ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

কাজের লোকের কবির খোঁজে

দীপক দাস

একটা পাখি ডাকছিল। পুকুর পাড়ে শুকনো একটা নারকেল গাছ। তার কোটর থেকে। একটা শালিখ পাখি। তারপর হঠাৎ উড়ে গেল। গিয়ে বসল আরেকটু দূরে। ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে। শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর ইন্দ্র। বেশ বড়সড় পুকুর। ওপারে গৃহবধূরা বাসন মাজতে ঘাটে এসেছেন। একপাশে ছিপ ফেলছে দু’জন। দু’একজন চান করছে। আমরা বসে বসে দেখছি সেসব। গ্রাম বাংলার ছবি।

দেখতে ভালই লাগছে। বেশ সুন্দর জায়গাটা। একটা ঢালাই পুকুর পাড়কে বেড় দিয়ে গ্রামের দিকে ঢুকেছে। রাস্তার পাশে প্রচুর গাছ। তার আরেক পাশে নয়ানজুলি। তাতে গুটি কয়েক হাঁস চরছে। কুদুমরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কোনও গ্রামের ছবি। আমার তো পুকুর ঘাটটাই বেশি ভাল লাগছিল। অনেকগুলো পৈঠা পাড় থেকে জলের তলা পর্যন্ত নেমেছে। শেষ ধাপগুলো শ্যাওলা ধরা। অল্প জলে ছোট ছোট মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাটের দু’দিকে বেশ স্থূলকায় দু’টো বসার জায়গা। এখন গরম কাল। গরম মানে প্রচণ্ড গরম। দু’জনেই পুকুরের জলে চোখ মুখ ঘাড় ঠান্ডা করেছি। তবে শীতকালে অলস দুপুরে তেল মেখে এই জায়গায় বসে আড্ডা দেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত।

হাঁসগুলো জলে চরে, করে কোলাহল।

জায়গাটা নারিট। আমতা থানার অন্তর্গত এক সময়ের বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখনও বেশ সুন্দর। মঙ্গলবার ছিল সেদিন। আমাদের বেড়িয়ে পড়ার দিন। নারিট গ্রাম দেখতে আসিনি। এসেছি এক কবির খোঁজে। কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বাংলার শিশু সাহিত্যকে রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁদের একজন। কবির বাড়ি হাওড়া জেলাতেই অনেক আগেই জানা ছিল। ছোটবেলায় ছোট ভাইয়ের কিশলয় বইয়ে ছিল একটা ছড়া, ‘মৌমাছি মৌমাছি/ কোথা যাও নাচি নাচি,/ দাঁড়াও না একবার ভাই’। খুব ভাল লাগত ছড়াটা। আমার মা-ও ছোটবেলায় পড়েছে। হাওড়াতেই বাড়ি এমন এক কবির। নিজে হাওড়াবাসী হয়ে তাঁর জন্মভিটে দর্শন না করাটা ক্ষমার অযোগ্য কাজ বলেই মনে হয়।

খোঁজ খবর করে বেরিয়ে পড়া। কিন্তু কবির ভিটেয় এসে মুশকিলে পড়লাম। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের পরিবারের বহুদিন হল কলকাতাবাসী। তাঁর জীবিতকালেই। কবির সম্পর্কে জানতে গেলে ভরসা তাঁর নামাঙ্কিত একটি গ্রন্থাগার। তাঁরাই যত্ন করে রেখেছেন কবির বইপত্র, চিঠিচাপাটি, গুণীজনের প্রশস্তি। কিন্তু গ্রন্থাগারটি বন্ধ। গ্রন্থাগারিক এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে সেসবের চাবিকাঠি। তাঁদের খোঁজ আবার জানেন সুদীপ নামে এক তরুণ। তিনি স্থানীয় থানার সিভিক ভলান্টিয়ার। তাঁকে ফোন করেছি। খেতে গিয়েছেন তিনি। তাঁরই অপেক্ষায় আমরা পুকুর ঘাটে অপেক্ষমান।

