দীপক দাস
ঘুরতে গিয়ে ঘরও দেখেছিলুম। হরেক কিসিমের।
থাকার জন্য নয়। থাকার ঘর দেখার কাহিনী তো অন্য। তা নিয়ে ইতিহাস লেখা যায়। সে ঘর খোঁজা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখা কিশোর-কিশোরীদেরও হার মানায়। এ ঘর পথ ও পথের প্রান্তে দেখা।
শুরু থেকেই শুরু করি। বহু বছর আগের কথা। তখনও ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের জন্ম হয়নি। আমরা খেলার মাঠের কয়েকজন এক সঙ্গে আড্ডা মারি। তারা কেউই আমার সমবয়সী নয়। সমবয়সীরা সকলেই বয়সোচিত কাজকর্ম করে ভারী ব্যস্ত। আমার সঙ্গীরা কেউ ছাত্র, কেউ ভায়ের বন্ধু। তাদের সঙ্গেই ইচ্ছে হলে বেরিয়ে পড়ি ছুটির দিনে। কাছে পিঠে কোথাও। কিন্তু দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি তখনও। খেলাধুলোই বেশি ভাল লাগত। তাই মাঠেই পড়ে থাকতুম। তো একদিন অফিসে বেজায় হেনস্থা করা হল আমাকে। এক সিনিয়র প্রচুর ঘুরে বেড়ায়। তারা কয়েকজন মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। আমি মন দিয়ে শুনছিলুম। হঠাৎই ওই সিনিয়র বলল, ‘তুমি কোথাও ঘুরতে যাও না নিশ্চয়? তোমার মুখের কাটিং দেখেই বোঝা যায়।’ মুখের কাটিং দেখে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বোঝা যায়!
কথাটা ভারী আঁতে লেগেছিল। মুখের ঘোরাফেরার ছাপ নেই? চল তো বেরিয়ে পড়ি। বেরিয়ে পড়লাম পুজোর সময়। প্রথমবার ইন্দ্র, আমার মেজভাই আর এক বন্ধু বেরিয়েছিল। বন্ধুর পিছুটান ছিল। ফলে বারবার ফোন। আজ ফিরবে তো? কখন আসছ? বন্ধু সাংঘাতিক ধুরন্ধর। রহস্যময় গলা করে ফোন জানিয়ে দিয়েছিল, ‘এখানে জঙ্গলে হাতি বেরোয়। এখন আর ফিরতে পারব না।’ ওপার থেকে আশ্বাস, ‘না না ফিরতে হবে না। কাল এসো।’ আসলে এত ডাকাডাকির একটাই কারণ। পুজোর সময় তো। ঘরের লোকটা কখন ফিরবে আর কখন ঠাকুর দেখতে বেরনো হবে তা নিশ্চিত করা।
ওই সফরেই দেখেছিলুম, অন্যধরনের বাড়ি। জায়গাটা অভিরামপুর পেরিয়ে। ভালকির কিছুটা আগে। একটা পাড়া। বাড়িগুলোর বেশির ভাগই মাটির। কোনওটাতে আলকাতরা মাখানো। টিনের চাল। একটা বাড়ির চালে হাওয়া মোরগের মতো টিনের পায়রা দেখেছিলুম। বাড়িগুলোর গায়ে ফুল, লতাপাতার নকশা। নকশা আঁকা বাড়ি দেখেছিলুম শান্তিনিকেতনেও। আমরা শান্তিনিকেতনে গেলে আমার কুটীরে উঠি। আমার কুটীরের অতিথিশালার পিছন দিকে, পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে একটা জঙ্গল পড়ে। জঙ্গল পেরিয়ে দু’পাশে জঙ্গল ঘেরা সুন্দর একটা রাস্তা। ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে এত ভাল লাগে। বুলেভার্ডের মতো সেই রাস্তা ধরে এগলে খেলার মাঠ। ডানদিকে একটা পরিত্যক্ত স্টুডিও। তার বাঁদিকের রাস্তা ধরলে পড়ে আদিবাসী পল্লি। ওই পল্লির এক ঘরের দেওয়ালে দেখেছিলুম ফুল আঁকা।
পুরুলিয়ায় বরন্তির বাড়ির আবার অন্য রূপ। পল্লির রূপ বাইরে থেকে দেখলে অন্য আদিবাসী বসতের মতোই। আমি তো শান্তিনিকেতনের আদিবাসী পল্লির সঙ্গে বেশ মিল পেয়েছিলুম। কিন্তু ঘরগুলোর বেশির ভাগই একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়া। মাটির বাড়ি। কোনওটার দেওয়াল নকশাদার। কোনওটা লাল মাটি দিয়ে ভাল করে নিকোন। পাকা বাড়িও আছে। তবে মাটির বাড়িগুলোর বেশির ভাগের সামনে একটা গোয়াল ঘর। গরু, বাছুর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জৈবিক কাজের ফলে সামনেটা ভিজে ভিজে। স্বাভাবিক ঝাঁজাল গন্ধ। ভিতর দিকে লোকজন থাকে। আমি ঝিল পেরিয়ে বরন্তি নেচার স্টাডির হাটের ডানদিকের পল্লিটার কথা বলছি।
বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলে গিয়েছিলুম ছ’জন মিলে। আমাদের গ্রুপের ওয়েবসাইট উদ্বোধনে। দীপু, কচি, অরিজিৎ, জুয়েলদের সঙ্গে আমি আর ইন্দ্র দাপিয়ে বেড়িয়েছি। মে মাসের গরমও কাবু করতে পারেনি আমাদের। জঙ্গলের রূপে তো মুগ্ধ। ওখানকার বাড়িঘরও বেশ ভাল লেগেছিল। ভুটভুটি ভ্যানে করে ঘুরতে বেরিয়েছিল। বাসুদেবপুর বিট অফিসে হাতি দেখতে যাওয়ার আগে থেমেছিলুম চা খেতে। রাস্তার পাশে চা খাচ্ছি। তখনই নজরে এসেছিল বাড়িগুলো। টিনের চাল, মাটির দেওয়াল। টিনগুলো অনেকদিন আগে লাগানো হয়েছে, দেখেই বোঝা যায়। পাকা দোতলা বাড়িও আছে। কিন্তু তাদেরও টিনের চাল।
এক জায়গায় অনেক রকম বাড়ি। সে-ও দেখেছিলুম। মলুটিতে গিয়ে। ঝাড়খণ্ডের এই জায়গাটা রূপে এবং বৈচিত্রে অসাধারণ। সেই বৈচিত্র ঘরবাড়িতেও। একটা মাটির দোতলা। কোনও শ্রী নেই। দেওয়াল থেকে মাটি খুলে খুলে পড়েছে। দেওয়াল মৌমাছির চাকের মতো খোবলানো খোবলানো। তার পাশেই পাকা দোতলা। আবার কিছুটা গেলে একটা বাড়ি। সেটাও দোতলা। টিনের চাল। কিন্তু বাড়ির ছাঁদ অন্য জায়গায় দেখা মাটির দোতলার সঙ্গে মেলে না। দোতলার দু’পাশে দু’টো জানলা। খুবই ছোট। সেটা দিয়ে কীভাবে হাওয়া বাতাস খেলে কে জানে! তবে জানলার ওপরে সারিবন্ধ ঘুলঘুলি। প্রথমে তো আমরা বুঝতে পারিনি। কীসের জন্য। আমাদের মধ্যে কে একজন বলল, ‘ওখান থেকে লোকে গুলি চালাত।’ একজন বলল, পায়রাদের বাসা করার জন্য বানানো হয়েছে। তবে কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পেরেছিলুম, ওগুলো আসলে ভেন্টিলেটার। এরকম মোটা দেওয়াল আর ছোট জানলার ঘরে বেশি ঘুলঘুলির দরকার আছে অবশ্যই। ঘরগুলোয় শীতাতপ যন্ত্র না থাকলেও বোধহয় অসুবিধে নেই।
দোতলা বাড়ি থেকে কিছুটা এগোলেই রাস্তার এপারে ওপারে সারি সারি ঘর। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল, পাকা দেওয়াল খড়ের চাল, মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল চৌহদ্দির বাড়িও আছে। তার দেওয়াল নীল রঙে রাঙানো। আরেকটা বাড়ি দেখেছিলুম। তার নীচে তিনটে খুপরি মতো ঘর। একটায় খড় রয়েছে। একটায় কাটা খড়ের বস্তা। আরেকটায় কিছু নেই। ওপরে লম্বা একটাই ঘর। তার মেঝেয় পেঁয়াজ ঢালা। বুঝলুম, ওটা ফসল এবং গবাদি পশুর খাদ্য রাখার জন্য তৈরি।
ঘুরতে গিয়ে সেই জায়গার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। মানুষজন দেখেও। আর মুগ্ধ হই নানা ধরনের বসত দেখে। ট্রেনের জানলা থেকে দেখা একগুচ্ছ বাড়ি একবার আমাদের চোখ আটকে রেখেছিল। রামপুরহাট থেকে দুমকা যাচ্ছিলুম। ট্রেন ছুটে আমরা চোখ মেলে তাকিয়ে আছি জানলা দিয়ে। মাঝে মাঝেই এসে যাচ্ছে একেকটা পাড়া। অল্প জঙ্গলের ভিতর থেকে বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। ছবির মতো।
বাড়ি দেখে আরেকবার খুশি হয়েছিলুম। সে অবশ্য ছবিতে। কচি, জুয়েলরা সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিল। জুয়েল লিখেছিল সেই সফরের কথা তাতেই ছিল ছবিটা। জোড়া পুকুর পাড়ে কয়েকটা বাড়ি। খড়ের চাল নিচু চাল। মাটির ক্ষয়াটে দেওয়াল। কিন্তু কী আশ্চর্য তার রূপ। ওই বাড়ির বাসিন্দারা হয়তো অনেক অসুবিধায় থাকেন। তাঁরা হয়তো ওই বাড়ি ভেঙে ফেলে দিয়ে পাকা বাড়ির স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু আমার চোখ ভরে গিয়েছিল। পল্লি বাংলার রূপ এখনও অবিকৃত রয়েছে যে!
বাড়ি দেখে মুগ্ধতা যেমন আছে তেমনই কান্নাও আছে। সেটা পুরুলিয়ার মুরগুমায়। অযোধ্যার দিকে যাওয়ার সময়ে দেখেছিলুম। এক মহিলা দাঁত মাজছিলেন একটা বাড়ির সামনে। সেটা বাড়ি বললে অনেক বেশি বলা হয়। চালের খড় ঝুরো ঝুরো হয়ে গিয়েছে। সামনে বাঁশ, বাখারির নানা গোঁজ। এই বাড়িতে থাকতে হয়! পুরুলিয়া সুন্দরী। কিন্তু সেই সৌন্দর্য আরও উদ্ভাসিত হতো যদি এই মানুষগুলোর কিছুটা জীবনধারণ কিছুটা সহজ হতো।
বাড়ির ছবি দেখে কষ্ট হয়েছিল আরেকবার। বাংলাদেশের সাংবাদিক বন্ধু নয়নভাই ফেসবুকে পোস্ট করেছিল বরিশালের এক গ্রামের ছবি। আমি মন্তব্য করেছিলুম, ‘এ তো আমাদেরই গ্রাম’। নয়নভাই উত্তরে লিখেছিল, ‘দেশ তো একটাই, ভাই। শুধু কাঁটাতারের তফাৎ’।
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ, দীপশেখর দাস, সৌগত পাল, শুভ বৈদ্য।
কভারের ছবি- সুন্দরবনের সেই পাড়া।