শতাব্দী অধিকারী
নৌকা ভিড়ল তীরে। আমরা সবাই একে একে নামলাম। খানিক দূর হেঁটে এগিয়ে যেতে দেখলাম বাঁদিক বরাবর কয়েকটা গুমটি। বাকি রাস্তা ধুলো এবং কাদা। বাঁধ তৈরি হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট। এই বাঁধ নিয়ে অনেক গল্প শোনাল আল্পনার ভাই। কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না, শুধু এইটুকু বুঝলাম এই বাঁধ তৈরি এবং কমপ্লিট হওয়া নিয়ে গ্রামবাসীরা খুব উত্তেজিত। এর আগেরবারের বাঁধ নাকি ভেঙে গিয়েছিল আয়লাতে, তারপর এই।
এরপর আমরা আবার ভ্যানে উঠলাম। আল্পনা জানাল আমি আর আল্পনা যাব ওর বোন কল্পনার বাড়ি। কারণ ওখানেই ওর মেয়ে থাকে। বাড়িটা ক্যানালের এপারে। আর ওর ভাই, ভাজ আর ভাইপো যাবে ওর বাপের বাড়়ি, যেটা ক্যানালের ওপারে। যদিও পিসি নেওটা বাবু আল্পনার সঙ্গে ছোট পিসির বাড়িই যেতে বায়না ধরল। অদ্ভুত লাগল দেখে, এতে ওর মায়েরও বিশেষ অসুবিধা হল না। এত দীর্ঘ রাস্তার ধকল শেষে ছেলেকে অনায়াসে পিসির সঙ্গে পাঠিয়ে দিল মা। আমরা তিনজন এগোলাম। প্রথমে পাড়ার মাঝের সরু রাস্তা, তারপর ধানক্ষেতের আল ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম দু’পাশ থেকে নুইয়ে পড়া ধানগাছ দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে। তারপর এল ফাঁকা একটা জমি। ধান কাটা হয়ে গিয়েছে।
আল্পনা দেখাল, ‘‘ওই যে আমার বোনের মেয়ে দাঁড়িয়ে। বাবু ওর খুব নেওটা।’’ কিছুদূর এগোতে ফ্রক পরা সেই মেয়ে এসে বাবুকে কাঁখে তুলে নিল। আমরা আরেকটু এগিয়ে দেখতে পেলাম আল্পনার বোনের ছেলেকে। সে-ও ওই একইরকম প্যাংলা। কিন্তু ভাইবোনের মুখ ভারী মিষ্টি। অদ্ভুত একটা লালিত্য রয়েছে। সে লালিত্যের উৎস তখন দূরে উঁচু মাটির ঢিপির উপর দাঁড়িয়ে। এলো চুল। সদ্য স্নান সেরে ওঠা। কপালে চন্দনের ফোঁটা। পুজোও সারা হয়ে গিয়েছে অতএব। আলগা গায়ে কাপড় জড়ানো। মুখখানা ভারী মিষ্টি। এই হল গিয়ে আল্পনার ছোট বোন, কল্পনা। আর কল্পনার পাশে দাঁড়িয়ে মিতভাসি আল্পনার মেয়ে। এক্কেবারে মায়ের মুখ বসানো।
একটু কল্পনার বাড়ির বর্ণনা দিই। ছোট এক কামরার মাটির ঘর। মাটি থেকে উঁচু। কারণ বন্যার আশঙ্কা। টিনের চাল। সামনে ছবিতে আঁকা বাড়ির মতো এক চিলতে দাওয়া। মাটিতে নিকোনো। সামনে নিকোনো উঠোন অনেকটা জায়গা জুড়ে। বাঁদিকে হাঁসের ঘর, গোয়াল ঘর। ডানদিকে এক চিলতে জমি। পাশে গাছ ঘেরা পুকুর। তাতে টলটলে জল। এক্কেবারে ছবির মতো। ঘরের দাওয়ায় বসতেই কল্পনা বলে উঠল, ‘‘আরে আরে!! কাদায় বসছেন কেন দিদি!’’ আমি ঘুরে দেখলাম, কই কোথাও তো কাদা নেই। বুঝলাম ও মাটিকেই কাদা বলতে চাইছে। আমি বললাম এই ভাল, ঠান্ডা। তবু সে শুনল না। খেজুর পাতার চাটাই এনে দিল। বলল, এর উপর বসুন। আমি তো দেখেই চমকে গিয়েছি। নিজের বাড়ির জন্য বহুদিন ধরে ঠিক এইরকমই আসন খুঁজছি। জিজ্ঞাসা করলাম, এরকম কি পাওয়া যায় এখানে, আমি কিনব তবে। কল্পনা বলল, ‘‘না না এটা তো মা বানিয়েছে। আমার মা বানায়। ঘরের জন্য।’’ অতএব আর কেনার অবকাশ নেই। ঠাম্মার তৈরি নাড়ু কী কেউ কিনে নিয়ে যেতে পারে!
কল্পনাকে যত দেখছিলাম অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। মেয়ের বন্ধু এসেছে,তাকে বলছে, ‘‘এখন বাড়ি যেতে হবে না। এই রোদে কোথায় যাবি। দু’টো খেয়ে নে। বিকেলে যাবি।’’ কিংবা পাড়ার এক বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীয়ের ঝগড়া হয়েছে। স্ত্রী অভিমানে কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না, তার ছেলেকে ভাত পাঠিয়ে দিল এই মহিলা। বিকেলে চড়কের মেলা থেকে কিনে আনা চমচম, জিলিপি ছেলের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিল ওদের জন্য। দুপুরে তাদের শাশুড়িকে শাকভাজা আর ভাত দিল। আমাদের শহুরে পাড়ায় এখন এই চচ্চড়ি দেওয়া নেওয়া বিলুপ্তপ্রায়। কল্পনাদের বিশাল ভাঁড়ার নেই, স্বামীর কাজ নেই, তবুও পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য ওদের ভাতের হাঁড়িতে চাল কম পড়ে না কখনও।
এরপর আমি, কল্পনা আর আল্পনা সামনের টিউবওয়েলে স্নান করলাম। পাশে খেজুর গাছের আড়ার। অল্পই। ঠান্ডা জল বালতি বালতি কল্পনা আমার মাথায় ঢেলে যাচ্ছিল। আর আমি হাপুস-হুপুস করে স্নান করছিলাম। সেই ছোটবেলার মতো। আমরা তিনজন হাসছিলাম, গল্প করছিলাম। একটা টুকরো ছবি, একটা ভাল লাগা, মনকে খুলে দেওয়া অনুভূতি! কতদিন পর ওভাবে খোলা আকাশের নীচে স্নান করলাম কে জানে।
কল্পনার রান্নাঘরে ঢুকে তো আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। এক্কেবারে ছবির মতো। দৌড়ে গেলাম ক্যামেরা আনতে। কিন্তু এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে একটা ছবিও ভাল তুলতে পারিনি। খেলাম ডাল, শাকভাজা, ভাত। পাস দিয়ে মুরগির ছানারা হেঁটে যাচ্ছে। ইয়া বড় রাজহাঁস ইয়া বড় বড় ডিমে তা দিচ্ছে, আলু শুকোচ্ছে ওধারে। সেসব দেখব না খেতে বসব! ছটফট করতে করতে খেতেই বসলুম। সেই খেজুর পাতা দিয়ে বোনা আসনে। খাওয়া সেরে উঠেছি সবে, এমন সময় কল্পনার ছেলে লাফাতে লাফাতে এসে মায়ের আঁচল ধরে ঝুলে পড়ল। তার দাবি বরফওলা আসছে, তাকে বরফ কিনে দিতে হবে। ওই বরফে বাজে জল থাকে, বাজে রং থাকে, বিকেলে মেলায় ভাল আইসক্রিম খাব ইত্যাদি ইত্যাদি বলেও কোনও লাভ হল না যখন বরফওলাকে থামাল আল্পনা। আমরা সবাই একটা করে বরফ নিলাম। আল্পনা খাওয়াল। সেই বরফের দাম চার টাকা হবে না সাড়ে তিনটাকা হবে সেটা নিয়েও বরফওলার সঙ্গে দড়াদড়ি চলল খানিকক্ষণ। ততক্ষণে কল্পনার উচ্ছ্বল, দুষ্টু কিশোরী রূপটা বেরিয়ে এসেছে। সেই বরফওলা পাশের পাড়ার। তার সঙ্গেও মশকরা চলল। এসব খুনসুটি মিটতে দাওয়ায় এসে টানা ঘুম। মনে হচ্ছিল, কীসের চড়ক, কীসের মেলা। এই বেশ আছি। কোত্থাও যাওয়ার কোনও দরকার নেই।
বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ আল্পনা ঘুম ভাঙাল। দেখলাম কল্পনার মেয়ের ততক্ষণে ওর সবচেয়ে ভাল জামাটা পরে ফেলেছে। এখন গুচ্ছের ক্লিপ নিয়ে সাজতে বসেছে। কল্পনার ছেলের ততক্ষণে সাজ কমপ্লিট। আল্পনার মেয়ে পুচকেটাকে সাজিয়ে নিজে সাজছে। কল্পনা বলল, দিদি তুমিও সেজে নাও। বললাম, স্নান সেরে উঠে যা পরেছি সেটা পরেই যাব। ওরা তো শুনে অবাক! সে কী সাজবে না! আমি মুচকি হেসে মনের সুখে ওদের ছবি তুলতে লাগলাম। তার মধ্যে আল্পনার কুচি করে দিচ্ছি কখন, কখনও কল্পনার বেণী বেঁধে দিচ্ছি। ওদের সকলেরই চুলের গোছ খুব সুন্দর। সেটা বলতেই কল্পনার বর প্রেমিকের সুরে বলল, ‘‘এখন কী দেখছেন দিদি, আগে একহাতে ধরা যেত না। ওই অসুখের সময় সব চুল উঠে গেল।’’ পাড়ার লোক খোঁজ নিয়ে গেল, কী গো কখন রওনা দিচ্ছ? কোন মেলায় যাচ্ছ? বেশ একটা সাজ সাজ রব।
অবশেষ সাজগোজ শেষে আমরা বেরলাম। কল্পনার বর গেল না শুধু। কেন গেল না। সে কারণ আমি জানি।
পড়ন্ত রোদে আমরা মাঠের পর মাঠ, ক্ষেতের পর ক্ষেত পেরিয়ে এগোলাম। মাঝে কল্পনা একজনের বাড়ি দেখাল, বলল, ‘‘ওই যে ওই বাড়িটা দেখছেন, ওই বাড়ির ছেলে বাঘের হাতে পড়েছিল। গতবছর খবর হয়েছিল। খবর করতে এসেছিল সব।’’
লেখার প্রথমে যে ক্যানালের কথা করেছিলাম, একসময় সেই ক্যানালের পাশের রাস্তায় এসে উঠলাম আমরা। ক্যানালের ধারের রাস্তা বেয়ে হেঁটে গেলে বেশ গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটছি মনে হয়। পাড়ার লোকে গল্প করছে, খেজুর গাছের নীচের মাচায় বসে কোনও মেয়ে প্রেমালাপ করছে সেসবও চোখে পড়ে। আল্পনা বোনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কীরে! এবারও তোদের রাস্তা বাঁধিয়ে দিলে না! বর্ষায় তো হাঁটতেই পারব না।’’ উত্তর এল ওই গুড়ের গল্প, কয়েকটা জায়গায় ইট ফেলা হয়েছে বটে। সামনেই তো ভোট। কিছুদূর এগনোর পর আল্পনার বাপের বাড়ির বাকি লোকের সঙ্গে দেখা হল। ছোটখাটো রিইউনিয়ন যেন। সবাই সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পড়েছে। পরিপাটি করে সাজুগুজু করেছে।
ক্যানালে জল নেই। শুকনো। দেখে আমার দেজাভুঁ মতো ঠেকছিল। যেন কোথায় দেখেছি, যেন কোথায় দেখেছি। আল্পনা বলল, জোয়ার আর বর্ষায় ক্যানাল টইটুম্বুর থাকে। এই জলেরও লিজ দেওয়া হয়। লোকেরা কয়েক বছরের জন্য জলের একটা অংশ কেনে, সেখানে মাছ চাষ করে। এছাড়া, এই ক্যানালের জল থেকেই যেহেতু আশপাশের জমিতে জল যায়, সেহেতু কে কতটা জল পাবে তা-ও ঠিক করে দেওয়া। কল্পনার বর এই ক্যানালেই মাটি কাটতে এসেছিল। ১০০ দিনের কাজ। ওকে সে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। কারণ, ওর ঘরের দেওয়ালে কে বিজেপি লিখে চলে গেছে। তাতেই গ্রামের তৃণমূল মাতব্বরের ধারণা হয়েছে, সে বিজেপি করছে। অতএব, তাকে কাজ দেওয়া হবে না। দু’দিন পর পর তাকে কাজ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই অপরাধে। গ্রামের রাজনীতির এমন আরও নানান নমুনা শুনেছিলাম আমাদের সান্ধ্য আড্ডায়। যদি সুযোগ হয় বলব।
সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম মেলা প্রাঙ্গণে। এই মেলা প্রাঙ্গণ আমার দেখা মেলাগুলোর মতো নয়!
(চলবে)
খু ব সুন্দর বন’না,লেখার হাত খুব পটু ছবিগুলো ভালো, বাকি লেখাপড়ার অপেক্ষায় থাকলাম