কৃশাণু মাইতি
কাঠমান্ডুর দক্ষিণ পূর্বে মাত্র ৪০ কিমি দূরে ধূলিখেলের পাশেই ‘গান্ধা মাল্লা’ পাহাড়ের মাথায় বৌদ্ধদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র ধর্ম স্থান হলো “নমো বুদ্ধ”। শুধু মাত্র ধর্মপ্রাণ মানুষ নয় প্রকৃতি প্রেমী দের জন্যও নমোবুদ্ধ হল সেরা জায়গা। বৌদ্ধদের সেরা তিন স্তূপ-এর মাঝে নমোবুদ্ধ হল একটি। অপর দূটি কাঠমান্ডুর “বৌদ্ধনাথ” ও ‘স্বয়ম্ভূনাথ’ । নেপালে অনেকেই বেড়াতে আসেন অথবা তীর্থ করতে আসেন কিন্তু নমোবুদ্ধ না এসেই ফিরে যান। অথচ সঠিক ভাবে ভ্রমণসূচি বানিয়ে ভ্রমণ তালিকায় মাত্র এক দিন যুক্ত করলেই অনায়াসে ঘুরে নেওয়া যাবে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের পূর্ব জন্মের লীলাভূমি।
ইতিহাসের পাতা থেকে :- প্রথমেই জেনে নিই নমো বুদ্ধ’র ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগেকার কথা। এই অঞ্চলে তখন রাজত্ব করছেন মহারাজ ‘মহারাথা’। মহারাজের তিন পুত্র, তার মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হলেন “মহাষ্টতু” (তিব্বত : নিংগুই কিংসপো)। তিনি যেমনি বিদ্বান তেমনি দয়াবান, সেই সঙ্গে বহু সৎ গুণের অধিকারী। স্বাভাবিক কারণেই তিনি সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন। একদিন মনোরম আবহাওয়া দেখে তিন ভাই চললেন জঙ্গল ভ্রমণে। ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এসে পৌঁছন পাহাড়ের গায়ে এক গুহায় এবং দেখতে পান এক বাঘিনী পাঁচ বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। বাঘিনীটিকে দেখেই রাজপুত্ররা বুঝতে পারলেন যে বাঘিনী খুব ক্ষুধার্ত, আর ক্ষুধার ভারে খুব রুগ্ন। এত রুগ্ন যে নড়া চড়া করতে পারছে না, মৃত্যু আসন্ন প্রায়। মাতৃ স্নেহে অন্ধ বাঘিনী গুহা থেকে বের হয়ে খাবার খুঁজতে যায়নি যদি বাচ্চাদের কোনও অনিষ্ট হয়। কিন্তু নিজে খিদের জালায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে দিনের পর দিন ধরে।
প্রথমে তিন রাজকুমার এসব দেখে এই জায়গা ছেড়ে চলে যান, কিন্তু কিছু ক্ষণের মাঝে কণিষ্ঠ রাজকুমার মহাষ্টতু আবার ফিরে আসেন। বাঘিনীকে দেখে দয়াবান রাজকুমারের মনে দয়ার উদ্রেক হয়, তিনি নিজের হাতে নিজের শরীরের মাংস কেটে বাঘিনীর মুখে তুলে ধরেন। বাঘিনীও রাজকুমারের নিজের উৎসর্গ করা শরীর গ্ৰহণ করে। কিছুক্ষণ পর অপর দুই রাজকুমার ভাইর খুঁজে এসে দেখেন শুধু মাত্র শরীরের “হাড় ও চুল” অবশিষ্ট পড়ে রয়েছে। রাজকুমাররা ওই “হাড় ও চুল” তুলে নিয়ে আসেন, এবং ওই “হাড় ও চুলে”র উপর তৈরী হয় এক স্তূপ। যা আজকের দিনে নমোবুদ্ধ স্তূপ।
এর প্রায় ৩৫০০ বছর পর স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ওঁর দুই শিষ্যকে নিয়ে সঞ্জ দ্য ফিয়ুজসের নামে জঙ্গলাকীর্ণ এই গ্ৰামে উপস্থিত হন। প্রথমেই প্রণাম করে স্তূপটিকে তিন বার প্রদক্ষিণ করেন। সর্বশেষে বললেন, উনিই ছিলেন ৩৫০০ বছর আগের মহান রাজকুমার “মহাষ্টতু”। গৌতম বুদ্ধ এখানে আসার পর জায়গাটি ধীরে ধীরে নমো বুদ্ধ নামে সমধিক পরিচিত হয়ে ওঠে।
লোককথা অনুসারে “মহাষ্টতু” অর্থাৎ প্রথম গৌতম বুদ্ধ এখানে দেহ রাখেন। ‘নমোবুদ্ধ’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থানে পরিণত হয়েছেন। যুগে যুগে মহান ব্যক্তিরা এখানে আসেন পুণ্য করতে। সারা বিশ্ব থেকে বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা একবার হলেও এই পুণ্যভূমিতে এসে প্রার্থনা করে যান।
প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে নমোবুদ্ধ :– নেপালের কার্ভ জেলার সর্বোচ্চ জায়গায় (১৭৫০ মিটার) রয়েছে এই বৌদ্ধ বিহার। শুধু মাত্র তীর্থযাত্রীদের জন্য নয় ভ্রমণার্থীদের জন্যও নমোবুদ্ধ সমান ভাবে আদরণীয়। স্তূপ থেকে প্রায় ১০০০ সিঁড়ি অতিক্রম করে পাকদণ্ডী পথ বেয়ে উপরে পৌঁছতে হবে। উপরে পৌঁছলেই অবাক হওয়ার পালা। উপর থেকে চারিদিকের দৃশ্য খুবই মনোরম। ৩৬০ ডিগ্ৰি অ্যাঙ্গেলসে সবুজ পাহাড়ের সারি। যেদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। আর তার পরেই দিগন্ত জুড়ে রয়েছে আমাদের প্রিয় সাধের হিমালয়। পরিষ্কার দিনে এখান থেকে হিমালয়ের অনেকগুলো শৃঙ্গ দেখা যায়। তা নাকি এক কথায় অসামান্য)। তাছাড়া দূরে একটা দুটো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পাহাড়ের ধাপ কেটে চাষ হচ্ছে।
