অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ভুলির দিনগুলো— দ্বিতীয় পর্ব

সৌগত পাল

ক্লাসে স্যার বলে চললেন প্রতি পেপারে ৭টি করে প্রশ্ন থাকবে। ৫টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ৫টি প্রশ্ন ১০০ নম্বর। ১টি প্রশ্ন ২০ নম্বর! এতো লেখা কি করে লিখবো। সেই কবে ইতিহাসের খাতায় লিখেছি। কিন্ত তখনও সব শেষ হয়নি। স্যারের পরবর্তী বোমা সব প্রশ্নের উত্তর কেবল ইংরাজী আর হিন্দিতেই লেখা যাবে!

সন্ধেবেলা ৭টি বিছানাতে যেন ৭টি প্রস্তর মূর্তি। কাল এই সময় কত হইচই কত আনন্দ আর আজ খালি দীর্ঘশ্বাস এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সায়ন্তন একবার বলল, “ও কিছু না, স্যার আমাদের ভয় দেখালেন। এখানে ফেল-টেল কিছু হয় না। যাতে আমরা পড়াশোনা করি তাই এরকম বলেছেন।“ সবাই একটু স্বস্তি পেল মনে হল। আস্তে আস্তে কালকের ফর্মে ফেরা শুরু হল। রাতে শোবার সময় কালকের পর থেকেই আবার শুরু হল। যার ঠাণ্ডা লাগছিল তাকে সবাই পরামর্শ দিল, “তোর যা জামাকাপড় আছে সব পরে শুয়ে পড়। তাহলে এর ঠাণ্ডা লাগবে না। আরো দুটো দিন একইভাবে কেটে গেল। শুক্রবার সবার মন খুব খুশি কারন আজ পঞ্চমী। আজ ক্লাস করে টানা চারদিন ছুটি, সবাই বাড়ি যাবো। আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যেও একটা পুজো হচ্ছে। সবাই সেখানে ঘুরে এলাম। দুপুরের খাবার পর ক্লাসে এসে এর কারো মন বসছে না। সবার দাবি আজ তাড়াতাড়ি ছুটি দিতে হবে। কিন্ত স্যার ঠিক চারটেয় ছাড়লেন। মানে সেই সাড়ে চারটের ব্ল্যাক ধরতে হবে। আমার ভয় করতে লাগল। সাড়ে চারটের ব্ল্যাক হাওড়া ঢোকে রাত সাড়ে নটা। এদিকে হাওড়া থেকে আমতার শেষ ট্রেন ও একই সময়ে। একটু এদিক ওদিক হলে রাত স্টেশনে কাটাতে হবে। ধানবাদ স্টেশনে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি দেখলাম ব্ল্যাক ডায়মন্ড স্টেশনে ঢুকছে। আবার একই সাথে দেখি জয়সলমীর হাওড়া এক্সপ্রেস। লেট ছিল এখন আসছে। ভেবে দেখলাম এটা এক্সপ্রেস তাই এর স্টপেজ কম। তাই ব্ল্যাক এর আগে হাওড়া ঢুকবে। তাই জয়সলমীর এক্সপ্রেস এর দিকেই এগোলাম। বাকি রাও চলল। ওরা বর্ধমান নেমে যাবে। সেখান থেকে ব্যান্ডেল। সবাই স্লিপার ক্লাসে উঠে পড়লাম। লেট গাড়ি তাই ফাঁকা। আরাম করে শুয়ে চলে যাবো।  কিন্ত ওই সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। ভরত বলল, “স্লিপার যখন খালি তখন এসি খালি থাকবে। আর আমরা তো স্টাফ। এসিতেই যাবো।’’

শোভা মনোহর।

তাই সবাই নেমে এসি কোচের দিকে চললাম। কিন্ত ওখানে শোয়া তো দূর বসার জায়গা খালি নেই। এদিকে ট্রেন ও ছেড়ে দিয়েছে। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে নীতিশ তার ফোনে দেখছিল ট্রেন বর্ধমান কখন ঢুকবে। হঠাৎ নীতিশের চিৎকার, “আজ আর বাড়ি যাওয়া হবে না।“ কেন কেন, সবার প্রশ্ন। “আরে এটার তো বর্ধমান স্টপেজই নেই। দুর্গাপুরের পর একদম হাওড়া। আমি নিশ্চিন্ত কারন আমি তো হাওড়া নামবো। ওরা একে অপরকে দোষ দিতে শুরু করল। ওদের ঝগড়া শুনে একজন যাত্রী বললেন ওনার ওদিকেই বাড়ি। ট্রেন লেট না করলে  হাওড়া থেকে বাড়ি যেতে সমস্যা হত না। এখন উনি আসানসোল নেমে বর্ধমান, ব্যান্ডেল হয়ে ফিরবেন। শুনে বন্ধুরা ভরসা পেল।

আর আসানসোল আসতে সবাই নেমে গেল। আর সেই ভদ্রলোক নামার আগে আমাকে বলে গেলেন আমাদের সিট তো খালি হয়ে গেল। আপনি আরাম করে শুয়ে চলে যান।কিন্ত টিকিট দেখতে এলে? আরে আপনিতো রেলেরই লোক। কিছু বলবে না। বন্ধুরা সবাই শুভেচ্ছা জানিয়ে  চলে গেল আর আমি দুরু দুরু বুকে কামরা তে প্রবেশ করলাম।

তারপ্র? তারপর আর কি, যে ভাবনা নিয়ে ওই ট্রেনে উঠেছিলাম যে হাওড়া তাড়াতাড়ি পৌছাবো সে তো গেলোই উপরন্ত এই ভয় হতে লাগল যে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ছেড়ে এই ট্রেনে উঠলাম সেই ব্ল্যাক ডায়মন্ড না এর থেকে আগে হাওড়া পৌছে যায়। শেষমেশ ৯টা ২০তে অনেক কষ্টে তিনি হাওড়া এলেন। দৌড়ে আমতা লোকালের জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে এলাম। দেখি পাসের প্ল্যাটফর্মে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ঢুকছে। জয়সলমীর এক্সপ্রেস আমাকে ১০মিনিট আগে হাওড়া নিয়ে এসেছে।

রেললাইনের পাশে ময়ূর চড়ে।

এদিকে ৯টা ৩০ হয়ে গেলেও আমতা লোকালের কোনো ঘোষণা শোনা যাচ্ছে না। শুনলাম এখন এটার সময়ের কোনো ঠিক নেই। যখন ইচ্ছে হয় ছাড়ে।  অথচ কিন্ত আমরা কজন মিলে যখন শেষ লোকালে সফর করতাম তখন ঠিক সময়েই চলত। এদিকে ট্রেন যত দেরি হচ্ছে আমার চিন্তা হচ্ছে, কেননা পরদিন ভোরে আবার ট্রেন ধরবো। গন্তব্য বেগুনকোদর। যেটা নিয়ে লেখা আগেই হয়েছে। কখন বাড়ি ফিরবো আর কখন বেরবো এসব ভাবতে ভাবতে ১০টা ১০ এ আমতা লোকালের ঘোষণা । বাড়ি ঢুকতে ১২টা আর শুতে না শুতে আবার ৩টের সময় উঠে চললাম বেগুনকোদর অভিযান এ।

পুজো মেটার পর আবার ফিরে এলাম। যথারীতি ক্লাস চলতে লাগল। মাঝে মাঝে আবার আমাদের শ্রমদান করতে হত। যেমন বাগানের মাটি কাটা অথবা ভলিবলের কোর্ট বানানো। অনেক লোকজনের সাথে আলাপ হচ্ছিল। সিনিয়রদের ট্রেনিং হতো ১৫দিনের। তাই আমরা থাকাকালীন কত ব্যাচ এল আর চলে গেল।

সিনিয়ররা দেখতাম রাতের খাবার খেতে বেশ দেরী করে যেতেন। ব্যাপারটা প্রথমে বুঝিনি। একদিন আমরা একটু রাত করে খেতে বসেছি। দেখি আমাদের পাশের ঘরের লোকজন খেতে বসেছেন। আমরা খাচ্ছি রুটি, ডাল, সয়াবিন আর ওঁরা দেখি মুরগীর মাংস দিয়ে জমিয়ে খাচ্ছেন। ব্যাপারটা কি? পরের দিন একই ব্যাপার। আমাদের হাবিবুর হল মাংসবিলাসী, সে রীতিমত বিদ্রোহের সুরে বলল কাল আর একটা হেস্তনেস্ত সে করবে।

পরদিন সকাল। হাবিবুর মেস মালিকের মুখোমুখি। “আমাদেরও চিকেন দিতে হবে। শুধু সিনিয়ররা কেনো খাবে।“

তখন মেস মালিক রহস্যটা ভাঙ্গলেন। মেসের খাবার সবার জন্যই সমান। যারা অন্য কিছু খেতে চান কিনে এনে দিলেই রান্না করা হয়। সিনিয়ররা এখানে চাকরি মুক্ত হয়ে ছুটি কাটাতে আসেন। তাই নানারকম খাবার তৈরী করান।

ব্যাস। সুতরাং আমরাও রান্না করিয়ে খেতে পারি। তাহলে দেরি করে লাভ নেই। আজই হবে। বিকেলে সবাই গেলাম বাজারে। মাংস কিনে দিয়ে দিলাম রাঁধুনীকে। কিন্ত সে বলে আগে থেকে বলে রাখতে হয়। তবে সে বিকেলে সেই মতো মশলা তৈরী করে রাখত। আজ হবে না।

সর্বনাশ। তাহলে উপায়? রাঁধুনী উপায় বললেন। মেসের বাইরে দোকান আছে সেখানে রান্না করে দেয়। সবাই মিলে গিয়ে রান্না করতে দিয়ে এলাম। ক্যান্টিন থেকে রুটি নিয়ে নেবো। এখন কে কটা রুটি খাবে তা হিসেব শুরু হল।

আমাদের মধ্যে একজন ঘোষণা করল সে ৩০-৩৫টা রুটি খাবে। ডাল সয়াবিন দিয়েই সে ১৬টা রুটি খায়, আজ মাংস সুতরাং ডবল খাবে।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *