ইতিহাস ছুঁয়ে পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

চণ্ডীদাসের ছাতনা থেকে যমধারার জঙ্গলে— পপাত পর্ব

দীপক দাস

গালে কষিয়ে চড় অনেক ভাবে মারা যায়। খাওয়া যায়। আবার উল্টোদিক থেকে বললে খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। সেই ব্যবস্থাটাই করল ইন্দ্র। শুশুনিয়ার কোলে কোথায় থাকা যায় সেটা ট্রেকারে আস্তে আস্তেই খোঁজ নিয়ে ফেলেছিলাম। ট্রেকার স্ট্যান্ডের কাছে ডানহাতি রাস্তাটা শুশুনিয়া পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছে। ওখান থেকে আরণ্যক গেস্ট হাউস হাঁটা পথ। ট্রেকার চালক হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ওই যে রাস্তার ঢাল ওর কাছেই। কিন্তু ইন্দ্রবাবু এবং তাঁর ভাইটি ট্রাক নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন। তাই ভরদুপুরে ফ্যাশন দুরস্ত পোশাকআশাক এবং নানা প্রসাধনী ঠাসা সেই ট্রাক নিয়ে হাঁটতে রাজি হলেন না তাঁরা। চালককে জিজ্ঞাসা করলেন, পৌঁছে দেবেন? চালক রাজি। তবে জানিয়ে দিলেন, ৫০ টাকা লাগবে।

গাড়ি স্টার্ট দিল। আর আমরা নেমে গেলাম। মানে এতটাই কাছে। ট্রেকার স্টার্ট দিয়েই বন্ধ করে দিলে সেটা গড়িয়ে গড়িয়ে যেখানে থামবে সেখানেই আরণ্যক। ৫০ টাকা বের করে দেওয়ার সময় স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল ঠাস ঠাস আওয়াজ। আমাদের গালে পড়া চড়গুলো। চালকের মুখে তো একগাল হাসি। দুপুর রোদে, খিদে পেটে মনে হচ্ছিল, ব্যাটা দিই একটা ধোবি পাট। যে কোনও ট্যুরিস্ট স্পটের বদনাম হয়, কিছু লোকের এই অতিরিক্ত লোভের কারণে। তিনি খাবারওয়ালাও হতে পারেন। আবার ভাড়া গাড়ির চালকও হতে পারেন। বিষণ্ণ মনে আরণ্যকে ঢুকলাম।

ঘাসের বাগিচা। এলাকাটা বড়ই সুন্দর।

ঢুকেই আরেক বিপত্তি, ইন্দ্র এসি রুম ভাড়া নেবে বলে বায়না করতে শুরু করল। আমাদের প্রথম দিকের সফরগুলোয় ওর এইরকম নানা বায়নাক্কা ছিল। ঘোরা মানে ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে। এটাই মনে করতাম আমি। কিন্তু সেই মনোভাব দলে আনতে বেশ দেরি হয়েছিল। ইন্দ্রর বায়নার চোটে। এখন অবশ্য বুঝে গিয়েছি ও। সেই বোঝার পিছনে অনেক বোঝানো আছে। খারাপ ভাষায় যাকে বলে গালাগাল। তাই মুরগুমায় গিয়ে হোম স্টে মালিকের দেওয়া আটার মোটা মোটা লুচি চোখ বড় করে খেয়ে নিয়েছিল। কোনও প্রতিবাদ নেই। চোখ বড় হয়েছিল, লুচিগুলো নামছিল না গলা দিয়ে। ‘চুপ চুপকে’র রাজপাল যাদবের চাপাটি খাওয়ার মতো অবস্থা।

আমাদের দু’টো ঘর নেওয়া হল। আর ইন্দ্রকে বলে দেওয়া হল, এসি ঘর তোমরা নিতেই পার। তবে সাধারণ ঘরের ভাড়াই তবিল থেকে দেওয়া হবে। অতিরিক্ত ভাড়া নিজেরা দেবে। গেস্ট হাউসটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেল আমার। একটেরে একটা জায়গায়। আশেপাশে কোনও বসত নেই। পাশে শুশুনিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিস। আরণ্যকের সামনে পাকা রাস্তা। তার পরেই জঙ্গল। হাউসের পিছন দিকেও রাস্তা। তার পরে ফাঁকা মাঠ। রাস্তার প্রচুর গাড়িঘোড়া চলে না বলে নির্জনতা নষ্ট হয়নি।

সেই পরিযায়ী।

তরতাজা হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সদলে। শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে। তখন আমাদের দলে একটাই ক্যামেরা। সেটা ইন্দ্রর। ফলে ছবি তোলার হলে ওকে খুব তোষামোদ করতে হতো। আর সুযোগ বুঝে ইন্দ্রও ভাও খেত। ছবি তুলতে বললেই বলত, পরে। যেতে যেতে রাস্তার পাশে এক জলাশয়ে দেখি, একটা পরিযায়ী পাখি। সাদা ধবধবে একটা হাঁস। ইন্দ্রকে বললাম, ছবি তোল, ছবি তোল। ও রাজি হচ্ছিল না। পরিযায়ী, এমন সুযোগ মিলবে না বলে জোর করে ছবি তোলালাম। ও বাবা ফেরার সময়ে দেখি, সেই হাঁস দলবল জুটিয়ে বসে রয়েছে। আর দলের সকলেই পাতি। তার মানে ধবধবে হাঁসটাও পাতি। দেখে তো ইন্দ্রর কী রাগ। বারবার বলতে শুরু করল, ওই তো তোমার পরিযায়ী। ছবি তোলো আরও। আমি গম্ভীর মুখে বললাম, শুধু ওই হাঁসটার ছবি তুললি? একটা গ্রুপ ফোটো তুলবি না? মন খারাপ করবে তো ওর সঙ্গীরা। আমার দিকে কটমট করে তাকাল ইন্দ্র।

মগ্ন পাথর শিল্পী।

শুশুনিয়া পাহাড় পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটা বেশ। কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশটা কেমন যেন ঘিঞ্জি। রাস্তার পাশে এক জায়গায় ঘেরা বাড়ি। ওখানে নাকি কোনও স্টুডিও হচ্ছে। মানে হুজুগে লোকজন বাড়বে। সেটা পেরিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে, এক পাথর শিল্পী একমনে কাজ করে চলেছেন। পাথর কুঁদে তৈরি হচ্ছে থালা, বাটি, মূর্তি। পাদদেশে কয়েকটা দোকানও রয়েছে। পর্যটকদের জন্যই। রয়েছে একটা মন্দিরও। পুজোর ঘণ্টা বাজছিল। নীরবতা খান খান। একটা ঝরনা রয়েছে শুশুনিয়ায়। পাহাড়ের বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকা জলস্রোত বেরিয়ে আসে অনবরত ধারায়। জলের মুখটায় একটা জন্তুর মুখ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল, এতে স্রোতের প্রাকৃতিক ব্যাপারটাই হারিয়ে গিয়েছে। ফিরে আসার সময়ে ঠিক হল, এই জলই এলাকার লোকে খান। আবার ড্রাম ড্রাম জল ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে মনে হল, প্রকৃতির জলে ব্যবসাও চলে।

দুপুরে ঝরনার চলে চান করে বেশ শান্তি পেলাম। হিমশীতল জল। কিন্তু আমার মেজ ভাই কিছুতেই চান করতে চাইল না। একটুখানি জল হাতে নিয়ে মাথায় ছিটিয়ে দিয়ে বলল, হয়ে গেছে। সবাই তো রে রে করে উঠল। এই গরমে চান না করে কী করে থাকা যায়! ও বলল, সকালে চান করে বেরিয়েছি তো। পুরো শুশুনিয়া সফর জুড়ে মেজ আমাদের খোরাক জুগিয়েছে। রাস্তার পাশে, ওই যেখানে ধবধবে হাঁসটা বসেছিল, সেই জলাশয়টা দেখে বলল, এবার বুঝেছি। সবাই ওর দিকে ঘুরে তাকাল, কী বুঝেছে জানতে। মেজ বলল, এখান থেকেই মাটি সরে গিয়ে শুশুনিয়া পাহাড়টা তৈরি হয়েছে। তাই এখানটা গর্ত হয়ে গেছে। সবাই তো নয়া ভূগোলের সন্ধানে উৎসুক। শুরু হল, যাচাই পর্ব। স্বীকৃতি দেওয়ার আগে যা করা হয় আরকী। তবে মেজ নিজের তত্ত্বে ঋজু থাকল শেষ পর্যন্ত। আর ওর নাম হয়ে গেল প্রফেসর ক্যালকুলাস। টিনটিনের কমিকসের উদ্ভট আবিষ্কারের নায়ক।

শুশুনিয়া পাহাড় থেকে তোলা।

দুপুরে মোড়ের মাথার হোটেলে খাওয়াদাওয়া করে ঘুম। বিকেল চড়লাম পাহাড়ে। এই প্রথম পাহাড় চড়া। প্রথমে খুব উৎসাহ। হা হা হি হি করতে করতে উঠছি। তারপরেই প্রতি পদক্ষেপ ভারী হয়ে উঠছিল। দু’কদম উঠি আর চার মিনিট বিশ্রাম নিই। পায়ের পেশি টেনে ধরেছে। দরদর করে ঘাম হচ্ছে। ততক্ষণে ইন্দ্র আর কৃষ্ণ ক্ষান্ত দিয়েছে। দু’জনেই তো গাবলুগুবলু, ইয়ে মানে স্বাস্থ্যবান। তাই নিউটনের সূত্র ওদের ওপরে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এদিকে বাবলা আর মেজ তরতর করে উঠছে। আমি ধুঁকতে ধুঁকতে। শেষ পর্যন্ত আমাকেও ক্ষান্তি দিতে হল। মেজ আর বাবলা চুড়োয় উঠে ইয়াহু করে হাঁক দিল। আমি তখন জামা খুলে হাঁপাচ্ছি। ওরাও পরে জামা-গেঞ্জি খুলে ফেলেছিল। প্রচুর ইটে ভর্তি একটা খেজুর গাছের কাছে বসে হ্যা হ্যা করতে করতে বিশ্রাম নিলাম। ওই চুড়োতেও দেখি, ধাপে ধাপে কয়েকটা ছাউনি। অস্থায়ী দোকান সেসব। পর্যটনের মরসুমে দোকান দেওয়া হয়।

তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। এবার নামা উচিত। পাহাড়ের ওপরে হনুমানের লাফালাফি দেখেছিলাম। আরও কোনও জন্তু যদি থাকে। নামার সময়ে আবার অন্য বিপদ। পা রাখা যায় না। টেনে নামিয়ে নিতে যায় ধরিত্রী। আমার পায়ে চপ্পল। অসুবিধে হচ্ছিল। চপ্পল পড়েছি বলে ইন্দ্র তো গালাগাল করছিল। কিন্তু মেজর কোনও সমস্যা নেই। দেখি, তরতর করে নামছে। তারপরই ঘটল কাণ্ডটা। হড়কে পিছনে ঠুকে পড়ল ব্যাটা। ভাগ্যিস গড়িয়ে যায়নি! বিপদ কাটিয়ে পাদদেশে নেমে হাঁফ ছাড়লাম।

ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো বলার অবস্থায় নেই আমরা তিনজনে।

তখন মনে অ্যাডভেঞ্চারের মজা। ঘোষণা করলাম, আগামিকাল যমধারার জঙ্গলে অভিযান। শুনেই মেজ বলল, যমদুয়ার থেকে ফিরতে পারব তো!

ছবি— একমাত্র চিত্রগ্রাহক ইন্দ্রজিৎ সাউ

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *