শতাব্দী অধিকারী
ছোট থেকে বারবার যে মেলা দু’টো দেখেছি তারমধ্যে একটা হল দোলতলার মেলা। যা হুগলি জেলায় দ্বিতীয় প্রাচীনতম মেলা এবং আমার বাড়ির পাশের গলিতে শীতলা মন্দিরের বার্ষিক পুজোর শীতলা মেলা। দুই মেলা ঘিরেই অজস্র স্মৃতি। দোলতলার মেলা বহরে বড়। আর শীতলাতলার মেলা ঘরোয়া। ছোট। কিন্তু ছোট মোল্লাখালির এই চড়কের মেলা এর দু’টোর কোনওটারই চরিত্রগত বৈশিষ্টের সঙ্গে আঁটে না। মেলা বলতে, ক্যানালের ধারের রাস্তার ডান পাশ ঘেঁষে খান পাঁচেক দোকান। একটা ফুচকার দোকান। একটা আইসক্রিমের ঠেলা। একটা রঙিন বরফের গাড়ি। রাস্তার বাঁ পাশে একটা মাঠ। যাতে লোক থিক থিক করছে। মাঠের আয়তনে উপস্থিত লোকসংখ্যা বেশি। সেই মাঠের একপাশেই ছোট মন্দির। সেখানে পুজো হচ্ছে। আমরা যখন পৌঁছলাম পুজো প্রায় শেষের দিকে। মন্দিরের সামনে লালপেরে সাদা কাপড় আর ভেজা গামছা গায়ে দিয়ে বহু লোক বসে রয়েছে। প্রতিটা মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে তাঁরা সবাই উচ্চস্রে কাঁদছে, আকুতি-মিনতি করছে, সামনে নুইয়ে পড়ছে কাঁদতে কাঁদতে। তাদের ঘিরে থাকা ভিড় সামনে ঝুঁকে দেখতে দেখতে প্রায় পড়েই যাচ্ছে। ভেকধারী শিব পার্বতী নিয়ন্ত্রণ করছে সেই ভিড়।
কিন্তু এই কান্নাকাটি কিসের জন্য? জিজ্ঞেস করতেই আল্পনা বলল, পুজো শেষে বাবার (পড়ুন শিবের) ঘটের উপর রাখা পদ্মফুল নিজে থেকে গড়িয়ে পড়ে। উড়ে এসে যে কারও কোঁচড়েও পড়তে পারে। সেই পদ্ম পেলেই বাবার কৃপা পাওয়া যায় বলে জনশ্রুতি। অতএব সামনে আঁচল পেতে সেই পদ্মলাভের জন্যই এই আকুতি ভক্তদের। মনে মনে মুচকি হাসলাম। ভাল বেশ। যাক। বিশ্বাস নিয়ে আর কোনও কথা না বলে আমি যে জন্য এসেছি সেজন্য লেগে পড়লুম। ছবি তুলতে। এদিক-ওদিক সেদিক। ভিড়ে আমায় নজরে রাখছিল আল্পনার গোটা পরিবার। কখনও মেয়ে, কখনও মা, কখনও বোন, কখনও বোনঝি। শহুরে মেয়ে যাতে হারিয়ে না যায়!
পুজোর মাঠের ধারের দিকে চড়কের সরঞ্জাম রাখা। বাঁশের খুঁটি, তাতে লোহার হূক আরও কত কী। অন্যদিকে, লম্বা বাঁশ পোঁতা। কাঠামো বানানো। বুঝলাম, এখানেই ঝাঁপ হবে। ছবি তুলতে তুলতে ঘেমে গিয়েছি, এমন সময় আল্পনার মা আমায় খুঁজে বার করলেন ভিড় থেকে। বললেন, ‘‘চল, আমরা একটু ওদিকে যাই। কল্পনা ততক্ষণে আমাদের কাছে এসেছে। সে-ও বলল, বড্ড গরম, চলো আমরা নদীর পাড়ে যাই। আমরা মেয়েরা সবাই একজোট হলাম। আল্পনা, কল্পনা, ওদের দুই মেয়ে, ছেলে আর দিদা। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম নদীর দিকে। একটু এগোতেই সে কী ভীষণ হাওয়া। যেন সামনেই সমুদ্র।
পৌঁছলাম ঘাটে। ভাঙাচোড়া, অস্থায়ী। দু’পাশে ‘সুন্দরবন’। আর সামনেও। নীচে কাদায় কাঁকড়া, কাঁকড়ার খোলস, গুলে মাছ। একটা ছোট হাতে বাওয়া নৌকা ওপারে যাওয়ার জন্য রওনা দিল। আল্পনা উল্টোদিকের দ্বীপের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘‘ওই যে, ওখান থেকেই বন আরম্ভ হয়েছে।’’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আর বনবিবির মন্দির কোথায়?’’ উত্তর এল, ওধারেই। অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনে হল যেন পৃথিবীর শেষে দাঁড়িয়ে আছি। শেষ সভ্যতা। মানুষ, বাড়ি, ধানের ক্ষেত। এই জলটুকু পেরিয়ে গেলেই অন্য পৃথিবী। সেখানকার আমি কিছুই চিনি না। কিছুই জানি না। আল্পনা বলল, ‘‘কাল যদি থাকেন, পরশু সকালে আমরা ওধারে যেতে পারি।’’ আমি ঘাড় নাড়লাম। মনে মনে আমি জানি, আমি থাকব না কাল এখানে। আমায় ফিরে যেতে হবে আরও জটিল জগতে। যেখানকার জট ছাড়াতে ছাড়াতে একসময় অবসন্ন হয়ে পড়তে হয়।
আমাদের ফোটো সেশন হল বেশ অনেকক্ষণ। আমরা একে অপরের ছবি তুললাম, সেল্ফি তোলা হল। তারপর যেন কোথা থেকে জানা গেল ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। অতএব, ফেরো বাস্তবে। লাগাও ছুট। সন্ধে হয়ে এসেছিল ততক্ষণে। আলোও কমে এসেছে। তাই ছবি ভাল উঠল না। তবে গোটা বিষয়টা দেখে আমি যাকে বলে স্তব্ধবাক। প্রথম কয়েকটা বার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে গলায় চলে আসছিল। পরে খানিক ধাতস্থ হল। চড়কের ঝাঁপ বেশিরভাগ লোকেরই দেখা। জানি। তবে এ আমার প্রথমবার। সেই কারণে, বিস্মিত হওয়া মার্জনীয় হয়ত। ঝাঁপ চলাকালীন, মাঠে এক অদ্ভুত উন্মাদনার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সন্ধের নিভে আসা আলো, সমবেত কণ্ঠোস্বর, ভক্তি (নাকি উন্মাদনা!), ঘুঙুর নাচ, সিঁদুর মাখা লোহার ফলা, দড়ির জাল, বাচ্চাদের কান্না, উপর থেকে ঝরে পড়া বাতাসা, নারকেল, পেয়ারা, আম আর সমবেত জনোচ্ছ্বাস, শ’য়ে শ’য়ে অপরিচিত মুখ যেন কোন এক মায়ার সৃষ্টি করেছিল। যা অবর্ণনীয়, অকহতব্য।
হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম। কেন পেলাম, তা মনে নেই এখন। মাঠের ভিড় কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম আলোর দিকে। সবাই বলছিল এবার মেয়েদের ঝাঁপ শুরু হবে। লোভ হল। ভয় হল। একবার পিছু ফিরলাম বটে। কিন্তু ফিরে গেলাম না। ঘোরে। কল্পনারা ততক্ষণে ছোট ছোট জিনিসপত্র কিনে ফেলেছে মেলার দোকান থেকে। কল্পনার মেয়ের কাঠের ময়ূর, ছেলের কমলা গুলি ভরা বন্দুক। আল্পনা বাড়ির জন্য মিষ্টি কিনল। কালোজাম ধরনের, কিন্তু আকারে অনেক ছোট। রসে ভর্তি বিশাল গামলা থেকে আঙুল ডুবিয়ে মুঠো মুঠো মিষ্টি কাগজের ঠোঁঙায় ভরছিলেন দোকানের মহিলা। তারপর ওজন দরে বিকোচ্ছিল সে সব। পাশে জিলিপি বানাচ্ছিল একজন স্টোভ জ্বালিয়ে। বুঝলাম এরা গ্রামেরই লোক। যে যার মতো ছোট করে দোকান দিয়েছে। তেলেভাজা নেওয়া হল তারপর। সে সব নিয়ে আমরা ফেরার রাস্তা ধরলুম।
ততক্ষণে আঁধার নেমেছে। দূরের আলো ফিকে হয়ে আসতেই আমাদের চারপাশ থেকে মুড়ে নিল অন্ধকার। প্রথমে একহাত দূরেই কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এল। দেখলাম আকাশে অদ্ভুত আলো। তবে তারা নেই। মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ওপারে তাল, নারকেল গাছ। ওদের অবয়ব স্পষ্ট, তাই চিনলাম। আমার সামনে পিছনে আল্পনার বাড়ির লোক। ওরা কথা বলছিল, গল্প করছিল। আমি চুপচাপ হাঁটছিলাম। এরপর আমরা মূল রাস্তা থেকে ক্ষেতে নামলাম, সেই একভাবেই ধানগাছের মাঝখান দিয়ে পাতা আল ধরে ধরে এগিয়ে গেলাম। একসময়ে ফিরলাম কল্পনার বাড়ি। ততক্ষণে আল্পনার বুনোইয়ের বিকেলের কাজ সারা হয়ে গিয়েছে। দাওয়ায় আলো জ্বলছে।
আমরা অন্ধকার ডিঙিয়ে বসলাম দাওয়ার আলোয়। তার আগে হাত, পা, মুখ ধোয়া হল। কল্পনার ছেলে হঠাৎ বলে উঠল, ‘‘আজ আমাদের বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটবে!’’ আমি সবে ভাবতে শুরু করেছি কী ঘটনা ঘটতে পারে তার সম্ভাবনা-অসম্ভাবনা নিয়ে এর মধ্যেই ও পিছনে লুকিয়ে রাখা মিষ্টির প্লাস্টিক সামনে ধরে দুলিয়ে, দুলিয়ে নাচতে লাগল। সে ওদের কী মজা! জিলিপি, মিষ্টি, তেলেভাজা, এসব কী রোজ রোজ খাওয়া হয়! মজা করে খেলাম। এর মধ্যেই আকাশ লাল করে এল। হাওয়া দিতে লাগল এমন যেন ঘরের চাল উড়ে যায়। তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। দাওয়ায় আড়াল বলতে বাকারির ঢাল। বৃষ্টি চলল অনেকক্ষণ। ততক্ষণ সান্ধ্য আড্ডা জমল।
কল্পনার প্রেম তথা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার গল্প, ঘর তৈরির গল্প, মেয়ের বিয়ের খাট তৈরির জন্য গাছ পুঁতে রাখার গল্প, সেই গাছ গ্রামের তৃণমূল মাতব্বরের কেটে নিয়ে যাওয়ার গল্প অনেক কিছু। বৃষ্টি থামল একসময়। কল্পনা উনুনে ভাত বসাল। ডিমের হাঁড়ি নামানো হল। সেই ডিম ভাজা হল। আমার কেন জানি না খুব মন খারাপ হল। বাড়িতে পোষা মুরগি ডিম পারলে নিশ্চই খুব আনন্দ হয়। সেই ডিমগুলোই আমরা খেয়ে ফেললাম। নিমেষে। তসলিমা নসরিন ওঁর কোনও একটা বইয়ে লিখেছিলেন তাঁর বাবার নির্দেশে তাঁর মায়ের বাড়ির পোষা হাঁস কেটে রান্না করার কথা। সে কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
সেদিন রাতে ঘুম হল দারুণ। ঠান্ডা ছিল বলে কি না জানি না। তবে, ঘুম নিশ্চিন্ত ঘুম।
(চলবে)
ভালো লাগছে লেখাটা মাটির গন্ধ মাখা