অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

জীবনানন্দ দাশের ধানসিরি ডিমাপুরে!— শেষ পর্ব

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

কিছু টুকরো অপ্রীতিকর ঘটনার উদাহরণ পাওয়া গেলেও সৌভাগ্যবশত, আমি যে এলাকায় এখন থাকি, সেখানকার পরিবেশ তুলনায় বেশ শান্ত। স্থানীয় মানুষের আধিক্যও কম। ফলে খাওয়াদাওয়ার অসুবিধাটা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে।

এই জায়গাটা যেন বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের প্রবাসীদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। ডিমাপুরের এই একটা জিনিস কিন্তু বেশ মন ভাল করে দেওয়ার মতো। এখানে প্রায় সমস্ত ধর্ম, বর্ণের মানুষ পাওয়া যাবে। কাছের দুর্গামন্দিরের কাঁসর-ঘণ্টার শব্দে যেমন রোজ ঘুম ভাঙে আমার, তেমনই ঘর থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে কানে আসবে আজানের ধ্বনি। কালীপুজোয় ডিমাপুর কালীবাড়ির ভোগের স্বাদ যদি আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে ছটপুজোয় ঠেকুয়া আর রাসপূর্ণিমায় গুরুদ্বারের বিশেষ ভোজের স্বাদও মুখে লেগে থাকতে বাধ্য। ডিমাপুর শহরে কমবেশি গোটা পঞ্চাশেক দুর্গাপুজো হয়। দশমীর নিরঞ্জন যেন মিলিয়ে দেয় গোটা শহরটাকে। দীপাবলিতে মাড়োয়ারিদের বাজি ফাটানোও এক মনে রাখার মতো দৃশ্য।

এই সেই ধানসিরি। জীবনানন্দীয় নয় মোটেই।

মজার কথা, ধানসিরি নামে একটা নদী আছে ডিমাপুরে। একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। নদীর ওপর সেতু তৈরি হচ্ছে। এই নদীই কি জীবনানন্দ দাশের সেই কালজয়ী ধানসিরি? একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। বলতে পারলেন না। সে নদী তো বাংলাদেশে!

চোখে পড়বে বড়দিন এবং ইংরেজি নববর্ষ ঘিরে স্থানীয়দের উৎসাহ। নাগাল্যান্ডে মূলত খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মানুষের আধিক্যের কারণে যেটা বেশ স্বাভাবিক। আলোর মালায় সেজে ওঠে গির্জাগুলো। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই স্থানীয় মানুষদের উৎসব শুরু হয়ে যায়। এক থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত চলে বিখ্যাত হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল। ধনেশ পাখি উৎসব। স্থানীয়দের কাছে খুব বড় উৎসব এটি। মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন অবশ্য হয় কোহিমায়। সমস্ত নাগা উপজাতি সম্প্রদায়কে একসূত্রে গাঁথে এই উৎসব। প্রদর্শন চলে সমস্ত সম্প্রদায়ের নিজস্ব খাওয়াদাওয়া এবং সামগ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের। এছাড়া বড়দিন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে গোটা ডিসেম্বর জুড়েই।

কালীবাড়ি।

স্থানীয় মানুষজন বেশ আমুদে প্রকৃতির। মোটামুটিভাবে উচ্চমধ্যবিত্ত হওয়ায় (কী ভাবে বা কেন, সেটার বিশ্লেষণে আপাতত থাক!) এদের কাছে পৃথিবীতে যেন কেবল তিনটে জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন, বিনোদন আর বিনোদন। আক্ষরিক অর্থেই এরা বর্তমানে বাঁচে। বাকি দুনিয়ায় কী হল না হল, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে এরা বিশেষ আগ্রহী নন! মানুষজন এমনিতে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। একবার মানিয়ে নিলে যে কোনও সমস্যায় ওদের পাশে পাওয়ার প্রত্যাশা করা নিরর্থক নয়। নজর এড়ায় না কিছুটা পাশ্চাত্য (ব্রিটিশ) সংস্কৃতির প্রভাবও। নাগাল্যান্ডের রাজ্যভাষা ইংরেজি। যদিও স্থানীয়রা নিজেদের মধ্যে নাগামিজ ভাষায় কথা বলে। বাংলার সঙ্গে যার কিছুটা মিলও আছে। এবং খ্রিস্টান রাজ্য হওয়ায় প্রতি রবিবার (প্রার্থনার দিন) প্রায় সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে।

রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ।

খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর হাত ধরেই এখানকার মানুষদের প্রথম পা ফেলা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার পথে। শুনেছি, খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার আগে মানুষের মুণ্ডশিকারের পরম্পরা ছিল। এখানে ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনও ছুৎমার্গ নেই। মেয়েদের যথেষ্ট স্বাধীনতা ও সম্মান আছে। ছোটখাট অপ্রীতিকর ঘটনা থাকলেও মেয়েদের প্রতি অশালীনতার ঘটনা কিন্তু তুলনায় কম। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা ভাল, গড়পড়তা নাগা মেয়েরা কিন্তু যথেষ্ট সুন্দরী হয়!

প্রকৃতি এবং পর্যটন কেন্দ্র।

পর্যটকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, ডিমাপুরকে সেভাবে খুব ভাল পর্যটনকেন্দ্র মোটেই বলা যাবে না। আগেই বলেছি, শহরটা বেশ অপরিচ্ছন্ন। সমতল অঞ্চল হওয়ায় আবহাওয়ার দিক থেকে কলকাতার সঙ্গে সাযুজ্য রয়েছে। শীতে মোটামুটি ঠান্ডা, আবার গ্রীষ্মে তেমনই রৌদ্রের তেজ। হাতে গোনা যে কয়েকটা দেখার জায়গা রয়েছে, তার মধ্যে নাগাল্যান্ড সায়েন্স সেন্টার মন্দ লাগবে না। রয়েছে একটি জুওলজিক্যাল পার্ক-সহ আরও বেশ কয়েকটি ছোটখাটো পার্ক। আর রয়েছে কাছারি রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। যেটি বর্তমানে আমাদের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের অধীন। এবং পুরোটাই উন্নয়নের পথে।

একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বহু নেতিবাচক দিক থাকলেও নাগাল্যান্ডের সেরা জায়গা এই ডিমাপুরই। খুব উঁচু মানের স্কুল-কলেজ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকলেও ডিমাপুরের পরিবহন ব্যবস্থা কিন্তু মোটের ওপর চলনসই। রেলপথের সুবিধার পাশাপাশি ছোটখাটো হলেও একটি বিমানবন্দরও রয়েছে। সরকারি বাসও আছে। এর পাশাপাশি থাকা এবং খাওয়ার জন্য রয়েছে প্রচুর হোটেলও।

গুরুদ্বার।

তা সত্ত্বেও অবশ্য প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া এখানে মোটামুটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কখন যে কী ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। বিভিন্ন কারণে প্রায়দিনই অধিকংশ দোকানপাট বন্ধ থাকতে দেখা যায়। তবে প্রতিবন্ধকতা যেমন আছে, তেমন তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইটার মধ্যেও বেশ একটা মজা আছে। “আরণ্যক”-এর সত্যচরণও প্রথমটায় দুর্গম জঙ্গলে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়েছিল! চাকরি ছাড়ার চিন্তাও করেছিল। অথচ পরে সেই জঙ্গলের নেশাই তাকে পেয়ে বসেছিল! আমার ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা অন্তত এই মুহূর্তে সুদূরপরাহত বলেই বোধ হয়!

রাজবাড়ির একটি অংশ।

তবু, কথায় আছে, যে সয় সে-ই রয়! সয়ে যাচ্ছি। সয়ে যাচ্ছি। বাকিটা সময়ের হাতে!

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *