয়েছে। সেইরকমই এক জনপদকে সাধনপীঠ করেন তিনি।
আজমোতুল্লাহের বড় ছেলে গরিবুল্লাহ ধর্মপ্রচারকই ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন কবি। সুফি সাধকেরা ইসলাম ছাড়াও হিন্দু ধর্মের নানা আচার, সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। গরিবুল্লাহের সত্যপীরের পাঁচালি রচনা তারই প্রমাণ। ফলে এই সুফি সাধকদের সব ধর্মের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এখনও আছে। গরিবুল্লাহের কবি পরিচয় মুছে যাওয়ার একটা কারণ বোধহয়, তাঁর এই সাধক সত্তা বেশি প্রচার হওয়া। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের ইতিহাসের পড়ুয়ারা বোধহয় চেনেন কবি গরিবুল্লাহকে। বাংলাদেশেও গরিবুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। কিন্তু সাজেশন করে পড়া পড়ুয়াদের দায় আমি নিতে পারব না।
গরিবুল্লাহের সময়ের কৌশিকী আর নেই। সেই স্রোতস্বিনী এখন মজা খাল আর জলাশয়ে ভাগ ভাগ হয়ে গিয়েছে। কৌশিকীর মতো সুন্দর নাম ভুলে লোকে এখন তাকে কানা নদী বলে। মানে ‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে’ অবস্থা আরকী। কিন্তু গরিবুল্লাহের মাজারের পরিবেশ তাতে নষ্ট হয়নি। গাছপালা ভর্তি, ছায়া ছায়া মাজারের সামনে দাঁড়ালে মনে প্রশান্তি আসে। যেমন প্রশান্তি আসে সুফি সাধকদের গান শুনলে। ‘যোধা আকবর’এর ‘খাওয়াজা মেরে খাওয়াজা’ গান কেমন মন ভরিয়ে দেয়। তার জন্য আস্তিক হওয়ার দরকার পড়ে না!
শান্ত, ছায়া ঘেরা মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনা করে নেওয়া যায় পরপর দৃশ্যকল্প, স্রোতস্বিনী কৌশিকী বহমান। দূরে পালতোলা ডিঙ্গায় এক সওদাগর বাণিজ্যে চলেছেন। নদীর তীরে নিজের সাধনপীঠে বসে ইউসুফ আর জুলেখার প্রেম-ভালবাসার কাহিনী রচনায় মগ্ন এক কবি।
ছবিটা একটু পাল্টেও নিতে পারেন। সওদাগর কৌশিকী বয়ে যেতে যেতে দেখলেন, নদীর তীরে বেশ জনসমাগম। মাঝি-মাল্লাদের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। এক মাঝি জানালেন, পির শাহ গরিবুল্লাহ সত্যপীরের পাঁচালি পড়ে শোনাচ্ছেন ভক্তদের। এলাকার হিন্দু-মুসলমান সকল ভক্তই হাজির তাঁর পাঁচালি পাঠ শুনতে।
অসাধারণ দৃশ্য না? বিশেষ করে এই সময়ে!
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ
কভারের ছবি— গরিবুল্লাহের মাজার।
(সমাপ্ত)