ইন্দ্রজিৎ সাউ
পরের দিন ভোর চারটেতেই সকলকে তুলে দিলাম। পৌনে ছ’টা নাগাদ যাত্রা শুরু। আগের দিনই ওখানকার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। যেহেতু আমরা প্রাতরাশ করব না তাই প্রত্যেকের জন্য দু’টো করে ডিম সেদ্ধ করে দেবে। কথা মতো ডিম সেদ্ধ নিয়ে আর চা খেয়ে, প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সূর্যের আলো ঠিক করে ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই গেলাম বরুনদাবন চেক গেট। এখালে জীবজন্তুদের জন্য একটি সল্ট লিংক করা আছে। আর আছে ওয়াচ টাওয়ার।
কিছুক্ষণ এখানে কাটানোর পর চাওলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। চাওলাতেও একটি সল্ট লিংক করা আছে। সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে যেখানে হরিণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণীর দেখা মেলে। সুন্দরবন গিয়ে জঙ্গলের একটা নিয়ম শিখেছিলাম, কোন পশু দেখতে হলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমাদের কাছে সময় কোথায়। আজই বাকি অংশ ঘুরতে হবে। অগত্যা চাওলা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম কোনও কিছু না দেখে। ততক্ষণে সূর্য অনেকটাই প্রকট হয়েছে। কিছু দূর এগিয়েই দেখলাম ময়ূর ঘুরছে। আমাদের হুগলির রাজহাটের মতো না খেতে পাওয়া ময়ূর নয়। খুব হৃষ্টপুষ্ট আর খুব সুন্দর। এখানেও জাতীয় পাখি। রাজহাটেও জাতীয় পাখি। কিন্তু স্বাস্থ্যে আর যত্নে বড়ই তফাৎ। ভারত এমনই। এখানে ভেদাভেদটা বড়ই প্রবল।
ময়ূর দেখে গেলাম বারাইপানি ঝরনা দেখতে। বারাইপানি ঝরনা বেশ খানিকটা দূরে, মাঝে কয়েকশ ফুট গভীর খাত। নীচের দিকে দেখলে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। আর দেখলাম কত নাম না জানা পাখি। তাদের কলরবে মুখর হয়ে ছিল চারিদিক। কিন্তু দুরত্ব আর সূর্যের দিকে হওয়ায় ঝরনা শুধু ধোঁয়াশা দেখলাম। দূর থেকে মনে হচ্ছিল, মোটাসোটা একটা সাদা দড়ি পাহাড়ের গা থেকে ঝুলছে। ওখান থেকে বেরিয়েই সুব্রত একটা আমলকি গাছ দেখতে পেল। তবে আমাদের এখানে পাওয়া বড় আমলকি নয়। ছোটবেলায় একটি টক ফল আমরা খেতাম। যেটিকে চলতি ভাষায় নোড় ফল বলতাম। ঠিক ততটাই ছোট। ছোটবেলায় খেলা কাচের গুলির মতো আকারের। আগের দিন আসার সময় বাচ্ছারা আমাদের এই ফল খেতে দিয়েছিল। হই হই করে প্রবল উৎসাহে সবাই আমলকি পাড়তে শুরু করে দিলাম। পাশেই বনরক্ষী ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ‘রে রে’ করে চেঁচিয়ে বললেন, “ওটা হনুমান দের খাবার তোমরা পেড় না”। সুব্রত ততোধিক উৎসাহ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “হনুমান আমাদের পূর্বপুরুষ আমরা খেলে কিছু মনে করবে না।’’ যাই হোক বনরক্ষীর বাধায় আমরা আমলকি ছেড়ে ওখান থেকে চলে এলাম।
তখন বেলা অনেকটাই গড়িয়েছে। দুপুরের রসদের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সঙ্গে রান্নার সমস্ত রকম সরঞ্জাম মজুত ছিল। একটা জায়গাও বেছে নিয়েছিলাম। গাঁ লাগোয়াই জায়গা। গ্রামটার নাম নওনা। সেখানেই দুপুরের খাওয়াদাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। রান্নার তোড়জোড় করতেই গ্রাম থেকে একজন চলে এলেন। আমাদের রান্না করতে নিষেধ করলেন। স্বাভাবিক যুক্তিবাদী বাঙালি আমরা। মানে তার্কিক বাঙালি আরকী। কেন রান্না করা যাবে না? কী বৃত্তান্ত জেরা হল। গাঁওবালে বললেন, শের খানেরা তিন কিলোমিটার দূর থেকে কাঁচা মাংসের গন্ধ পায়। খেতে চলে আসবে। তখন বিপদ হবে। তার থেকেও বড় কথা, বনরক্ষীরা টের পেলে হাঁড়ি কড়া তুলে নিয়ে গিয়ে আটকবে রাখবে। দুপুরবেলা হরিমটর। কথা বলে জানলাম, জঙ্গলে বেশ কিছু হিংস্র প্রাণী রয়েছে। বাঘ, চিতাবাঘ, রয়েছে।
বাতিল হল ওখানে রান্নার পরিকল্পনা। ঢুকে গেলাম গ্রামের ভিতরে। ওখানে পরিচয় হল সুপাই বার্জ আর দুস্তি চত্রারের সঙ্গে। ওঁদের আমাদের সমস্যার কথা বলতে, ওঁরাই একটি ঘরে রান্নার ব্যবস্থা করে দিলেন। খুবই ছোট গ্রাম। মাত্র কয়েক ঘরের বাস। সুপাই বার্জ তাঁর ঘর দেখতে নিয়ে গেলেন। ঘর বলে যেটা দেখালেন, সেটা ঘর না বলে বেড়া দিয়ে ঘেরা মাথায় খড়ের ছাউনি আর মাঝে মাঝে মাটির প্রলেপ দেওয়া একটা আশ্রয় মাত্র। যার মেঝেটা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে। ঘরের একটা বড় অংশে নতুন খড় রাখা। নাম মাত্র শোয়ার জায়গা। দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ও একটা কথা তো বলাই হয়নি, আমাদের রান্নার জল এনে দেওয়া থেকে অনেক কাজই ওঁরা এক প্রকার জোর করে দিয়ে ছিল।
আমরা তো সুপাই বার্জের মেয়েকে দেখে অবাক। ছ’সাত বছরের মেয়ে। বাড়ির কাজ করছিল। গোয়াল থেকে গোবর নিয়ে যাচ্ছিল। গোবরের কথা ছেড়েই দিলাম। যে ডাবায় সে গোবর বইছিল তার যা ওজন! আমাদের এলাকার ওই বয়সের কোনও বাচ্চার মাথায় চাপিয়ে দিলে সে কেঁদে ফেলবে।
খাওয়ার পাট মিটিয়ে আমরা জোরান্ডা ফলস দেখতে রওনা দিলাম। পথে পড়ল মেঘাসনি যাওয়ার রাস্তা। এটা বাঘেদের কোর এরিয়া। এখন পর্যটকদের ঢোকা নিষেধ। আগে জঙ্গলে ঢোকা যেত। কিন্তু কিছু পর্যটকদের বাঁদরামোয় জঙ্গল এবং প্রাণীর বহু ক্ষতি হচ্ছিল। তাই ঢোকা নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। সিমলিপালের জীবজন্তুর সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ। হিংস্র প্রাণী তো আছেই। আছে হাতির পাল, নানা ধরনের হরিণ, বুনো শুয়োর, খরগোশ। এসব কিছুই তখন দেখতে পাইনি।
জোরান্ডা গিয়ে কিছুক্ষণ তো সবাই চুপ করে গেলাম। মনে হল, আমরা আফ্রিকার কোনও জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিজে আফ্রিকা যাইনি। ডিসকভারি চ্যানেল হ্যায় না। এতই তার মন মুগ্ধকর সৌন্দর্য। ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিল না। ফেরার পথে বিকেলে আলো মরে এসেছিল। রাস্তায় দেখা হয়ে গেল একটা বার্কিং ডিয়ারের সঙ্গে। একেবারেই আমাদের গাড়ির সামনে চলে এসেছিল। আরেকটু এগোতেই বুনো শুয়োর। একটা, দু’টো করে চরে বেড়াচ্ছে।
তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় জঙ্গল পথে পড়ে অন্যরকম ছবি তৈরি করছে। সেই আলোতেই দেখতে পেলাম, একটা প্রাণী। লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। গাড়ি দেখে ভয়ও নেই। খরগোশ।
ছবি—লেখক
(সমাপ্ত)