বড় তরফ।

তার আগে অবশ্য কবির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঘাট থেকে কিছুটা পিছনে কবির মর্মর মূর্তি। এক বকুল গাছের ছায়ে। মূর্তির পাশ দিয়ে গ্রন্থাগারে ঢোকার রাস্তা। আর মূর্তির ঠিক উল্টোদিকে দু’টো বিশাল বিশাল প্রাসাদের সদর দরজা। একটা দরজার ওপরে লেখা ‘বড় বাটী নারিট’। আরেকটির আখর ‘ছোটবাটী নারিট’। বড় বাটি, ছোট বাটি মানে নারিট গ্রামের জমিদার বংশের বড় তরফ আর ছোট তরফ। নবকৃষ্ণ বড় তরফের। ছবিটবি তোলা হয়ে গিয়েছে। স্কুল ফেরত একটা বাচ্চাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে, ক্যামেরার ক্লাস নিয়ে আমাদের যৌথ ছবিও তুলিয়েছি। অনেকগুলো শাটার টেপার শেষে ছেলেটি সফল হয়েছে। সফল মানে তাতে বোঝা যাচ্ছে, একটা আমি। আরেকটা ইন্দ্র।

শেষপর্যন্ত সুদীপবাবু এসেছিলেন। কিন্তু দু’চারটে ফোন করে জানালেন, গ্রন্থাগারিক অন্য গ্রন্থাগারে আজ। এখন সরকারি গ্রন্থাগারগুলোয় কর্মীর সংখ্যা ভীষণ কম। একজন গ্রন্থাগারিককে একাধিক গ্রন্থাগারের দায়িত্ব সামলাতে হয়। তিনি সপ্তাহে তিনদিন এখানে আসেন। আর স্থানীয় ব্যক্তিটি ব্যক্তিগত কাজে আমতা গিয়েছেন। ফিরতে রাত হবে। অর্থাৎ আমাদের ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে। কী আর করা! সেদিন ব্যর্থ হয়েই ফিরেছিলাম। তবে পুরোপুরি ব্যর্থ বলা যাবে না। আমতা থেকে নারিট পর্যন্ত জায়গাটা বেশ লেগেছিল। দামোদরের প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। ফলে নালা নিকাশি প্রচুর। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। পাকা রাস্তার দু’পাশটা ঘন সবুজ। আর বন্যা প্রবণ বলে বাড়িঘরগুলো একটু উঁচুতে। তবে প্রত্যেক বাড়িই ঘেরা গাছপালায়। গাছে ঘেরা আঁকাবাঁকা অপরিসর পাকা রাস্তায় সফর মন্দ লাগছিল না।

ব্যর্থতার দিনে আরেকটি লাভ হয়েছিল। এক পণ্ডিত ব্যক্তির সন্ধান। তিনি মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন। কবির গ্রামে ঢোকার আগে মোড়ের মাথাতেই একটা পুরনো আদলের বড়সড় স্কুল। ‘ন্যায়রত্ন ইনস্টিটিউটশন নারিট’। খোলা গেট দিয়ে চোখে পড়েছিল ঋষিতুল্য এক ব্যক্তির মূর্তি। ঢুকে পড়েছিলাম। জেনেছিলাম উনি মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। পরে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের আরও পরিচয় জানা গিয়েছিল। মহেশচন্দ্র পণ্ডিত ব্যক্তি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। বহু শাস্ত্রে পণ্ডিত মহেশচন্দ্র মহামহোপাধ্যায় উপাধি পেয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে দিয়েছিল ‘কম্পানিয়ন অফ দ্য অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’, সংক্ষেপে সিআইই, উপাধি দেন। এই উপাধি বিদ্যাসাগরও পেয়েছিলেন। সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’এ তাঁর একটি অণু-জীবনীও রয়েছে। কবি নবকৃষ্ণের সম্পর্কিত জ্যাঠামশাই তিনি।

ন্যায়রত্ন স্কুল। স্কুলের পাশে ন্যায়রত্নের মূর্তি।

কবির জীবনীর নাগাল পেতে আরেক মঙ্গলবার নারিট গমন করতে হয়েছিল। সেদিন পেয়েছিলাম সেই স্থানীয় ব্যক্তিটিকে। যিনি এক সময়ে গ্রন্থাগারিক ছিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে তাঁকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে গ্রন্থাগার খুলিয়ে তথ্য সংগ্রহ চলেছিল। এতদিন পরে ভদ্রলোকের নাম ভুলে গিয়েছি। উনি খুবই সাহায্য করেছিলেন। নবকৃষ্ণের বইগুলো বের করে দিয়েছিলেন। ইন্দ্র ছবি তুলেছিল। দেখিয়েছিলেন নবকৃষ্ণকে লেখা রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের চিঠি। আমাদের প্রস্তাব মতো রাজি হয়েছিলেন মাধব ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য জীবন ও সাহিত্য’ বইটি জেরক্স করতে দিতে। আবার সুদীপবাবুকে ফোন করা হয়েছিল। তিনি দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিলেন। এবং পুরো বইটি জেরক্স করিয়ে ইন্দ্রদের এলাকার হাঁটাল বিশালাক্ষী স্কুলের শিক্ষক কালীপদবাবুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

সত্যি কথাটি স্বীকার করে নেওয়াই ভাল, কবি নবকৃষ্ণ সম্পর্কে আমার পাণ্ডিত্য বা জানা ওই ‘মৌমাছি মৌমাছি’ ছড়াতেই শুরু এবং শেষ ছিল। ছড়াটি ‘কাজের লোক’ শিরোনামে বিখ্যাত। প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে নারিট থেকে ফেরার পরে অফিসের দু’জনকে কবির কথা বলেছিলাম। একজন আমার পিতৃতুল্য সহকর্মী অরণিদা (বন্দ্যোপাধ্যায়)। দ্বিতীয়জন বন্ধু-সহকর্মী সৌমিত্র সেনকে। দু’জনেই উচ্ছ্বসিত। অরণিদা বলেছিলেন, ‘আরে এঁর লেখা টুকটুকে রামায়ণ একসময় দারুণ বিখ্যাত ছিল।’ আর সৌমিত্র খুশি, ‘এক কবির মূর্তি বসেছে গ্রামে! এর থেকে ভাল খবর আর কী হতে পারে?’ ও নিজেও একজন কবি তো।

নবকৃষ্ণের নামাঙ্কিত গ্রন্থাগার।

জেরক্সটা বহুদিন হাতে পেয়েছি এক বছরের বেশি হয়ে গেল। পড়া হয়ে ওঠেনি। শেষপর্যন্ত সময় পেয়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধা। নবকৃষ্ণ বহুমুখী প্রতিভাধর। জমিদার বংশের সন্তান হলেও জীবনটা খুব একটা সুখের নয়। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা রাজনারায়ণ মারা যান। ১৪ বছর বয়সে মা। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু অসুস্থতা এবং বাবা-মায়ের না থাকা, এই দুইয়ের আক্রমণে পড়াশোনা এন্ট্রান্সেই শেষ। অথচ পড়ে এই কবির কবিতা স্কুলে পড়ানো হত। স্কুলে পড়তে পড়তেই কবিতা লেখা শুরু। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ‘সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ। পরে স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘ভারতী’ পত্রিকায় বেরোয় ‘ধরাসুন্দরী’ কবিতা। কবিতাটি তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কবিতাটি ‘ভারতী’র দফতরে পাঠান।

টুকটুকে রামায়ণ।

শিশুপাঠ্য বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের লেখক নবকৃষ্ণ। ‘রংচং’, ‘ছেলেখেলা’, ‘পুষ্পাঞ্জলি’। ছোটদের উপযোগী করে লিখেছিলেন, ‘শিশুরঞ্জন রামায়ণ’। পরে এই বইটিই বর্ধিত আকারে ‘টুকটুকে রামায়ণ’ হিসেবে প্রকাশিত হয়। বইটি বহুদিন স্কুলপাঠ্য ছিল। ‘ছবি ও ছড়া’ কাব্যে রয়েছে তাঁর বিখ্যাত ‘কাজের লোক’ কবিতাটি। যদিও প্রথমে কবিতাটি ‘মৌমাছি, পাখী ও পিপীলিকা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। আরেকটি ছড়া এখনও প্রচলিত। ‘আমার কথাটি ফুরলো, নটে গাছটি মুড়োল, কেন রে নটে মুড়োলি?…’। কবির আরেকটি কবিতা এক সময় বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। সেটাই কবির শেষ লেখা। ‘গোকুলে মধু ফুরায়ে গেল/ আঁধার আজি কুঞ্জবন,/ (আর) গাহে না পাখী, ফুটে না কলি,/ নাহিক অলি-গুঞ্জরণ’…। কবিতাটি এক সময়ে আইএ ক্লাসে পড়ানো হত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ পছন্দ ছিল কবিতাটি। তিনি সুর করে গাইতেন।

রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে যোগীন্দ্রনাথ সরকার, কুদুমরঞ্জন মল্লিক সমকালীন সুখ্যাত কবিদের সঙ্গে পরিচয় বা বন্ধুত্ব ছিল নবকৃষ্ণের। ভাল পরীক্ষক ছিলেন বলে ভাষাচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। মাধব ভট্টাচার্য সম্পাদিত বইটিতে কবির রচনা সংকলিত হয়েছে। তাতে দু’টি বোমাও আছে। বইয়ের পিতৃস্মৃতি অংশে নবকৃষ্ণের ছেলে সুপ্রভাত ভট্টাচার্য অভিযোগ করেছেন, সত্যজিৎ রায় নবকৃষ্ণকে বিশেষ সম্মান দেননি। তিনি সত্যজিৎকে ‘নবকৃষ্ণ বিদ্বেষী’ বলেছেন। তাঁর অভিযোগ, সরকারি সহযোগিতায় সত্যজিৎ রায়ের সম্পাদনায় ‘আলোর ফুলকি’ নামে একটি শিশুপাঠ্য সংকলন প্রকাশিত হয়। সুপ্রভাতবাবুর মতে, ‘তাতে বহু অখ্যাত কবির কবিতা স্থান পেলেও নবকৃষ্ণের ঠাঁই হয়নি’। প্রকাশের পরে তা নিয়ে সমালোচনা হয়। তারপরে নবকৃষ্ণের একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র যোগ হয়েছিল। সুপ্রভাতবাবুর আরও অভিযোগ, সত্যজিতের সম্পাদনায় কিশলয় থেকেও বাদ গিয়েছিল নবকৃষ্ণের কবিতা। সত্যজিতের মৃত্যুর পরে কিশলয়ে ফিরে আসেন কবি। তার বছর দশেক আগে নবকৃষ্ণ মারা গিয়েছেন।

কবির আরেকটি বইয়ের প্রচ্ছদ।

দ্বিতীয় অভিযোগটি সেই সময়ের নোটবই প্রণেতাদের বিরুদ্ধে। নোটবইয়ে নবকৃষ্ণের ‘নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার’ কবিতাটি কবিশেখর কালিদাস রায়ের অনুকরণে লেখা বলে উল্লেখ থাকত। সুপ্রভাতবাবু লিখেছেন, তাঁর বাবার কবিতাটি ‘প্রচার’ পত্রিকায় বাংলার ১২৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। আর কালিদাসের কবিতার প্রকাশকাল ১৩১৩ সালে। ‘প্রচার’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের জামাই রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই অভিযোগের মীমাংসা আমার আর ইন্দ্রের পক্ষে করা সম্ভব নয়। ঘুরতে বেরিয়ে সাহিত্যের কূট তর্কে প্রবেশ করতে অপারগ আমরা। শুধু এক কবিকে আমরা সম্মান জানাতে চাই।

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *