জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

হিজলির সৈকতে

পার্থ দে

হাতে সময় কম। মাত্র একটা দিন ছুটি। নিজের বা ভাড়ায় একটা গাড়ি যোগাড় করুন…..আর যদি পিকনিকের মুড থাকে তাহলে রান্নার সরঞ্জাম ও কিছু খাদ্য সামগ্রী গাড়িতে লোড করুন। সঙ্গে একটা ফুটবল আর একটা ক্যামেরা নিয়ে নিন। ব্যাস ৫-৬জন বন্ধু/বান্ধবী বা পরিবার দলবেঁধে টি-টোয়েন্টি মোডে বেরিয়ে পড়ুন এক অফবিট ডেস্টিনেশনের উদ্দ্যেশ্যে। কলকাতা থেকে মাত্র ১৬০ কিমি দূরে এই জায়গাটি হল পূর্ব মেদিনীপুরের হিজলি শরিফ।

ঝাউ পাইনের বাগান -সবুজ ঘাসের গালিচা – শান্ত স্নিগ্ধ বেলাভূমি – ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ – ট্রলার, জাহাজের ভেসে যাওয়া। এইসব নিয়ে হিজলি সৈকত। এখানে রসুলপুর নদী হুগলি নদীতে মিশেছে, আবার কিছু দূরে হুগলি নদীও বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। তাই নদীর বিশালাকার ব্যাপ্তি এখানে। যেন একটা মিনি সমুদ্র। পূর্ণিমা, অমাবস্যা তিথি বা আবহাওয়া খারাপ থাকলে জলের ঢেউ বেড়ে যায়। কাছেই একটা হিজল গাছের (ম্যানগ্রোভ) জঙ্গল। সকাল ৮টা-৯টার মধ্যে জোয়ারের কারণে জল অনেক কাছে চলে আসে। গাছগুলি তখন জলে অর্ধনিমগ্ন হয়ে পড়ে। কয়েকটি শুকনো গাছ যেন ফটো তোলার জন্য পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গাছের নিচু ডালে বসে জলে পা ডুবিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারেন। অথবা দড়ির দোলা কিনে নিয়ে গিয়ে পাশাপাশি দুটি শুকনো গাছে বেঁধে শুয়ে শুয়ে দোল খেতে পারেন। সকালে মনের সুখে জলকেলিতে মেতে উঠুন। ভয় নেই এখানে জলের গভীরতা খুব বেশি নেই। তাই ছোট বাচ্চারাও আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। তবে জল লবণাক্ত। বেলা বাড়তেই জল কোনও এক অভিমানে দূরে সরে যায় (চাঁদিপুরের মতো)। কুছ পরোয়া নেই। তখন বিচ ভলি বা ফুটবল খেলতে পারেন। বয়স্করা লুডো বা তাস খেলতে পারেন। আবার বিকেলে ৪টা-৫টা নাগাদ জোয়ার আসে। আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে অপূর্ব এক সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকতে পারেন।

জলমগ্ন তট।

এবারে জায়গাটার একটু ইতিহাস ছোট্ট করে বলি। তাজ খাঁ হলেন জনৈক আফগান মেদিনীপুর জেলার একমাত্র ক্ষুদ্র মুসলমান রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা (ইং ১৬২৮ থেকে ১৬৪৯)। সমুদ্র তীরবর্তী হিজলি তাঁর রাজধানী। ‘সনদ’ পেয়েছিলেন দিল্লির বাদশাহর শর্তে উড়িষ্যার সুবেদারের কাছ থেকে। সম্রাট শাজাহান ২৮টি মহল নিয়ে “হিজলী ফৌজদারী” গঠন করে দেন। প্রথম ফৌজদার তাজ খাঁ। ভাই সিকান্দারের হাতে শাসনের ভার দিয়ে নিজে ধর্মচর্চা নিয়ে থাকতেন। উপাধি পেয়েছিলেন “মসনদ-ই -আলা”। তিন গম্বুজের একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন এই ধার্মিক শাসক। পারিবারিক চক্রান্তে সিকান্দার নিহত হলে বিষন্ন তাজ খাঁ অমর্ষির পির “হজরৎ মখদুম শেখ-উল-মোশায়েখ শাহ আবুল-হক-উদ্দিন চিশতি”-র কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। স্বল্প কাল পরে মসজিদের সামনের “হুজরা”র ভিতর সমাধিমগ্ন হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

হিজলি শরিফ।

ধর্মপ্রাণ, উদার ও অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে তাজ খাঁ আজও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবার পূজা পান। মাজারের বাইরে গাছের নিচে একটি লৌহদণ্ড আছে যেটিকে সিকান্দারের “আশাবাড়ি” বলে (আসলে এটি জাহাজের নোঙ্গরের অংশ)। সেটির উচ্চতা প্রায় ৩ ফুট ও ওজন প্রায় ৪০ কেজি। সমুদ্রের করাল গ্রাসে রাজপ্রাসাদ, দুর্গ সবই অবলুপ্ত। কেবল মসজিদখানি আজও অক্ষত রয়েছে। গ্রামটির নাম নিজকসবা। প্রতি শুক্রবারে ভক্তদের বেশি ভীড় হয়। হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের এক অসাধারণ মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। উভয় ধর্মের মানুষেরা মাজারের বিপরীতে দুর্গা পুজো, গঙ্গা পুজো ইত্যাদির আয়োজন করে। তাছাড়া প্রতি বছর চৈত্র মাসের প্রথম শনিবারে ঘটা করে “উরুস উৎসব” হয়। তখন লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয় । ভীড় এড়াতে চাইলে এই দিনগুলি বাদে যে কোন সময় যেতে পারেন।

কপালকুণ্ডলার মন্দির।

কীভাবে যাবেন :-

কলকাতা থেকে সরসরি বোগা বা হিজলি শরিফের বাস আছে। বোগা বা শ্যামপুর বাসস্টপ থেকে টোটো বা মেশিন রিক্সায় হিজলি।

নিজস্ব গাড়িতে এলে দীঘা রুটে হেঁড়িয়া থেকে বামদিকে হিজলির পথ চলে গেছে। ট্রেনে যেতে চাইলে সাঁতরাগাছি থেকে সকাল ০৬.১০ এর দীঘা লোকালে ০৯.৩৬-এ হেঁড়িয়া স্টেশনে নেমে টোটোতে বাসস্টপ পৌঁছে, আবার বোগাগামী বাসে উঠতে হবে। যাঁরা দীঘা থেকে ফেরার পথে এই জায়গাটা ঘুরে দেখতে চান, তাঁদের কাঁথির রূপশ্রী মোড় থেকে পেটুয়াঘাট যেতে হবে (১৪ কিমি)। প্রথমে লাইট হাউস, শিব মন্দির ও কপালকুণ্ডলা মন্দির দেখে পেটুয়াঘাটে গাড়ি পার্কিং করে ফেরি নৌকায় নদী পেরিয়ে হিজলী যেতে হবে।

হিজলি চরে।

কাছাকছি আর কী কী স্পট দেখবেন :-

** হেঁড়িয়া হয়ে হিজলি আসার পথে নীলকুমারী মায়ের মন্দির দেখে নেবেন।

** ফেরী নৌকায় রসুলপুর নদী পেরিয়ে ওপারে পেটুয়াঘাট মৎস বন্দর যার পোশাকি নাম দেশপ্রাণ ফিশিং হারবার।

** ১ কিমি দূরে দরিয়াপুর লাইট হাউস। উচ্চতা ৯৬ ফুট। দর্শনের সময় বিকাল ৩টা থেকে ৫টা।

** আরো একটু এগিয়ে সিদ্ধেশ্বর মহাদেবের মন্দির। অষ্টাদশ শতকে রাজা যাদবরাম রায় এই চারচালা মন্দিরটি নির্মান করেন। প্রতি বছর ১লা আশ্বিন বিরাট বড় মেলা বসে।

** সামান্য দূরে রাজা যাদবরাম রায় নির্মিত মা ভবানীর মন্দির। কাঁথির ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এখানে জঙ্গলের মধ্যে এই মন্দিরটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৬১ সালে বিখ্যাত কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলার উপন্যাসের স্মৃতি বিজড়িত বলে এটি কপালকুণ্ডলা মন্দির বলে বিখ্যাত। মন্দিরটিকে সংস্কার করা হয়েছে। এখানে কোনও বিগ্রহ নেই।

** এখান থেকে কয়েক কিমি দূরে আরো দুটি পরিত্যক্ত লাইট হাউস আছে। একটি পোর্তুগিজদের তৈরি। অন্যটি ইংরেজদের তৈরি।

** উৎসাহীরা সমুদ্রপাড় বরাবর নির্জন এই পথ ধরে এগোতে থাকলে প্রথমে বাঁকিপুট সৈকত, তারপর যথাক্রমে ভোগপুর, গোপালপুর, কাদুয়া, জুনপুট, হরিপুর, শৌলা, চাঁদপুর, বগুরান জলপাই ইত্যাদি সৈকত দেখতে পাবেন।

দরিয়াপুর লাইট হাউস।

 

কোথায় থাকবেন :-

কয়েকটি “হোম স্টে”র নাম ও ফোন নাম্বার—গুরু গোবিন্দ নিবাস (৮৭৬৮৮৯৩০০৩), হিজলী সৈকতাবাস (৯৭৩৩৫১৪৭৪৩), সাগরিকা পান্থনিবাস (৯৬০৯৬১৩৩৭৭), নিরালা পান্থনিবাস (৯৭৩৪০২১২৭৩), শান্তি পান্থনিবাস (৭০৭৬৪০৯৭৯১)। আর আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন তাহলে চাঁদনী রাতে টেন্ট খাঁটিয়ে বালিয়াড়িতে থাকতেই পারেন। তবে অবশ্যই খেজুরি থানা / নিজকসবা ফরেস্ট অফিস (বাজকুল রেঞ্জ)/ খেজুরী-২ ব্লক অফিস থেকে অগ্রিম অনুমতি নিতে হবে।

খাওয়া দাওয়ার জন্য ছোটোখাটো কিছু হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে।

 

 

কিছু কথা :-

# মসজিদ কমিটির নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলবেন। এমন কিছু করবেন না যাতে ধর্মীয় ভাবাবেগ ক্ষুন্ন হয়।

# শুদ্ধ দেহ ও মনে মসজিদে প্রবেশ করবেন।

# বালিয়াড়িতে গাড়ি চালাবেন না।

# যত্রতত্র আবর্জনা ফেলবেন না।

# কমিটির পক্ষ থেকে টয়লেট, বাথরুম ও পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। তবুও জল কিনে খাওয়াই ভালো।

ছবি- লেখক

কভারের ছবি- পেটুয়াঘাট মৎস্য বন্দর

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *