অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

গৌড়হাটির রূপকথা

পার্থ দে

ছোটবেলায় পিসির কাছে কত রূপকথার গল্প শুনেছি। পিসি আমাদের বাড়িতে চাষের শাকসবজী নিয়ে আসত। বাবার খুড়তুতো বোন হলেও ভালোবাসার টানে  প্রতি বছর বাবাকে ভাই ফোঁটা দিতে আসতো। অনেক বছর আগে পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন আর কাজের চাপে ফুরসৎ মেলে না। পিসি দুঃখ করে বলে, আমরা তো গরিব, কুঁড়েঘরে থাকি আমাদের বাড়ি যাবি কেন …! পিসিকে কথা দিই খুব শিঘ্রই যাবো।

সেইমতো শীতের সকালে বাইক আর ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাঁশকুড়া থেকে মুম্বাই রোড (N.H.-6) ধরে ডেবরা পেরিয়ে বুড়ামালা স্টপেজ। এখান থেকে বামদিকে একটি গ্রামীন পাকা রাস্তা সোজা শ্যামচক রেলস্টেশনে এসেছে। ওই রাস্তায় কিছুটা এসে, আবার বামদিকের ফাঁকা মাঠের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা মোরাম রাস্তার লাল ধূলো উড়িয়ে এগিয়ে চললাম গৌড়হাটি গ্রামের উদ্দেশ্যে। পিসি বলে দিয়েছিল, “রায়বাড়িতাদের এলাকার একটি বিখ্যাত জমিদার বাড়ি। যে কোন লোককে জিজ্ঞেস করলেই রাস্তা বলে দেবে। সেইমতো রাস্তার কয়েকটি মোড়ে রায়বাড়ি যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করে পিসির বাড়ি পৌঁছতে কোন অসুবিধা হল না। তখন বাজে দশটা। বাইকের মিটার বলছে বাড়ি থেকে ৪৫ কিমি রাস্তা এসেছি।

জমিদার বাড়ি।

কী নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। ইউক্যালিপটাস, মেহগিনি, শিরীষ গাছের মাঝে অ্যাজবেস্টসের ছাউনিযুক্ত মাটির বাড়ি। সরকারি অনুদানে তৈরি এই বাড়ি ও পাশেই শৌচাগার। বাড়ির সংলগ্ন ধান রাখার হামার ঘর ও হাঁস মুরগি রাখার ঘর। ঘরের চালে চালকুমড়ো ও পুঁই গাছ, ঘরের পাশে কিছু বেগুন, লঙ্কা ও গাঁদা ফুলের গাছ। সামনে বড় একটা পুকুর। লক্ষ্য করলাম পাড়ার প্রতিটি বাড়িতেই শৌচাগার ও বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। বাড়ির কাছেই একটি টিউবওয়েল বসেছে। পাড়ার মাটির রাস্তাটি ঢালাই হবে, তার প্রস্তুতি চলছে। আমাকে পাড়ার লোকেরা কোন সরকারি কর্মী বলে ভাবল, হয়তো আমি রাস্তার কাজের তদারকি করতে এসেছি।

বাড়ির সামনে আসতেই খাঁচার টিয়া কেঁ কেঁকরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। ঘরের বাইরে রোদে বসলাম। পিসি আমাকে দেখে খুব খুশি হল। কিছুক্ষনের মধ্যেই মাটির উনুন জ্বালিয়ে গরম গরম চা বানিয়ে দিল। তারপর চাষের চালের মুড়ি, সঙ্গে বেগুনি, পিঁয়াজি ও পাঁপড় ভাজা। গল্প করতে করতে সেগুলি উদরপূর্তি করলাম। পিসেমশায় মূলতঃ চাষবাস করে, যখন চাষ হয় না তখন রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে যায়। আগে সবজি ও ফুল চাষ করত, এখন ওসব বন্ধ। পিসতোতো বোনের অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ভাই, বড় অজয় (বয়স ২২ হবে) পড়াশুনার পাট অনেকদিন আগেই চুকিয়ে দিয়ে এখন সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে মাছ বিক্রি করে। মাছের আড়তে যাওয়ার জন্য রাত তিনটে থেকে বেরিয়ে পড়ে। ছোট মোহন (বয়স ১৭) একাদশ শ্রেণীতে পড়ছে।

পিসির বাড়ি।

অজয় বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ মাছ বিক্রি সেরে বাড়ি এল। বিক্রিবাট্টার হিসাব শেষ করে পিঁয়াজী দিয়ে পান্তাভাত খেতে বসল। খাঁচা থেকে টিয়াকে (নাম টুনি) বের করে তাকেও পান্তা খাওয়াতে লাগল। শুনলাম টুনি নাকি তাদের খাওয়ার পাতেই খেতে পছন্দ করে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। দারিদ্রতা সত্ত্বেও পিসিদের এই সহজ সরল গ্রাম্য জীবন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। মনে হল পৃথিবীর সব সুখ এখানেই আছে।

খাওয়া শেষ হলে, অজয়কে নিয়ে গ্রাম দর্শনে বের হলাম। প্রথমেই ওই পাড়ার বিখ্যাত রায়বাড়িদেখতে গেলাম। বহু পুরানো বাড়ি, বর্তমানে মেরামতি ও রং করা হয়েছে। সামনে বিরাট বড় একটা ধান রাখার হামারঘর। পাশেই দুর্গামণ্ডপ ও রাসমঞ্চ। প্রতিবছর এখানে দুর্গাপুজা, কালীপূজা ও রাসপূর্ণিমার পূজা হয়। আমাদের দেখে রায়বাড়ির এক প্রবীণ সদস্য বেরিয়ে এলেন। আমি অজয়ের মামাতো ভাই পরিচয় দিয়ে ঐ বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস জানতে চাইলাম। সঙ্গে ক্যামেরা দেখে উনি একটু সন্দেহের চোখে তাকালেন। শুধু বললেন, এটা একসময় জমিদার বাড়ি ছিল। এর বেশী কিছু বলতে চাইলেন না।

পান্তা প্রিয় টুনি।

মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। একটা জায়গায় গাঁদাফুলের ক্ষেত দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে কে যেন মাঠের ওপর হলুদ কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। কিছুদূর যেতেই আদিবাসী পাড়া। কয়েকজনকে দেখলাম ঘরের বাইরে রোদে বসে ভাত খাচ্ছে….দূরে পুস্যি কুকুরটি জুলুজুলু চোখে ঐদিকে তাকিয়ে বসে আছে, আবার কেউ পুকুরঘাটে গল্প করছে। এখানকার সব ছোটছোট মাটির বাড়িগুলি দেখে মনে হচ্ছে যেন আধুনিক ইকো কটেজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল ইত্যাদি আছে। পিসিদের চারটি হাঁস ও একটি মোরগ আছে। পৌষ সংক্রান্তিতে মোরগ লড়াইয়ের জন্য অজয় মোরগটিকে তালিম দেয়।

গ্রামের একটি শিব মন্দির দেখে রেলস্টেশানের দিকে চললাম। রাস্তার দুদিকে আকাশমনির দল। পাশের মাঠে রজনীগন্ধার চাষ করা হয়েছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। হাতে আর বেশী সময় নেই। আজই বাড়ি ফিরতে হবে। তাই এবার সোজা পিসির বাড়িতে চলে এলাম।

পিসির রান্না হয়ে গেছে। পিসেমশায়ের মাঠ থেকে ফিরতে চারটে বেজে যাবে, তাই পিসি আমাদের ভাত খেয়ে নিতে বলল। পুকরে স্নান সেরে কাঁপতে কাঁপতে কিছুক্ষন রোদে দাঁড়ালাম। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসলাম। ভাতের সঙ্গে ডাল, আলুভাজা, বেগুনভাজা, বড়িভাজা ও হাঁসের ডিমের ঝোল। ঘুরতে ঘুরতে ভালোই খিদে পেয়েছিল। পরম তৃপ্তি করে খেলাম।

শীতের গ্রাম।

পিসি থাকতে বলেছিল, কিন্তু যা কাজের চাপ আমার তো থাকা সম্ভব হবে না। তাই এবার বাড়ি ফেরার পালা। পিসির কুঁড়েঘর, অজয়, টুনি, রায়বাড়িকে পেছনে ফেলে ফিরে চললাম। কাল থেকে আবার এক কর্মব্যাস্ত জীবন শুরু হবে। ফেরার পথে মাঠে পিসেমশায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *