কমল ঘোষ
‘‘জাহাজে ফিরবেন? একবার জাহাজবাবুদের আপিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসুন, আপনাদের জাহাজ ঠিক সময়ে ছাড়বে কি না।’’
সহৃদয় ভদ্রলোক কথাগুলো না বললে যে সে যাত্রায় কী হত, সে কথা ভেবে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। কালাপানি পেরিয়ে দিন দশেকের আন্দামান যাত্রায় এসে শেষে এখানেই পাকাপাকি ভাবে আস্তানা গেড়ে বসতে হবে না তো? এই আশঙ্কা মনের ভেতর বহন করে দুরুদুরু বুকে যখন পোর্ট ব্লেয়ারের আবের্দিন বাজারে তথাকথিত ‘জাহাজ বাবুদের আপিস’-এ গিয়ে পৌঁছলাম, তখন প্রথমেই এক শীর্ণকায় ব্যক্তির মুখোমুখি আমরা।
নাক পর্যন্ত চশমা নেমে এসেছে। বোতাম আটকানো থাকা সত্ত্বেও যে ঢলঢলে জামাখানা গা থেকে খুলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। মাথার উপর আদ্দিকালের পাখাটি বনবন করে ঘুরলেও বুকের বোতামখানা খোলা ভদ্রলোকের। গরম যেন কিছুতেই কাটে না।
আমাদের জনা তিনেকের দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ফের চোখটা নামিয়ে বললেন, ‘‘বাঙালি তো?’’ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শেষে কৌতুহল নিরসনে জন্য প্রশ্নটা করেই বসলাম, ‘‘কী করে বুঝলেন?’’ ভদ্রলোক টেনিদা মার্কা একখানা হাসি হেসে বললেন, ‘‘এই আপিসে নয় নয় করে ১৬ বছর হয়ে গেল। রামের বনবাসের চেয়েও বেশি। এই চেয়ারে বসে কত বাঙালি দেখেছি, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। আর বাঙালি চিনব না? তা বলুন কী জানতে এসেছেন, আপনাদের জাহাজ ঠিক সময়ে ছাড়বে কি না?’’
ফের বিস্ময়। এ কি অন্তর্যামী? মনের মধ্যে থেকে প্রশ্ন টেনে বার করে আনছে! বললাম, ‘‘ঠিক তাই। আমাদের ফেরার জাহাজ ঠিক সময়ে ছাড়বে তো?’’ তারিখটা জেনে নিয়ে বললেন, ‘‘নাহ, কোনও চান্স নেই।’’
কখনও মাথায় প্রাকৃতিক বজ্রপাত হয়নি ঠিকই, কিন্তু ভদ্রলোকের উত্তরটা শুনে বজ্রপাত হলে মানুষ মৃত্যুর আগে কেমন বোধ করতে পারে, তা টের পেলাম বলে মনে হল। তিনজনে মিলে প্রায় আর্তনাদ করলাম, ‘‘অ্যাঁ? বলেন কী? কেন? তা হলে পরের জাহাজ কবে?’’
ভদ্রলোকের বোধহয় আমাদের বেহাল দশা দেখে কিঞ্চিৎ দয়াদাক্ষিণ্য হল। জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে সামনের চোয়ারগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘‘বসুন, বসুন। একটু জল খান। এ আর নতুন কী? এমন তো প্রায়ই হয়।’’ পরে যে কথাগুলো শোনালেন, সেগুলোর ধাক্কা সহ্য করার জন্য আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না। তিনি বললেন,‘‘আপনাদের ফেরার জাহাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছে। সে যাবে রিপেয়ারিংয়ে। আর এক জাহাজ গিয়েছে লাক্ষাদ্বীপে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সফর আছে। তাই এখান থেকে সেই জাহাজ পাঠানো হয়েছে ওখানে। সুতরাং পরের জাহাজ ছাড়তে আরও দিন পনেরো।’’
অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে যে আমাদের তিনজনেরই শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত নামতে শুরু করেছে, তা বুঝতে পেরেই বোধহয় সেই ভদ্রলোক পরামর্শ দিলেন, ‘‘টিকিট বাতিল করে পয়সা ফেরত নিয়ে আপনারা বরং বিমানে ফিরে যান। পারলে আজই টিকিট কেটে ফেলুন। না হলে পরে আর নাও পেতে পারেন।’’
বিনামূল্যে পরামর্শটি তো বেশ দিয়ে দিলেন, কিন্তু রেস্তটি কি মূল্য ধরে দেবেন? মনে মনে এই কথা বলতে বলতে যখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসছি, তখন আমরা দিশাহারা। সামনে বড় কঠিন পথ।
কাঠ ও খড় দুইই পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আকাশপথে ফেরারই ব্যবস্থা হল। তবে জাহাজ ভ্রমণ যে কতটা ঝুঁকির ব্যাপার, তা সে যাত্রায় টের পেলাম। তাই এখনও কেউ জাহাজে আন্দামান যাবে বা সেখান থেকে ফিরবে শুনলে, তাঁকে এই ঘটনার কথা না শুনিয়ে পারি না। অনেকে ভাবে, বাঙালি যখন, কাঠি তো দেওয়ার চেষ্টা করবেই। কিন্তু এ যে কাঠিবাজি নয়, জীবন দিয়ে অর্জন করা অভিজ্ঞতা, সে আর কে বোঝাবে?
জাহাজ ভ্রমণ যে শুধু ঝুঁকির নয়, সময়ের দফা রফা হওয়ারও আর এক নাম, তা নিয়ে আর একটা ঘটনা শোনাই। সেই সফরেই রওনা হওয়ার সময়ের ঘটনা। বিকেল চারটেয় জাহাজ ছাড়ার কথা। তিনি ছাড়লেন সন্ধে সাতটার পর। ভাল কথা। জাহাজের চলা শুরু হল। তবে নতুনত্ব কিছু নেই।
বাবুঘাট থেকে হাওড়া বা হাওড়া থেকে বাগবাজার জলে ভেসে যাওয়ার সময় যে অভিজ্ঞতা হয়, জলের মাঝখান থেকে দু’দিকে শহর সভ্যতার দৃশ্য দেখতে দেখতে ভেসে যাওয়া যায়, তেমনই যেন।
বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সাগর ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই সেই ভ্রমণ-সূচনায়। তবে আশ্বাস পাওয়া গেল ওয়াকিবহাল মানুষদের কাছ থেকে। যাঁরা একাধিকবার জাহাজে ভ্রমণ করছেন, তাঁদের কাছ থেকে। জাহাজ একবার সাগরে পড়ুক, তারপরে দেখবেন কেমন লাগে। সারা জীবন মনে রাখবেন সেই অভিজ্ঞতা।
মনে সেই আশা ও পরের সকালে সেই দৃশ্য দেখার স্বপ্ন চোখে নিয়ে জাহাজের কেবিনে শুয়ে তো পড়লাম। জলে ভাসমান অবস্থায় ঘুমও হল ভালই। মায়ের কোলে দোল খেতে খেতে যেমন ঘুম আসত ছোট্টবেলায়। যেন তেমনই। কিন্ত সকালে ঘুম ভেঙে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। এই দৃশ্যের আগাম খবর কিন্তু সেই ওয়াকিবহাল সহৃদয়রা কেউই দেননি। ফলে ধাক্কাটা বেশ জোরেই খেতে হল।
পর দিন সকালে চোখ খুলে দেখলাম আগের সন্ধের মতো জলের মাঝখান থেকে দু’দিকের জনজীবন দেখা যাচ্ছে! জাহাজ কি তবে ফের কলকাতার দিকে ফিরছে? আমাদের এক সফরসঙ্গী, যাঁর বাড়ি বাটানগরে, তিনি আবিষ্কার করলেন, ‘‘আরে, এ তো মনে হচ্ছে ডায়মন্ড হারবার!’’ কথাটা শুনে যেমন চমকে উঠলাম, তেমনই অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হল না। তা তো হতেই পারে। না হলে আর দু’দিকে এমন শহরাঞ্চল দেখা যাবে কী করে?
কৌতূহল নিরসনের জন্য পাকড়াও করা হল এক জাহাজকর্মীকে। তিনি মিচকি হেসে বললেন, ‘‘ঠিকই তো ধরেছেন। ওটা ডায়মন্ড হারবারই।’’ বোঝো ঠেলা। যে রাস্তা খিদিরপুর থেকে বড়জোর তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়, সেই রাস্তা জাহাজে চেপে কি না লাগল প্রায় বারো ঘণ্টা! জাহাজ কর্মী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ‘‘বুঝুন তা হলে। কতবার সরকারকে বলা হয়েছে আন্দামানের জাহাজ হলদিয়া বন্দর থেকে ছাড়া হোক। তা হলে অনেক তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছনো যাবে। তা নয়। কলকাতা থেকে ছাড়া মানে সাগরে পড়তেই ২৪ ঘণ্টার বেশি লেগে যাবে। এই একটা দিন পুরো নষ্ট। জ্বালানিরও অপচয়।’’
অপচয় বলে অপচয়। সে জাহাজ হলদিয়া পৌঁছল সন্ধেবেলা। জানা গেল, জাহাজের গঙ্গায় ভাসার আপন নিয়ম হল, যতক্ষণ গঙ্গায় জোয়ার থাকবে, ততক্ষণ তিনি এগোবেন। ভাটায় তিনি বিশ্রাম নেবেন। এ ভাবে তিনি কলকাতা থেকে হলদিয়া পৌঁছতে সময় নেবেন এক দিনেরও বেশি। দ্বিতীয় রাতে যখন শুতে গেলাম সকলে, তখন জাহাজ বিশ্রামরত। আশার কথা শোনা গেল, মাঝরাতে ভাটা এলে তিনি ফের এগোবেন এবং বঙ্গোপসাগরে তাঁর প্রবেশ ঘটবে। তা-ই হল। তবে তাঁর সাগরে প্রবেশ করার দৃশ্য আর দেখা গেল না। কারণ, তখন সবাই ঘুমিয়ে। জেগে থাকলেও কতটা লাভ হত জানি না। কারণ, রাতের অন্ধকারে আর কীই বা বোঝা যেত? তবে দ্বিতীয় সকালে যা দেখলাম, তা সত্যিই অপূর্ব। চিরস্মরণীয়। সাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে এক অজানা আনন্দের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুভূতি কি আর লিখে ঠিকমতো বোঝানো যায়?
তবু সে অনুভূতি বোঝানোর চেষ্টা না হয় আর একদিন করা যাবে। আর তখনই বোঝানো যাবে জাহাজ-ভ্রমণ শুধুই ঝুঁকির বা সময় অপচয় নয়। এর তৃপ্তি যে কোনও বিলাসবহুল বিমান ভ্রমণের আনন্দকেও টক্কর দিতে পারে অনায়াসে।
জাহাজ ভ্রমণের সেই মজার গল্প না হয় আর এক দিন করা যাবে।
ছবি- সুব্রত চক্রবর্তী এবং দেব প্রিয়ার সৌজন্যে
(সমাপ্ত)