ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

দুই সখীতে খাজুরাহে

জয়ন্তী গলুই

‘হ্যালো আমরা এইমাত্র অমরকন্টক পৌঁছলাম। জানো আমাদের সঙ্গে অদ্ভুত দুটো মেয়ে এসেছে। কোনও পুরুষ নেই!’

নর্মদা দেবী মূর্তি।

কথাগুলো আমাদের উদ্দেশ্যে। আমি আর আভাদি, আমরা এসেছি মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণে। এর আগেও ভূটান গেছি এক সঙ্গে। আভাদি অ্যাথলিট। জাতীয় মিটেও খেলেছে এক সময়। ডিসকাস থ্রো, জাভেলিন থ্রো আর শর্টপাট ছিল আভাদির ইভেন্ট। এখন আবশ্য অবসর নিয়েছে কর্মজীবন থেকে। জিপিও’তে চাকরি করত। ষাট পেরিয়েও খেলোয়াড় জীবন থেকে পুরোপুরি অবসর নেননি। কলকাতার কয়েকটি ক্লাবে কোচিং করান।

আমরা বেরিয়ে ছিলাম হাওড়া থেকে মুম্বাই মেলে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে। পরের দিন বিলাসপুর, বিলাসপুর থেকে নর্মদা এক্সপ্রেসে পেনডা রোড। ওখান থেকে টাটা সুমো করে অমরকণ্টক। বিন্ধ্য, সাতপুরা আর মৈকাল এই তিনটি গিরি শৃঙ্গের মিলনস্থল হল অমরকণ্টক। অমরকণ্টক থেকেই উৎপন্ন নর্মদা আর শোন নদী। প্রথমে গেলাম শোনমুড়া, শোন নদীর উৎপত্তিস্থল। পাহাড়ের এক কোণে পাথরের তৈরি মুখ দিয়ে কলের মতো অবিরাম জল পড়ে যাচ্ছে। এটাই শোন নদীর উৎপত্তি।

পাশেই সোনাক্ষী দেবীর মন্দির। অষ্টভুজা সোনাক্ষী সিংহেশ্বরী। শোন নদী এখানে উৎপন্ন হয়ে নর্মদার বিপরীতমুখী হয়ে বয়ে গিয়ে পাটনার কাছে গঙ্গায় মিশেছে। এখান থেকে সিঁড়ি করা রয়েছে। পাহাড়ের প্রান্তে ভারী সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে। এরপর দেখলাম মাই কি বাগিয়া। মানে মাতাজির বাগান। গাছ আর গাছ। ছায়া সুনিবিড় করে রেখেছে মাই কি বাগিয়া। মাই কি বাগিয়ার পরিবেশ ভারী শান্ত।

অমরকণ্টকের প্রধান আকর্ষণ, নর্মদা উদগম মন্দির দর্শনে। অমরকণ্টক প্রাচীন ঐতিহাসিক পুণ্যভুমি। মন্দিরে ঢুকেই চোখ পড়ে এক বাঁধানো কুণ্ড নর্মদার উৎসস্থল। নর্মদা উদগম কুণ্ড, নর্মদার মতো লম্বা নদীর উৎস। কিন্তু একটা বদ্ধ কুণ্ড। কুণ্ডের পবিত্রতা বজায় রাখাতে বর্তমানে কুণ্ডস্থানে স্নান নিষিদ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে কুণ্ডের এপারে এক শিব মন্দির। মন্দিরের দক্ষিণ দেওয়ালে নর্মদা মাতার ছবি টাঙানো। মন্দিরের গায়ে লেখা নর্মদা উদগম। রোজ সন্ধ্যায় মূল মন্দিরের আগে এখানে আরতি হয়। কালো কষ্টিপাথরের নির্মিত মা নর্মদার তপস্বিনী মূর্তি। বড় বড় টানা চোখ, টিকালো নাক, সোনার গয়না পরিহিতা মায়ের প্রিয় লাল ওড়না আর অঙ্গসজ্জায় সজ্জিত। ভক্তিভরে মাকে প্রণাম করলাম।

আমি আর আভাদি।

পরেরদিন বাস ছাড়বে সকাল সাতটায় এরপরের গন্তব্য খাজুরাহো। আমি আর আভাদি ভোর ৫টায় নর্মদা নদীতে স্নান সেরে যাত্রা করলাম।

পরেরদিন খাজুরাহো মন্দির পরিদর্শন করলাম। খাজুরাহো মন্দিরকে ভারতের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত মন্দির হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শিল্পের দিক থেকে বিবেচনা করলে এই ধরনের মন্দির ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই অঞ্চলে অনেকগুলো মন্দির রয়েছে। তাই এই মন্দিরকে গুচ্ছ খাজুরাহো মন্দির বলা হয়। এই মন্দিরকে Temple of love বলা হয়। কারণ এখানে দেবতাদের ভালোবাসার প্রতিকৃতি কারুকার্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

খাজুরাহ মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল চান্দেল রাজ বংশের শাসনকালে। ৯৫০-১০৫০ সালের মধ্যে এই মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল। মুসলিম শাসনের সূচনার দিকে এই মন্দিরগুলো অধিকাংশে ধ্বংস করা হয়। এখানে যে মন্দিরগুলো রয়েছে সেগুলি মূলত হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির।

খাজুরাহো মন্দিরগুলো পরিদর্শন করলাম। গাত্রে নানা প্রকার ভাস্কর্য মনকে আকৃষ্ট করে। সন্ধ্যায় খাজুরাহো মন্দির চত্বরে লাইট এবং সাউন্ড অনুষ্ঠান দেখলাম। এক অনন্য সুন্দর পরিবেশ। খুব ভালো লাগল।

হরিণের সঙ্গে দেখা।

পরের দিন বাসে করে দুপুরে পৌঁছলাম কানহা। ওইদিন জিপে করে দুপুরে কানহা ফরেস্ট অভিযান। এইপ্রথম বার আমার জঙ্গল দর্শন। মনে মনে রোমাঞ্চ। চারিদিকে নিস্তব্ধ, শুনশান। আমরা যারা জিপে আছি, নিশ্চুপ হয়ে আছি। একটা জায়গায় জিপে এসে থেমে গেল। পাখিগুলো চিকচিক করে ডাকছে। অনেক পরে বাঘ বাবাজির দেখা পেলাম। বাঘ দেখায় খুব ভয় লাগছিল। জঙ্গলে প্রচুর প্রাণী। যেতে যেতে চোখে পড়েছে হরিণ, শম্বর, হনুমান। একটা জিনিস দেখে খুব মজা লাগছিল। হনুমানগুলো গাছে উঠে বুনো ফলগুলো নীচে ফেলছে। আর হরিণগুলো তা মহানন্দে খাচ্ছে। সন্ধ্যার মধ্যেই আমাদের জঙ্গল সফর, আনন্দ সফর শেষ হল। ওই দিন কানহা ফরেস্টের পাশে এক কটেজে থাকলাম।

পরের দিন সকাল ৭টায় বাসে করে পাড়ি দিলাম জবলপুর। মার্বেল রক দেখলাম বোটে করে। খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। বোটের চালক আমাদের বলে যাচ্ছিলেন, কোন কোন হিন্দি ছবির শ্যুটিং হয়েছে।

এর পর আমরা এলাম নর্মদা জলপ্রপাত দেখতে। আমি আর আভাদি রোপওয়ে করে পৌঁছলাম নর্মদা জলপ্রপাতের কাছাকাছি। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। অপরূপ সৌন্দর্যে আবিষ্ট হলাম।

পরের দিন সন্ধ্যার পর পাঁচমারি। এখানে দেখলাম জটাশঙ্কর কেভ মন্দির। অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে নিচে পৌঁছলাম। দারুণ এক অনুভূতি। বাবার কাছে প্রার্থনা জানালাম। এর পর গেলাম প্রিয়দর্শিনী। এখান থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বিকালের দিকে এলাম পাণ্ডভাগা। এখানে পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাস চলাকালীন থাকতেন। অনেক উঁচু। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনে বিরাট লনে প্রচুর ফুলের বাগান। এর পর গেলাম পাঁচমারি লেক। জলের অভাবে লেকটার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়েছে। তবে লেকের জলের অভাব, সৌন্দর্যের ঘাটতি পূরণ করে দিল রাজেন্দ্রগিরি। সূর্যাস্তের ছবি। সূর্যাস্ত দেখে মোহিত হয়ে গেলাম।

খাজুরাহো মন্দির।

সূর্যাস্ত দর্শনের পরে আমাদের সফরের অন্ত হল। পরের দিন পিপারিয়া রেলস্টেশন থেকে মুম্বাই মেল ধরে রওনা দিলাম হাওড়ায়।

ছবি-লেখিকা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *