দীপক দাস
‘মধুচক্রে নামিয়ে দিও।’ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলল গাড়ির চালকের উদ্দেশ্যে। আমি একবার দিলীপদা, আরেকবার সুমন্তর দিকে তাকালাম। না, দু’জনের কারও মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। আগেই শুনেছিলাম, কাগজের গাড়িগুলোতে রাতে লোক তুলতে তুলতে যায়। না হলে শুধু কাগজের জন্য সেই হিলি থেকে মালদায় এলে পরতায় পোষায় না।
ঠিকই। সে কথা মানিও। গভীর রাতের যাত্রীদের ভাড়াতেই কিছু লোকের সংসার কোনও মতে চলে যায়। কিন্তু তা বলে মধুচক্র! বিষয়টা তো আমাদের নিউজ বুড়োকে জানানো উচিত। সিঁটিয়ে বসে রইলাম গাড়ির ভিতরে। ধরা পড়ার ভয় পাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, এরকমও তো হতে পারে, আমাদের গাড়ি মধুচক্রের সামনে থামল আর পুলিশ রেড করল। এই ভোর রাতে সেটা খুবই সম্ভব। কাগজের গাড়ি সমেত আমরাও ধরা পড়লাম। কাগজের বদনাম। আমাদের তো বেইজ্জতের চূড়ান্ত। কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো বুকের পাটা আমার কোনও কালেই ছিল না। মুখ বুজে রইলাম। দেখা যাক শেষপর্যন্ত কী হয়। কাগজের নাইট ম্যানেজার দিলীপদা তো কিছু বলছেন না।
রাস্তার পাশ থেকে একজন লোক আর একটা চেয়ার উঠল। যে লোকটি মধুচক্রে নামিয়ে দিতে বলেছিল সে ফিরে গেল। দেখলাম, রাস্তার পাশে একটা হোটেল। তার মানে হোটেল থেকে মধুচক্রে। বা বেশ মজা তো। কিন্তু চেয়ার নিয়ে কি কেউ মধুচক্রে যায়? জায়গাটা যে ঠিক কোথায় বুঝতে পারলাম না। পুরনো মালদা থেকে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরেছিলাম। জায়গাটা গাজোলের আগে কোথাও হবে। এখানকার কিছুই চিনি না। চিনব কী করে? মাস ছয়েক হল মালদায় এসেছি। উত্তরবঙ্গ সংবাদে কাজ নিয়ে। কিন্তু ততদিনে শুধু আমাদের মেসবাড়ি, বচ্চনের দোকান আর মহানন্দা পেরিয়ে ইংরেজবাজারের আদালত পর্যন্ত চিনে উঠতে পেরেছি।
চেনা সম্ভবও ছিল না। রোজ রাত দু’টো পর্যন্ত কাজ। পাতা প্রেসে পাঠিয়ে প্রথম ছাপা কাগজ ওপর ওপর এক ঝলক দেখে নিয়ে মেসে ফিরতাম। কাছেই মেস। হাঁটা পথ। মেসে ফিরে কাগজটা আরেকটু ভাল করে পড়া। তারপর এক এক করে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায়। একটাই বাথরুম। তাই লাইনে পড়ত। কোনও কোনও দিন এর ঘরে ওর ঘরে গল্পও শুরু হত। শুতে শুতে রাত তিনটের বেশি। পরদিন বেলা ১২টা পর্যন্ত ঘুম। এলাকা চিনব কী করে? আমাদের নিউজ বুড়ো রতনদা। ব্যুরো পদটাকে এভাবেই বদলে নেওয়া হয়েছিল। কল্লোলদা, পার্থদারা তো স্থানীয় উচ্চারণে বলল, নিউজ বুড়া। রতনদা প্রায়ই বলতেন, যেখানে কাজ করতে এসেছ সেখানকার এলাকাগুলো চেনো।
চেনার তো খুব ইচ্ছে। অন্তত শিব্রাম চকরবরতীর চাঁচলে তো যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। মালদায় চাকরি করতে এসেছি অনেকটা ওঁর টানে। আমার গুরুদেব। ওঁর মতো মেসবাসী হওয়ার, বোহেমিয়ান জীবনযাপন করার ইচ্ছে তো বহুদিনের। ওঁর জন্মস্থানটা তো ছুঁয়ে দেখা দরকার। যেদিন মহানন্দা পেরিয়ে প্রথম ইংরেজবাজারে গেলাম সেদিন রাজা শরৎবাবুর নামে রাস্তা দেখে আপ্লুত। ইনি শিব্রামের কাকা। বহু গল্পে এঁর কথা আছে। খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও জায়গাতেই যাওয়া হয়নি। দুপুর ১২টায় ঘুম থেকে ওঠার পরে খাওয়ার জোগাড় করতে করতেই তো আবার দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। জায়গা চেনার সুযোগ কোথায়?
আজ অনেকদিনের ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে। এলাকা দেখতে বেরিয়েছি। সঙ্গে নাইট ম্যানেজার দিলীপদা। ওঁর বাড়ি হিলিতে। সেখানেই যাব। তারপর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। সঙ্গে আছে সুমন্ত। আমার সহকর্মী। ওর বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরের তপনে। এই যাওয়াও হতো না। যদি না পরদিন দোলের ছুটি থাকত। দোলের ছুটিতে কাগজ বেরবে না। তাই এলাকা দেখতে বেড়িয়ে পড়া।…
গাড়ি ছুটছে। মাঝে মাঝে থেমে লোক তুলছে। আর আমি আড়চোখে তাকিয়ে আছি মধুচক্রে নামতে যাওয়া লোকটার দিকে। সে তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চোখে ঘুম নেই। সুমন্তও জেগে। ও কম কথা বলে। দিলীপদা শুধু মাঝে মাঝে জায়গা চেনাচ্ছিলেন। এটা গাজোল। এখান থেকে গৌতম খবর পাঠায়। ফটোগ্রাফার পঙ্কজের বাড়িও এখানে। এটা পতিরাম। সাজাহান আলির বাড়ি। আমাদের কাগজের সাংবাদিক। এভাবেই এগোতে এগোতে একসময় বালুরঘাট পৌঁছলাম। বালুরঘাটে আমাদের সাংবাদিক সুবীর মহন্তের বাড়ি। ফটোগ্রাফার মাজিদুরও এখান থেকেই কাজ করে। এত ভোরে ওদের ফোন করার মানে হয় না।
তারপর গাড়ি আস্তে হয়ে থামল মধুচক্রের সামনে। একী! এ যে একটা মিষ্টির দোকান। লোকটা চেয়ার নিয়ে মধুচক্রের দিকে হেঁটে গেল। যিনি মিষ্টির দোকানের নাম মধুচক্র রাখেন তাঁকে সেলাম না ঢুকে উপায় নেই। অসামান্য রসবোধ। দিলীপদা বলল, মিষ্টি তো ভালই। মধুচক্রের দইও খুব ভাল।
গাড়ি আবার গড়াল। বালুরঘাটে আমাদের কাগজ নেমেছিল কি? ১০ বছর পরে আর খেয়াল নেই।
তখন মোবাইল ক্যামেরার এত চল হয়নি। ফলে ছবি নেই। কভারের ছবি মাজিদুর সরদারের সৌজন্যে। মধুচক্রের ছবি সুবীর মহন্তের দেওয়া।
(চলবে)