দীপক দাস
নানা গল্প বলছিল সুমন্ত, দিলীপদা। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের গ্রাম দেখিয়ে বলেছিল এক আত্মীয়ের গল্প। তাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছিল ওপারে। একদিন মেয়েটির বাবা মারা গেল। কিন্তু বিকেলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে গেট খোলার নিয়ম নেই। মেয়েটি দেখতে পাচ্ছে, বাড়িতে কত লোক শেষ দেখা দেখতে আসছে। তারই বাবাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে। কান্নাকাটির আভাস মিলছে। কিন্তু সে আর জন্মদাতার কাছে যেতে পারছে না। পাঁচটা বাজার ওই অপেক্ষা যে কত দীর্ঘ তা মেয়েটি ছাড়া কে বুঝবে। সীমান্তে নানা টানাপড়েন চলে। বিএসএফের সঙ্গে গ্রামবাসীর। গ্রামবাসীর সঙ্গে রাজনীতির। এই সীমান্তেই এক বিএসএফ জওয়ানকে পিটিয়ে মেরেছিল গ্রামবাসীরা। মেয়েদের সঙ্গে অভব্যতার জন্য। আবার কোথায় যেন গ্রামের এক বধূকে ইচ্ছাকৃত গুলি করে মেরেছিল বিএসএফ। বধূটি তখন পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল। বাংলায় একটা শব্দ আছে, প্রান্তিক। এর যে কত মানে! কত অবমাননাকর! যারা রয়ে যায় নির্জনে, জীবনের, সমাজের চলমান রাজনীতির স্রোত তাদের পাশ কাটিয়েই চলে। চলতেই থাকে। যতদিন না তারা গর্জে উঠে দাবি আদায় করায় সাহস পুঞ্জীভূত করতে পারে।
‘এবেলা’য় থাকার সময়ে একবার এক সীমান্তবাসীর কথা ছাপা হয়েছিল। ওই লেখাটা লিখতে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিল মাজিদুর। রবিউল নাম ছেলেটার। হিলির হাঁড়িপুকুরের বাসিন্দা। ওদের পুরো জীবনটা পরিচয়পত্র নির্ভর। ওষুধ কিনতে গেলে পরিচয়পত্র। কোথাও বেরতে হলে পরিচয়পত্র। গ্রামে ঢুকতে গেলে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে ঢুকতে হয়। মাজিদুর একটা ছবি পাঠিয়েছিল। রবিউল দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’টো পায়ের একটা ভারতে। আরেকটা বাংলাদেশে। এখানে ভারতের গ্রামের দুর্গাপুজোয় বাংলাদেশ থেকে লোকজন আসেন। আবার বাংলাদেশের স্কুলে ভারতের ছেলেমেয়ে পড়তে যায়। মাদ্রাসায় নমাজ পড়ে।
সাংবাদিকতায় ভুলচুক হলে একটা কথা শুনতেই হয়, ঠান্ডা ঘরে বসে খবর করলে এই তো হবে! কথাটা রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও সত্য। জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অফিসে বসে ম্যাপে দাগ দিলে রুটি নেই তো কী হয়েছে, কেক খাচ্ছে না কেন উক্তি বেরবে। ম্যাপের সেই আঁকিবুকিতে ভুগবে সাধারণ মানুষ…
সামনেই এক বিএসএফ জওয়ান ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঢুকলাম কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের গ্রামে। ছোট ছোট ঘরবাড়ি। এক বৃদ্ধ গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছিলেন। তিনি অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। অবাক হওয়ারই কথা। গ্রামে দেখার তো কিছু নেই। তারা কীভাবে বাঁচে, সেটা দেখার আছে। গ্রামীণ সৌন্দর্য আছে। কিন্তু সে তো এপার আর ওপারে এক। শরীর তো একটাই। মাঝে জোরজবরদস্তি দাগের বিভেদ। বৃদ্ধের অবাক চোখের পিছনে এই কারণগুলো থাকতে পারে। জানি না। আমার মনে হচ্ছিল। আমরা দেখলাম, একটা পিলার। যার ওপাশটা বাংলাদেশ। এপারটা ভারত। বৃদ্ধ গরু চরিয়ে বাংলাদেশ থেকেই ফিরছিলেন। আমি কি বাংলাদেশে পা দিয়েছিলাম? আমার পূর্বপুরুষের মাটিতে? মনে নেই।
হিন্দু মিশনপাড়া থেকে আমরা গিয়েছিলাম হিলি স্থল বন্দরে। একটা চেকপোস্ট। তার আগে সার সার লরি দাঁড়িয়ে আছে। একটা রেললাইন। লেভেল ক্রসিংয়ের মতো জায়গাটা। ওপারে বাংলাদেশ। কাস্টমস অফিস। বিডিআর। তখন বিডিআর অর্থাৎ বাংলাদেশ রাইফেল ছিল। এখন তো নাম বদলে বিজিবি হয়েছে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চেকপোস্ট থেকে আবার সীমান্তবর্তী একটা গ্রামে ঢুকলাম। গ্রামের নাম দক্ষিণপাড়া। রাস্তার পাশে বাঁশের পাড়া করা। তাতে রাইফেল হাতে একজন করে বিএসএফ জওয়ান বসে। দূরে রেললাইন। একটা ট্রেন গেল। হিলি চেকপোস্টের দিকেই। ট্রেনটা চলে যেতে দেখতে পেলাম লাইনের পাশে একটা খড়ের কুঁড়েঘর। সেখানে এক বিডিআর রক্ষী বসে রয়েছেন। আর তখনই রাস্তার ডানপাশ থেকে আমাদের সামনে বেরিয়ে এলেন তিনজন মোটা মোটা মহিলা। দেখলেই কেমন যেন চোখে লাগে। এত মোটা যে শাড়ি হাঁটুর বেশ কিছুটা নীচে নেমেই থেমে গিয়েছে। তিন মহিলার একজনের হাতে একটা মোবাইল। কথা বলছে। পুরো প্যাকেজটা হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে ফ্যান্সি ড্রেস পার্টিতে চলেছে ওরা। একটু নজর করতে বুঝতে পারা গেল, কী কারণে ওরা এত মোটা। এসব দেখে বেশিক্ষণ থাকিনি আমরা।
দক্ষিণপাড়া ছাড়াতে দিলীপদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বুঝতে পেরেছেন?’ হ্যাঁ বললাম। ওরা চোরাচালানকারী। কাপড় চালান করছে। মেয়েদের সারা শরীরে কাপড় জড়ানো রয়েছে। তাই এত মোটা। ফোনে ওপারের রাস্তা সাফ আছে কিনা জানার চেষ্টা চলছিল। সীমান্তে অনেক সমস্যা। তার মধ্যে চোরাচালান একটা। এখন তো মাঝে মাঝে বিএসএফ-বিজিবি যৌথ তল্লাশি চালায়। কিন্তু কিছু ফল হয়েছে কী? কে জানে?…
সীমান্ত পর্ব মিটিয়ে ঘরে ফেরার পালা। রবিনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তারপর থেকে আর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। ফোনে দু’একবার কথা হয়েছে। বহু বছর পরে এই লেখার জন্য আবার যোগাযোগ হল। দিলীপদা বাসে তুলে দিলেন।
সন্ধ্যেবেলা আমি আর সুমন্ত বালুরঘাট চলে এলাম। সেখান থেকে বাস ধরে মালদা ফিরতে হবে। সেদিন কাগজের অফিস বন্ধ। তাই কাগজের গাড়ি মালদার অফিসে যাবে না। বাসের টিকিট মিলল। সিটও। গাড়ি গড়াল। মধুচক্র থেকে দই আর খাওয়া হল না। সেই আক্ষেপ কাটতে না কাটতে শুরু হল মিউজিক্যাল চেয়ার। একেকটা স্টপ আসে। আর কন্ডাক্টর এসে বলেন পিছনে যান। কী কাণ্ড! পরে বুঝলাম, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসন সংরক্ষণ করা আছে। তাঁরা উঠলেই কন্ডাক্টর খেদিয়ে দিচ্ছেন আমাদের। সীমান্তের মতো। মাজিদুর গল্প বলেছিল। একবার বিএসএফ এবং বিডিআর একদল ভবঘুরেকে নো ম্যানসল্যান্ডে বসিয়ে রেখেছিল। টানা ১৪ দিন। কেউ কারও দিকে ঢুকতে দিচ্ছে না। টিভিতে খবর হওয়ার পরে তাদের গতি হয়। আমাদেরও হল। আর লোক উঠল না। আমরা ঘুমোতে ঘুমোতে মালদায় ফিরলাম। সেই সদরঘাটের মোড়। সেই মেসবাড়ি।
খিদে পেয়েছিল দু’জনেরই। জানতাম সোমা খাবার পাঠিয়েছে আমাদের জন্য। সোমা আমাদের সহকর্মী। আসলে তখন ও বন্ধু হয়ে গিয়েছে। ওদের বাড়িতে কী পুজো ছিল। বিকেলে বর বাপি আর বোনকে দিয়ে খিচুড়ি পাঠিয়েছিল। বাপিও আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। এমনিতে চুপচাপ হলে কী হবে বাপি খুব রসিক। আমাদের মেস বাড়ি চিনত না। সোমা ফোন করেছিল। আমরা তো তখন হিলি। ওর থেকে নম্বর নিয়ে বাপিকে ফোন করলাম। বললাম, সদরঘাট মোড়ে বচ্চনের দোকানে জিজ্ঞাসা করো উত্তরবঙ্গ সংবাদের মেস কোথায়? শুনে বাপির উত্তর, ‘সদরঘাটে বচ্চন দোকান দিয়েছে? বলো কী!’
খিচুড়িটা কিন্তু জব্বর ছিল। সঙ্গে তরকারি আর চাটনি। আহা! মেসে আমি আর সুমন্ত। বাকিরা বাড়িতে। আমরা পরদিনও রান্না করিনি। খিচুড়ি পরিমাণে প্রচুর।
দু’রাত, একদিন সোমা অন্নপূর্ণা অবতার ছিল আমাদের কাছে।
কভারের ছবি— সীমান্তে বিএসএফ এবং বিজিবি’র যৌথ প্রহরা। ছবি মাজিদুর সরদারের সৌজন্যে।
(শেষ)