চন্দন দত্ত রায়
কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে? আমি বলি কী চলে যান পৃথিবীর সেরা ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। ঠকবেন না। একদিন বা দু’দিন কাটিয়ে আসুন বাদাবন আর দক্ষিণ রায়ের রাজত্বে। লঞ্চের পাটাতনে বা চেয়ারে বসে ভেসে পড়ুন নদীর জলে। দেখে নিন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় #ম্যানগ্রোভ #বনাঞ্চল,আর তার জীবনের বৈচিত্র্যকে।
আমাদের সুন্দরবন মোট সুন্দরবনের মাত্র ৪২০০ বর্গকিলোমিটার। মোট সুন্দরবনের ৪০ ভাগের মতো, ৬০ভাগ বাংলাদেশে। ১৯৭৩ সালে মূল এলাকাটি ব্রাঘ্য প্রকল্প হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালের ৪ মে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষিত হয়। ১৯৮৭সালে ইউনেস্কো বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে।
সুন্দরবন আমি অনেক বারই গেছি। কখনো রায়দীঘী থেকে তো কখনো আবার সোনাখালী থেকে। আবার দু’এক বার ক্যানিং থেকেও গেছি। দেখিছি কলসদ্বীপ, ভগবতপুর কুমির প্রকল্প, সজনেখালি, সুধন্যখালি, পিরখালি, গাজিখালি, মোল্লাখালি, দোবাকি, বুড়ির ডাবরী, পঞ্চমুখানী, নেতা ধোপানির ঘাট। রাতে থেকেছি সজনেখালি পাখিরালয়ে। আবার কখনও লঞ্চের খোলা ডেকে। দেখেছি এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য পথের বড় বড় নদী আর ভয়ানক সব খাড়ি।
এই নদী পথে অলস ভাবে দেহটাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ টাকে যথা সম্ভব সজাগ রেখে শুধু এপাশে ওপাশে আর দুরে তাকিয়ে থাকুন।মাঝে মাঝে জলের দিকে নজর অবশ্যই রাখবেন,হয়তো বা দেখবেন কোন ডলফিন আপনার লঞ্চের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে কখন ভুস ভুস উঠেছে আবার ডুবছে। দেখুন সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, হেতালের বাদাবন। কাদার মধ্যে উঁচু হয়ে থাকা শ্বাসমূল। বড় বড় ঠেস মূল ওয়ালা গাছ। কখনো জোয়ারের জল সব ডুবিয়ে জঙ্গলের গভীরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। হেতালের পাতার রঙ আর দক্ষিণ রায়ের গায়ের রঙ একই রকম। সেই হেতাল বনের ভেতরের সরু সরু ঢালু পথ যা নদীতে এসে মিশেছে আপনার দৃষ্টি ভ্রম হতেই পারে। ভাটার সময়ই হচ্ছে পশুদের দেখার উপযুক্ত সময়। এই সময় অনেকখানি পার উন্মুক্ত হয়। পশুরা এই সময়েই উন্মুক্ত প্রান্তরে আসে।
তবে ভাটার সময় বিপদও আছে। একবার এইরকম বিপদের সন্মুখীন আমাদের হতে হয়েছিল। কাদার মধ্যে লঞ্চের প্রপেলার ঘুরছিল না। লঞ্চ অনেকক্ষন আটকে পরেছিলো। আহা! সেও এক অন্যরকম গা ছমছমে অনুভূতি। দুধারের ঘন জঙ্গল আপনার প্রায় কাছাকাছি তার মাঝে আপনি লঞ্চে,”নট নরন চরন”।আবার কখন জোয়ার আসবে তার অপেক্ষায়।রোমাঞ্চকর পরিবেশ,কেমন লাগবে বলুন তো!
ভাটার সময় দেখতে পাবেন বা এক পা এক পা করে এগুচ্ছে বক ও লম্বা ঠোঁট ওয়ালা সারস মাছের আশায়,আর টপাটপ করে মাছ ধরে কপাৎ করে গিলে নিচ্ছে। কাঁকড়ার ইতি উতি ছোটা ছুটি,টুক করে গর্তে ঢুকে যাওয়া। গাছের ডালে বসে আছে নিরাশক্ত ভাবে মাছরাঙা, লক্ষ কিন্তু জলের দিকে। কোনো কোনো সময় ঝপাং করে জলে ডাইভ মারছে। আবার কখনও জল না থাকা থকথকে কাদার মধ্যেই হরিণ পা তুলে ওপরের গাছের পাতা খাবার চেষ্টা করছে। দেখা হতে পারে মনিটার লির্জাডের সঙ্গে।
বন শুয়োররা কাদায় মুখ গুঁজে কি যেন খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। লালমুখো বাঁদরের দল সজাগ চোখে মাঝে মাঝে পেছনে জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছে আর তাড়াতাড়ি জলে কি যেন ধুয়ে নিচ্ছে। দেখা পেয়ে যেতে পারেন অলস ভাবে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে হাঃ করে কোন কুমির হয়তো বা শুয়ে আছে। আপনি হয়তো বা ভাববেন লঞ্চটা আরেকটু কাছে যাক তারপর ছবি তুলবো। আমি বলি কি আপনি ভুল করলেন! হঠাৎ আপনাকে কোন সূযোগ না দিয়েই ঝপাং।
আমার একবার এইরকম হয়েছিল। একটা হরিণ ফাঁকা জায়গায় জলের ধারে বসেছিলো। ভাবলাম আর একটু লঞ্চটা এগিয়ে যাক তারপর ছবি তুলবো,হলো না! হরিণটা হঠাৎ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পালালো। অবিশ্বাস্য ভাবে দেখলাম হরিণটা যেখানে বসেছিল তার কাছেই জলটা দারুন ভাবে ঘুলিয়ে উঠলো। দেখে বুঝে চমকে উঠলাম, একটা কুমির হরিণটাকে তাক করেছিল। হরিণটা তা বুঝতে পেরেই লাফ দিয়ে উঠে পালালো। আফশোষ রয়ে গেলো কোন ছবিই নিতে পারলাম না।
অনেকে তো আবার অন্য কাউকে দেখানোর জন্য ডাকে ,তাহলে তো হলোই,জঙ্গলে সবাইকেই চোখ সজাগ রাখতে হবে ডায়ে,বাঁয়ে,সামনে।আপনার সারেঙ্গ যেই লঞ্চের #এক্সিলেটার কমাবে তখনই বুঝতে হবে তার নজরে কিছু পরেছে। আপনি যদি সৌভাগ্যবান হন তাহলে সাক্ষাত হতে পারে #দক্ষিন #রায়ের সঙ্গেও।ভয়ানক সাহসী ও ধূর্ত এই জঙ্গলের রাজা। আপনি ওনাকে না দেখতে পেলেও তিনি কিন্তু হয়তো আপনাকে নজরে নজরে রেখেছে। আপনি ভাবতেই পারবেন না যে নদীর দুকূল দেখা যায় না,অবলিলাক্রমে কিভাবে এরা সাঁতরে এপার ওপার করে খাবারের সন্ধানে। কিভাবে নৌকা থেকে পাশে ঘুমন্ত মানুষকে না জানিয়ে আরেকজনকে মুখে তুলে নিয়ে চলে যায় একদম নিঃশব্দে।
নিদারুণ এক ভয় ভীতির পরিবেশে মাঝিরা নৌকায় রাতে ঘুমায় ভাবুন তো! কিছু কিছু দ্বীপে নদীর চরে লাঠির ডগায় ছেঁড়া কাপড় উড়তে দেখতে পাবেন। একটু সমবেদনা জানাবেন, বুঝবেন ওখানে কোনো হতভাগ্যের জীবন দক্ষিণ রায় সর্বনাশ করে গেছে।
নদী পথে আপনার সাথে দেখা হতে পারে বাংলাদেশ অভিমুখী মালবাহী ট্রলারেরও। ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় আপনার দেখা হবেই জীবন জীবিকার সন্ধানে কাঠুরিয়াদের নৌকার সাথে। দেখা হতে পারে মধূ সংগ্রহকারী মউলেদের নৌকার সঙ্গেও। ছিপ নৌকা বা বড় নৌকার জেলেদের সাথেও আপনার দেখা হবে। কিনে নিতে পারেন ট্যাঙরা, পাবদা, পাটসে, ভাঙ্গনের মতো সুস্বাদু মাছ। সুন্দরবনের মহিলারা হাঙর, কামট, কুমির ভরা ঐ জলের মধ্যে জীবনকে বাজি রেখে কিভাবে চিংড়ির মীন ধরে বেড়াচ্ছে তাও আপনার নজরে পরবে। তাৎক্ষনিক ভাবেএই সকল মানুষের জীবন জীবিকা সম্পর্কে আপনার শ্রদ্ধা,ভালোবাসা আস্তে বাধ্য।
রায়মঙ্গল, বিদ্যাধরী, মাতলা, স্বরস্বতী, কালিন্দী ও অনেক নাম না জানা এই নদী গুলিতে বিশেষ করে পঞ্চমুখানীতে যখন আপনার ছোট্ট লঞ্চটা মোচার খোলায় মতো উথালপাথাল করবে হয় আপনি ভয় পাবেন, নাহলে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগানো সুখকর অনুভূতি আপনার হবেই হবে! এক এক করে বিভিন্ন ওয়াচ টাওয়ারে যখন আপনি উঠবেন,সামনের ফাঁকা জায়গা থেকে আপনি চোখ সরাতে পারবে না। মনে হবে এক্ষুনি হয়তো বা জঙ্গলের রাজা ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে একদিক থেকে অন্য দিকে যাবে। এমনি করেই এক এক #বনবিবির থান সহ যখন সব কটি জায়গা দেখে আপনার লঞ্চ যখন সন্ধ্যায় সজনেখালির মাঝ নদীতে নৌঙ্গর করবে তখন সেখান থেকে দুধারের জঙ্গলকে দুর থেকে অনুভব করা আর লঞ্চের সাথে নদীর জলের ধাক্কার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে নিজেদের মধ্যেও কি দেখলাম তাই নিয়ে কথা বলা বা গানের আসর বসিয়ে সঙ্গে অবশ্যই চা টিফিন সহযোগে দিনটা বা দিনগুলো কাটলো বল তো!আর সে যদি #জোৎস্না আলোকিত় #চাঁদনী রাত হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
এই ভ্রমনের সাথে আপনি গোসাবার বিধবাপল্লী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত হ্যামিলটন সাহেবের বাংলোকেও অন্তভুর্ক্ত করতে পারেন। এক অসাধারণ ভ্রমণ আপনার হাতের কাছেই। সবই আপনার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে।
গোধূলী লগ্নে ফিরে এসে বাংলোয় জামাকাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে সারাদিনের ঘোরাঘুরির ক্লান্তি কাটিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই খবর পেলাম তিনি এসেছিলেন।ঐ জলাশয়ে জল খেতে,তাকে ক্যামেরা বন্দী করেছেন ম্যাডাম। ব্যাস এইটুকুই যথেষ্ট! সোজা চলে গেলাম ওনার ঘরের কাছে। দরজায় আওয়াজ করে অনুমতি নিয়ে আসার কারনটা জানাতেই উনি সেই দূর্লভ ছবি গুলো দেখালেন। আহা! কী রাজকীয় ভঙ্গি, মাথা উঁচু করে জঙ্গলের রাজা প্রকাশ্যে আসছেন। সামনের পা দুটো সামান্য ফাঁক করে জল খাচ্ছেন এই রকম কয়েকটা ছবি দেখলাম। মনটা ভরে উঠলো আর আক্ষেপ করলাম নিজেদের কপালের উপর। আমরা তোমাকে দেখার জন্য সারা দিন বোটে এখান ওখান ঘুরে মরলাম,আর সেই তুমি সারাদিন আমাদের সাময়িক বাসস্হানে! একেই বলে কপাল। যে ম্যডামের কথা বললাম তিনি বটানির ছাত্রী,রিসার্চ স্কলার। ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছিলেন। কয়েকদিন আগে এসেছেন এবং আরো কয়েকদিন থাকবেন।
অভাগাদের আজই শেষ রাত।যাই হোক কি আর করা যাবে।ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে বসলাম,একটা অনুভূতি কিন্তু বলছে সে আছে,চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তা জানান দিচ্ছে। আজকে জঙ্গলটা অন্য রকম।কেমন যেন একটা গন্ধ,হরিণ গুলোর মাঝে মধ্যেই ভয়ার্ত” বাক বাক” ডাক,জ্বল জ্বলে চোখ রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
এর মধ্যেই ডাক বড়কর্তার,” আপনারা নিচে নেমে আসুন ওখানে আজ থাকা যাবে না”। গতকাল রাতেও আমরা অনেক খানি সময় ঐ ওয়াচ টাওয়ারে ই বসেছিলাম,আজ তার জঙ্গলের রাজার আগমনের কারনে তা নিষিদ্ধ স্হান হয়ে গেল। কি আর করা যাবে,আমরা তো তার রাজত্বেই এসেছি ।সে রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেছিলো। তাড়াতাড়ি সে পাট চুকিয়ে সবাই ওপরে।নিচে নামার গেট বন্ধ হয়ে গেল।ফরেষ্টার বাবু জানালেন বাংলোর চারদিকে যে নেট দিয়ে ঘেরা আছে তার অনেক জায়গায়তেই কাটা আছে।কখন কি হয় বলা যায়না এর আগেও সে ভেতরে চলে এসেছিল।তাই দরজা বন্ধ করেদিলাম।দয়াকরে কেও নিচে নামার চেষ্টা করবেন না,ওপরের বারান্দা থেকে দেখুন।হয়তো দুএক দিন সে এখানেই থাকবে।
প্রায় সারা রাতই ঐলম্বা টানা বারান্দার এদিক থেকে ওদিক করে গেছিলাম।কখনো বা বারান্দার শেষ প্রান্তে ফরেষ্টার বাবুর ঘরে বসে পেছনের জল খবার পুকুরের দিকে অন্ধকারেই তাকিয়ে থাকা। যদি কোন শব্দ পাই।এক অদ্ভূত অনুভূতির মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যেতে লাগলো। না! কিছুই, মানে যা দেখতে চেয়েছিলাম তা হয়তো পেলাম না।কিন্তু সেই ঘন অন্ধকার রাতে দক্ষিণ রায়ের ভয়ে ভীত হরিণদের সেই ভয়ার্ত আওয়াজ ঝি ঝি পোকার কনসার্ট আর জোনাকির দ্বপ দ্বপ আলো।আর সবকিছুর উপরে তার জানান দেওয়া উপস্হিতি।।
এই কি কম কিছু পাওয়া!
(সমাপ্ত)