অবস্থান গুণে বিহারটি যেমন আকর্ষণীয় তেমনই সৌন্দর্য্য গুণে। মঠে রয়েছে ব্রোঞ্জের এক বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি। এছাড়াও ছোট ছোট মূর্তি (বাঘিনী, বাঘের বাচ্চা) করে তুলে ধরা হয়েছে ৬০০০ বছর আগের ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মুখে খাবার তুলে দেবার ঘটনা। গুহাটিকেও সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যা পৌরাণিক কাহিনীর সত্যতা প্রমাণ করে। (ছবি তোলা নিষেধ থাকায় মঠের ভেতরের কিছু মূর্তির ছবি নিতে পারিনি)। এছাড়াও বৌদ্ধদের রীতি মেনেই পুরো পাহাড়টাই রঙিন পতাকা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে, যা দেখা চোখের পক্ষে খুব আরামদায়ক।
কী করে যাবেন: নমোবুদ্ধ কাঠমান্ডু থেকে ৪০ কিমি এবং ধূলিখেল থেকে ১২ কিমি দূরে অবস্থিত। দু’টি জায়গার যে কোনও এক জায়গায় থাকলেই গাড়ি বুক করে অনায়াসে ঘুরে আসা যায় এই পবিত্র বৌদ্ধ মঠটি।
যাঁরা বাসে করে ঘুরতে চান প্রথমেই কাঠমান্ডুর রত্না পার্ক বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে বানেপা চলে আসুন। বানেপা থেকে নমোবুদ্ধ যাওয়ার ছোট বাস নিন (প্রতি ২০ মিনিট অন্তর), ভাড়া নেবে নেপালি ৬০ টাকা প্রতি জনা। যাঁরা ধূলিখেলে থাকবেন তাঁরাও বানেপা থেকে আসা বাস ধরে নিন, ভাড়া নেপালি ৫০ টাকা। নমোবুদ্ধ যেতে হলে ধূলিখেল হয়েই যেতে হবে। তবে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, কোনও কোনও জায়গায় রাস্তা নেই বললেই চলে। তবে খুশির খবর এই যে রাস্তা সারাই-এর কাজ শুরু হয়েছে।
ট্রেকিং করে নমোবুদ্ধ: যারা ঘুরতে গিয়ে একটু অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন, ট্রেক করতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য নমোবুদ্ধ হল ঠিকঠাক পছন্দ। ধূলিখেল থেকে ট্রেক করে নমোবুদ্ধ যাওয়ার খুব সুন্দর একটি রাস্তা রয়েছে। দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। বিদেশিদের কাছে এটি একটি যথাযথ গন্তব্য। ধূলিখেলের কালীমন্দিরের পাস দিয়েই নমোবুদ্ধ যাওয়ার পায়ে হাঁটা পথ। এছাড়াও পনৌটি থেকেও ট্রেক করতে পারেন। হিমালয়কে সাক্ষী রেখে সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নমোবুদ্ধ ট্রেক করার অভিজ্ঞতা সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।
কোথায় থাকবেন: নমোবুদ্ধতে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। আপনাকে ধূলিখেল অথবা অন্য কোনও শহরে ফিরে আসতে হবে। মঠের নিজস্ব অতিথিশালা থাকলেও সাধাণের থাকার ব্যবস্থা হয় না। কাঠমান্ডু থেকে যাঁরা গাড়ি করে আসবেন তাঁরা নমোবুদ্ধর সঙ্গে রাখুন হিন্দু তীর্থ পনৌটি এবং সাঙ্গার বিশ্বের সর্বাধিক লম্বা শিব মূর্তি (১৪২ ফুট)।
বিঃদ্রঃ :– ১) ঘুরতে গিয়ে কোনও ময়লা ফেলে আসবেন না। বৌদ্ধ বিহারটি অতীব পরিষ্কার।
২) সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সঙ্গে জল রাখবেন।
৩) পাহাড়ের উপরে খাবার দোকানের অভাব রয়েছে, তাই সঙ্গে শুকনো খাবার থাকলে খুব সুবিধা হয়।
৪) যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে তাঁদের উপরে না ওঠাই শ্রেয়। খুব খাড়া সিঁড়ি।
৫) ট্রেক করলে অবশ্যই স্থানীয় গাইড নেবেন।
৬) সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ফেরার সময় বাসের সময়সূচি জেনে নেবেন।
৭) নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা থাকলে নমোবুদ্ধ থেকে সূর্যাস্ত দেখুন।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)