দীপক দাস
পথই পথ দেখাবে। কে বলেছিলেন? জানা নেই। কিন্তু কথাটা ভারী খাঁটি। আমাদের বিভিন্ন সফরে কথাটা খাঁটি থেকে খাঁটিতর হয়ে উঠছে।
এই যেমন আজ। সপ্তমীর দুপুর। চারমূর্তি ঝাড়গ্রাম পাঁচমাথার মোড় থেকে বেলপাহাড়ির বাসে চেপেছি। পৌঁছতে একটা দেড়টা হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত জানি না, কোথায় থাকা হবে? আদৌ থাকার জায়গা পাব কিনা। না পাওয়ার সংশয়টার এবারের সফরে খুবই বাড়বাড়ন্ত। শুরু থেকে নানা বিপত্তি। গার্ডবাবু, শুভ ছুটি পেল না। আমাদের শহর শাখার তিন সদস্য— কচি, জুয়েল আর অরিজিৎ কেউ রাজধানী ছেড়ে নড়তে চাইল না। শেষ বিপদ-ডাকন সাঁতরাগাছি-ঝাড়গ্রাম মেমুর মস্করা।
খুলেই বলি তাহলে। এবার দলে কিছু সাংগঠনিক বদল হয়েছিল। গ্রুপে নানা গুঞ্জন। আমি নাকি ক্যাপ্টেন্সির পদ আটকে পড়ে আছি? সেটা কি ভাল? নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা ছাড়তে হয়। কোথায় থামা উচিত সেটা না জানলে খুব সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের আগের সফরেই একজন স্পষ্ট ঘোষণা করেছিল, সে ক্যাপ্টেন্সির দায় দায়িত্ব নিতে সক্ষম এবং প্রস্তুত। আপদ প্রমাণিত হওয়ার আগে পদ ছাড়া সম্মানের। ফলে সফরের শুরুতে ইন্দ্র ক্যাপ্টেন এবং দীপু ভাইস ক্যাপ্টেন। এবং শুরুর সিদ্ধান্তেই মতবিরোধ, কোন ট্রেনে যাওয়া হবে? ইস্পাত না ঝাড়গ্রাম মেমু। আমাদের ভ্রমণ দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্তি-প্রতি যুক্তির ঝড়। যেন হিরো কাপের ফাইনালের সেই তিন রান বাকির শেষ ওভার। বল কাকে করতে দেওয়া হবে? সচিন না কপিল? অভিজ্ঞদের পরামর্শ ছিল, ইস্পাত। কিন্তু দীপুর আবার মেমু প্রেম প্রবল। ইন্দ্রও ইস্পাত।
পদচ্যুত হয়ে প্রথমে আমি কোনও মতামত দিইনি। শুধু বয়সটাই দেখলি। না হয় ট্রেনে বাসে সুযোগ পেলে একটু ঝিমোই। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো কেমন নিই, সেটা দেখলি না? শেষ পর্যন্ত অভিমান ভেঙে ইস্পাতে মত দিয়েছিলাম। তাতে আবার দীপুর অভিমান। ও গ্রুপে লিখল, ‘ঠিক আছে, সবার যখন ইস্পাতে ইচ্ছে তাই হোক’।
কারও কারও কাছে অভিমান কাজ হাসিলের শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু অভিমান যে কত সর্বনাশের প্রেমিক-প্রেমিকার সর্বনাশের কারণ! দীপুর মানভঞ্জন করতে গিয়ে আমাদেরও সর্বনাশ হল। সাঁতরাগাছি স্টেশনে অনেক আগে পৌঁছে গিয়েছিলুম। একবার মৃদু স্বরে প্রস্তাবও দিয়েছিলুম, খড়্গপুর লোকাল আসছে। চল খড়্গপুর পর্যন্ত চলে যাই। কিন্তু দীপু রাজি নয়। প্রেম অন্ধ হলে জীবনে ব্যথা প্রচুর। দীপুর মেমু প্রেমিকা শুরু থেকে দাগা দিতে শুরু করল।। ভোরে হালকা কুয়াশা। ফলে ট্রেনও মন্দগামী। তার ওপরে সব স্টেশনে থামতে থামতে চলেছেন। মনে হচ্ছিল আন্দুল, মৌড়িগ্রাম, সাঁকরাইল সব স্টেশনের যাত্রীদের ঝাড়গ্রাম নিয়ে যাবার পণ করেছেন গার্ড আর চালক। আমি সুযোগ পেয়ে গেলুম। ওদের অনভিজ্ঞতা পদে পদে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। দীপুকে বললুম, আবাদা স্টেশনে যদি ট্রেন থামে, তাহলে তোর আর ইন্দ্রর পদ গেল। দীপুকে লজ্জা দিয়েই ট্রেন থামল আবাদায়। যে স্টেশনে সব লোকাল স্টপ দেয় না। ভাইস ক্যাপ্টেন সংকোচে অধোবদন।
প্রতিশোধ তো নেওয়া গেল। কিন্তু ট্রেন যদি সব স্টেশনের যাত্রীদের ওপর দয়া দেখাতে দেখাতে চলে তো হয়ে গেল। হাফ বেলা ট্রেনেই নষ্ট। ব্যাপারটা কী হচ্ছে, সেটা তো জানা দরকার। কাকে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে? এক সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। কিন্তু তিনি আমাদের মতোই আতান্তরে। আগের লোকাল ছেড়ে দিয়ে মেমুতে উঠেছেন। দ্রুত যাবে বলে। ট্রেনের হাল হকিকত সবচেয়ে ভাল জানেন হকারেরা। তাঁদের কাউকে জিজ্ঞাসা করা যাক। এক ডিমওয়ালা উঠতে জিজ্ঞাসা করা হল, ব্যাপার কি দাদা? তাঁর উত্তর শুনে তো আঁতকে ওঠার জোগাড়। বললেন, পুজোর সময় তো। ট্রেন ফাঁকা যাচ্ছে বলে অল স্টপ করে দিয়ে দিয়েছে। সে কী কথা! এ তো বাসে হয়। আমাদের বড়গাছিয়া-শিয়ালদহ রুটের বাসগুলো তো যাওয়ার থেকে দাঁড়ায় বেশি। বাসের চলার আওয়াজের থেকে কন্ডাক্টরের চিৎকার শোনা যায় বেশি। ট্রেনেরও এই হাল! বাবলা বলল, জানলা দিয়ে দেখো তো, গার্ড-ড্রাইভার ঝাড়গ্রাম ঝাড়গ্রাম বলে হাঁকছে কিনা।
তো এইরকম সব স্টেশনের রূপ দেখতে দেখতে ঝাড়গ্রাম পৌঁছেছে। ভীষণ দেরিতে। এখনও পর্যন্ত একটাই প্রাপ্তি, পান্থসখা নামক হোটেলে আড্ডা। এই হোটেলটা ঝাড়গ্রামের অন্যতম মিথ। কবি অশোক মহান্তির হোটেল। একসময় লেখকদের নিয়মিত আড্ডায় জমজমাট থাকত। প্রথমে আদালত চত্বরের আমগাছের নীচে আড্ডা বসত। আসতেন বিভিন্ন জেলার সাহিত্যিকেরা। লোককবি ভবতোষ শতপথীও আড্ডায় আসতেন। অশোকবাবু পান্থসখা খোলার পরে আড্ডা চলে আসে হোটেলে। অনেকে পান্থসখাকে ঝাড়গ্রামের কফি হাউস বলেন। অশোকবাবু অকাল প্রয়াত। হোটেলটি চালান তাঁর ভাই উত্তম মহান্তি। এই তীর্থস্থান দর্শন না করলে চলে!
দোকানে তখন উত্তমবাবু ছিলেন না। আমরা খেতে বসে গিয়েছিলাম। পরোটা, ঘুগনি। সব শালপাতার পাত্রে। শেষ পাতে রসগোল্লা। নতুন ধরনের। তালের গুড়ের। ইন্দ্র মিষ্টি খাবে না বলে ঘোষণা করেছিল। ওর ঘোষণা তো! কিছুক্ষণ পরেই দেখি, বাবলার ভাগের রসগোল্লার অর্ধেকটা উড়ে গেল। খেতে খেতেই উত্তমবাবু এলেন। তারপর এক প্রস্ত কথাবার্তা। ছবি তোলা। ততক্ষণে একে একে আসতে শুরু করেছেন কবি বংশী প্রতিহার, শিখা মল্লিক। আদালত চত্বরের চাউনিতে বসে গল্প শুরু হল আমাদের। এক এক করে আসতে শুরু করলেন সংযম পাল, তপন চক্রবর্তী, রাজা ভট্টাচার্য, আরতিদি। পদবিটা ভুলে গিয়েছি। ছোটখাট আড্ডাই শুরু হয়ে গেল। পুরনো কথা, নতুন লেখা, নতুন প্রজন্ম, বাংলা সাহিত্যের পাঠক। উঠতে ইচ্ছে করছিল না। সংযম পাল সুন্দর বলছিলেন। কিন্তু আমাদের যে আবার যাওয়ার তাড়া।
তারপর বাসে। বেলপাহাড়ির পথে। কিন্তু থাকার ব্যবস্থা? একটা পথ খুলেছে। পাঁচ মাথার মোড়ে এক বাস কন্ডাক্টর একটি নম্বর দিয়েছিলেন। এক বাস মালিকের নম্বর। তাঁর হোম স্টে আছে। কিন্তু জায়গা আছে কিনা জানেন না। খোঁজ নিয়ে ফোন করবেন বলে জানিয়েছেন। বাসে বসার জায়গা পেয়েছি। পুরুলিয়া এক্সপ্রেস। খুব ভাল যায়। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। আমার যা স্বভাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন এল। জায়গা নেই। এমনকি বিডিও অফিসের অতিথিশালাতেও অতিথিরা ঘর দখল করে নিয়েছেন। তবে তিনি একজনের নম্বর দিলেন। তাঁকে ফোন করতে জানালেন, ঘর মিলবে। আমরা যেন বেলপাহাড়ির সুপার মার্কেটের কাছে নেমে যাই। ইন্দ্রর কাছে বার্তা শুনেই আমি ঘুমিয়ে পড়লুম।
ঘুম ভাঙল প্রবল হট্টগোলে। কে যেন পড়ে গিয়েছে জানলা গলে। আমি আমাদের ছোটা ডনের দিকের তাকালুম। বেচারার হাইট কম, যদিও ফাইট জাদা। না, ও জানলার ধারে বসেনি। আর ঘুমের চটকা ভাঙতে বুঝতে পারলুম, কে নয়, কী একটা পড়ে গিয়েছে। বাস এমন গর্তে পড়েছে যে এক যাত্রীর হাত থেকে মানিব্যাগ ছিটকে জানলা দিয়ে পড়ে গিয়েছে। বাস থামল। মানিব্যাগের মালিক নেমে ছুট লাগালেন। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি। তারপর সাফল্য। বাস চলল।
নামার কথা ছিল সুপার মার্কেটের সামনে। কিন্তু ভুল করে নামলাম ইন্দিরা চকে। তারপর আবার পিছিয়ে আসা। বিডিও অফিস, থানা। থানার সামনে অ্যান্টি ল্যান্ডমাইন গাড়ি। এক সময়ের উত্তাল, ভয় জাগানো পরিস্থিতির স্মারক হয়ে রয়ে গিয়েছে গাড়িগুলো।
এরপরের সময়টা খুব দ্রুত। ঘরে ঢুকে এক রাতের ভাড়াটে হিসেবে সইসাবুদ করে চান। তারপর কাছের একটা হোটেলে ডাল, পাঁচমিশালি তরকারি আর ডিম ভাজা দিয়ে মোটা চালের ভাত খেয়ে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়া। আজকের সফর, ঘাগরা, তারাফেনি, বামুনডিহায়। মৃদু হয়ে আসা আলোয় ঘাগরা আর রাতের অন্ধকারের তারাফেনির অন্য রূপ। সে রূপ বোধহয় কোনও পর্যটক চাক্ষুস করেননি।
ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ, দীপশেখর দাস এবং বিভাস বাগ।
প্রচ্ছদের ছবি— ঘাগরার রূপ।
(চলবে)