সৌমেন জানা
মুর্শিদাবাদ নামটি শুধু বাঙালি সমাজেই নয় কিংবা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাতে নয় বরং সমগ্র ভারতবর্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। মুর্শিদাবাদের প্রতি ইঞ্চি জমিতে মিশে আছে অতীত দিনের সোনালি স্মৃতিচিহ্ন, হাসি-কান্নার না বলা কত কথা। সুখ-দুঃখের কত না ফল্গুধারা। তৃষ্ণার্ত মনে একটু প্রশান্তি ও পাঠকদের জন্য ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজরিত মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের সামান্য কিছু কথা ও তথ্য নিয়ে না লিখে পারলাম না।
মুর্শিদাবাদ ঘুরতে ঘুরতে পৌছে গিয়েছিলাম ফুটি মসজিদের কাছে। মুর্শিদাবাদ শহরের এক প্রায় জনহীন প্রান্তরে অত্যন্ত অবহেলায় ভগ্নস্তূপের মত পড়ে আছে ফুটি মসজিদ। বেশ কিছুটা উঁচুতে সৌধের প্রবেশ পথ। সে পথে সিঁড়ি কয়েক ধাপ আছে বটে, কিন্তু তার দশাও অতি করুণ। আগাছা গজিয়ে সিঁড়ির অনেকটাই ঢেকে দিয়েছে ঝোপ-জঙ্গলে। সাপখোপের উপদ্রব আছে। বেশ কসরত করে ওপরে উঠে মূল উপাসনা হলের মাটিতে পা রাখলাম। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ও উচ্চতা যথাক্রমে ১৩৫ ফুট ও ৪০ ফুট। আয়তনে এই মসজিদ মুর্শিদাবাদের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। মসজিদের চারকোণে চারটি মিনার রয়েছে। এই মসজিদের গড়নের সঙ্গে কাটরা মসজিদের গড়নের মিল আছে। যদিও কাটরা মসজিদের অন্দরের খিলানগুলি অনেক বেশি ছন্দময় এবং দৃষ্টি নন্দন। এখানে মেঝে ঘাস আর আগাছায় ভরে গিয়েছে। দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছ।
সময়ের করাল গ্রাসের ছাপ প্রতিটি কোনায়। কিন্তু এক আশ্চর্য আকর্ষণ। মসজিদটি যেন নীরবে বয়ে বেড়াচ্ছে সেই নবাবি ঐতিহ্যI চারি দিক খোলা একটি প্রশস্ত জমির উপরে অত্যন্ত অবহেলিত এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মসজিদ লাগোয়া জায়গাও বেদখল হয়ে গিয়েছে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় এখন ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অসাধারণ মসজিদটি। মসজিদের দেওয়ালে ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যশৈলীর কারুকাজ রয়েছে। যা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণের।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। ভাল লাগছিল না পরিত্যক্ত, ভগ্নপ্রায় স্যাঁতস্যাঁতে ইমারতের ভেতরটায় দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পরিত্রাণ পেলাম। শোনা যায়, মুর্শিদ কুলি খাঁর দৌহিত্র নবাব সরফরাজ খান তাঁর অক্ষয়কীর্তি হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন এই মসজিদটিকে। তাই তিনি নাকি এক রাত্তিরের মধ্যেই বিশাল এই মসজিদ বানানোর চেষ্টা করেন। যদিও এইসব বিষয় যে অতিরঞ্জিত তা বেশ বোঝা যায়।
কথিত আছে, নবাব সুজাউদ্দৌলার মৃত্যুর পর ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ বাংলার মসনদে বসেন। মসনদে বসলেও রাজ্য শাসনের ভার মন্ত্রীবর্গের ওপরে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্তে ভোগ বিলাসে মেতে থাকতেন। হারেমে অগুন্তি বেগম, দাসি বাঁদি -তবু লালসার আগুন মেটে না তাঁর। নগরের পথে কোনও সুন্দরী রমণী চোখে পড়লেই তাঁকে নিজের আসক্তি জালে আবদ্ধ করার জন্য কোনও কিছুই বাদ রাখতেন না।
অনিবার্য ভাবেই এ জাতীয় বিলাসি জীবন আর অনাচারের প্রভাবে রাজ্য শাসনের কাজে অবহেলা এবং অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। মন্ত্রী মণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গেও নবাবের বিরোধ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছিল। অবশেষে দিল্লীর বাদশাহ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন। আলিবর্দি খাঁর নেতৃত্বাধীন ফৌজের হাতে নবাব সরফরাজ খাঁ নিহত হন। নিজের স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি সুরম্য মসজিদ স্থাপন করার কাজ শুরু করিয়েছিলেন নবাব সরফরাজ খাঁ তাঁর জীবদ্দশায়। কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ার ফলে কাজটি সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। নবাবের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর সাধের কীর্তি সৌধ নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণই রয়ে গিয়েছিল। নিজেকে চিরস্থায়ী করার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হওয়ার আগেই নবাব ফৌত হয়ে গেলেন। অসম্পূর্ণ গম্বুজের কারণেই মসজিদটি ফৌতি মসজিদ বা ফুটি মসজিদ বলে পরিচিত হয়ে রইল চিরকালের মতো। অবশ্য, এ-ও এক ধরনের টিকে যাওয়া। অক্ষয় না হোক ক্ষয়কীর্তির মধ্যে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া।
ইতিহাসের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফিরলাম। এখন মুর্শিদাবাদ হারিয়েছে নবাবি ঐতিয্য। কিন্তু ফের উৎসুক মানুষের ভিড়ে গমগম করবে অতীত দিনের রাজধানী। আজও আমরা স্বপ্ন দেখি। বড় সাধ, ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলো ওড়া হারানো গৌরব ফিরে ফিরে দেখি। আয় সে পুরানো স্মৃতি ফিরে আয়…।
ছবি-লেখক
(সমাপ্ত)