অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

রাবড়ি-বৈশাখী বিকেলে

দীপক দাস

মঙ্গলে ঊষাটা কখন হয়? ঠিক বলতে পারবুনি গো! মানে আমি এই পাড়ারই লোক। কিন্তু ঊষাকে ঠিক চিনি নে বাপু। আগে চিনতুম। এখন ভুলতে বসেছি।

ওই সময় যে আমার গভীর রাত। তিমির সাতটি তারার থেকেও বেশি কালো তখন আমার চোখে। ঘুম তিমির বিনাশি হয় না। ফলে উঠতে দেরি। ফলে সকালের সকল কাজের দেরি। একদিনের ছুটিতে দুপুরে ঘুমের চেষ্টা। সেটাও দেরিতে। ফলে বিকেলে বাইক নিয়ে সাঁই সাঁই আর হয়ে ওঠে না। তাছাড়া সঙ্গীরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে ব্যস্তও হয়েছে। এদিকে আমার দুরন্ত দুপুরগুলো সব ক্লান্ত। বিকেল বলে কিছু নেই। দুপুর থেকে লাফিয়ে সন্ধে। ঘরের কোণে হেদিয়ে মরে মরে মরিয়া হয়ে উঠেছিলুম। এক মঙ্গলবার ইন্দ্রকে ফোন করে জানিয়ে দিলুম, বেরবোই।

গাঁওখানি মোর।

বেরিয়ে পড়লুম শেষে। আমি আর ইন্দ্র। শুভ উত্তরপ্রদেশে মালগাড়ি নিয়ে দৌড়চ্ছে। বাবলার ব্যবসার চাপ। দীপু রোজকারের মতো বোটানিক্যাল গার্ডেনে। সুতরাং আধ পড়ন্ত বিকেলে দু’জনে। তবে ছোট সফর হোক বা বড়, ঘুরতে বেরলে হাতের কাছে থাকা সকলে বলাই আমাদের দস্তুর। দীপু যেতে পারবে না। তবু ফোন করলুম। ও বলল, ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে যেতে। গেলাম। আমাদের গ্রামের কোম্পানি ট্যাঙ্কের মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর ইন্দ্র ছবি তুলছিল। এই জায়গাটা বেশ লাগে আমার। পিচ রাস্তার ওপরে একটা ঝাঁকড়া অশত্থ গাছ। তার পরে খাল। খালের ওপারে একটা ইটের পাঁজা, বাঁশবাগান, ডোবা মতো পুকুর আর হরেক গাছের জঙ্গল। অন্যদিন দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে যাই। আজ দাঁড়িয়ে দেখলাম। সেই যে কবি ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন, দেখা হয়নি দুই পা ফেলিয়া। সেটা আজ বেশ উপলব্ধি করতে পারলুম।

নানা কোণ থেকে ছবি তুলছিল ইন্দ্র। ঠিক তখনই এল দীপু। সঙ্গে এক বিরাট চমক। দেখি, নন্দিদি দীপুর পিছনে বসে। নন্দিদি মানে আমাদের বোন নন্দিতা। বেচারা আমাদের সঙ্গে সফরে বেরোবে বলে বহুদিন থেকে বায়না করে চলেছে। ওর নিজের দাদা প্রত্যেকবার বাড়িতে নানা কথা বলে কাঁচি করে দেয়। আজ দীপু নন্দিকে সঙ্গে করে নিয়ে বেরিয়েছে দেখে অবাকই হলুম। দীপু বলল, আজই পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই…

আমরা। তবে ইন্দ্র মানেই গুবলেট। সেলফি তুলেছে হেলমেট পরে। খেয়াল হতে আবার পোজ দিতে হল।

আমাদের আজকের সফর বেশি দূর নয়। পাশের জেলা হুগলির সেই রাবড়ি গ্রাম। আবার যাচ্ছি সেই অমৃত কড়াইয়ের সন্ধানে। বড়গাছিয়া সকাল বাজার পেরিয়ে পড়লুম ফুরফুরা-আঁইয়া-গোপালপুর রোডে। হাওড়া-আমতা রেললাইন আর প্রতিমার চুল তৈরির জায়গাটা পেরিয়ে গেলে রাস্তাটা আমার খুব ভাল লাগে। দু’পাশে আদিগন্ত চাষের জমি। সবুজ ধানের হিল্লোল। তার মাঝে মাঝে একটা আলপথ গ্রামের দিকে ঢুকে গিয়েছে। গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তার পাশে খিরিশ, বটের মতো কিছু মহীরুহ। কলকাতার ফুটপাতে বিভিন্ন শিল্পীর ছবির প্রিন্ট বিক্রি হয়। গ্রামের ছবিও থাকে তাতে। আমার মনে হয়, এই রাস্তার দু’পাশের যে কোনও জায়গার ছবিই ছবির মতো সুন্দর।

এই এলাকাটা হুগলি জেলায় পড়ে। হাওড়ার একেবারেই সংলগ্ন। কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে কিছুটা আলাদা বলেই মনে হয়। এখানে এখনও বিকেলে কোনও রাখাল বা গৃহবধূ গরু নিয়ে ঘরে ফেরে। এখনও খাল পাড়ে কোনও বৃদ্ধ বা জোয়ান এক মনে ছিপ ফেলে। আর কয়েকজন খুব মন দিয়ে সেই ছিপ ফেলা দেখে। আরেকটু এগিয়ে লক্ষ্মণপুর ঢুকলে এক ছায়া ঘেরা পাড়ার দেখা মেলে। রাস্তার পাশে মাঝেই মাঝেই খণ্ড খণ্ড ডোবা। বোঝা যায় একসময় বড় সড় কোনও প্রবাহ ছিল। সময়ের পলিতে তারা মজে গিয়েছে। ডোবা ঘিরে বাঁশগাছ, প্রাচীন বৃক্ষ। কিন্তু তার পরের রাস্তাটা কেমন যেন জবরজং। আরেকটু এগোলে বিদ্যুৎ দফতরের নতুন সাবস্টেশন। ওটা হওয়াতে জায়গাটায় দোকানপাট বাড়ছে। নির্মাণ হচ্ছে। সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর হ্যাঁ, আরেকটা তথ্য, এই রাস্তা দিয়েই কিন্তু সিঙ্গুরের বাস চলে। সেই সিঙ্গুর, চাষ বনাম কারখানার সিঙ্গুর।

ওই যে দূরে যন্ত্রসভ্যতার বেড়া। সবুজ যতদিন থাকবে ততদিনই শান্তি।

এসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলুম রাবড়ি গ্রামে। গাংপুর। আঁইয়া গ্রাম পঞ্চায়েত। এবং রাস্তা ভুল করলুম। যদিও এটাই ঠিক রাস্তা বলে জেদটা বজায় রেখেছিলুম। আগের রাবড়ি খেতে আসার যে অনেক স্মৃতি। সেই লোককে খুঁজতেই বাইক ঢুকছিল পাড়ার মধ্যে। তখনই দূর থেকে চোখে পড়ল একটা পেট। ইন্দ্রকে বললুম, ওই পেটের সামনে বাইক থামা। ওঁর কাছে রাবড়ি মিলবে। জিজ্ঞাসা করতে হ্যাঁ বললেন সেই জালার মতো বিশাল পেটের লোকটি। আমি ফিসফিসিয়ে দীপু, নন্দিকে বললুম, এই পেট একমাত্র মোদকদেরই হয়। ভদ্রলোকের নাম সনৎ ঘোষ। উনি রাবড়ি ছাড়াও সরভাজা করেন। এতো নাকের বদলে নরুন নয়, নাক আর নরুন দু’টোই মিলল! দু’টোই নেওয়া হল।

কিন্তু আগের বারের রাবড়িওলা? সেই নেপাল বালতি? যাঁর রাবড়ি নিয়েই তো কত কাণ্ড! খুঁজতে খুঁজতে এ গলি, ও গলি পেরিয়ে মিলল তাঁকে। ভদ্রলোকের কিছুই মনে নেই। অনেক কষ্টে, অনেক উদাহরণ দিয়ে মনে করানো গেল তাঁকে। নেপালবাবু ইন্দ্রকে চিনতে পারলেন। স্বাভাবিক। উনি যদি বালতি হন, চেহারায় ইন্দ্র ওয়াটার পিউরিফায়ার তো বটেই। মনে থাকবেই। আবার রাবড়ি কেনা হল। তারপর বাড়ির পথ। কিন্তু কিছু দূর যেতেই আকাশ কালো করে এল। দু’ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। আমরা পড়িমড়ি করে বাইক ছোটালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব স্বাভাবিক। ঠিক হয়েছিল আকাশ ভাল থাকলে ডোমজুড় যাওয়া হবে। কিন্তু প্রকৃতির অবস্থা খারাপ দেখে দীপু একবার হ্যাঁ বলে, আরেকবার না বলে।

রসস্থ সরভাজা।

শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক হল। কিন্তু ডোমজুড় যাওয়ার আগেই পুলিশে পাকড়াও করল। লাইসেন্স আছে, হেলমেট আছে। কিন্তু অফিসার অত্যন্ত সাবধানী এবং জনহিতার্থে চিন্তিত। তিনি বিমার কাগজ দেখতে চাইলেন। ইন্দ্রর আছে। কিন্তু দীপু সেটা বাড়িতে ফেলে এসেছে। অফিসার খুব কড়া। বিমার কাগজ দেখাতেই হবে। দীপু বলল, তোমরা দাঁড়াও। আমি বাড়ি থেকে নিয়ে আসছি। ইন্দ্র ততক্ষণে ওর এক পরিচিত পুলিশ অফিসারকে খুঁজে পেয়েছে। তাঁকে ফোন করল। তার কিছুক্ষণ পরেই দেখি, অফিসারের ফোন এল। ফোন কেটে উনি দীপুর লাইসেন্সটা ফেরত দিয়ে বললেন, যান। অনেকদিন আগেই বুঝেছিলাম, খুঁটির জোর ছাড়া এ বাংলায় কিছু করা মুশকিল।

ডোমজুড়টা মোটেও বেড়াবার জায়গা নয়। কিন্তু ইন্দ্র কী কাজে এসেছে। ও কাজ মেটাতে মেটাতে আকাশ আবার বিগড়ে গেল। কোনও মতে মতিঝিলের আগে এসেছি আমরা। প্রবল জোরে ধেয়ে এল ঝড়। ইন্দ্রর মতো শক্ত হাতও বাইকের হ্যান্ডেল ধরে রাখতে পারছিল না। রাস্তার ধুলো একজোট হয়ে আছড়ে পড়ছিল আমাদের গায়ে। ধুলোর যে ওমন শক্তি থাকতে পারে সেদিনই প্রথম বুঝলাম। কোনও রকমে গিয়ে ঢুকে পড়লাম ডোমজুড় স্টেশনে। ওয়েটিং রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হল ঘন ঘন বজ্রপাত। প্রবল বৃষ্টি আর ভীষণ ঝাপটা। ঝড়ের চোটে ডাল ভাঙছে। স্টেশনে বাসা বেধে থাকা কাকগুলো একটা একটা করে খসে পড়ছে নীচে। দীপু অবশ্য বলল, ওরা খসে পড়ছে না। বিপদ এড়াতে নিজেরাই নেমে পড়ছে। দীপুর কথায় আমরা কখনও গুরুত্ব দিই না। ও জঙ্গলে গাছ চিনতে পারে না। অথচ বটানি ওর বিষয়। আর কাক তো জুওলজির ভাগে পড়ে।

ঝোড়ো কাক।

আমরা চারজনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। আরও লোকজন কোথা থেকে এসে যেন আশ্রয় নিল। আমার চিন্তা হচ্ছিল নন্দির জন্য। বেচারা একদিন ঘুরতে বেরিয়েছে আর প্রকৃতির সেটাও সহ্য হল না! তাছাড়া ওর বাবা, মা চিন্তা করবে। ও নিজেও চিন্তিত। ওকে আমরা অপয়া বলে সাব্যস্ত করব কিনা। দীপু নন্দির চিন্তা দূর করে দিল। বলল, দিনটাই আজকে ওর খারাপ যাচ্ছে। প্রথমে অফিস থেকে ফেরার পথে বোলতা কামড়েছে। তারপর পুলিশে ধরল। শেষে ইন্দ্রদেব আর বরুণদেবের যৌথ হামলা। নন্দি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, ও তাহলে পনৌতি নয়। সকলে চিন্তা মুক্ত হতে আমি মোবাইলে বাজের আলোয় ঝোড়ো প্রকৃতির ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সাফল্য অধরা। থির বিজুরি বাস্তবে কি আর হয়!

আধ ঘণ্টার মধ্যে ঝড় বৃষ্টি থেমে গেল। এবার ফেরার পালা। কাকগুলো তখন ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে গাছের তলায় বসে কাঁপছে। বড় রাস্তায় যখন উঠলাম দেখি, রাস্তায় অনেক লোক। ওরা গাছের ডাল, কৃষ্ণচূড়া গাছের ফল কুড়োচ্ছে। পরে জ্বালানির কাজে লাগবে।

গাছের ক্ষতি কিন্তু মানুষের লাভ। কী অদ্ভুত বিপরীত নিয়ম দুনিয়ায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তো তাই হল। রাবড়ির পরে পুলিশ আর কালবৈশাখী!

(সমাপ্ত)

 

প্রথম বারের রাবড়ি অভিযান পড়তে হলে এই লিঙ্কে যান…

অমৃত কড়াইয়ের সন্ধানে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *