দীপক দাস
‘উঠে কী হবে?’ একটা করে পা বাড়াচ্ছি আর গুরুবাক্যটা মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। গুরু মানে, সেই মালদার চাঁচলের রাজপুত্র থেকে কলকাতার চাতালের প্রিন্স। শিব্রাম চকরবরতী। শিব্রাম সারা জীবনই ভারী গেঁতো মানুষ। পাহাড়ে একদম উঠতে চাইতেন না। পাহাড় চড়ার কথা বললেই বলতেন, কী হবে উঠে? সেই তো নেমে আসতে হবে!
আমারও সেই অবস্থা। সিদ্ধেশ্বর পাহাড় জয়ের অভিযান। কিন্তু অভিযানের খানিক বাদেই আমার হাল শিব্রাম। গত অগস্টে ঘাটশিলা গিয়েছিলাম দল বেঁধে। মানে যতটা দল বাঁধা যায় আরকী। ইন্দ্র, গার্ডবাবু শুভ, ঘাসপুস কা স্টুডেন্ট দীপু, ছোটা ডন বাবলা ওউর ম্যায়। বিভূতি তীর্থদর্শনের পরে সাইট সিন। ভাড়া করা হয়েছে একটি গরিব রথ, অটো। যাব রঙ্কিনী মন্দির, যাদুগোড়া হয়ে গালুডি। চালক সাহেব যেতে বললেন, একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। সিদ্ধেশ্বর পাহাড়। লোকজন যায়। পাহাড়ে শিবের একটা মন্দির আছে।
জায়গাটা ঠিক কোথায় বলতে পারব না। তবে যাদুগোড়া যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে। মূল রাস্তা থেকে সামান্য ভিতরে ঢুকতে হয়। আরেকটি নিশানা, সিদ্ধেশ্বর পাহাড়ের কাছাকাছি কেন্দাদি নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের একটা স্টোর ক্যাম্প আছে। একদম রাস্তার গায়েই।
দু’পাশে গাছগাছালি ঘেরা ঝকঝকে রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম সিদ্ধেশ্বরের পাদদেশে। যেতেই ঝটপট পাহাড় চড়ার প্রস্তুতি। কিন্তু যাত্রা শুরুর আগেই বেঁকে বসল ইন্দ্র। ও পাহাড়ে উঠবে না। অটোয় বসে থাকবে। দলের দামোদর শেঠও কি আজকাল শিব্রাম পড়ছে নাকি? মনে হচ্ছে যেন গত বইমেলায় শিব্রাম রচনাবলী কিনেছিল? কথা বলে জানা গেল, ও শিব্রামের কথামৃতের শিষ্য নয়। রসামৃতের ভক্ত। ওই রাবড়িচূর্ণ, রাবড়ির হাঁড়ি, দিলখুশা কেবিন, এসবই অনুসরণ করে। ও যাবে না, কারণ দমে কুলোবে না। বেচারা জ্বর নিয়েই এবার ঘুরতে বেরিয়েছে। এখন জ্বর নেই। কিন্তু পাহাড়ে উঠবে না।
এই সুযোগ ছাড়া যায়! এই সফরে ও দাবি তুলেছে, দলের ক্যাপ্টেন্সি বদল করার। ও দায়িত্ব নিতে পারবে বলে জানিয়েছে। শুভ বলল, তুমি কি নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন হতে চাও? আরেকটা কে যেন বলল, ও রাজনীতির দলের ক্যাপ্টেন হতে চায়। অনুগামীদের এগিয়ে দেবে লাঠি, গুলি খাওয়ার জন্য। নিজে ঘরে বসে ঘোলা জলে মাছ ধরবে। আমি তেমন কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলাম, এখানে ভালুক বেরোয়। তোর যতই ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট থাকুক ভালুকের সঙ্গে লড়ে পারবি না। ওরা ভাল জুড়ো জানে। একবার জড়িয়ে ধরলে কাশ্মীরি আলুসেদ্ধ করে দেবে। কিন্তু ভয়, সমালোচনা কোনও কিছু দিয়েই ইন্দ্রকে নড়ানো গেল না। একটা মহুল গাছের নীচে দাঁড় করানো অটোয় বসে রইল ও আর চালক। মহুয়া গাছের নীচে তোমাকে ভালুক ধরার টোপ করে রেখে গেলুম।
আমরা উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের নীচের দিকটা পিকনিক পার্টি নোংরা করে রেখেছে। থালা, গ্লাস পড়ে রয়েছে। আমরা যেখানে গাড়ি রেখেছি সেখানটা বেশ নোংরা। কিন্তু একটু উঠলেই প্রকৃতি তার আসল রূপে। নুড়ি, পাথর ফেলা রাস্তা। বোঝাই যাচ্ছে পাহাড় চড়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। চালক মশাই ঠিকই বলেছিলেন, লোকজন উঠে পাহাড়ে। চড়াই পথের কিছুটা বাঁক পেরোতেই একটা নলকূপ দেখতে পেলাম। পাশেই সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বিশাল চৌবাচ্চা। অভিযাত্রীদের জন্য জলের ব্যবস্থা? কিন্তু কলে জল পড়ে না। চৌবাচ্চায় জল আছে। তাতে কয়েকটা ব্যাঙ ঘরবাড়ি করেছে। কে একটা যেন বলল, হাতিদের জন্য জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রে রে করে তেড়ে উঠলাম, হতভাগা, হাতিদের কল টিপে দেয় কে? তারা কি কল টিপে জল ভরে? তারপর জল খায়? জলাধারের সমাধান না করেই জায়গাটা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম।
কিন্তু আরেকটা বাঁক পেরোতেই আমার হাল খারাপ। পা আর চলে না। একটু এগোলেই হাঁফ ধরে যাচ্ছে। দীপু, বাবলা, শুভ একটু একটু করে আমাকে ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে কুড়ি মিটার, তারপর ৫০, তারপর…। আর আমার শিব্রামের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, উঠে কি হবে? সেই তো নেমে আসতে হবে! তার চেয়ে বরং কোনও পাথরে বসে বিশ্রাম নিই। ওরা জয় করে ফিরলে এক সঙ্গে নেমে যাব। তারপরই মনে পড়ল, এখনও ক্যাপ্টেন্সি যায়নি। থমকে যাওয়া কি শোভা পায়? আগে না যেতে পারি, দলের কাছাকাছি থাকতে হবে। স্বীকার করতে আমি অকুতোভয়, এমন আত্মপ্রেরণার অন্যতম কারণ ইন্দ্রর ব্যঙ্গের হাত থেকে বাঁচা।
হাঁফাতে হাঁফাতে, জিরোতে জিরোতে অবশেষে চূড়ায় পৌঁছলাম। বাকিরা তখন শৃঙ্গ জয় করে ফেলেছে। চূড়াটা তেমন কিছু নয়। অল্প সমতল মতো জায়গা। অনেকটা ফ্যান্টমের ওয়াকার টেবিলের মতো। টেবিলের ঠিক মাঝখানে একটা শিবমন্দির। চারদিক খোলা। মন্দিরের অধিষ্ঠাতাই বোধহয় সিদ্ধেশ্বর। তাঁর নামেই পাহাড়। চারিদিকে ধূপের প্যাকেট, প্লাস্টিকের টুকরো, চপ্পল পড়ে রয়েছে। তার মানে কোনও একটা সময়ে এঁর কাছে ভক্তের সমাগম ঘটে।
মন্দির দেখতে পাহাড় চড়লাম! এত কষ্ট করে? শুভ, দীপু তখন টেবিলের কিনারায় গিয়ে ছবি তুলছে। বাবলা আর আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি। তখনই দীপু বলল, ‘‘বড়দা এদিকটা দেখো।’’ দেখলাম আর থ হয়ে গেলাম। পাহাড় চুড়ো থেকে দূরে তাকালে এক বিস্তৃত সৌন্দর্য ক্ষেত্র। আদিগন্ত। প্রচুর জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝে মাঝে চাষের বা ফাঁকা জমি। দু’টো রঙের অপরূপ বৈপরীত্য। জঙ্গলের রং বেশ ঘন সবুজ। দূর থেকে কালচে সবুজ লাগছে। অন্যদিকে ফাঁকা জমির রংটা কিছুটা ফিকে সবুজ। একই সবুজের দুই বাহারে অন্য রূপ খুলে গিয়েছে দিগন্ত জোড়া। দু’রঙা সবুজের মাঝে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে সুবর্ণরেখা। আমাজন নদীর একটা পরিচিত ছবি আছে। অনেক উঁচু থেকে তোলা ছবি। সেই ছবিতে আমাজনকে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা খালের মতো লাগে। দূর আর অনেক উঁচু থেকে সুবর্ণরেখাকে সেরকমই লাগছিল। নদীর উপরে একটা সেতু। আমি আর শুভ দু’জনে প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলাম, ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’। সেই বিখ্যাত সিনেমা। যদিও সিদ্ধেশ্বর পাহাড় থেকে দেখা সুবর্ণরেখার সেতুর সঙ্গে কাওয়াই নদীর সেতুর ঘটনার কোনও মিলই নেই।
মনটা খুশিতে ভরে উঠছিল। কারণ যেদিকে তাকাই শুধু সুন্দর আর সুন্দর। শুধু অবস্থানটা পাল্টে নিলেই হল। টেবিলের আরেক প্রান্তে অন্য সুবর্ণরেখা। যেখানেও একটা সেতু দেখা যাচ্ছে। সেতুটা ধোঁয়ায় ঢাকা। কারণ ওর পাশেই রাখামাইন তামার খনি। এই দিকটাও অসাধারণ। আমরা ঘাটশিলায় ঢোকার পরে বেশ কয়েকবার বৃষ্টি পেয়েছি। বৃষ্টিতে ধুয়ে জঙ্গলের রং খুলেছে। মাঝে মাঝে ধান জমিতে জল জমে আছে। অসাধারণ সে দৃশ্য। কম্পিউটারের কি বোর্ড হাতড়েও সেই সুন্দর বর্ণনার উপযুক্ত শব্দ খোঁজার অক্ষম চেষ্টা করছি মাত্র। যেদিক দিয়ে চুড়োয় উঠেছি সেদিকেও একটা পাহাড় আছে। একটু ন্যাড়া। শুকনো। কিন্তু তা-ও দেখতে ভাল লাগে।
এতক্ষণ পর পাহাড়ে ওঠাটা সার্থক মনে হল। গুরুবাক্য অমান্য করে ভুল কিছু করিনি। আসলে শিব্রাম বোধহয়, পাহাড়ের সৌন্দর্য ছেড়ে নেমে যেতে হবে এই কষ্টেই পাহাড়ে উঠতে চাইতেন না।…
অনেকক্ষণ ছিলাম চুড়োয়। তারপর নামতে শুরু করলাম। উঠতেই যা কষ্ট। নামতে সময় লাগে না। নামতে নামতে দেখলাম, দুই মহিলা জঙ্গলে কাঠ কুড়োচ্ছেন। পাহাড়, জঙ্গল অনেকের কাছে বেঁচে থাকার আশ্রয়। আমরা রূপদর্শী। আর তাঁরা জীবনদর্শী।
ও হ্যাঁ, ওই নলকূপ আর জলাধার হাতির জন্য করা হয়নি। এখানে হাতি আসে না। করা হয়েছে মন্দিরে আগত ভক্তদের জন্য। শ্রাবণ মাসে কোনও একদিনে জমজমাট হয় সিদ্ধেশ্বরের চুড়ো।
ছবি- দীপশেখর দাস (দীপু) এবং সৌগত পাল (শুভ)
(সমাপ্ত)